আবদুর রাজ্জাক রাজু
সম্প্রতি নাটোরের গুরুদাসপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে চলনবিল রক্ষা আন্দোলনের জনৈক মুখপাত্র বলেছেন, “আমরা চলনবিলও চাই- রবীন্দ্র বিশ^বিদ্যালয়ও চাই”। তাই চলনবিল আর রবীন্দ্র বিশ^বিদ্যালয় একই সুরে ও আবেগের সাথে গাঁথা তা সবারই সমান অনুভূতি বটে। দুটোই গুরুত্বপূর্ণ । তবে চলনবিল না থাকলে রবীন্দ্র বিশ^বিদ্যালয় অর্থহীন সে কথাও বুঝতে হবে। বিশেষ করে দেশ ও দেশের জনপদ, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য আগে। দেশের মানুষ ও পরিবেশ সর্বাগ্রে। শিল্প, কলকারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এগুলোর প্রাধান্য পরে। কারণ “মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই – নহে কিছু মহিয়ান” । কবি’র সে কথার মর্ম অনুধাবন কিন্তু কঠিন নয়। কাজেই চলনবিল বাঁচলে এর মানুষ বাঁচবে। চলনবিল মরলে এর মানুষসহ গোটা প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ সবই হুমকি, ঝুঁকি ও বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যাবে। এর অস্তিত্ব বিলীন হবে। সেটাকে বলা যায় এক ধরনের সুনামি। সে কারণেই পরিবেশ বাদ দিয়ে কোনো উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি হতে পারে না এ মতবাদ আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। সে অর্থে চলনবিলের ব্যাপকতা ও তাৎপর্যের সাথে রবীন্দ্র বিশ^বিদ্যালয় তুলনীয় হতে পারে না।
রবীন্দ্র বিশ^বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে গত ১৫ জুলাই ২০২৫ একই বিশ^বিদ্যালয় মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে কিছু বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে। যা বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ের জ্ঞান ও মানের সাথে যায় না। যেমন: “পরিবেশ কর্মী পরিচয়ে একটি লোভী স্বার্থান্ধ গোষ্ঠি রবীন্দ্র বিশ^বিদ্যালয় হলে চলনবিল ক্ষতিগ্রস্থ হবে বলে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে”। এ নিবন্ধে প্রথমেই আমি ওই পরিবেশ কর্মী তথা চলনবিল রক্ষা আন্দোলনের আহবায়কের সাম্প্রতিক মন্তব্যের উদ্বৃতি দিয়েছি। তিনি চলনবিল ও রবীন্দ্র বিশ^বিদ্যালয় দুটোই চেয়েছেন। তিনি বলেননি, এই বিশ^বিদ্যালয় হলে চলনবিল ক্ষতিগ্রস্থ হবে। বরং চলনবিলের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তথা চলনবিলের পানি নিস্কাশনের বহু খাল বা নদীমুখ যেখানে এসে মিশেছে সেখান থেকে বিলের পানি প্রবাহ যমুনায় গড়াতে বাধাপ্রাপ্ত হলে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় চলনবিলে নানামুখী পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দেবে; যদি শাহজাদপুরের বুড়ি পোতাজিয়ার উল্লেখিত নির্ধারিত স্থানে উক্ত বিশ^বিদ্যালয় ভবন ও ক্যাম্পাস নির্মিত হয়- ¯্রফে এই অকাট্য যুক্তিটা তিনি সামনে এনেছেন। অর্থাৎ নিরেট বিলের মাঝখানে বিরান বিল এলাকায় একটি বিশাল জলাধারের বুকে বড় বড় কংক্রীটের পাকা দালানসহ ভরাট-পাইলিং করে বিশাল আকারের স্থাপনা ও রাস্তাঘাট নির্মাণ কখনো পরিবেশসম্মত হতে পারে না। আর এ ব্যাপারটা বিজ্ঞানের তত্ব, তথ্য বা সূত্র দিয়ে বুঝানোর প্রয়োজন পড়ে না। সাধারণ জ্ঞান, বিবেক ও বাস্তব বিচার বিচেনাতেই এর মর্ম-তাৎপর্য সহজে বোধগম্য। সেটা চলনবিল না হয়ে অন্য যে কোনো বিশাল জলাভূমি বা বিস্তৃত খাল নদী লেক হলেও একই কথা প্রযোজ্য হত।
আবার বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত উপরোক্ত একই সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপিত প্রশ্ন “গত ৯ বছরে এ নিয়ে কেন প্রতিবাদ হল না” তার জবাবে বলা যায়, সম্ভবত বুড়া পোতাজিয়ায় রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মিত হবে তা গণমাধ্যমের সুবাদে বৃহত্তর জনপরিসরে প্রচার ও চাউর হয়ে সবার নজরে এসেছে হালে, অতি সম্প্রতি মাত্র। মানে এখানকার শিক্ষার্থীদের স্থায়ী ক্যাম্পাসের দাবিতে আন্দোলনের সূত্রে স্থান নির্বাচনের বিষয়টি ব্যাপকভাবে জানাজানি বা প্রকাশিত হয়। এতে করেই চলনবিলের মাঝে বিশাল স্থাপনা নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ওঠে। এমনকি এটা আবার ওই বিশ্ববিদ্যালয় না হয়ে অন্য বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের কোনো প্রসঙ্গ হলেও পরিবেশবাদীরা অনুরূপ অভিযোগ আপত্তি তুলতে পারেন তাও অযৌক্তিক এবং অবিবেচনাপ্রসূত হবে না তা নিশ্চিতই বলা যায়। এ ক্ষেত্রে কৃষি বা পরিবেশ অধিদপ্তর কী ছাড়পত্র কিংবা প্রত্যয়ন দিলো কি দিলো না সে যুক্তি অবান্তর। কারণ খালি চোখে ও সুস্থ জ্ঞানে যার বাস্তবতা ও পরিণাম উপলব্ধি করা যায় অনুবীক্ষণ বা দূরবীক্ষণ লাগিয়ে তা দেখার আবশ্যকতা কোথায়। তাছাড়া আমাদের দেশের সমাজ ব্যবস্থায় ক্ষমতা ও প্রভাব থাকলে কোনো ছাড়পত্র যোগার করাই অসাধ্য-দু:সাধ্য নয় সেটা সব্রাই জানা।
এখন আসি শাহজাদপুরের “বুড়া পোতাজিয়া হতে চলনবিল ৬৮ মাইল দূরে অবস্থিত” একই সংবাদ সম্মেলনে এমন উদ্ভট দৃষ্টিভঙ্গীর অবতারনা প্রসঙ্গে। এটা যেন মাতৃগর্ভে শিশুর অবস্থান সত্বেও ভ্রমাত্মক ব্যবধানের অনুমান। আচ্ছা ,তাই যদি হবে তো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চলনবিল মধ্যস্থিত শাহজাদপুরে না এসে উল্লেখিত ৬৮ মাইল দূরবর্তী চলনবিলে আস্তানা গাড়লেন না কেন। কেনই বা তিনি অনেক কালজয়ী লেখনীতে শাহজাদপুরকে চলনবিল নামে অভিহিত করেছেন। আরো কেন ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে , রবী ঠাকুর, শাহজাদপুর কাছারীবাড়ী ও চলনবিল এসব অখন্ড ইতিহাসের অংশ বা অধ্যায়। এগুলোর একটিকে আরেকটি থেকে পৃথক বা আলাদা করা যায় না। ঐতিহাসিকভাবে স্বতসিদ্ধ যে, শাহজাদপুর চলনবিলের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এর প্রায় চতুর্পাশেই আজো বিল আর নদনদী ঘেরা।তাই বুড়িপোতাজিয়া বা শাহজাদপুরের সাথে চলনবিলের সম্পর্ক প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত। তাহলে কোন্ যুক্তি ও প্রমাণের ভিত্তিতে বলা হল, “বুড়া পোতাজিয়া বা শাহজাদপুর থেকে চলনবিল ৬৮ মাইল রৈখিক দূরত্বে অবস্থিত”। বরং শাহজাদপুর সহ পূর্বের বৃহত্তর চলনবিলের যে ১২টি থানা অধুনা উপজেলাকে শত শত বর্ষ যাবৎ নানা প্রকারে পরিবেশগতভাবে বিধ্বস্ত ও বিপন্ন করা হয়েছে তার ফলে সমগ্র চলনবিল আজ পরিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ কারণে উপমহাদেশের বৃহত্তম এই বিল দ্রæত সংকুচিত হয়ে আসছে যা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ অশনিসংকেত স্বরূপ।
ওদিকে যুগ যুগ ধরে অসংখ্য অগনিত বাঁধ, ¯øুইচগেট, পোল্ডার, ব্রীজ,কালভার্ট, ড্যাম,সড়ক,রাস্তাঘাট,রেলপথ,পুকুর,বাড়ীঘর,ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্প-কলকারখানা ইত্যাকার স্থাপনা নির্মাণ করে প্রকৃতপক্ষে চলনবিলের প্রাণ-প্রকৃতি, পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য বহুলাংশে ধ্বংস করা হয়েছে। এখন সেই ধ্বংসযজ্ঞের শেষ পেড়েক ঠোকা হবে যদি এই বিলের বুকে এবার রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশাল ইট পাথরের দালানকোঠা সহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মিত হয়। তাই চলনবিলবাসীর পক্ষে আমাদের প্রস্তাব , বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাস ওখানে না করে শাহজাপুরের পূর্ব অথবা উত্তরের উঁচু স্থলভাগ এলাকার যে কোন স্থানে বগুড়া-নগরবাড়ী মহাসড়ক সংলগ্ন কিংবা এর অদূরবর্তী উপযুক্ত স্থান নির্বাচিত করে নির্মাণ করা হলে তা চলনবিল রক্ষায় সহায়ক হবে। এ নিবন্ধ লেখার সময় সংবাদপত্রে খবর দেখলাম, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নির্মাণের প্রস্তাব একনেকে পাশ হয়েছে, তবে শর্ত হলো-পরিবেশগত সমীক্ষা জরিপ সাপেক্ষে। অবশ্য এটা ভাল খবর। তাসত্বেও তড়িঘড়ি করে চলনবিলের ঐ স্থানে তা করাটা ঠিক হবে না। আর যদি শেষমেষ তাই হয় তাহলে চলনবিলবাসীকে এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। মনে রাখতে হবে, শুধু রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, কর্তৃপক্ষ এবং শুভার্থীরাই নয়, চলনবিলের সব মানুষেরও প্রাণের দাবি- এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত শাহজাদপুরেই স্থাপিত হোক। তবে চলনবিলের পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্থ, এর জলাভূমি বিনাশ বা এর কোনরূপ ক্ষতি না করে তা করতে হবে- এটাই একমাত্র চাওয়া। কোন মহলের এমনটি ভাবনা-চিন্তা করা ভুল তথা অমূলক হবে যে, যারা চলনবিল রক্ষার্থে বুড়ি পোতাজিয়ায় এর নির্মাণের বিরোধীতা করছে তারা রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়েরও বিরুদ্ধে বা বিপক্ষে, ওরা এর শত্রæ। তারা চায় না এটা হোক। এই ধারণা আত্মকেন্দ্রিক , একপেশে এবং সম্পূর্ণ অযথার্থ।
বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলকে দূরদর্শী দৃষ্টি দিয়ে, চলনবিল দৃশ্যপটে ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের দেশীয় এবং স্থানীয় অভিঘাতের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে এই কাজটি করতে হবে। কারণ এটা কোন সাময়িক, অস্থায়ী ও ছোটখাটো হালকা স্থাপনা নয়। এমনকি ভবিষ্যতে এর কলেবর, পরিসর ও পরিধি প্রয়োজনের ও চাহিদার আলোকে ক্রমান্বয়ে আরো বৃদ্ধি ও প্রসারিত হয়ে অবশেষে শহরায়নের দিকে ধাবিত হবে। তখন চলনবিলের আরো বিস্তৃত জায়গা দখলের দরকার দেখা দেবে। এর পরিণতিতে বর্তমানে মৃতপ্রায় চলনবিলের মৃত্যু আরো ত্বরান্বিত হবে যার দুর্যোগময় সর্বনাশা ফলাফল ভোগ করতে হবে সমগ্র চলনবিলের বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্ম এবং প্রকৃতিকে। তেমনটি কারোই কাম্য নয়। সে কথা ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে পদক্ষেপ নেওয়াই শ্রেয়। কেননা, স্থান হিসেবে বুড়া পোতাজিয়া এখনও ধারণাগত, প্রস্তাবিত এবং পরিকল্পিত পর্যায়ে রয়েছে যা অদ্যাবধি কার্যকরীভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। এর বিকল্প এবং বিজ্ঞান সম্মত উপায় খোঁজার এখনো সময় এবং সুযোগ আছে। অবকাশ আছে গভীরভাবে ভেবে দেখার ও পরিণতি চিন্তা করার।
এখানে চলনবিল ইস্যুটি কিছুতেই অগাহ্য করা ঠিক হবে না। অস্থীর , অশান্ত আর তাড়াহুড়ো করে গৃহীত সিদ্ধান্ত আমাদের বিরাট অকল্যাণ বয়ে আনতে পারে।এ দেশের বহু কর্মকান্ড, প্রকল্প, প্রতিষ্ঠান,স্থাপনা অপরিকল্পিত এবং পরিবেশ বিরুদ্ধ পন্থায় করে ইতোমধ্যেই জাতির অপরিসীম ক্ষতি তথা অমঙ্গল করা হয়েছে এবং সে ধারাবাহিকতা আজো অব্যাহতভাবে চলছে।এ কারণেও দেশে আজ অসাম্য-বৈষম্য ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এবারে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও অপরিণামদর্শীর মতো কিছু করা হোক তা চলনবিল এলাকাবাসী চাইবে না। আশা করি বিচার, বিবেক, বুদ্ধি,যুক্তির সম্মিলনে ভৌগলিক ও পরিবেশগত দিক এক্ষেত্রে প্রাধান্য এবং অগ্রাধিকার পাবে। তানাহলে এ কাজটা হবে চলনবিলের জন্য সর্বশেষ বোমা বর্ষন , বিল পাড়ের মানুষের জন্য মরণ ফাঁদ। শিক্ষা বিস্তারের নামে পরিবেশ ধ্বংস করা হলে সেটা হবে ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নিন্দনীয় কাজ যেমনটি চলনবিলে এযাবৎ হয়ে এসেছে শত বাধা নিষেধ সত্বেও। চলনবিল বিসর্জনের বা এর অস্তিত্বের উপর আঘাত আসে এমন কিছুর বিনিময়ে তো আমরা অন্য কিছু চাইতে পারি না তা যতই দামী আর মূল্যবান হোক। আমরা রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত এখনও নড়চড় করতে বা সরাতে পারবো , কিন্তু চলনবিলকে তো সরাতে-নড়াতে পারবো না। সুন্দরবন বা হাওরের মতোই এটাও আমাদের এক অনবদ্য প্রাকৃতিক দান, স্থায়ী নৈসর্গিক সম্পদ, প্রকৃতির আশীর্বাদ। অপরদিকে রাষ্ট্র অনেক রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। কিন্তু একটি চলনবিল গড়ে তোলার বা সৃষ্টি করার সাধ্য কারো নেই। বিধায় সবশেষে এ সিদ্ধান্ত পূনর্বিবেচনার সবিনয় দাবি জানাই।
লেখক : সম্পাদক , সাপ্তাহিক চলনবিল বার্তা, তাড়াশ, সিরাজগঞ্জ।
চলনবিল বার্তা chalonbeelbarta.com