চারদশক পর চলনবিলে হেইয়াবোল

Spread the love

আলী আক্কাছ, গুরুদাসপুর (নাটোর) :
চারদশক পর হঠাৎ জেগে উঠলো চলনবিল। ১শ’ ফিটের বাহারি নৌকাগুলোর বাইচ দেখতে বিলের দুইপাড়ে লাখো মানুষের ঢল। মুহুর্মুহু বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দে এগিয়ে চলছে একেকটি নৌকা। সেই শব্দে তাল মিলিয়ে গর্জন করে উৎসুক দর্শনার্থীরা প্রেরণা দিচ্ছিল বাইচের নৌকায়।
বেরসিক বৃষ্টি বাধা হতে পারেনি অদম্য প্রতিযোগিদের। আল্লাহ-রাসুলের নাম নিয়ে হেইয়াবোল-হেইয়াবোল সহ নানা শ্লোক আর নেচে গেয়ে চলনবিলের বিলসাসহ কাটাগাং নদী এলাকায় দারুন ছন্দের সূচনা করেন মাঝিরা। ঐতিহ্যের এ নৌকা বাইচের বর্ণিল আয়োজনে গ্রাম বাংলার চারপাশ রাঙিয়ে যায় উৎসবে।
নাটোর জেলা প্রশাসনের আয়োজনে গুরুদাসপুরের খুবজীপুর ইউনিয়নের বিলসা এলাকায় কাটাগাঙে ওই নৌকাবাইচ অনুষ্ঠিত হয়। “নদী দূষণ রোধ করি, নির্মল বাংলাদেশ গড়ি” প্রতিপাদ্যে আয়োজিত প্রতিযোগিতাটি মা জননী সেতু থেকে রুহাই পর্যন্ত দুই কিলোমিটার বিস্তৃত জলপথে অনুষ্ঠিত হয়।
নাটোর জেলা প্রশাসক আসমা শাহীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য সচিব মো. সাইদুর রহমান। বিশেষ অতিথি রাজশাহী বিভাগীয় কমিশিনার আজিম উদ্দিন, ডিআইজি শাহজাহান আলী, নাটোরের পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম ও গুরুদাসপুরের ইউএনও ফাহমিদা আফরোজ বক্তব্য রাখেন।
শুক্রবার (১২ সেপ্টেম্বর) চলনবিলের বিলসা এলাকায় ছিলোনা তিল ধারনের ঠাঁই। বিভিন্ন জেলা থেকে ২১টি দল রেজিস্ট্রেশন করলেও মূল প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় ১২টি দল। মূল প্রতিযোগিতার আগে স্থানীয় পানসি নৌকাগুলোর বর্ণিল মহড়াও ছিল আকর্ষণীয়। নৌকা বাইচের চুড়ান্তপর্বে তুমুল প্রতিদ্ব›িদ্বতার পর চ্যাম্পিয়ন হয় ‘নিউ একতা এক্সপ্রেস’। দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ‘বাংলার বাঘ’ আর তৃতীয়স্থানে ছিলো ‘আল মদিনা’ নৌকা। তিনটি নৌকাই ছিলো শাহজাদপুর এলাকার। বিজয়ীদের পুরস্কার হিসেবে আগের মত শিলকাপ নয় দেওয়া হয় মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর ও এলইডি টিভি। অংশগ্রহণকারী নৌকা দলগুলোকে অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও দেয়া হয়। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় অর্থ বা নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি ছিল না। তবে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ, যত্রতত্র পুকুর খনন ও পলি জমায় চলনবিলে আগের মত আর দীর্ঘসময় পানি থাকেনা। নৌকা বাইচের বিষয়টি মাথায় রেখে সবার সহযোগিতায় চলনবিলকে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন।
‘চলনবিল রক্ষা আন্দোলন’ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সচিব এসএম মিজানুর রহমান বলেন- “শাহজাদপুরের বুড়িপোতাজিয়া নামক স্থানে রবীন্দ্র বিশ^বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে চলনবিলের পানি ঢোকা এবং বের হওয়ার সুগম রেখে বিশ^বিদ্যালয়টি করা হোক। নইলে চলনবিল বাঁচানো যাবেনা।”
বিলসার স্বর্ণদ্বীপ কফি হাউজের মালিক রমিজ উদ্দিনসহ স্থানীয়রা বলেন- “অপার সম্ভাবনার চলনবিলে ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচের কথা আগে কেউই ভাবেনি। আশির দশকে ময়েজ ফকির, ইমান আলী, রওশন হাজীসহ সেসময়ের তরুণদের প্রচেষ্টায় একবারই নৌকা বাইচ হয়েছিল।”
চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সভাপতি মজিবুর রহমান মজনু বলেন, “রাজনৈতিক নেতাদের গ্রæপিংয়ের কারণে মানুষের মনে আগের মত ঐক্য নেই। ছোটখাটো যেকোন বিষয় নিয়েই বিবাদে জড়িয়ে পড়েন তারা। আধিপত্য বিস্তারে সহিংসতাও দেখা যায়। অন্তর্বর্তী সরকার থাকায় স্থানীয়দের অনুরোধে জেলা প্রশাসন এ নৌকা বাইচের উদ্যোগ নেয় এবং সফল হয়। নৌকাবাইচ দেখতে দলমত নির্বিশেষে সবাই এসেছিলেন। আনন্দ-উচ্ছ¡াসও করেছেন তারা। মেয়ে-জামাই, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে বাড়িতে বাড়িতে উৎসব করেছেন বিলপাড়ের মানুষ। প্রতিবছর এমন নৌকাবাইচের আয়োজন করলে গ্রামীণ মানুষ মুক্ত পরিবেশে বিনোদন উপভোগ করবে।”
ইউএনও ফাহমিদা আফরোজ বলেন- “এতদিন নৌকা বাইচ হয়নি কেন তা বলতে পারব না, তবে মানুষের বিনোদনের আকাঙ্খা পুরনের চেষ্টা করেছি। আমরা সফলও হয়েছি। চেষ্টা থাকবে প্রতিবছর নৌকাবাইচের আয়োজন করার।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD