শাহজাহান সাংবাদিক :
কোরবানীর অর্থ হচ্ছে বিলিয়ে দেওয়া আত্মসমর্পণ করা,আরবীতে উজহিয়া শব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে। আল্লাহর রাহে নিজেকে বিলীন করা, মুসলিম জাতীর জনক হযরত ইব্রাহিম (আঃ ) আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য নিজের কলিজার টুকরা সন্তানকে কোরবানী করেছিলেন। আল্লাহর হুকুম পালনে একটুও দেরি করেন নাই। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন হে নবী আপনি নামাজ পড়–ন এবং কোরবানী করুন। এখানে আল্লাহ তায়ালা তার নবী কে প্রথমে নামাজের কথা বলেছেন তারপর কোরবানী করতে বলেছেন। সুতরাং নামাজ পড়া ফরজ আর কোরবানী করা ওয়াজিব। তথাকথিত সমাজে দেখা যায় অনেকে নামাজ পড়ে না কিন্ত কোরবানী দেয় ফরজকে বাদ রেখে ওয়াজিবকে প্রধান্য দেয় সেখানে সন্দেহ আছে। কোরবানীতে একটি গরু ৭ জন পর্যন্ত ভাগে দেওয়ার নিয়ম আছে। ৭জনের একজনও যদি বেনামাজি হয় সে কোরবানীর হক আদায় হয়না। নিজের নামে কোরবানী করা ওয়াজিব। নিজের নামে কোরবানী বাদ রেখে মৃত্যু মা বাবা অথবা অন্যের নামে কোরবানী করা ওয়াজিব নয়। হিজরি দ্বাদশ মাসের ১০ তারিখে আসন্ন যে ঈদ তা কোরবানির ঈদ, বড় ঈদ, হজের ঈদ, আত্মত্যাগের ঈদ, পশু জবাই করার ঈদ তথা ঈদুল আজহা নামে আমাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে। সৃষ্টির আদি মানব হজরত আদমের (আ.) পুত্রদ্বয় যথাক্রমে হাবিল ও কাবিলই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম কোরবানির প্রথা চালু করেন। কিন্তু ইবরাহিম (আ.) যে কোরবানির নজির স্থাপন করেন, তা ইতিহাসে বিশ্বপ্রভুর নির্দেশের ফরমাবরদারি আর তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের ক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রণিধানযোগ্য ও তাৎপর্যম-িত। জন্ম থেকে বার্ধক্য অবধি সারাটি জীবনই তাঁর কেটেছে নানা অগ্নিপরীক্ষায়; আর তিনি সব পরীক্ষায় একান্ত অনুগত ও বাধ্যগত হয়ে অংশগ্রহণ করেছেন এবং সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন। সবচেয়ে বড় যে পরীক্ষাটি তাঁকে দিতে হয়েছিল তা হলো, তাঁরই প্রাণাধিক প্রিয় সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.), যাঁকে জীবনের ৮৬ বছরের বার্ধক্যে একান্ত প্রার্থনার পরিপ্রেক্ষিতে পেয়েছিলেন, মহান প্রভুর নির্দেশে তাঁর গলায় ছুরি চালানো। এমন কঠিন ও দুঃসাধ্য পরীক্ষাতেও ইবরাহিম (আ.) সামান্যতম বিচলিত হননি, নিজেকে হতাশা বা দুশ্চিন্তার গহ্বরে নিক্ষেপ করেননি বা অসহনীয় শোকেও মুহ্যমান হননি। প্রবল ইমানি শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে তিনি এ দুঃসহ পরীক্ষায় নিজেকে উতরে নেন, ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশে নিজেকে সংযুক্ত করেন এবং পরবর্তীকালের জন্য খোদায়ি আনুগত্যের বিরাট এক শিক্ষা রেখে যান। আমাদের জন্য রেখে যাওয়া সেই শিক্ষাটিই আমরা ঈদুল আজহার পবিত্র ও বরকতম-িত দিবসে পশু কোরবানির মধ্য দিয়ে বস্তুত নিজেদের অভ্যন্তরে শিকড় গেড়ে থাকা যাবতীয় আমিত্ব আর পশুত্বকে বর্জনের সত্যিকার সুযোগ লাভ করি। মহাকবি ইকবাল তাই বলেছেন- ইবরাহিমি ঈমান যদি আজো কোথাও হয় বিদ্যমান/করতে পারে অগ্নিকু-েও খুবসুরত এক গোলেস্তান।
আত্মত্যাগের নজির স্থাপন করে প্রিয়তম বস্তু উৎসর্গকরণের মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভে ব্রতী হওয়ার নামই কোরবানি। আত্মত্যাগের মহান উৎসব হচ্ছে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। ঈদের এই পবিত্র দিনে আমরা আল্লাহপাকের নৈকট্য লাভের জন্য সচেষ্ট হই এবং হজরত ইবরাহিম (আ.) যে আত্মত্যাগ ও মহান আদর্শ দুনিয়ার বুকে স্থাপন করে গেছেন, তা অনুসরণের শপথ নিই। তাই ঈদুল আজহার গুরুত্ব ও তাৎপর্য প্রতিটি মুসলমানের কাছে অপরিসীম। আরবি জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সমগ্র বিশ্বের মুসলমানরা ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ পালন করে থাকে। পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে আল্লাহপাক এরশাদ করেন :আমার কাছে পশুর রক্ত, মাংস, হাড় ইত্যাদি কিছুই পৌঁছায় না। পৌঁছায় শুধু তোমাদের অন্তরের তাকওয়া বা ভয়ভীতি।
আমরা কোরবানির মাধ্যমে কে কতটুকু আত্মত্যাগ, খোদাভীতির পরিচয় দিচ্ছি এবং আল্লাহর পবিত্র আদেশ কতটুকু পালন করছি, আরøাহ তা প্রত্যক্ষ করেন। সুদীর্ঘকাল আগে হজরত ইববাহিম (আ.) আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র হজরত ইসমাইলকে (আ.) নিজ হাতে কোরবানি দিয়ে আত্মত্যাগের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। কিন্তু আল্লাহতায়ালার হুকুমে কোরবানি হয়েছিল একটি পশু। হজরত ইবরাহিমের (আ.) এই আত্মত্যাগ মুসলিম ইতিহাসে চিরভাস্বর ও অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। পরবর্তীকালে সেই অবিস্মরণীয় ত্যাগের শিক্ষাকে অক্ষুন্ন রাখার উদ্দেশ্যে আল্লাহতায়ালার প্রতি পূর্ণ আস্থা ও নিদর্শনস্বরূপ আমরা প্রতি বছর ঈদুল আজহা পালন করে থাকি।
আল্লাহপাক ইবরাহিমকে (আ.) তার প্রিয় বস্তু কোরবানি দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে হজরত ইবরাহিম (আ.) বহুসংখ্যক বকরি কোরবানি করেন। আবার আদেশ হলো, ইবরাহিম তোমার প্রিয় বস্তু কোরবানি করো। তিনি ক্রমাগত বহু সংখ্যক দুম্বা, মেষ ও উট কোরবানি করলেন। কিন্তু বারবার তার প্রতি একই আদেশ হলে তিনি বেশ চিন্তিত হন এবং ভাবতে থাকেন, আমি তো প্রিয় বস্তু কোরবানি করিনি। তিনি স্থির করলেন, তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করবেন। তখনই তিনি তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে সব কথা খুলে বললেন। কিশোর পুত্র ইসমাইলও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত হলেন এবং বললেন, পিতা আপনি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছেন, আপনি তা পালন করুন। পিতা পুত্রকে বেঁধে কোরবানি দিতে উদ্যত হলেন। তখনই গায়েবি আওয়াজ হলো : থামো ইবরাহিম, তোমার ত্যাগে আমি মুগ্ধ হয়েছি, তোমাকে পুত্র হত্যা করতে হবে না। আমি শুধু তোমার ইচ্ছার ঐকান্তিকতা ও সংকল্পের দৃঢ়তাই পরীক্ষা করছিলাম, তুমি সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছ।
হজরত ইবরাহিম (আ.) নিজের প্রাণাধিক সন্তানকে মহান আল্লাহর নামে উৎসর্গ করে আত্মত্যাগের যে আদর্শ স্থাপন করেছেন, সেই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্য আমাদের উচিত তাঁর বিধানগুলোকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করা এবং বিশ্ব মানবতার ক্ষেত্রে হজরত ইবরাহিমের (আ.) এই আত্মত্যাগ মানবকল্যাণে বিলিয়ে দেওয়া।
আমাদের সামাজিক, পারিবারিক ও জাতীয় জীবনে ঈদুল আজহা আনন্দ নিয়ে আসছে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে, ছোট-বড়, ধনী-গরিব এক কাতারে শামিল হওয়ার যে দৃষ্টান্ত ঈদ উৎসবে পরিলক্ষিত হয়, তা অন্য কোনো ধর্মীয় পর্বে দেখা যায় না। এর মাধ্যমেই আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক জীবন বিকশিত হয়। ঈদুল আজহার শিক্ষাই হচ্ছে আত্মত্যাগে উজ্জীবিত হওয়া, মানবিক কল্যাণ সাধন করা, সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করা।
পবিত্র ঈদুল আজহা প্রতি বছর আমাদের জন্য বয়ে আনে আত্মত্যাগের মহান বার্তা। এই পবিত্র দিনে আমরা আত্মত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে পারি। লক্ষ্য রাখতে হবে, আমরা যেন নিছক লৌকিকতা ও প্রতিযোগিতামূলক রক্তক্ষরণ ও গোশত ভক্ষণ করে মহান ঈদুল আজহার তাৎপর্য ও শিক্ষাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত না করি।