আবদুর রাজ্জাক রাজু
দুই বছরের বেশী যাবৎ করোনা অতিমারিতে বিশ্ব তছনছ হয়েছে । ইতোমধ্যে বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে । সে মৃত্যু স্বাভবিক মৃত্যু ছিল না । অবশ্য বিশ^ থেকে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস এখনও সম্পূর্ণরুপে বিদায় হয় নি। মৃত্যুর মিছিলও থেমে যায় নি। এখনও করোনা পজিটিভ ধরা পড়ছেই। শুধু তাই নয় পৃথিবীর দেশে দেশে এ মরণ ব্যাধির পরিণামে বহু সামাজিক রুপান্তর ও পরিবর্তন ঘটেছে, ঘটে চলেছে । যেটাকে সমাজ বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ’নিউ নরমাল’। মানুষের সমাজ জীবনে নানারুপ অভাবিত ও অপ্রত্যাশিত ধারা প্রবাহ লক্ষ্য করা গেছে । কত আপনজন দূরে সরে গেছে ,পালিয়ে রেহাই পেতে চেয়েছে । পক্ষান্তরে পর আবার হয়েছে আপন । মৃত্যুর কফিনে স্বজনরা না এসে অনাত্মীয় অন্যরা এসে সৎকারে অংশ নিয়েছে মানবিক বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে । মহানুভবতা, সাহস ও প্রেরণার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অনেক রাষ্ট্রীয় শাসন চর্চায় এই সুবাদে কর্তৃত্ববাদের ভূত ঘাড়ে চেপে বসেছে। গণতন্ত্র ও বাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে ।মানুষের বাক স্বাধীনতা ও মুক্ত চিন্তাধারা কিংবা মতামত প্রকাশ বাধাগ্রস্থ হয়েছে । করোনা বা স্বাস্থ্য খাত নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বহুজনকে জেল জুলুমের শিকার হতে হয়েছে। বৈশ্বিক পরিসরে ইতিবাচক পরিবর্তনের চেয়ে নেতিবাচক সামাজিক গতি প্রকৃতি বেশী প্রতিফলিত হয়েছে যা কল্পনাও করা যায় নি।
অনেক মানুষ মনে করেছিল এই গজব মছিবত বা দুর্যোগ দুর্দিন মহামারী আকারে আবির্ভূত হলেও এর অভিশাপের মধ্যেই আর্শীবাদ লুকায়িত আছে । এর পরিতাপে মানুষ স্রষ্টাকে বেশী চিনবে। তার প্রদর্শিত পথে চলতে আরো বেশী যত্মবান হবে । মন্দ পথ পরিহার করে মঙ্গলের পথে চলবে । এই আপদ বিপদ তাকে অন্যায়ের পথ থেকে ন্যায়ের পথে , অসত্যের এবং অবিচারের অনুশীলন হতে সত্য ও সুবিচারের দিকে ফিরিয়ে আনবে । দেশে দেশে যুদ্ধ, হত্যা, হানাহানি , হিংসা, প্রতিহিংসা কমে আসবে । অস্ত্রের প্রতিযোগীতা, দুর্নীতি ও দুঃশাষন হ্রাস পাবে । মানুষের পাপাচার ,মিথ্যাচার ,পংকিলতা ও অপরাধ প্রবনতা কমে যাবে। জঙ্গী সন্ত্রাসবাদ এবং একে অন্যের অশুভ ও অকল্যাণ করা থেকে মানুষ বিরত হবে বা এর পরিমাণ মাত্রা ক্রমশঃ কমে আসবে । অশান্তি ও বিশৃংখলা অন্তত বাড়বে না করোনার শিক্ষার কারণে । এই গভীর উপলব্ধি থেকে মানুষ পরস্পরের প্রতি আরো সহানুভূতিশীল ও সৌহাদ্যর্র্পূ হয়ে উঠবে । করোনার অন্তর্নিহিত অনুভবে মানুষ হবে আরো আত্মিক, মানবিক এবং হিতাকাংখী । তার মধ্যে বৈরীতার চেতনা নিস্তরঙ্গ হয়ে প্রাণীত্ব ও পশুত্বের প্রসার অনেকখানি বিলোপ হয়ে মনুষত্ব্যের গুণাবলী হবে অধিক শাণিত তথা জাগ্রত ।
ধারণা করা হয়েছিল, করোনার পরে পৃথিবী হবে অপেক্ষাকৃত শান্তিময় ও জঞ্জালমুক্ত । করোনা মানব সমাজকে ধুয়ে মুছে বিশুদ্ধ পরিশুদ্ধ করার দিকে ধাবিত করবে। এসিডে পুড়ে সোনা যেমন আরো খাঁটি ও নির্ভেজাল হয়, মানবজাতি করোনার দ্বারা নিস্পেষিত ও পর্যুদস্ত হয়ে তেমনি আরো মানবিকতার ও প্রেমের পরাকাষ্ঠা প্রর্দশনে আরো অঙ্গীকারাবদ্ধ ও দৃঢ়বদ্ধ হতে পারবে। কেননা বিশ^ব্যাপী প্রার্থনালয়ে তারাই তো ¯্রষ্টার সমীপে তওবা করে ক্ষমা চেয়েছে, কান্না করেছে কুপথ থেকে সুপথে ফিরে আসতে যেন করোনার ছোবল থেকে রেহাই পেতে পারে। বিশাল দুঃখ কষ্টের পর মানুষ তো অধিক সংবেদনশীল, সহমর্মী ও সতাদর্শের অনুসারী হবে সেটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা ছিল। তার মধ্যে চরম অনুতাপ ও অনুশোচনা তাকে আরো মানবিক মূলেৈবাধ, নৈতিকতা ও বিশুদ্ধতার দিকে পরিচালিত করবে । করোনার নতুন স্বাভাবিক পরিবর্তনে জগতে প্রবাহিত হবে শান্তির অমীয় ধারা অধিক পরিমাণে।
অথচ করোনা বিদায় নিতে না নিতেই আমরা আজ কী দেখতে পাচ্ছি । করোনার শিক্ষা আমাদের কী কাজে লেগেছে? সাড়া পৃথিবী জুড়ে অগণতন্ত্রিক , একনায়কতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক, লোকরঞ্জনবাদী ও জনতুিষ্টবাদী শাষন-শোষনের ধারা প্রক্রিয়া চরম পর্যায়ে চলে গেছে । উদার গণতন্ত্র ও মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা সংকুচিত হচ্ছে ক্রমান্বয়ে। করোনার যুদ্ধ শেষ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হওয়ার পূর্ব মুহুর্তেই নির্মম যুদ্ধের দামামা বেজে চলেছে দুর্বলের ওপর । সে যুদ্ধ সংঘর্ষ দীর্ঘায়িত হয়ে পারমাণবিক প্রলয়ে পরিণত হওয়ার আশংকা জোড়দার হচ্ছে । বর্তমানে বিশ্বের বহু দেশে অস্থিতিশীলতা ও বিশৃংখলা বিরাজ করছে, বেড়ে চলেছে । তাহলে প্রকৃতির দান নিষ্ঠুর করোনা অপেক্ষা মানুষ আরও কত ভয়াবহ তথা ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে তা আমরা দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি । অতএব করোনার গজবের প্রকোপ আপাতত প্রশমিত হলেও মানুয়ের রক্তের হলি খেলা বেড়েই চলেছে। সমাজে সর্ব প্রকার অবক্ষয় এবং দূষণ- দুর্নীতি উর্দ্বমুখী। পৃথিবীর কোথাও যেন স্বস্তি নেই, শান্তি নেই । কেননা , আমরা করোনা থেকে কোন শিক্ষা বা তালিম নিতে পারিনি। যদিও করোনা ছিল মানুষের ভ্রান্তি, নৈরাজ্য ও হঠকারিতার ফল ।
উল্টোটা করোনার চেয়েও মানব সমাজ আজকে ক্রমশ হয়ে উঠছে বিভৎস, বিভাজিত ,উগ্র, সহিংস আর অসহিষনু । এটা যেন কোভিডের অপেক্ষা অধিক দুঃসময়ের ও দুর্দিন-দুর্দশার অশনি সংকেত । আমরা ভেবেছিলাম প্রলয়ংকারী এই ব্যাধি –বিমারে মানব সমাজের কিছুটা হলেও সংশোধন এবং পরিমার্জন ঘটবে। তাদের মানসিকতা হবে স্বচ্ছ ও মলিনতামুক্ত। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, হচ্ছেটা তার বিপরীত । তবু মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহতায়ালার কাছে অশেষ শুকরিয়া যে, বাংলাদেশে প্রায় করোনামুক্ত পরিবেশে নির্ভয়ে নি:সংকোচে আমরা মুসলিম উম্মাহর অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর উদযাপন করতে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে , আমরা যেন প্রকৃত রমজান, প্রকৃত রোজা , প্রকৃত ঈদ অর্থাৎ এক কথায় এসবের মূল মমার্থ বুঝে সে অনুযায়ী আমল ও আকীদা প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হই আল্লাহ সেই তাওফীক আমাদের দিন। অধিকন্ত করোনার স্বাস্থ্য বার্তা আমরা সদাসর্বদা মেনে চলি ও নিরাপদে থাকি। সকলকে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক চলনবিল বার্তা, তাড়াশ, সিরাজগঞ্জ।