- গাজী সৈয়দ শুকুর মাহমুদ : পৃথিবীর আদি মানব হযরত আদম (আ:) ছিলেন জ্ঞানী, আদর্শ, বহু গুণে গুণান্বিত, প্রকৃত মানুষ। মানবের আদি পিতা হযরত আদম (আ:) ও তার সহধর্মিনী আদি মাতা হযরত হাওয়া। তাদেরকে বিক্ষিপ্তভাবে পৃথিবীর ভিন্নস্থানে অবতরণ করা হলেও পুন:মিলন হয় আরবে। যে আরব পূর্বে যাজিরাতুল আরব নামে পরিচিত ছিল। সৌদ বাদশাহ্্র শাসন আমল হতে দেশটির নাম পরিবর্তন করে সৌদি আরব নামে এখন পরিচিত। আল্লাহর পছন্দনীয় ভাষা আরবি সেহেতু আরবেই আদমের জীবন যাত্রা শুরু হয়। তার পূর্বে এ পৃথিবীতে মানব বা মানবশ্রেণীর কিছু ছিল না। আদম (আ:) এর পর তার পুত্রগণ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হাবিল পরিবার সভ্য ও সম্ভ্রান্ত আর কাবিল পরিবার পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত। শয়তানের ধোকায় পড়ে হাবিলকে হত্যা করে কাবিল। এরপর হাবিলের সন্তানেরা প্রেরিত ধর্মের অনুসারী হয়। আর কাবিল পরিবার শয়তানের ধোকায় পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত । কাবিলের পরিবার দ্রুত বংশ বিস্তার করে। তারা ধর্মহীন অসামাজিক অসভ্যতায় জড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে মানব সভ্যতা ভুলে গিয়ে অসভ্যতায় পরিণত হয়। এমনকি বসবাসের ঘর বাঁধা, ইজ্জত রক্ষার্থে কাপড় তৈরি ও কাপড় পড়তে এবং সঠিক নিয়মে খাদ্য খাওয়াও ভূলে যায়।বংশবৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে মানুষ। এক এলাকা হতে অন্য এলাকায়, দেশ হতে দেশান্তরে।
যেহেতু মানব জাতি এক, তাদের সমাজব্যবস্থা, ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান ও ভাষা একই হবার কথা, শারীরিক গঠন-আকৃতি, দেহের বর্ণ আলাদা আলাদা। মানুষের ভাষাও আলাদা। আরবের বিপথগামী মানুষ থেকে হাবিল পরিবারে জনৈক মেসের নামিয় ব্যক্তি অনেক দূরে একটি দ্বীপাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। তার নামানুসারে সে স্থানের নামকরণ করা হয় “মিশর”। মিশরের মেছের পরিবারের মানুষেরা প্রাথমিক সভ্যতার পর ধীরে ধীরে অসভ্যতায়- মুর্খতায় জড়িয়ে পড়ে।
¯্রষ্ঠার সৃষ্টি মানব জাতিকে জ্ঞানে- গুণে, সামাজিক ও সভ্যতা দিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ করতে যুগে যুগে হেদায়েতের পথ প্রদর্শক হিসেবে পাঠিয়েছেন নবী ও রাসূল। সেসূত্রে মানবের হেদায়েতের জন্য যদিও জানা যায় যে নবুয়াতের দ্বিতীয় নবী আদম (আ:) এর এক পুত্র শীষ (আ:), কিন্তু তার অনুকূলে তেমন কোন দলিল পাওয়া যায়নি। । তবে নুহ্ (আ:) এর নবুয়াতের যথেষ্ট দলিল রয়েছে। এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা না করে উল্লেখ করা হচ্ছে পৃথিবীর মানব সভ্যতা ও মানুষের ভাষা কোথায়, কখন, কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে তা বিভিন্ন গবেষণার তথ্যমতে পূন: আলোচনা করা হচ্ছে।
মিশরে জন্মগ্রহণকারী নবী হযরত নূহ্ (আ:) মানুষকে সভ্য সামাজিকতায় ফিরিয়ে আনতে আহ্বান করেন। তার আহবানে সাড়া দিয়ে কিছু মানুষ সভ্যতায় ফিরে আসলেও অন্যান্যদের সাথে নূহ্ (আ:) এর পুত্রগণের মধ্যে তিন পুত্র তার ধর্মীয় কাজে বিরোধীতা করেÑ যথাক্রমে সাম, কেনানও ভরত। পিতা পুত্রের মত পার্থক্যতায় পুত্র সাম পরিবার-পরিজন নিয়ে চলে যায় পাহাড়ি অঞ্চলে। সামের নামানুসারে ঐ পাহাড়ের নাম হয় ‘সাম পাহাড়’। পরবর্তীকালে ঐ পাহাড়ে সাম পরিবার ইয়াজুজ নামে পরিচিত হয়। অপর একটি গোত্র মাজুজ নামে পরিচিত হয়। উভয় গোত্রই দানব শ্রেণির মানব। নবী হযরত খাজা খিযির (আ:) এর জীবনীতে জানা যায় যে, বাদশা জুলকার নাইন (শাহ্ সিকান্দার বাদশাহ) সময়ে খিযির আ: এর সহযোগিতায় গোত্র দুটিকে ঐ পাহাড়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। নূহের পুত্র কেনান অন্য একটি এলাকায় চলে যায়। তার নাম অনুসারে সে এলাকার নামকরণ করা হয়েছে কেনান শহর। কেনান শহরে জন্ম হয়েছিল নবী ইয়াকূব (আ:)। নূহের অপর পুত্র ভরতকে একটি কিস্তিতে (জাহাজে) উঠিয়ে ভাসিয়ে দেন সাগরে। জাহাজটি ভাসতে ভাসতে পূর্বদিকে আসতে থাকে। জাহাজটি যে দ্বীপে নোঙর হয় ভরত পরিবার সে দ্বীপে অবতরণ করে বসবাস শুরু করে। যে কারণে ভরতের নামানুসারে দ্বীপটির নাম করণ করা হয় ভারত। হযরত নুহ্ (আ:) এর আরেক পুত্র আবির দক্ষিণ আরবে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। তার বসতবাড়ির নাম দ্বারে আবির। এই বাড়ির নামানুযায়ী আবিরের বংশধর দ্রাবির নামে পরিচিত।
ভরত পরিবারে মানুষের ধর্ম, সমাজ ও মানবতা ছিল না। তারা শুধু জানত মানুষে মানুষে মানুষ জন্ম দেয়া, সংগ্রহ করা এবং খাওয়া। তাদের বংশবৃদ্ধি হয়ে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে ঐ পরিবারের একজন জ্ঞানী মানবের জন্ম হয়। তার নাম “হিন্দ”। তিনি একটি ধর্মের প্রবর্তক। তার ধর্ম গ্রন্থের নাম ‘বেদ’। ভারতবর্ষের অসামাজিক, অসভ্য ও ধর্মহীন মানুষদের সামাজিকতা ও সভ্যতায় ফিরে আসতে আহ্বান করেন। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভারতবর্ষের মানুষ সামাজিকতা ও সভ্যতায় ফিরে আসে। তারা ধর্মীয় শাসনে সভ্য সামাজিকতায় চলতে শুরু করে। হিন্দ এর প্রচারিত ধর্মগ্রন্থই বেদ আর হিন্দ এর প্রচারিত ধর্মের অনুসারীরাই হিন্দু জাতি। যেহেতু সংস্কৃত ভাষার উৎপত্তি ভারতবর্ষ থেকেই আর ধর্মগ্রন্থ বেদের ভাষাও সংস্কৃত। এজন্য নি:সন্দেহে এই ধর্মগ্রন্থ বেদের প্রবর্তন/অবতরণ ভারতেই হয়েছে। এর প্রবর্তকও ভারতের আদিবাসিন্দা। কেউ কেউ লিখেছেন হিন্দ এর নাম ছিল ‘আল হিন্দ’। প্রশ্ন থেকে যায় যে, হিন্দ এর জন্ম ভারতে। জন্মসূত্রে তার ভাষা সংস্কৃত। তাই সংস্কৃত ভাষায় আল হিন্দ লেখার কোন সুযোগ ছিল না। অনুরূপ তৎকালীন সময়ে আরব, মিশর, ফ্রান্স, হিব্র ও অন্যান্য আরব এলাকায় আল শব্দ লেখা হয় নি। বর্তমানে যেমন লেখা হয়, আল আরাবিয়া, আল মাদানী ইত্যাদি। সেসূত্রেও হিন্দ এর নাম আল হিন্দ নয়।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি তথ্যে বলা হয়েছে, হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদ আর্য হিন্দু জাতিরা এনেছিল। তবে আর্য জাতির জন্মসূত্রে ভাষা সংস্কৃত ছিল না। এ জন্য তাদের কর্তৃক আনিত ধর্মগ্রন্থ নয়। কারণ বেদের ভাষা সংস্কৃত। তবে আর্য জাতিরা এ ধর্মকে সমর্থন দিয়েছিল। সে কারণেই আর্য জাতির সাথে অনার্য জাতির যুদ্ধ সংগঠিত হয়।
ভারতে বসবাসকারী মানুষেরা একজন মহামনিষীর হাত ধরে ধর্মীয় দিক নির্দেশনায় সভ্যতার সমাজে ভালই চলছিল। এর মাঝে লুটেরা, অশিক্ষিত মুর্খ্য বর্বর শ্রেণীর লোকেরা ধর্মীয় শাসনে ক্ষিপ্ত হয়ে ধর্ম যাজকদের হত্যা করতে শুরু করে। ফলে ধর্ম যাজক-ধর্মানুসারীদের সাথে মুর্খ বর্বরদের যুদ্ধ শুরু হয়। সে যুদ্ধে সমস্ত ভারত কুরুক্ষেত্রে পরিণত হয়। ধর্ম বিরোধীদের ”অসুর” বলা হত। এ যুদ্ধ চলে বহুদিন। ধর্মানুসারী ও ধর্মযাজক হতাহত হয় অনেক। এক পর্যায়ে ধর্ম যাজকগণ প্রায় নিধন হয়ে যায় । যুদ্ধে অসুরেরাও ধ্বংস হয়। তখন ধর্মগ্রন্থ পাঠ করার মতো পন্ডিত পাওয়াও দু:সাধ্য হয়ে পড়ে। যুদ্ধের পর জাতিকে পুন:গঠন করতে দূর দূরান্ত থেকে শিক্ষিত মানুষদের এনে ধর্মগ্রন্থ বেদের শাস্ত্র পাঠ করানো হতো।সে সময়ে যারা ধর্মগ্রন্থ পাঠ করত তারা ব্রাহ্মন পরিচয়ে পরিচিতি লাভ করেছিল। তারা প্রচার করত ধর্মগ্রন্থ বেদ, মহাপবিত্র গ্রন্থ ব্রহ্মশাস্ত্র। এটি ব্রাহ্মন পুরুষ ব্যতিত অন্যকোন গোত্র তো নয়ই ব্রাহ্মণ নারীরাও এটি স্পর্শ করতে পারবে না। ফলে ধর্মশাস্ত্র ব্রাহ্মণ গোত্রের মাঝেই সীমাবদ্ধ রয়ে যায়। সেই সুবাদে ব্রাহ্মনগণ ধর্মশাস্ত্রে নিজেদের মত করে কিছু শ্লোক যোগ করেছিল যথা- ব্রাহ্মন ছাড়া পূজার অনুষ্ঠান হবে না। মহানাম যজ্ঞানুষ্ঠানে ব্রাহ্মন ছাড়া পূজা পার্বন হবে না। পূজার সময়ে ব্রাহ্মনদের ধুতি, গামছা, চাদর অবশ্যই দিতে হবে। ব্রাহ্মনীর শাড়ি আবশ্যক। দেবীর ভোগ্য ব্রাহ্মনদেরই প্রাপ্য। ব্রাহ্মণদের জন্য বিশেষ খাবার ধার্য করতে হবে। ব্রাহ্মনদের উচ্ছিষ্ট খাবার তা-ই শিষ্যগণের ভোগ্য ইত্যাদি। ঐ সকল ব্রাহ্মনেরাই মানুষের গোত্র বর্ণ বিভাজন করেছে। কর্মভেদে যেমন মানুষের বর্ণ পরিবর্তন হয়, তেমনি কর্মভেদেই গোত্র বিভাজন করা হয়েছে।
বলা বাহুল্য, পরবর্তীতে মুসলিম সমাজেও অল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত নামিক আলেম মিলাত পড়া শিখেই সাধারণ মানুষের মধ্যে ফরমান জারি করে দিত গাছের প্রথম ফল, গাভীর প্রথম দুধ, জমির ফসলের প্রথম অংশ এগুলো মোল্লাকে না দিয়ে কেউ খেতে পারবে না। দেখেছি আরবি সাবান মাসের শুরু হতে প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত উত্তরপাড়া বা মধ্যপাড়ার মৌলভী/মুন্সি দাওয়াত দিতে গেলে সিরিয়াল ধরে থাকতে হত। মৌলভীর ধার্য্য দিন অনুযায়ী অনুষ্ঠান হত। তারপরও খাওয়া-দাওয়া শেষে মিলাত পড়ে মৌলভীকে নজরানা-হাদিয়া দিতে হত। তাও আবার কম হলে পরবর্তীকালে আর দাওয়াত গ্রহণ করেনি। মোল্লা / মুন্সিরা আরও ঘোষণা করেছিলেন যে, নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, নতুন ঘর ও মূল্যবান সম্পদের ব্যবহারের পূর্বে মোল্লার জিয়াপত-মিলাত না দিলে যাত্রা হয় না। এ যেন ব্রাহ্মনদের উত্তরসূরি।
ধর্মে মানুষের শান্তি, ধর্মেই মানুষ সামাজিকতায় সভ্য হয়ে চলতে পারে। অথচ ধর্মের মধ্যে ব্যক্তিস্বার্থ যোগ করে অশান্তি সৃষ্টি করেছিল গোত্র, বর্ণ, বৈষম্যতা। নাপিত, ধোপা, তেলি, মালি, চর্মকার, কর্মকার, কুম্ভকার, জেলে, চাষি এরা নি¤œগোত্র বা ছোট জাত। ধর্ম যাজক ব্রাহ্মন, মহাজন, গদিয়ান, ব্যবসায়ী, পন্ডিত গুরু এবং উচ্চ বংশীয়রা নি¤œগোত্র ছোট জাতের সাথে মেলা-মেশা, খাওয়া-দাওয়া, পূজা-পার্বন, উৎসব-অনুষ্ঠান করত না। নাপিত খত কামিয়ে না দিলে নর সুন্দর হয় না।ধোপা কাপড় ধুয়ে না দিলে ভদ্র পরিবেশ হয় না। মালি আঙ্গিনা ঝাড়ু না দিলে বা প্রত্যুষে ফুল না দিলে যাত্রা শুভ হয় না। অথচ উচ্চ বংশীয়রা ¯œান করে আসার পর ছোট জাতের ছায়া লাগলে তার শাস্তি হত, এমনকি শিরোচ্ছেদ করারও প্রমাণ রয়েছে। একারণেই গোত্র-বর্ণ বৈষম্যতায় ধর্মে অধর্মীয় আচারণ নি¤œগোত্রের মানুষেরা নির্যাতনের শিকার ছিল।
ধর্মশাস্ত্রে বলা হয়, ধর্ম যখন মানুষের হাত বদলায় মানুষ যখন ধর্মশাস্ত্রে সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন, সংস্কারের নামে কুসংস্কার যোগ করে তখন ধর্মগ্রন্থ হয়ে যায় কলুষিত, ধমের্র হয় গ্লানি এবং ধর্মশাস্ত্রের হয় অপব্যাখ্যা। তখন সৃষ্টিকর্তা ঐ ধর্ম সংশোধন করে নতুন ধর্ম অবতরণ করেন। নেমে আসে নতুন ধর্ম প্রচারক। আরব, মিশর, সিরিয়া, কেনান এর পাশাপাশি বহুপূর্বে ভারতবর্ষে হিন্দু ধর্ম প্রচারিত হয়েছে। যেহেতু বহুপূর্বে এই ধর্মের অবতরণ হয়েছিল, সেহেতু হিন্দু ধর্ম অনেক পুরাতন। এ জন্য ঐ ধর্মের নামকরণ করা হয়েছে সনাতন ধর্ম।
শুধু হিন্দুধর্মেই নয়, পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মগ্রন্থেও যেমন- ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মের বাণীতেও এ কথা উল্লেখ রয়েছে যে, মহান ¯্রষ্টা ঘোষণা করেছেনÑআমি পৃথিবীতে যে সকল ধর্ম নাযিল করেছি তা যখন মানুষের হাতে পরে পরিবর্তন-পরিবর্ধন, সংশোধন-সংযোজন, বিয়োজন হয়েছে; মোটকথা ধর্মের মধ্যে মানুষের হস্থক্ষেপ হয়েছে তখন আমি ঐ ধর্ম বাতিল করে পরবর্তী বাহকের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ ধর্ম নাযিল করেছি। হিন্দু ধর্মে গোত্র-বর্ণ, জাতভেদ বিভাজন করায় গোত্র-বর্ণ বৈষম্যতার শিকার ছোট জাতের হিন্দুরা অবহেলিত নির্যাচিত। নানা কারণেই ভারত বর্ষে আরেকটি ধর্মের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪৫ এ বুদ্ধুদেব বা গৌতমবুদ্ধের আবির্ভাব ঘটে। গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয় হিন্দু ধর্মেই। হিন্দু ধর্মে জন্মগ্রহণ করে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম প্রবর্তন করেন। তিনি একটি নতুন ধর্ম প্রচার করেন যার নাম বৌদ্ধধর্ম । এ ধর্মের মুলমন্ত্রÑঅহিংসা পরমধর্ম, জীব হত্যা মহাপাপ। তার মহামানবতা ও উদারতা দেখে গোত্র, বর্ণ বৈষম্যতার শিকার নি¤œ গোত্রের হিন্দুরা তখন বৌদ্ধধর্মে যোগ দিতে থাকেন। এ অবস্থায় ব্রাহ্মনগণ আরো কঠিন হুকুম জারি করেন। বলা হয় হিন্দু ধর্মের কোন লোক অন্যধর্মের লোকের সাথে মেলামেশা, খাওয়া দাওয়া করলে সে ধর্ম ত্যাগী হয়ে যাবে। তাকে আর স্বধর্মে স্থান দেয়া হবে না। ফলে ভারতবর্ষে হিন্দু ধর্মের লোক কমতে থাকে এবং বৌদ্ধধর্মের উত্তরোত্তর প্রসার ঘটে। এরপর খ্রিষ্টান ধর্ম ও মুসলিম ধর্মেও হিন্দু নি¤œগোত্রের মানুষ গোত্র, বর্ণ বৈষম্যতায় ক্ষিপ্ত হয়ে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে উল্লেখিত ধর্মসমূহে যোগ দেয়। বৌদ্ধ ধর্মের সমসাময়িক ভারতে আরও একটি ধর্ম অবতরণ হয়েছে। এটি জৈন ধর্ম নামে আত্মপ্রকাশ পেয়েছে। যার ধর্ম প্রচারকের নাম মহাবীর। এ ধর্ম পালন অত্যাধিক কষ্টসাধ্য হওয়ায় ধর্মের প্রচার প্রসার ততটা ঘটেনি।
ভারতবর্ষে যে তিনটি ধর্ম অবতরণ হয়েছে তা হলোÑ হিন্দু ,বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম। বৌদ্ধধর্ম প্রচারের পূর্বে পুরো ভারতবর্ষে শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মের লোকেরাই ছিল। হিন্দ এর প্রচারিত ধর্মানুসারীরাই হিন্দু জাতি হিসেবে পরিচিত। গবেষণার তথ্যমতে জানা যায় যে, পৃথিবীতে যত ধর্ম অবতরণ/ নাযিল হয়েছে তার বেশির ভাগই আরব, মিশর, সিরিয়া, জর্ডান ও হিব্রুতে। আরব মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরের মধ্যবর্তী স্থানের নাম হিব্রু। হিব্রু স্থানে হিব্রু ভাষায় বেশ কয়েকখানি আসমানি কিতাব রয়েছে। পবিত্র কোরআন শরীফে বর্ণনা অনুযায়ী এই পৃথিবীতে মানব জাতি হেদায়েতের জন্য পর্যায়ক্রমে এক লক্ষ চব্বিশ হাজার মতান্তরে দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী বা রাসূল অবর্তীণ হয়েছে। প্রত্যেকে নিয়ে এসেছেন ধর্ম। যা মানুষের কল্যাণে। এগুলো বেশির ভাগই অবর্তীণ হয়েছে আরব দেশগুলোর মধ্য হতে। মানব জাতির সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম সভ্য মিশর, তারপর পারস্য। অনেক দেরিতে হলেও মানব সভ্যতার ইতিহাসে তৃতীয় চীন।
বর্তমানে ভারতবর্ষে বহু ধর্ম, বহু বর্ণ, বহু গোত্র ও অনেক ভাষার মানুষ বসবাস করছে। ধর্ম যার যাই হোক ভাষার পরিবর্তন হয়েছে অঞ্চল ভেদে। মানুষের ভাষার পরিবর্তন হয়েছে সে অঞ্চলের মাটির গুণে। পৃথিবীতে বর্তমানে বহু জাতের মানুষ বসবাস করছে। এগুলো জাত নির্ণয় করা হচ্ছে ধর্ম, বর্ণ ও ভাষার কারণে। ভারত উপমহাদেশে প্রথম মানুষ মিশর থেকে আগত, তাদের ভাষা মিশরীয় হলেও পরবর্তীকালে ভাষা পরিবর্তন হয়ে সংস্কৃতি ভাষায় পরিণত হয়। এটিও হয়েছে অঞ্চল বা মাটির গুণে। মানুষের বংশ বৃদ্ধির পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় বসবাস বা অবস্থান করায় এলাকা ভেদে নতুন নতুন ভাষা সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমতঃ ভারতের সংস্কৃতি ভাষা থেকে হিন্দি ও বাংলা ভাষা সৃষ্টি হয়েছে। মিশর, আরব ও পারস্যের মানুষেরা পৃথিবীর পশ্চিমাঞ্চলে ইউরোপ, আমেরিকা তথা পশ্চিমা বিশ্বের অন্যান্য দেশে দখলদারিত্ব নিয়ে নতুন নতুন দেশ আবিস্কার করেছে। অ্যারাবিয়ান ও মিশরীয়রা ঐ সকল দেশে গিয়ে ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষায় পরিণত হয়েছে। এজন্য উল্লেখ করা হয়েছে স্থান, সময় ও মাটির গুণেই মানুষের ভাষা সৃষ্টি হয়। অনুরূপভাবে অ্যারাবিয়ান ও পারস্য সভ্যতার লোকেরা পূর্বদিকে ভারত উপমহাদেশে বাণিজ্য, কৃষি ও রাজত্ব করার জন্য আধিপত্য বিস্তার করেছে। যে কারণে ভারত উপমহাদেশে সংস্কৃত, হিন্দি, বাংলা, পাঞ্জাব, পাঠান, আফগান ও বেলুচি ভাষার মধ্যে আরবি ও ফারসি ভাষা মিশে রয়েছে।
বাংলায় আগত আরবি-ফারসি কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়েছে। (১) প্রশাসনিক ও আইন আদালত সম্পর্কীয় শব্দ, যেমন : আরজি, আলামত, উকিল, এজলাস, কসম, কানুন, খারিজ, মৌজা, মহকুমা, রায়, হাজত, হাজির বা হাজিরা, খালাস, চৌকিদার, দফাদার, আদালতে উকিলি সেরেস্তা ইত্যাদি। (২) ধর্ম সম্পকীয় শব্দ, যেমন: আল্লাহ, আখিরাত, ঈদ, ঈমান, কিয়ামত, কোরআন, কোরবাণী, জান্নাত, জাহান্নাম, রোজা, খোদা, তওবা ইত্যাদি। (৩) শিক্ষা সংক্রান্ত শব্দ, যেমন: ওস্তাদ, কলম, কিতাব, কুরসি, খাতা, গায়েব, তরজমা, দাখিল, দোয়াত, নগদ, মুন্সি ইত্যাদি। (৪) সংস্কৃতি ও বিবিধ বিষয় শব্দ, যেমন- আক্কেল, আদম, আদব, আতর, অজু, কবর, কিছমত, খাস, তাওফিক, তাসলিম, তাজ্জব, তামাদ্দুন, তালিম, তাহজিব, দুনিয়া, বিদায়, মসলিস, মঞ্জিল, মাখসুদ, মাহফিল, হাশর ইত্যাদি। এ সকল শব্দ ছাড়াও সঙ্গতিসম্পন্ন যুগ্ম শব্দ লক্ষ্য করা যায়। (ক) যেমন: আম (সাধারণ আম দরবার), আমমুখতার নামা, (খ) খাস (বিশেষ অর্থে যেমন খাস দখল, খাস মহল, খাস চামচা ইত্যাদি), (গ) গর (অভাব বা অ অর্থে যেমন: গড় মৌসুম, গড়রাজি, গড়হাজীর ইত্যাদি)। বাংলা ভাষায় আরবি-ফারিস ঐতিহ্যমন্ডিত হলেও সম্প্রতি এ শব্দগুলোকে বিদেশি শব্দ বলে বাংলা ভাষার আধুনিকায়ন করণে গবেষকদের প্রচেষ্টা চলছে। অ্যারাবিয়ান ও ফরাসিদের আগমনে ভারতবর্ষে মানব সভ্যতার দিক নির্দেশনা পেয়েছে। যে কারণে ঐ সকল বিদেশি ভাষার সংমিশ্রণে পাকিস্তানে উর্দু, পাঞ্জাব, পাঠান ও বেলুচি ইত্যাদি ভাষার সাথে আরবী , ফারসী ও অন্যান্য বিদেশি ভাষা মিশে আছে । অনুরূপভাবে ভারতীয় হিন্দি, কেরালা ও বাংলা ভাষা মিশে থাকায় এসকল ভাষা সমৃদ্ধশালী হয়েছে। ভারতীয় হিন্দি ও বাংলা ভাষা সম্মৃদ্ধশালী হয়েছে।
ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চল বাংলা এলাকার মানুষেরা প্রথমে যে ভাষায় কথা বলত এ ভাষাটির নির্দিষ্ট কোন নাম ছিল না। শুধু আমি, তুমি, আমরা, তোমরা, আশা, যাওয়া, খাওয়া ইত্যাদি বাক্য ছিল। প্রথমে ফরাসিরা ‘বঙ্গালাহ্’ শব্দ দিয়ে এ ভাষার নামকরণ করেছিল। তারা বঙ্গালাহ্ নামেই প্রচার করেছে। পরবর্তীতে বাঙালা, বাংলা ভাষা নামে প্রবর্তন হয়েছে। সে সুত্রেই বাংলা ভাষাভাষিরা বাঙালি (সূত্র বাংলা একাডেমি ধারাবাহিক বাংলা অভিধান-পৃষ্ঠা-৮৬৪) এ নাম ইঙ্গিতবহ। ভারতবর্ষের পুর্বাংশের মানুষ যে ভাষায় কথা বলে এই ভাষার নামকরণ করা হয় বাংলা ভাষা। কবে থেকে কোন সময় হতে এ ভাষার সূত্রপাত হয় তার কোন হিসেব মানুষের কাছে নেই। এর কোন বর্ণমালা অক্ষর এর লেখা বা শিলালিপিও ছিল না। ৭০০ খ্রীষ্টাব্দের পুর্বাব্দে দ্রাবিড়রা দক্ষিণ আরব থেকে বর্ণমালার কিছু শিলালিপি এনেছিল। সেগুলি কখন কোন সময়ে কি কারণে পাথরে খোদাই করা হয়েছিল তার কোন প্রমাণ বা সুত্র নেই। পরবর্তীতে এগুলো বাংলা বর্ণমালা বা বাংলা অক্ষর হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়Ñ অ আ ই ক খ। এই আক্ষরিক আকৃতিকে বাংলা বর্ণমালা হিসেবে পরিচয় করানো হয়। প্রথম দিকে া-আকার, -িইকার, ১ী- দির্ঘ ইকার, উ-কার, ে া ওকার ছিল না। তখন বাংলা ভাষা দূর্বোধ্য ছিল। পরবর্তীকালে আরও সংস্কার করে আজকে পরিশুদ্ধ বাংলা বর্ণমালায় পরিণত হয়। এ ছাড়াও ভারত উপমহাদেশে আগত অ্যারাবিয়ান, ফরাসি ও অন্যান্য ভাষাভাষীরা এদেশে বাণিজ্য, চাষাবাদ, দখলদারিত্ব শাসন ও রাজত্ব করতে এসে তাদের নিজস্ব প্রভাবে বাংলা ভাষায় স্ব স্ব ভাষা যোগ করেছে, ঐ সকল ভাষার সংমিশ্রণে সমৃদ্ধ বাংলা ভাষা। পরবর্তীকালে ইংরেজ দখলদারিত্বে ইংরেজি ভাষাও বাংলা ভাষার মাঝে সংযুক্ত হয়েছে।
কালের প্রবাহে বাংলা ভাষার সাথে প্রচুর আরবি-ফারসি, তুর্কী ও ইংরেজি ভাষার শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। বিভিন্ন তথ্য ও গবেষণার ভিত্তিতে বা গবেষকদের মতে বাংলা ভাষায় প্রায় সোয়া লক্ষ শব্দ আছে। এর মধ্যে আরবি ও ফারসি প্রায় ১০ হাজার শব্দ আছে। ইংরেজি ১ হাজার আছে। তুর্কী ৪ শতটি শব্দ পাওয়া যায়। অন্য তথ্য ও গবেষণায় কোন কোন গবেষকদের মতে ৩০ শতাংশ আরবি-ফারসি শব্দ আছে। এক্ষেত্রে গবেষকদের মতে উল্লেখ করা হয়েছে, যেহেতু মাটির গুণেই মানুষের ভাষা সৃষ্টি হয়েছে খোদ আরবেও দেখা যায় যে, তাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা আরবী হলেও পৃথক পৃথক অঞ্চলিক ভাষা পরিবর্তন। অন্যদিকে ভারত উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চল বার্মা, চীন, জাপান, রাশিয়া, হংকং ইত্যাদি দেশের ভাষা ভিন্ন ভিন্ন (মাসিক আল আবরার অনুচ্ছেদ ৭, পৃষ্ঠা-২১)। বাংলা ভাষা নিজেকে গতিশীল ও সমৃদ্ধ করতে এমনভাবে ঐ সকল ভাষার সাথে আত্মস্থ করেছে যে, এখন আর ঐ সকল শব্দকে বিদেশি শব্দ বলে মনে হয় না। উপরে উল্লেখিত তথ্যমতে প্রমাণিত যে, পৃথিবীর মানুষের হেদায়েত বা মানব সভ্যতার জন্য যুগে যুগে নবী-রাসূল ও মহামানবদের জন্ম হয়েছে। তাদের অনুসরণ করেই আদিম মানুষেরা সভ্য মানুষ হয়েছে। আর অঞ্চলভেদে সে এলাকার মাটির গুণেই হয়েছে মানুষের ভাষা।
লেখক : কথা সাহিত্যক ও কলামিষ্ট, শাহাজাদপুর, সিরাজগজ্ঞ।