জিটিবি নিউজ ডেস্ক : সরকারি সমীক্ষা অনুযায়ী ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটের পর বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তে কোনো ছিটমহলের অস্তিত্ব থাকবে না। অবসান ঘটবে দুই দেশের অর্ধলক্ষ মানুষের ৬৮ বছরের অবরুদ্ধ জীবনের। ঐতিহাসিক ও মহানন্দের এ ক্ষণটিকে স্মরণীয় করে রাখতে বাংলাদেশের ১১১টি ও ভারতের ৫১টি ছিটমহলে চলছে উৎসবের প্রস্তুতি। ইতোমধ্যেই নির্মাণ করা হয়েছে বিজয়ের নিশানাসহ শত শত তোরণ। বরণের অপেক্ষায় স্বাধীনতার মাহেন্দ্রক্ষণকে।
৩১ জুলাই মধ্যরাত থেকে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের ৭৫টি ছিটমহল হয়ে যাবে বাংলাদেশের। এ ক্ষণটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন এসব ছিটমহলের বাসিন্দারা। এ উপলক্ষে ছিটমহলবাসী ও বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি নিয়েছে।
কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, রাত ১২টায় ভারতীয় পতাকা নামানো, রাত ১২টা ১ মিনিটে ৬৮টি মোমবাতি প্রজ্বলন করে বিজয় দিবসের শুভসূচনা, মশাল জ্বালানো, ১লা আগস্ট সকালে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও সম্মিলিতভাবে জাতীয় সংগীত পরিবেশন।
রাষ্ট্রীয় কোনো কর্মসূচি না থাকলেও ছিটমহলের বাসিন্দারা নিজেরা ঐতিহাসিক এ মাহেন্দ্রক্ষণ উদযাপনে প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানান ছিটমহলবাসী।
এ দিবসেই ছিটমহলবাসীর দীর্ঘ ৬৮ বছরের অপেক্ষার অবসান হচ্ছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে এ তথ্য নিশ্চিত করেন ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ ইউনিটের সভাপতি মইনুল হক। তিনি জানান, শুক্রবার (৩১ জুলাই) দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে ছিটমহলের বিজয় দিবস পালন করা হবে। তাই রাত ১২টায় নামানো হবে ভারতীয় জাতীয় পতাকা। বিজয়ের আনন্দকে চির স্মরণীয় করে রাখতে শুক্রবার (৩১ জুলাই) ছিটমহলের প্রতিটি মসজিদে হবে মিলাদ মাহফিল, দোয়া, মন্দির ও গির্জায় হবে প্রার্থনা, আয়োজন করা হয়েছে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণ।
প্রতিযোগিতার মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডি ও ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলার প্রতিযোগিতা। সন্ধ্যার পর স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় রয়েছে, জারি-সারি ও ভাওয়াইয়া গানের আসর।
এছাড়া কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাড়িতে বাড়িতে চলছে কেনাকাটা। প্রায় প্রতিটি বাড়ি ও পরিবারই আয়োজন করেছে বিশেষ অনুষ্ঠান ও খাবারদাবারের। যুগ-যুগান্তরের যেসব প্রতিবেশী পৈতৃক ভিটা ছেড়ে ভারতে চলে যাবেন, তাদের আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে বিদায় জানাতে চান এপারে থেকে যাওয়া মানুষরা।
৬৮ বছরের অবরুদ্ধ জীবনের অবসান উপলক্ষে এ দিন ছিটমহলের প্রতিটি মুসলিম পরিবারে জ্বলবে ৬৮টি মোমবাতি আর হিন্দু পরিবারে জ্বলবে ৬৮টি প্রদীপ। সড়কগুলো আলোকিত করা হবে মশাল জ্বালিয়ে। আকাশে ওড়ানো হবে আকাশপ্রদীপ। আনন্দানুষ্ঠান চলবে রাতভর।
লালমনিরহাট ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আজিজুল ইসলাম ও কুড়িগ্রামের দাসিয়াছড়া ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সভাপতি আলতাফ হোসেন বলেন, ‘দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ৩১ জুলাই সারাদিন ও সারারাত আনন্দ অনুষ্ঠান চলবে। প্রতিটি ছিটমহলে সকালে আয়োজন করা হয়েছে খেলাধুলা প্রতিযোগিতা। বিকেলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। রাতে মঞ্চস্থ হবে নাটক। তবে নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকারিভাবে কোনো আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করা হয়নি।’
লালমনিরহাটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘৩১ জুলাই মধ্যরাত থেকে বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহল বাংলাদেশের হয়ে যাবে। বাংলাদেশের ছিটমহল ভারতের হয়ে যাবে। এসব ছিটমহলের নাগরিকরা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী দেশ বেছে নিতে পারবেন।’
লালমনিরহাটের পুলিশ সুপার টিএম মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ছিটমহলের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনো রকম অবনতি যাতে না হয়, সেজন্য প্রশাসন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে। আইনগতভাবে ৩১ জুলাই রাত ১২টার আগ পর্যন্ত আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছিটমহলে যাওয়ার সুযোগ নেই। ১ আগস্ট আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জেলার ৫৯টি ছিটমহলে অবস্থান নেবে। শোনা যাচ্ছে অনেকে সাদা কাগজে সই নিয়ে জমি কিনে নেয়ার চেষ্টা করছে। এসব চলবে না। ছিটমহল বাংলাদেশের অধিভুক্ত হওয়ার পর আইন অনুযায়ী জমি কেনাবেচা হবে।’
অন্যদিকে, ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহলে প্রায় ১৭ হাজার ১৬০ একর জমির মালিক হবে বাংলাদেশ সরকার। পক্ষান্তরে ভারতের ভেতর থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের প্রায় ৭ হাজার ১১০ একর ভূমির মালিকানা পাবে ভারত সরকার। চলতি বছরের ৬ জুলাই থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত যৌথ জনগণনা অনুযায়ী ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের লোকসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতীয় ১১১টি ছিটমহলের লোকসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪৪ হাজার।
ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের মধ্যে কুড়িগ্রাম জেলার অধীনে ১৮টি ও লালমনিরহাট জেলার অধীনে ৩৩টি। এগুলো ভারতের কোচবিহার জেলার প্রশাসনিক সীমানার ভেতরে।
অপরদিকে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহল পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার। এগুলোর মধ্যে কুড়িগ্রাম জেলায় ১২টি, লালমনিরহাট জেলায় ৫৯টি, পঞ্চগড় জেলায় ৩৬টি এবং নীলফামারীতে রয়েছে ৪টি।
লালমনিরহাটের ৫৯টির মধ্যে সদর উপজেলায় ২টি, হাতীবান্ধা উপজেলায় ২টি ও অপর ৫৫টি পাটগ্রাম উপজেলার ভিতরে অবস্থিত। পাটগ্রামের ৫৫টির মধ্যে ১৭টি ছিটমহল জনবসতি শূন্য। এগুলো শুধু আবাদি জমি।