এম. সেরাজুল হক এর ৬১ তম মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণে বিশেষ ক্রোড়পত্র
“চলনবিলের চেরাগ” এর আলো ছড়িয়ে পড়–ক সবখানে
বিশেষ সম্পাদকীয় কলাম
এম. সেরাজুল হক ঃ তাঁর কর্মকীর্তি আমাদের পাথেয়
মাওলানা সেরাজুল হক কীর্তিমান বাঙ্গালীদের অন্যতম একজন। তাঁর জীবন ইতিহাস জানলে বোঝা যায়- তিনি সমুদ্রের মতো বিশাল ও আকাশের মতো বিস্তৃত এক জ্যোতিস্ক মানব। আমরা আজ একবিংশ শতকে জীবনযাপনকারী তাঁর অনেক পরের প্রজন্ম ,উত্তরসূরী। ফলে এই বিশাল সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে আমরা কতটুকুই বা তাঁকে দেখতে পারি। আর তাঁর মতো গগনচুম্বী বিশাল নক্ষত্রের এক সুদূর প্রান্তে অবস্থান করে আমাদের কল্পনাও ধারণায় কতটাই বা আন্দাজ অনুমান হতে পারে তাঁর ব্যাপারে। তাঁর সম্পর্কে বলতে ও লিখতে সে ধরনের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা কোনোটাই আমাদের নেই বললেই চলে। মরহুমের বিষয়ে আমাদের জ্ঞানের দৈন্যতা, দুর্বলতা, অপারগতা ও অপর্যাপ্ততা নিসংকোচে স্বীকার করে লজ্জিত হওয়া ছাড়া গত্যান্তর নেই।
১৯০৩ সালে সিরাজগঞ্জের তাড়াশের তৎকালীন প্রত্যন্ত মোরশেদগুনা অধুনা সেরাজপুর গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়ে ১৯৬৩ সালে ৬০ বছর বয়সে আজকের দিনে ১৫ নভেম্বর যখন তিনি মারা যান, আমি তথা তাড়াশের আজকের আমাদের প্রজন্মের সবাই তখন শিশু, শৈশবে পদচারণা করছি। উল্লেখ্য, আজ অশেষ শ্রদ্ধায় ও ভালবাসায় আমরা তাঁর ৬১ তম মৃত্যু দিবস স্মরণ করছি। ফলে এটা সহজবোধ্য,তার সন্দর্শন-সান্নিধ্য সৌভাগ্য আমাদের কপালে জোটেনি। তাকে প্রত্যক্ষ জানা ও চেনার সুযোগ ঘটেনি। সে শূন্যতা ও বঞ্চনা আমাদের জন্য এক অনুশোচনা ও বেদনার ব্যাপার তো বটেই।তাঁকে প্রত্যক্ষ দেখার অভাব আজো আমাদের হৃদয় নাড়া দেয়, উদ্বেলিত করে। মাদ্রাসা ও মাধ্যমিকের অল্প স্তরের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও তাঁর মতো ব্যতিক্রমী ও বর্ণাঢ্য জীবন কাহিনি যতবারই শুনেছি , ততবারই মুগ্ধ, আপ্লুত আর আকর্ষিত হয়েছি। এখন তাহলে আমাদের বর্তমান প্রজন্মের তাঁর সম্পর্কে জানার উপায় কী ? প্রথম ও প্রধান উপায় তো তাঁর রচিত এবং প্রকাশিত পুস্তকাদি পাঠ করা। তাঁকে নিয়ে যে অসংখ্য পত্র-পত্রিকা ও গ্রন্থ সমূহ লেখা হয়েছে বা তাঁর জীবন ও কর্ম তুলে ধরেছে, লেখকের নিজের বেশুমার লেখা ও প্রতিবেদন অগনিত সাহিত্য সাময়িকী ও সংবাদপত্রে মূদ্রিত হয়েছে, সেসব সংগ্রহ করে পড়াশোনা করা। অর্থাৎ এই মনীষীর জীবন কাহিনী সম্বলিত ইতিহাস ও এতদ্বসংক্রান্ত রেফারেন্স বই, প্রকাশনাসমূহ এবং প্রামাণ্য দলিলপত্রাদি ঘেঁটে দেখা, পর্যবেক্ষণ ,পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা।
তারপর মরহুমের সমসাময়িক, সমকালীন যে অল্প সংখ্যক প্রবীণ ব্যক্তি আজো তাড়াশ বা চলনবিলে জীবিত বা বেঁচে আছেন তাদের কাছ থেকে শোনা ও অবগত হওয়া, সাক্ষাৎকার নেয়া। অন্যথায় নিদেনপক্ষে অধ্যাপক এম.এ হামিদ লিখিত ওই মহান ব্যক্তির জনপ্রিয় জীবনী গ্রন্থ “কর্মবীর সেরাজুল হক” অনুসন্ধান করে পড়ে ফেলা। অবশেষে তাঁকে ঘিরে পাঠচক্র করা। প্রসঙ্গক্রমে স্মর্তব্য, সেরাজুল হক ছিলেন এম.এ হামিদেরও গুরু বা ওস্তাদ। এই হল তাড়াশ, চলনবিল, পাকিস্তান, অবিভক্ত বাংলা, পাক ভারত ও সবশেষে ভারতবর্ষের অন্যতম বহুমাত্রিক বিপ্লবী সংগ্রামী, অনলবর্ষী বাগ্মী, রাজনীতিক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কবি, সমাজসেবী, ধর্মীয় সংস্কারক এবং ব্রিটিশ বিরোধী এক অগ্নিপুরুষ মহামানব এম. সেরাজুল হক এঁর জীবন, কর্ম সাধনা ও ত্যাগ-উৎসর্গ জানার কিছু মাধ্যম মাত্র। একমাত্র গবেষণা, নিরীক্ষা ও পঠন-পাঠন ছাড়া আজ আর এই ক্ষণজন্মা গুণীজনকে সম্যক উপলব্ধি করা, চেনা-জানা এবং ধারণা লাভের বিকল্প কোন পথ বা পন্থা নেই।
আমরা জেনেছি, জীবদ্দশায় তিনি প্রায় ডজনখানেক বিচিত্র ধরনের বই লিখে ও ছাপিয়ে রেখে গেছেন। অনেক পত্রপত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছেন। অগণিত সাহিত্য সাময়িকী ও সেকালের গণমাধ্যমে লেখালেখি ও সাংবাদিকতা করেছেন। কবি নজরুল সম্পাদিত সেকালের সুখ্যাত পত্রিকা ‘লাঙল’ এরও সম্পাদনায় তিনি সরাসরি যুক্ত ছিলেন।তাঁর “শিরাজী চরিত” বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন কবি বন্দে আলী মিঞা। কিন্তু দুঃখের বিষয়,এগুলোর কোন কিছুই আজ আর খুঁজে পাওয়া মনে হয় সম্ভব নয়। অথবা সুদীর্ঘ গভীর অনুসন্ধান করলে হয়তো দু’একটির দেখা-সাক্ষাৎ কিংবা অস্তিত্ব মিলতে পারে। সবচেয়ে আরেকটা অনুশোচনার বিষয় হল, তাঁর বেশ কিছু সংরক্ষিত পান্ডুলিপি তাঁর ইন্তেকালের পরে অযতেœ-অবহেলায় চিরতরে নষ্ট হয়ে কিংবা হারিয়ে গেছে। এগুলো আমাদের জন্য ছিল সোনার খনি, অমূল্য রতœ ভান্ডার। আমরা সেসবের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ, যতœ ও মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি।
মরহুমের পরিবার এবং বংশাবলী আগেও যেমন ছিল আজো তেমনি তাদের এই ইতিহাস প্রসিদ্ধ প্রয়াত মানুষটির প্রতি চরম উদাসীন ও নির্লিপ্ত রয়েছে যা সত্যই পরিতাপের বিষয়। বুঝলাম না, তাদের এই নিরব, নিস্ক্রিয় এবং নির্বিকার থাকার অর্থ বা মানে কী? এটা অজ্ঞানতা, কার্পণ্য না কুপমন্ডুকতা! এতে প্রতীয়মান হয়, গুণীরা শুধু সমাজেই নয়, নিজ পরিবারেও ‘কদর’ পাওয়া অথবা প্রয়োজনীয় ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন। অনুরুপ আজকেও বহু কবি-সাহিত্যিক আপন পরিবারেই উপেক্ষিত, অবহেলিত, অসমাদৃত হয়ে চলেছেন তা প্রায়শ:ই নির্মমভাবে পরিলক্ষিত হয়। অথচ আজ শুনলে অবাক লাগবে যে, উক্ত লেখকের রচিত বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত অমর গ্রন্থ “শিরাজী চরিত” বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ ক্লাসে এক সময় পাঠ্যবই হিসেবে পড়ানো হতো। আর তাঁর ওই মূল্যবান গ্রন্থখানি গবেষণা করে উল্লাপাড়ার অধ্যাপক গোলাম সাকলায়েন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট (পিএইচডি) ডিগ্রী লাভ করেন বলে জানা যায়। এখনকার তরুণ প্রজন্ম আরো বিস্মিত হবে শুনে যে, আমাদের এই ঐতিহাসিক মহাপ্রাণ মানুষটি মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, শেরে বাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, কবি নজরুল ইসলাম, ইসমাইল হোসেন শিরাজী, আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ, কবি আব্বাস উদ্দিন, কবি বন্দে আলী মিঞা প্রমুখ উনিশ শতকের ভারতবর্ষের তদানীন্তন জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিবিদ, লেখক, সমাজচিন্তক,কবি,সাহিত্যিক, বিপ্লবী-বিদ্রোহীদের সাথে সমগ্র ভারতবর্ষ বিচরণ করে যুগপৎ ব্রিটিশ বিরোধী রাজনীতি বেগবান করতে ভূমিকা রেখেছেন এমনকি কলম যুদ্ধ চালিয়েছেন। সোচ্চার ও উচ্চকণ্ঠ ছিলেন পরাধীনতার বিরুদ্ধে। একই কারণে ব্রিটিশ স্বৈরশাসকের রোষানলে পড়ে পূন: পূন: জেল-জুলুম খেটেছেন, অপরিসীম নিগ্রহ-নিপীড়ণের শিকার হয়েছেন। অবর্ণনীয় যাতনা-বঞ্চনা সহ্য করেছেন।
রাজনীতির পাশাপাশি সাহিত্য-সংস্কৃতি র্চ্চা এবং সমাজসেবা ছিল তাঁর নেশা ও বিশেষ ব্রত।রাজনীতিতে তাঁর মতো সততা ও স্বচ্ছতার ভাবমূর্তি আজ বুঝি কল্পনা করাও কঠিন। তাই চলনবিলের না হলেও অন্তত: তাড়াশবাসীর আবশ্যিক কর্তব্য ছিল, এই ইতিহাসখ্যাত মানুষটিকে ঘিরে তাড়াশে তাঁর নামে কিছু স্মৃতি চিহ্ন প্রতিষ্ঠা করে ন্যূনতম ধরে রাখা কিংবা প্রয়াস-প্রচেষ্টা চালানো। তাঁকে অনুকরণ ও অনুসরণ করে তাঁর জ্ঞান-প্রজ্ঞা, নীতি, আদর্শ, সততা ও সৃষ্টিশীলতাকে প্রাধান্য দেওয়া, পরিচর্যা করা এবং তরুণ প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দেয়া যেন তারা এই মহান নেতার জীবনী জেনে তার সারনির্যাস গ্রহণ করে উপকৃত হতে বা কল্যাণ লাভ পারে। এম. সেরাজুল হক নিজেই এক অসাধারণ এবং অসামান্য ইতিহাস। সেই সোনালী ইতিহাসকে যদি চলনবিল তথা তাড়াশের মানুষ লালন, ধারণ ও প্রতিপালন করে সমুন্নত ও সমুজ্জল পথের দিশা তথা পাথেয় করে রাখতে না পারে- তবে তা হবে এই পশ্চাৎপদ উপেক্ষিত জনপদবাসীর জন্য বড়ই দুর্ভাগ্যজনক। কারণ আমরা আর একটি আলোকিত সেরাজুল হক কখনোই পাবো না, মানবতার কল্যাণে যার সাড়াটি জীবন ছিল উৎসর্গিত। তিনি আমাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, আমাদের আলোর পথের দিশারী। তথাপি তার কর্মাদর্শের ও জীবনদর্শনের চর্চা অনুশীলনের মধ্য দিয়ে আমরা তাঁকে ভাবাদর্শের জগতে জীবন্ত করে রেখে বাস্তব সমাজ ও জাতির সেবা এবং কল্যাণের পথে তাঁর অনন্য মেধা ও প্রতিভার অমৃত সুধা ছড়িয়ে দিতে পারি।
এটা অবশ্যই মানতে হবে, তিনি তাড়াশের আদর্শিক জনক, সর্বজন বরেণ্য, স্মরণীয় পরম প্রিয়জন। আমাদের আলোকবর্তিকা,বাতিঘর। আজকে আমরা যারা সাহিত্য, সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা, ধর্ম, সমাজকর্ম, রাজনীতি ও বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা করে থাকি তাদের সবারই পূর্বসূরী আইকন বা আইডল সেরাজুল হক তা অস্বীকার করার যুক্তি, উপায় কেনোটাই নাই। আমরা যে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলি তা মরহুমের জীবনাচারে সুস্পষ্ট প্রতিফলিত হয়েছে।স্বাধীনতা,দেশপ্রেম, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য তিনি আজীবন লড়াই করে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর তৎকালে রাষ্ট্র-সমাজের উর্বর-উঁচু শ্রেণীর বহু লোক তাৎক্ষণিক বাণী পাঠিয়ে তাঁকে মহিমান্বিত ও প্রশংসায় ভূষিত করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো তাড়াশের পাদ প্রদীপে তার প্রভা, কিরণ ও উজ্জ্বলতা নিষ্প্রভ কেন? এ তো সেই “মানুষও রতন, করো তারে যতন” গানের মর্মার্থ আমাদের জন্য প্রযোজ্য ছিল। অথবা “এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন”। প্রকৃতই মানব প্রেমিক হক সাহেবের জীবন ও কর্ম আমাদের আজো কাঁদায় এবং একই সাথে অফুরন্ত অনুপ্রেরণা যোগায়।
মওলানা এম সেরাজুল হককে স্মরণ এবং তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণ
শামসুল আলম সেলিম
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে (১৯০৩) অনগ্রসর তাড়াশের অজপাড়াগাঁও মোরশেদগুনায় এ উপমহাদেশের ক্ষণজন্মা পুরুষ ‘কর্মবীর’ মওলানা এম সেরাজুল হকের জন্ম । সময় ও পারিপার্শিক প্রতিকুল পরিবেশেও তিনি তাঁর দৃঢ় মনোবল, অসাধারণ প্রতিভা ও দেশপ্রেম নিয়ে বিদেশী শাসকের অত্যাচার, জেলজুলুম, স্থানীয় জমিদারগণের প্রতিবন্ধকতা ও বৈরীতা, অশিক্ষিত ও উদাসীন জনগনের অসহযোগীতা সত্বেও দেশবাসীর পরাধীনতা ও শোষণের শৃংখল এবং অশিক্ষা-কুশিক্ষা, কুসংস্কার, কুপমন্ডুকতা, বৈষম্য ও জুলুম, বন্যা, জলাবদ্ধতা, দারিদ্র থেকে অবিরাম মুক্তির সংগ্রাম করেছেন। মওলানা এম সেরাজুল হক বৃটিশবিরোধী স্বাধীকার অন্দোলন, অবিভক্ত বাংলার কৃষক প্রজার দূর্দশা লাঘব, দুর্গম ও অবহেলিত, শোষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বন্যাকবলিত চলনবিল অঞ্চলের শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষি, খাল খনন তথা জীবনমান উন্নয়নে অসামান্য ও অভূতপূর্ব অবদান রেখে গিয়েছেন। এ্যাডভোকেট মুহম্মদ ফজলুর রহমান খাঁ লিখেছেন,“ তিনিই আমাদের নবদিগন্তে উদয়ের পথে যাত্রা করিয়েছেন। তাঁহার কর্মপ্রতিভার আলোচনা ও সমাদর না করিলে তাঁহার জীবনব্যাপী সাধনা ও ত্যাগের মহিমা দেশবাসী অবগত হইতে পারিবে না বা তাহারা ত্যাগীর ত্যাগের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশে অক্ষম প্রমাণিত হইবে।” এদেশের জন্য মওলানা এম সেরাজুল হকের অসামান্য অবদান কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ, তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণ, আদর্শ অনুসরণ এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নে সকলকে সচেতন ও যতœবান হওয়া প্রয়োজন।
মওলানা সেরাজুল হকের বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্ম সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনা করা অসম্ভব। তিনি ছিলেন একাধারে অদর্শবাদী কবি, পর্বতপ্রমাণ দেশপ্রেম ও দৃঢ়চিত্তের সংগ্রামী রাজনীতিবিদ, আদর্শ সমাজসেবক, বিদ্যোৎসাহী, মানবতার অগ্রদূত, নির্ভীক সাংবাদিক ও লেখক, বাগ্মী, প্রভৃতি বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী এবং দেশ ও জাতির জন্য বহুমাত্রিক অবদানে সফল একজন মহান নেতা। মওলানা সেরাজুল হকের জীবনীকার অধ্যাপক এম এ হামিদ তাঁকে ‘কর্মবীর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। মওলানা সেরাজুল হকের জীবন ও কমের্র বিভিন্ন দিক নিয়ে অনেকেই লিখেছেন। আমি তার রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে নব্বই এর দশকে লিখেছিলাম। আজকে সময়ের প্রয়োজনে তাকে স্মরণ, তাঁর অমর স্মৃতি সংরক্ষণ, বর্তমান প্রজন্মের জন্য কিছু তথ্য উপস্থাপন এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই।
মওলানা এম সেরাজুল হক মৃত্যুর (১৫ নভেম্বর ১৯৬৩) দুই বছরের মধ্যেই ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছিলেন। কেননা একসময়ের বাংলা ও আসাম কাঁপিয়ে বেড়ানো এই আদর্শবান সৎ লেখক ও রাজনীতিবিদকে জীবন সায়াহ্নে চরম অর্থকষ্টের মধ্যে অতিবাহিত করতে হয়। তাঁর রচিত অধিকাংশ বই-পুস্তক ম্যাগাজিন, পেপারকাটিং, প্রশাসনসহ ভারতবর্ষের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে যোগাযোগের প্রায় একশত চিঠিপত্র গ্রামের বাড়ীতে তিনচারটি আলমারীতে উইপোকার খোরাক হতে যাচ্ছিল। সেই সময় আর এক জহুরী, গবেষক, লেখক ও সমাজকর্মী অধ্যাপক এম এ হামিদ বিলচলনী সেগুলোর কিছু সংগ্রহ করে প্রায় এক বছরের গবেষণায় ১৯৬৬ সালে ’কর্মবীর সেরাজুল হক’ নামে ২৪০ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ রচনা করেন যা মওলানা সেরাজুল হকের উপর এখন একমাত্র মৌলিক গ্রন্থ। মওলানা এম সেরাজুল হকের অমর স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য ১৯৬৫ সালে অধ্যাপক এম এ হামিদ এবং মৌলভী তোফায়েল উদ্দিন সিদ্দিকীর উদ্যোগে ‘সেরাজুল হক সাহিত্য পরিষদ’ গঠন এবং ‘চলনবিল পল্লী উন্নয়ন সমিতির’ লাইব্রেরিকে ‘সেরাজুল হক স্মৃতি গ্রন্থাগার” নামকরণ করা হয়। সেরাজুল হক সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক মরহুম এম সেরাজুল হকের অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং প্রথমে তাঁর অপ্রকাশিত ‘আউলিয়া কাহিনী’ নামের একটি পান্ডুলিপি ‘অমর জীবন কাহিনী ’ নামে ১৯৬৬ সালে প্রকাশ করা হয়। এই পান্ডুলিপির কিছু অংশ কবি ইজাব উদ্দিন আহমদ তদানিন্তন রেডিও পাকিস্তান থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রচার করেন। পরবর্তীতে সেরাজুল হক সাহিত্য পরিষদ ও তাড়াশ প্রেসক্লাবের উদ্যোগে তাঁর ২৩ তম মৃত্যু বার্ষিকীতে (১৯৮৬) ‘চলনবিলের চেরাগ’ নামে একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হয়। চলনবিল পল্লী উন্নয়ন সমিতি ও সেরাজুল হক সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ১৫ নভেম্বর কর্মবীর সেরাজুল হক এর মৃত্যূবার্ষিকীতে কবর জিয়ারত, আলোচনাসভা ও দোওয়ার আয়োজন করা হতো। সেখানে অধ্যাপক এম এ হামিদ আমন্ত্রিত সে সময়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন । প্রতি বছর অনুষ্ঠিত সভায় চলনবিল এলাকার বহু মানুষের সমাগম হতো। স্বাধীনতার পর ১৯৮৬ সালে তার ২৩তম, ১৯৯৫ সালে ৩২তম, ২০০০ সালে ৩৭তম, ২০০১ সালে ৩৮তম, ২০০২ সালে ৩৯তম এবং ২০০৩ সালে ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাড়াশে আলোচনা সভায় আয়োজন করা হয়। এগুলোর শেষেরটি ব্যতীত সব কয়টিতে অধ্যাপক আব্দুল হামিদ সশরীরে উপস্থিত ছিলেন । সর্বশেষ তিনটি সভায় সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক এবং সমসাময়িক দুইজন জাতীয় সংসদ সদস্য প্রধান অতিথি ছিলেন। এসব অনুষ্ঠান আয়োজনে অধ্যাপক এম এ হামিদ বড় উদ্যোগী ও উৎসাহদাতা ছিলেন। তিনিই অনেকের সাথে যোগাযোগ করে আয়োজন করিয়েছেন এবং নিজে উপস্থিত থেকে আগ্রহীদের নিয়ে কমিটি বানিয়ে দিয়েছেন। পরবর্তীতে অধ্যাপক এম এ হামিদ এর অসুস্থতা ও মৃত্যুর পর ১৬ বছর ব্যবধানে ২০১৯ সালে ৫৬ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাড়াশে সোরজুল হক স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। এখনও সাপ্তাহিক চলনবিল বার্তায় ১৫ নভেম্ভরের সপ্তাহে বা অন্য কোথাও কদাচিৎ সেরাজুল হকের মৃত্যুবর্ষিকীকে উপলক্ষ্য করে বিচ্ছিন্নভাবে দু’একটি প্রবন্ধ-নিবন্ধ বা স্মৃতিচারণ প্রকাশিত হয়।
মহৎপ্রাণ ও কর্মবীর মওলানা সেরাজুল হকের জীবন, কর্ম ও আদর্শ বিশেষ করে বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে সেভাবে তুলে ধরা হয়নি। ‘কর্মবীর সেরাজুল হক’ গ্রন্থটি আর পূণ:মূদ্রিত হয়নি বরং ৫৮ বছর পর তার আর মাত্র পাঁচটি কপি কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। চলনবিলের কোথাও কোন রাস্তা-ঘাট, প্রতিষ্ঠান, ভবন সেরাজুল হকের নামে নেই। যতদুর মনে পরে তাড়াশ উপজেলা পরিষদের একটি আবাসিক ভবনের নাম ‘সেরাজুল হক ভবন’ রাখা হয়েছিল, এখনও সেটি অপরিবর্তিত আছে কিনা জানা নাই।দেশবাসীর জন্য মওলানা এম সেরাজুল হকের অসামান্য অবদান অস্বীকার বা উপেক্ষা করাব অবকাশ নেই। সুজলা সুফলা এ সোনার বাংলা খল্জী-মুঘল, ডাচ্-ইংরেজ, মগ-বর্গীদের দ্বারা বারবার লুন্ঠিত-শোষিত-নির্যাতিত হয়েছে। তুর্কী-মুঘলরা লুট করে ভারতবর্ষেই রেখেছে, কিন্ত বিজাতীয় বেণিয়ারা দুইশত বছর শুধু লুন্ঠন করে ইউরোপে পার করেছে, এ উপমহদেশে চাপিয়ে দিয়েছে সা¤্রাজ্যবাদী শাসন-শোষন। ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের বাজার হিসেবে এদেশের কৃষকদের নীলচাষ ও ব্যবসায়ী ও ক্রেতাসাধারণকে বিদেশী পণ্য, কাপড় কিনতে নির্যাতন করে বাধ্য করেছে, ধ্বংস করেছে বিশ^বিখ্যাত ঢাকার মসলিনসহ দেশীয় তাঁত শিল্প।বৃটিশবিরোধী স্বাধীকার আন্দোলনের স্বীকৃতি দিয়ে আজকাল অনেকের মুর্তি-মূরাল প্রতিষ্ঠা এবং জোর প্রচারণা চললেও পূর্ববঙ্গের আলেম সমাজের অবদান বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছে। বালাকোট প্রান্তরে আল্লামা সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী, মওলানা আব্দুল হাই, শাহ্ মোহাম্মদ ইসমাইল প্রমূখের এবং মওলানা এহিয়া আলী খানের ফাঁসিকাষ্ঠে আত্মবলিদানের ইতিহাস প্রায় বিস্মৃত। যেসব দেশপ্রেমিক মুসলমানদের আন্দামান, নিকোবর বা মাল্টায় দ্বীপচালান বা নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল বর্তমান ইতিহাসে তাদের নাম বর্তমান প্রজন্ম শোনেনি। পূর্ববঙ্গ, আসাম এবং ভারতের দেওবন্দ ও আলীগড় বিশ^দ্যিালয়কেন্দ্রীক আলেম সমাজের আন্দেলন বৃটিশ ঔপনিবেশিক শোষনের ভিত্ কাঁপিয়ে দিয়েছিল। তন্মোধ্যে ছিলেন এতদঞ্চলের কারা নির্যাতিত দুই সুর্যসন্তান মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ এবং মওলানা এম সেরাজুল হক।
মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের জন্ম ১৯০০ সালের ২৭ নভেম্বর উল্লাপাড়া থানার তারুটিয়ায়। তিনিও অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন সহ বৃটিশবিরোধী এবং পাকিস্তানের সময় ভাষা আন্দোলন সহ সকল বৈষম্যবিরোধী সংগ্রামের অবিসংবাদিত অগ্রনায়ক ছিলেন। বৃটিশ সকারের নির্যাতন-শোষণ বিরোধী ১৯২২ সালের ঐতিহাসিক সলঙ্গা বিদ্রোহের পর তিনি প্রায় এক বছর কারাভোগ করেন। মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ দুইবার দুই ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করেন । তর্কবাগীশ সাহেব ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদের (পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ) নির্বাচনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুসলিম লীগের প্রার্থী হয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ কংগ্রেস ও কৃষকপ্রজা পার্টির প্রাথীদ্বয়কে এবং ১৯৭০ এর নির্বাচনে পাবনা-২ ( তাড়াশ, উল্লাপাড়া ও রায়গঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে মুসলিম লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করে জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন। ‘পাকিস্তান প্রস্তাবের’ পক্ষে ১৯৪৬ এর নির্বাচনে শুধু ‘আজাদী (স্বাধীনতা)’ লাভ এবং মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকে জয়যুক্ত করার জন্য মওলানা এম সেরাজুল হক নিখিল ভারত মুসলিম লীগে যোগদান এবং নির্বাচনে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেন।
মওলানা এম সেরাজুল হক সেই বৃটিশবিরোধী স্বাধীকার আন্দোলনের একজন কারা নির্যাতীত সংগ্রামী। তিনি তাঁর ক্ষুরধার লেখনী, অনলবর্ষী বাগ্মিতা ও সন্মুখ-সংগ্রামে, ইংরজ খেদাও-স্বরাজ প্রতিষ্ঠা, অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলন, বিলাতী ও বিদেশী দ্রব্য বর্জন- স্বদেষী পণ্য ব্যবহার, মুসলিম জাহানের খেলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও চড়কা আন্দোলনসহ সকল সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ, নেতৃত্বদান এবং উপমহাদেশের বিভিন্নস্থানে বহুসভা ও গণজমায়েতে উদ্বুদ্ধকারক বক্তৃতা করেন। তিনি প্রথম বিশ^যুদ্ধের পর ১৯২১ সালে খেলাফত কমিটি এবং সর্বভারতীয় অপ্রতিদ্বন্দী দল কংগ্রেসের সদস্যপদ গ্রহণ করেন।মওলানা সেরাজুল হক বিশে^ মুসলিম খেলাফত পুনপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন করলেও আদর্শগতভাবে ছিলেন সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক। তিনি ১৯২৩-২৬ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা নিরসনে ১৯২৬ সালের ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুকে পাবনায় আমন্ত্রণ করে এনে দুই দিনব্যাপী সন্মেলন করেন। ১৯২৮ সলে আসামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তিনি আসাম যান এবং বিভিন্ন সভা সমিতিতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে শান্তি ও মিলনের বাণী প্রচার করেন। পূর্ণ স্বাধীনতার প্রশ্নে মওলানা সেরাজুল হক আপসহীন ছিলেন। তিনি বামপন্থী বিপ্লবী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হন। নেতাজীর সতীর্থ হতে তিনি লাহিড়ী মোহনপুরে পিস্তল সংগ্রহে গিয়ে সিআইডির নজরে পড়েন। পরে কোন নীতির প্রশ্নে কোন আপস না করায় তাঁকে তিন মাসের সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়।
মওলানা সেরাজুল হক প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের পরিবর্তে পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ^াসী ছিলেন। সে কারণে ১৯২৭ সালের সাইমন কমিশনের রিপোর্ট এবং ‘নেহেরু রিপোর্ট’ এর ঔপনিবেশিক স্বায়ত্বশাসনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং পন্ডিত নেহেরু, মিঃ আয়েঙ্গার, সুভাষ চন্দ্র, আলী ভাতৃদ্বয় ও সিরাজীর পূর্ণ স্বাধীনতা ও মিশ্র নির্বাচনের পক্ষে মতামত প্রদান করেন। এই ইস্যুতে তিনি তাঁর সুচিন্তিত মতামতসহ ‘স্বরাজ’ পত্রিকায় “ঔপনিবেশিক স্বায়ত্বশাসন ও পূর্ণ স্বাধীনতা” শীর্ষক প্রবন্ধ লেখেন।মওলানা সেরাজুল হক সে ময়ে অবিভক্ত বাংলার প্রধান প্রধান পত্রিকায় নিয়মিত সংবাদ, প্রবন্ধ-নিবন্ধ সমালোচনা, মন্তব্য প্রতিবেদন এবং স্থানিয় ও আঞ্চলিক সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও অভাব-অভিযোগের বিষয়ে লিখতেন। তাঁর লেখা অনেক সময় দেশব্যাপী আলোচনা সমালোচনার ঝড় তুলত। তাঁর ১০টি প্রকাশিত বইয়ের অধিকাংশ পাঠকনন্দিত ছিল। তন্মধ্যে গাজীয়ে বল্কান সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর জীবনী গ্রন্থ ‘সিরাজী চরিত’ গবেষণার জন্য রেফারেন্স বই হিসিবে ব্যবহৃত হয়। বইটি আচার্যদেব প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে উৎসর্গীত। বইটি রচনার কারণে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া সাহিত্যসভা ১৯ এপ্রিল ১৯৩৯ সালে মওলানা সেরাজুর হককে ‘বিদ্যার্ণব’ উপাধী প্রদান করে। তাঁর বচনের ন্যায় লিখনও ছিল প্রাণস্পর্শী। তাঁর সহজ ভাষার গদ্য রচনাগুলোতেই একধরনের আকর্ষণ ছিল যা পড়তে শুরু করলে আর বিরতি টানা যায় না। কবিতা ও গানে ছিল ছন্দ, ভাব, ভক্তি ও কাব্যিকতা।
মওলানা সেরাজুর হক বিশিষ্ট ইসলাম প্রচারক ছিলেন। আসামের তুরা পাহাড়ের কাছে গারোজন নামক স্থানে পাহাড়ীদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে একটি ‘ইসলম মিশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া তিনি, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী এবং মওলানা রুহুল আমিন একই সাথে আসামের তামারহাট ধর্মসভায় যোগদান এবং বক্তৃতা করেন। তাঁর লিখিত ‘শেরেক ধ্বংস-ঈমান রক্ষা, মূলত: মুসলমানদের মধ্যে কুসংস্কার, কুপমুন্ডকতা ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে একটি মূল্যবান দিকনির্দেশনামূলক বই। ব্যক্তি জীবনে তিনি এসবের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে বিভিন্ন সভাসমিতি ও মিলাদ-মাহফিলে নসিহত করতেন।কৃষক-প্রজা, রায়ত-খাতক আন্দোলনে নেতৃত্বদানের জন্য মওলানা সেরাজুল হক স্মরণিয় হয়ে থাকবেন।বৃটিশ বেণিয়া শাসনের শেষ দিকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তপ্রাপ্ত জমিদারদের অত্যাচারে কৃষক- প্রজাকুল যখন জর্জরিত সেই মুহর্তে মওলানা সেরাজুল হক তাদের জাগরনের জন্য পূর্ব-পশ্চিম বাংলার এপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পরিভ্রমণ করে সংগঠিত করেন। ‘হিতবাদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত মেদিনীপুরের ওয়াটসন জমিদারী কোম্পানীর বিরুদ্ধে ৯০ জন কৃষকের ৬৭ দফা অত্যাচারের কাহিনী, পশ্চিম বঙ্গের কৃষক-রায়ত সন্মেলনে উত্থাপিত হুগলী জেলার হরিপালের জমিদারে অত্যাচারের অভিযোগ সরেজমিনে তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন মওলানা সেরাজুল হক। যার রিপোর্ট বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য ও ব্যারিষ্টার দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের নিকট প্রদান এবং ‘প্রজার কথা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। হক সাহেবের প্রচেষ্টা এবং সভাপতিত্বে ১৯৩২ সালের ৩ মার্চ তাড়াশে সিরাজগঞ্জ মহকুমা ‘প্রজা সন্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয় যেখানে কোলকাতা থেকে প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ আসাদ উ্েদ্দৗলা সিরাজী, শাহ্ আব্দুর হামিদসহ বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ অংশগ্রহণ করেন।
পাবনা জেলা প্রজা সমিতির সম্পাদক হিসেবে মওলানা সেরাজুল হক চলনবিল অঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলেন। তাদের সমন্বয়ে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীকে প্রধান অতিথি করে নিয়ে ১৩৩২ খ্রিস্টাব্দে তাড়াশে ছাত্র কনফারেন্স করেন। সেদিন স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে তিনি তাড়াশ বাজারে পিকেটিং করে গাঁজার দোকান ও বিলাতী কাপড় বিক্রয় বন্ধ করেন। ১৩৩৯ সলের ৬ ও ৭ ফাল্গুন রাজশাহী জেলার চাঁচকৈড়ে‘নিখিল বঙ্গ রায়তখাতক কনফারেন্স” অনুষ্ঠিত হয়। অভ্যার্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ এবং হক সাহেব ছিলেন অর্গানাইজার ও জয়েন্ট সেক্রেটারি। কনফারেন্সে অতিথি ছিলেন তদানিন্তন শিক্ষামন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন,আইনপষিদ সদস্য ব্যারিষ্টার হোেেসন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সহ বাংলার রায়তখাতক সমিতির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। সভায় লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়। ১৩৪০ সালে তিনি ঢাকা জেলার ভাওয়াল অঞ্চলে একমাসব্যাপী অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ প্রজা কনফারেন্সে যোগদার করেন এবং সভার বিবরণ এবং কৃষকপ্রজার অত্যাচারিত হওয়ার করুণ কাহিনী বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করেন। মওলানা এম সেরাজুল হক, মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী , শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সহ জনদরদী নেতৃবৃন্দের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল হিসেবে জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ, ঔতিহাসিক প্রজাসত্ব আইন পাশ এবং ঋণসালিশি বোর্ড গঠিত হয়।সে যুগে চলনবিল অঞ্চল ছিল একটি বন্যাকবলিত এলাকা। তার মধ্য দিয়ে ১৯১৪ সালে সাঁড়া-সিরাজগঞ্জ রেললাইন স্থাপনের ফলে বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা তৈরী হতো। এখানে প্রায় প্রতিবছরই অতিবর্ষণ, বন্যা, অতিমারী , দূৃির্ভক্ষ লেগে থাকত।সেরাজুল হক উক্ত রেল লাইনে কয়েকটি ব্রীজ নির্মাণের জন্য পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন। যার প্রেক্ষিতে ১৯৩৯ সালে বারুহাসে তদানিন্তন পুর্ব পাকিস্তানের মšী¿ শামসুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কনফারেন্সে জলাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা হয়। এছাড়া পাকিস্তান লাভের পর ১৯৫০ সালে মওলানা সেরাজুল হকের লিখিত আবেদন ও আমন্ত্রণে তদানিন্ত পূর্ব পাস্তিানের পূর্ত সচিব হাসান আলী চলনবিল পরিদর্শন করেন। এরপর হক সাহেবের প্রায় এক যুগের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় পূর্ত বিভাগের সাব এসিসস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার ইউনুস উদ্দিন সরকারের তত্বাবধানে নয় লক্ষ টাকা ব্যয়ে নিমাইচরা-বেশানী খাল কাটা হয় যা আশীর দশকে নূরপুর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। চলনবিলের জল নিষ্কাশনের জন্য খননকৃত এই খালটি এখন ‘সাইড খাল’ নামে পরিচিত ।
মওলানা সেরাজুল হক ছিলেন একজন আদর্শ সমাজকর্মী। জীবনের শেষ দিনগুলোতে তিনি নিজ এলাকার উন্নয়নে ব্রতী হন। তিনি স্থানিয় সরকারের কেন্দ্র তদানিন্তন ইউনয়িন কাউন্সিলের কেরাণ (সগুনা ইউনিয়নে-কিন্ত প্রেসিডেন্ট মণিন্দ্রনাথ তালুকদারের সাথে মতানৈক্যের কারণে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন), দীর্ঘসময় ইউসি সদস্য, ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রেসিডেন্ট ছিলেন। হক সাহেব ইউনিয়ন কাউন্সিল প্রেসিডেন্ট সমিতির সিরাগঞ্জ মহকুমা সমিতির সভাপতি ছিলেন। মাধাইনগর ইউনিয়ন কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে তিনি তাড়াশ থেকে আরঙ্গাইল পর্যন্ত সাড়ে তিন মাইল দৈর্ঘ একটি খাল খনন এবং খালের ধার দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করেন। ওয়াশিন গ্রামে ইউসি অফিস প্রতিষ্ঠা করার পর অবকাঠামো নির্মাণ ও সমবায় সমিতি, নৈশ্যবিদ্যালয়, কুটির শিল্পসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে ওয়াশিনকে একটি আদর্শ গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলেন। তিনি বেহুলার কিংবদন্তী নিচানী নগরে সপ্তাহে দুই দিন বিনসাড়া হাট প্রতিষ্ঠা ও চালু রাখতে সহায়তা করেন। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারনের উদ্দেশ্যে ‘তাড়াশ ব্যাংকিং এন্ড ট্রেডিং কোম্পানী’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন।চলনবিল অঞ্চলে ১৩৩৮, ১৩৪৩ ও ১৩৬৯ বঙ্গাব্দে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় তিনি তদানিন্তন সরকারের মন্ত্রীবর্গ এবং সমাজসেবামুলক প্রতিষ্ঠানের কাছে লেখালেখি ও যোগাযোগ করে খাদ্য ও ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ এবং বুভুক্ষ মানুষের মধ্যে বিতরণ করেন। তাঁর এই মহৎকর্ম প্রসঙ্গে অধ্যাপক এম এ হামিদ লিখেছেন, ‘তাঁহার নিস্বার্থ সেবার কথা চলনবিল অঞ্চলের লোকেরা কোনদিনও ভুলিতে পারিবে না।’মওলানা সেরাজুল হক ১৯৪৮ সালে পাবনা জেলা বোর্ড নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন। ঈশ^রদী কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ফজলুল হক (নাইমুরি, উল্লাপাড়া) উল্লেখ করেন যে, সে সময়ের তরুণ ছাত্রসমাজ মওলানা সেরাজুল হককে জয়যুক্ত করার জন্য জোর প্রচারণা চালান। তাদের শ্লোগান ছিল ‘যদি দেশের কল্যাণ চাও- হক সাহেবকে ভোট দাও, মওলানা সেরাজুল হক Ñজিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ ..’ ইত্যাদি। হক সাহেব ১৮২৪ ভোট পাওয়া সত্বেও রায়গঞ্জের সোনাখারা গ্রামের আব্দুল গফুর তালুকদারের নিকট মাত্র ১২২ ভোটে পরাজিত হন। তাঁর নিজ থানার উলিপুরের মৌ: জহির উদ্দিন সরকার (প্রাপ্ত ভোট ২৮০) এবং চির প্রতিদ্বন্দ্বী দোবিলার ইব্রাহিম হোসেন তালুকদার (প্রাপ্ত ভোট ২৯৮) প্রার্থীতা করায় মূলত: তাঁর সেই দুঃখজনক পরাজয় ঘটে।
মওলানা সেরাজুল হক তদানিন্তন সিরাজগঞ্জের জনপ্রিয় মহকুমা প্রশাসক এইচ. এস. এম. ইসহাক সিএসপি সাহেবের ঘনীষ্ঠজন ছিলেন। এসডিও সাহেবের সহায়তা ও সেরাজুল হকের যৌথ প্রয়াসে তাড়াশ থানায় অনেক উন্নয়নমূরক কাজ হয়েছে। উক্ত মহকুমা প্রশাসক ১৯৩৫ সালে বস্তুল গ্রামে মওলানা সেরাজুল হকের সভাপতিত্বে তাড়াশ থানার আটজন প্রেসিডেন্টকে নিয়ে একটি মিড্ল ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠাকল্পে মিটিং করেন। পরে বস্তুল মাইনর স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে হক সাহেব ছিলেন প্রকৃত বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি। এছাড়া তিনি সিরাজগঞ্জ সালেহা ইসহাক হাই স্কুল (১৯৩৬), তাড়াশ হাইস্কুল (১৯২৪) ও মাটিয়ামালিপাড়া হাই স্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। শিক্ষকতা না করলেও তিনি এক সময় তাড়াশ থানা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন এবং সরকারের শিক্ষাপতিষ্ঠান কমানোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনি কুশুম্বী গ্রামে এক সভার আয়োজন ও প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলেন।
তিনি চলনবিল অঞ্চলের আদিবাসীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। ১৯৪২ সালে ‘ নবযুগ পত্রিকায় তিনি ‘ পাবনা জেলার আদিম অধিবাসীদের কাহিনী’ শিরোনামে তথ্যবহুল নিবন্ধ প্রকাশ করেণ। এছাড়া তিনি ‘পতিত জাতি উদ্ধারিনী সমিতির’ ব্যানারে তাড়াশ থানার বস্তুলে আদিবাসী কনফারেন্স এর আয়োজন করেন। তিনি তাঁদের দু:খকষ্ট জমির মালিকানার বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন।গোড়াতেই যে কথা বলছিলাম, মওলানা সেরাজুর হকের স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া জরুরী । তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা, তথ্যবহুল আলোচনা ও চর্চ্চা হতে হবে । অন্যথায় এই মহামানব হয়তো একসময় বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবেন অথবা বিকৃত তথ্য ও অনুমান নির্ভর গালগপ্পে তাঁর জীবনকথা রূপকথার উপাখ্যানে পরিণত হবে। মওলানা এম সেরাজুল হকের জীবন ও কর্মের সাথে শুধু একটি জনপদ নয় একটি উপমহাদেশে ইতিহাস ও সংস্কৃতি জড়িত । অতএব তাঁর জীবণচরিত আলোচনায় দায়িত্বশীল, নিরপেক্ষ ও নির্মোহ হতে হবে।চলনবিল অঞ্চলে স্থানিয়ভাবে মওলানা সেরাজুল হকের জন্ম ও মৃত্যবর্ষিকী নিয়মিতভাবে পালনে সচেতনসমহলকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। আজকাল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা আঞ্চলিক পর্যায়ে সংবর্ধণা, অভিষেক ও সংাস্কৃতিক বা জনসভার প্যান্ডেল বা সাউন্ড সিস্টেমের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়। মহাজনদের স্মরণসভার জন্য একটি ব্যানার, শব্দযন্ত্র, উপজেলা মিলনায়তন, কোন প্রতিষ্ঠানের সভাকক্ষ অথবা খোলা মাঠই যথেষ্ট। চলনবিল পল্লী উন্নয়ন সমিতি কোন কোন বছর দোওয়া শেষে খাগড়াই বাতাশা বা কফিল এ্যাসোরেটেড বিস্কুট বিতরণ করতো।
স্থানিয় পত্রিকাগুলো দিবসকে মার্ক করে বিশেষ সংখ্যা বা ক্রোড়পত্র বের করতে পারে। কাগজের অতিরিক্ত অংশে পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রদান বা নিজ নাম বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সৌজন্য বা স্পনসর করা যায়। এসব পত্রিকার বেশী কপি সংগ্রহ করে শিক্ষা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলি সেসব পাঠান্তে প্রতিযোগীতার আয়োজন করতে পারে। এছাড়া, মওলানা সোরজুল হক স্মারক বক্তৃতার আয়োজন বা ‘সেরাজুল হক মঞ্চ’ তৈরী বা ‘সেরাজুল হক পাঠচক্র’ গঠণ করা যায়।মওলানা সেরাজুল হকের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য কোন সড়ক, প্রতিষ্ঠান, সন্মেলন কক্ষ, খালকে সেরাজলু হকের নামে নামকরণ করতে হবে। এজন্য প্রশাসনের অনুমোদন, গেজেট নোটিফিকেশন, ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন বা উদ্বোধনের প্রয়োজন হয় না, মানুষের মুখেমুখেই সম্ভব। প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কমিটির অনুমোদন লাগে। এতদঞ্চলে হেদার খাল, হাসান রোড, মান্নান নগর, অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস মিলনয়তন, বেহুলার খাঁড়ী, ভীমের জাঙ্গাল এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে। শুধু একটি ব্যানার বা কয়েকটি খুঁটিতে নাম ও তীরচিহ্ন সম্বলিত টিনপ্লেট লাগিয়ে মুখে মুখে প্রচার করলেই জনগন একসময় নামটির সাথে পরিচিত হয়ে যান। সকলে চেষ্টা করলে তাঁর কীর্তিসমুহ যেমন: নিমাইচড়া-বেশানী খালকে ‘সেরাজুলহক খাল ’ (আগে লোকমুখে শোনা যেত), তাড়াশ থেকে আরঙ্গাইলের দিকের সড়কটিকে ‘সেরাজুল হক সড়ক (বা রোড) নামকরন সময়ের দাবী। এছাড়া উপজেলা পরিষদ সন্মেলন কক্ষকে ‘সেরাজুল হক মিলনায়তন (পরিষদ এবং সরকারি সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে)’ যে কোন কলেজে ‘সেরাজুর হক অডিটেরিয়াম, নতুন বা পুরাতন ভবণকে ‘সেরাজুল হক’ভবণ’ নামকরন করা যেতে পারে।পরিশেষে, অ-প্রজন্ম (অভয়-প্রজন্ম) বা জেন-জি (জেনারেশন-জি)-দের মধ্যে এখন জুলাই-‘২৪ আন্দোলনের অর্জনকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলতে শোনা যায়। তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি কিন্ত সংগ্রাম করে, বুকের রক্ত দিয়ে দুঃশাসন ও বৈষম্য থেকে এবার হয়তো সাময়িক স্বস্তি ও মুক্তির স্বাদ পেয়েছেন। সত্যিকারের স্বাধীনতা অর্জন ও স্বাধীনতা রক্ষা করা আরও কঠিন। তাদের উদ্দেশ্যে বলবো ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তি’ নামক অতি প্রয়োজনীয় জিনিষ দুটি সমার্থক তবে এক নয়। আমাদের ১৯৭২ এর সংবিধানে বলা হয়েছিল ‘জাতির মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের’ মাধ্যমে জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে সংবিধানে সংশোধন করে লেখা হয়েছে ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।’ এই ‘স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধ’ বললে শুধু একাত্তরের ৯ মাসের যুদ্ধ বুঝায় কিন্ত ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম ’ বলতে সন্মুখযুদ্ধ নাহলেও অতীতের সকল অন্যায়-অত্যাচার শোষন-বঞ্চনা, গণহত্যা ও সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সব ঐতিহাসিক আন্দোলন, সংগ্রাম বা বিদ্রোহকে জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বৃটিশবিরোধী ঐহিাসিক স্বাধীকার আন্দোলনের ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সালে একবার এদেশ ‘পাকিস্তান’ নামে স্বাধীন হয়েছিল। সেখানে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের চারটি উপাদান যথা: ভূখন্ড (দুইটি), সরকার, জনগন ও সার্বভৌমত্ব বিরাজমান ছিল ; কিন্ত সে অর্জন আমাদের প্রকৃত মুক্তি ও স্বাধীনতার আকাংখা পুরণ করতে পারে নি। তখন আমরা মূলত: এক উপনিবেশ থেকে আর এক উপনিবেশের শোষণ-বৈষম্যের শিকার হয়েছিলাম। তবে সেটুকুও স্বাধীন না হলে আমরা হয়তো অখন্ড ভারতের সেভেন সিষ্টারের ন্যায় বড় জোর একটি প্রদেশ থেকে যেতাম। মওলানা এম সেরাজুল হক ছিলেন দেশমাতৃকার সেই স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের এক অগ্রসৈনিক, মহান নেতা ও একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক বীর। আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে ও বিন¤্র শ্রদ্ধাভরে তাঁেক স্মরণ ও তাঁর স্মৃতিকে সংরক্ষণ করবো।
লেখকঃ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, প্রাবন্ধিক ও গবেষক । লালুয়ামাঝিড়া. তাড়াশ, সিরাজগঞ্জ।
১১ নভেম্বর ২০২৪
এম. সেরাজুল হক – কবি নজরুল ও গায়ক আব্বাস উদ্দিন ছবি-সেরাজুল
অধ্যাপক শফিউল হক বাবলু
অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বাঙলার মাটিতে যে কয়জন অকুতোভয় বীর সৈনিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন এম. সেরাজুল হক তাদেরই একজন। জন্ম ১৯০৩ সালে তৎকালীন পাবনা জেলাধীন তাড়াশ থানার মোর্শেদগুনা (বর্তমান সেরাজপুর) গ্রামে । এবছর তার ৬১ তম মৃত্যু বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। ১৯৬৩ সালের ১৫ নভেম্বর তার মৃত্যু দিবস। এম. সেরাজুল হক বাল্যকাল হতেই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। মেধার স্বাক্ষর হিসেবে তিনি ১৯১৬ সালে পাবনা জেলা বোর্ডের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় সমগ্র জেলার মধ্যে ১ম স্থান অধিকার করেন। কৌতুহল বশত সে সময় পাবনা জেলা স্কুল পরিদর্শক তাকে জিজ্ঞেস করে ছিলেন‘ বড় হয়ে তুমি কি হতে চাও?’ উত্তরে উনি বলেছিলেন ‘ বড় হয়ে আমি মহাত্মা গান্ধী হতে চাই। ’ পরবর্তীতে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকামী মানুষের দল জাতীয় কংগ্রেসে তিনি যোগ দেন।
এম. সেরাজুল হক ইংরেজ বিরোধী একজন স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন। মুলত: তিনি ছিলেন একাধারে একজন সাহিত্যিক, সাংবাদিক,কবি,সমাজকর্মী ও রাজনীতিবিদ। এম. সেরাজুল হক তৎকালীন সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখেন।তিনি অবিভক্ত ভারতে কংগ্রেসী আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৩০ সালে কারাবন্দী হন। ফলে ভারতবর্ষের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সাথে বন্দী জীবনে তার পরিচয় ঘটে। ব্যক্তিজীবনে তিনি অনেকবার ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে জেলখানায় বন্দী হন। তিনি অধিকাংশ সময় সিরাজগঞ্জ, পাবনা, ঢাকা, ওপার বাঙলার কৃষ্ণনগর, দমদম ও কোলকাতার সেন্ট্রাল জেলে বন্দি থাকতেন। বন্দি জীবনেই অবিভক্ত ভারতের বরেণ্য রাজনীতিকদের সাথে তার ঘনিষ্ট যোগাযোগ ও সম্পর্ক তৈরি হয়। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ছিলেন তার ঘনিষ্ট বন্ধু। সারা ভারতবর্ষের কাঠমোল্লারা কবি নজরুলকে যখন ‘কাফের’ আখ্যা দেন আমাদের হক সাহেব তখন কবি নজরুলকে সংবর্ধিত করেন। এম. সেরাজুল হকের আমন্ত্রণেই কবি নজরুল এসেছিলেন সিরাজগঞ্জের মাটিতে। প্রঙ্গত: উল্লেখ্য যে, ১৯৩২ সালে উত্তরবঙ্গে ঐতিহাসিক ‘বঙ্গীয় মুসলিম’ কনফারেন্স অনুষ্টিত হয়। ঐ কনফারেন্সের সেক্রেটারী ছিলেন চলনবিলের অহংকার তাড়াশের কর্মবীর এম. সেরাজুল হক। তার আমন্ত্রণেই কবি নজরুল সিরাজগঞ্জে এসেছিলেন।
উত্তরবঙ্গের সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম তরুণসংঘ কর্তৃক আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে কবি নজরুল কর্মবীর এম. সেরাজুল হককে দুটি চিঠি লেখেন, তন্মধ্যে প্রথম চিঠিটি বাংলা সনের ৩০ শে আর্র্শি¦ন ১৩৩৯ সাল , ২য় চিঠিতে ইংরেজী ২-১১-৩২ সন উল্লেখ রয়েছে। কবি নজরুল চিঠি দুটিতে উল্লেখ করেছিলেন জনাব সেক্রেটারী মহোদয় ,‘ যে সময় সারা বাঙলার কাঠমোল্লারা আমাকে ‘কাফের’ আখ্যা দিচ্ছে সে সময় আপনারা আমাকে সংবর্ধনা দিচ্ছেন; ধন্য আপনারদের সাহস’। প্রিয় পাঠক, সেদিন ১৯৩২ সালে সিরাজগঞ্জের মাটিতে কবি নজরুল ইসলাম যে জ্বালাময়ী ভাষন দিয়েছিলেন ঐ ভাষনটিই সারাদেশের কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পড়ান হয়। যা ‘যৌবনের গান’ নামে পরিচিত। মুলত: এম. সেরাজুল হক ছিলেন কবি নজরুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ১৯৩২ সালে অবিভক্ত ভারতের জলপাইগুড়িতে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের এক জনসভায় হক সাহেবকে কবি নজরুলের সঙ্গে আমন্ত্রিত অতিথি করা হয়েছিল। কিন্তু সে সভায় হক সাহেবের উপস্থিত হতে বিলম্ব হওয়ায় কবি নজরুল রাগান্বিত হয়ে সভা স্থল ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। এম. সেরাজুল হক ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি ছিলেন একাধারে সাংবাদিক , সাহিত্যিক, সমাজসেবী ,সুবক্তাও রাজনীতিক। কর্মবীর সেরাজুল হক তার মেধা ও যোগ্যতার গুণে কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবি নজরুলের প্রভাবশালী ‘লাঙল’ পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিলেন । এ প্রসঙ্গে নজরুল বলেছিলেন ‘আজ থেকে আমার দায়ভার কমলো । লাঙল পত্রিকার সকল দায়িত্ব আমার যোগ্য বন্ধু হক সাহেবের হাতে তুলে দিয়ে আমি নিচিন্ত হলাম।’
অপরদিকে কর্মবীর এম. সেরাজুল হকের সঙ্গে কিংবদন্তি গায়ক ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের আরেক নায়ক আব্বাস উদ্দিনের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এম. সেরাজুল হকের প্রচেষ্টায় ১৯৪৯ সালে ১৬ই জানুয়ারী তৎকালীন পাবনা জেলাধীন বন্যাবিধস্ত চলনবিলাঞ্চলের বারুহাসে বিলচলন মোজাহিদ কনফারেন্স অনুষ্টিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন অবিভক্ত ভারতের হোমরেজিষ্ট্রেশন জেল ও সাহায্য বিভাগীয় মন্ত্রী জনাব মফিজউদ্দিন আমম্মেদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন অবিভক্ত বাঙলার জনপ্রিয় গায়ক আব্বাস উদ্দিন আহম্মেদ। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে এম. সেরাজুল হক ছিলেন অবিভক্ত ভারতে এক আস্থার প্রতীক। বাংলা ১৩৪৮ সালে ভারতবাসীকে জাগরিত করার জন্য রংপুরে যে মুসলিম কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় এম.সেরাজুল হকের সঙ্গে সেই কনফারেন্সে গায়ক আব্বাস উদ্দিন জলপাইগুড়ি জেলার এক জনসভায় বলেছিলেন,‘আপনাদের কোন ভয় নেই। আমার সঙ্গে আছেন বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম ও বাঙলার আর এক অকুতোভয় সৈনিক এম. সেরাজুল হকঅ অবশ্যই আমাদের তরী এক দিন ইনশাল্লাহ তীরে ভীড়বেই’। সত্যি অবিভক্ত বাঙলার তিন বুলবুল তাদের নেীকা তীরে ভীড়িয়েছিলেন। তাদের প্রানপণ লড়াই সংগ্রাম প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়েই ভারতভর্ষ স্বাধিনতা লাভ করেছিল। এম. সেরাজুল হক নিঃসন্দেহে তাড়াশ,বৃহত্তর চলনবিল তথা অবিভক্ত ভারতের কৃতি সন্তান। এটা যেমন তাড়াশবাসীর র্গব তেমনি তাকে নিয়ে আমাদের অনেক কষ্টও রয়েছে।
১৯৬৩ সালের ১৫ই নভেম্বর তার মৃত্যুর পরে দেশ-বিদেশের অনেক পেপার- পত্রিকায় তাকে নিয়ে শোকবাণী ছাপা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে লন্ডন হতে প্রকাশিত হামারাওয়াতান , আওয়ার হোম ও আমারদেশ পত্রিকার সম্পাদক ব্যারিষ্টার আব্বাস যথার্থই লিখেছিলেন,‘ এম.সেরাজুল হক নিঃসন্দেহে পাক- ভারত তথা উপমহাদেশের কৃতি সন্তান। এদেশের যখন সত্যিকার ইতিহাস লেখা হবে এম. সেরাজুল হকের নাম অবশ্যই সেখানে স্থান পাবে’। দুঃখের সাথে বলতে হয়, এমন একজন গুণী মানুষকে কালের পরিক্রমায় আমরাও ভুলতে বসেছি। নব প্রজন্মের কাছে এটি একটি অচেনা নাম। সেরাজুল হক কোন ব্যক্তি বা পরিবারের নয় , তাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব চলনবিল তথা তাড়াশবাসীর। তিনি এ মাটির একজন গর্বিত সন্তান। তিনি আমাদের অহংকার।
লেখক ঃ এম. সেরাজুল হকের আপন নাতী। প্রভাষক, তাড়াশ মহিলা ডিগ্রী কলেজ। সাংবাদিক, দৈনিক মানবজমিন ও সম্পাদক, সেরাজুল হক স্মৃতি পরিষদ, তাড়াশ, সিরাজগঞ্জ।
ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের রাজবন্দী – মাওলানা এম. সেরাজুল হক
মেহেরুল ইসলাম বাদল
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিল “চলনবিল”। যার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে প্রসিদ্ধ ইতিহাস ও কিংবদন্তী । সারা চলনবিল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিস্ময়। এই চলনবিলকে ঘিরে আছে কাহিনী, দুঃখ-বেদনা,আশা-নিরাশা,ভাঙা ও গড়ার ইতিহাস। আছে কতিপয় খ্যাতিমান ব্যক্তির জীবন যুদ্ধের গৌরবময় জীবনালেখ্য। এই চলনবিলের কোলজুড়ে বিকশিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সানুকুল পরিবেশেই জন্ম নিয়েছেন কত না জ্ঞানী-গুণী কবি-সাহিত্যিক। তাদেরই অন্যতম কৃতি সন্তান তুখোর ব্যক্তিত্বের অধিকারী, তীক্ষèমেধা সম্পন্ন, অনলবর্ষী বক্তা,সাংবাদিক,সাহিত্যিক,সু-লেখক,ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের রাজবন্দী মাওলানা এম সেরাজুল হক । তিনি তাড়াশ থানার সেরাজপুর গ্রামে ১৯০৩ সালের ১ নভেম্বর সোমবার জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শেখ মেছের উদ্দিন ও মাতা সবজাহান নেসা। তিনি ১৯৬৩ সালের ১৫ নভেম্বর শুক্রবার মৃত্যু বরণ করেন। দিনটি উদযাপনের জন্য সেরাজুল হক স্মৃতি পরিষদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের কর্মসুচী পালনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছে।
পরাধীন জন্মভুমির মুক্তি সাধনের জন্য মাওলানা এম. সেরাজুল হক ছাত্র জীবন থেকেই ভারতের আজাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। যার ফলে তার লেখাপড়া বেশী দুর অগ্রসর হতে পারে নাই। তিনি অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে যোগদান করিয়া ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার ও বিপ্লবাতœক কার্যে মাতিয়া পড়ায় ১৯৩০ সালে তাঁকে কারাবরণ করতে হয় এবং ১৯৩২ সালে কিছুকাল বাড়ীতে অন্তরীন থাকিতে বাধ্য করা হয়। এ সময় তিনি কংগ্রেস ও খেলাফত কমিটির সক্রীয় সদস্য ছিলেন।
মাওলানা এম . সেরাজুল হক একদিন সকাল ৮টায় নিজ বাড়ীর বৈঠক খানায় চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়িতে ছিলেন। এমন সময় পুলিশ(ফৌজ) তার বাড়ীর চতুুুরদিক পুর্ণ হইয়া গেল। সবার মাথায় লাল পাগড়ী। কারণ জানতে চাইলে তাড়াশের পুলিশের প্রধান কর্মকর্তা বলিলেন, আপনার আমন্ত্রণ। ১৫৩,১৫৭,১১৭,১২৪(ক) প্রভৃতি ধারায় ওয়ারেন্ট হইয়াছে। ১৯৩০ সালের ২৮ আগষ্ট তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং থানায় ব্যক্তিগত জামিনে মুক্তি দেয়া হয়। সিরাজগঞ্জ কোর্টে দীর্ঘদিন মামলা চলে। অল্প বয়সের জন্য তাকে ক্ষমাপ্রার্থী হইতে বলা হইলে হক সাহেব বলেন যে,“আমি ইংরেজ শাসন পছন্দ করি না- বিদেশী শাসনে আমার বিশ^াসও নাই”। সুতরাং আমি তাহাদের উচ্ছেদ চাই। এ কারণেই বিচারে তাহাকে ৩ মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সংগ্রামী নেতা ও মুসলিম জাগরনের অগ্রসৈনিক হইবার কারণে সিরাজগঞ্জ জেল থেকে ৪ দিন অবস্থানের পর তাঁকে পাবনা জেল খানায় পাঠানো হয়। তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদি হিসেবে কয়েকদিন তাঁকে জাঙ্গীয়া পড়িয়া রাখা হয়। ওই সময় পাবনা জেলে মাত্র ৪ জন হিন্দু ও ২৫৪ জন কয়েদি ছিল মুসলমান। অথচ তাদের জন্য জুম্মার নামাজের কোন ব্যবস্থা ছিল না। সেরাজুল হক জেলারকে নামাজের কথা বললে জেলার বলেন, কয়েদিদের আবার কিসের নামাজ।হক সাহেবের নেতৃত্বে পরের দিন জুম্মার নামাজের দাবীতে হরতাল পালিত হয়। পরে বহু তর্ক বিতর্কের পর আলোচনার মাধ্যমে জেলার নামাজের অনুমতি দিতে বাধ্য হন।একদিন জুম্মার নামাজের খুৎবা পাঠ করার সময় জেলার নিজেই উপস্থিত থেকে বারান্দা দিয়ে পায়চারী করিতে লাগিলেন। হক সাহেব সেই দিন মওলানা আবুল কালাম আজাদের কোরআন শরীফের উর্দ্দু অনুবাদ তফসিরুল কোরআন কেন বাজেয়াপ্ত হয়েছে তাহা আলোচনা করিতেছিলেন।
পরের দিন হক সাহেবকে দমদম জেলে পুলিশ পাহারায় পাঠানো হল। এখানে এসে মাওলানা আব্দুল্লাহেল বাকী ও মাওলানা কাফী ভ্রাতৃদ্বয়,যতীন্দ্রনাথ রায়,ডাঃ সুরেশচন্দ্র গুপ্ত, মৌলভী সৈয়দ আব্দুল করিম,মৌলভী ইয়াকুব আলী,বিশিষ্ট কমিউনিষ্ট নেতা বঙ্কিম মুখার্জী প্রভৃতির সংগে আলাপ ও পরিচয় হয়। যার ফলে তার মনে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের জোয়ার আরও দানা বেধে উঠে।
ওই জেলে থাকাবস্থায় একদিন কংকর মিশ্রিত চাউলের ভাত ও পচা মাছ খেতে দেওয়া হলে জেলখানায় ধর্মঘট করতঃ জেলের চেয়ার,টেবিল আসবাবপত্র ভাঙ্গিয়া তছনছ ও লোপাট করা হয়। পরে ১ নভেম্বর ১৭জনকে পায়ে ডান্ডা-বেড়ী ও হাতে হাত কড়া পরিয়ে পাঠানো হয় কলকাতার আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে । এই জেলে এসে সেরাজুল হক সাহেব কাজী নজরুল ইসলাম,মাওলানা আবুল ফজল,হজরত মোহানী এবং মাওলানা আজাদ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী তৎপুত্র আসাদউদ্দৌলা সিরাজী, পীর বাদশা মিয়া, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার প্রমূখের সংস্পর্শে এসে রাজনৈতিকভাবে আরো সচেতন হয়ে উঠেন। ১৪ দিন পর ১৬ নভেম্বর জেল থেকে মাওলানা সেরাজুল হক মুক্তি পান। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে সিরাজগঞ্জে পৌছিলে হিন্দু-মুসলমানগণ তাকে বিপুলভাবে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন।
মাওলানা এম, সেরাজুল হক ছাত্র জীবন থেকেই পাক বাংলার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। এসবের মধ্যে আল মোহাম্মাদী, নেদায়ে ইসলাম, রওশন হেদায়েত, শরিয়তে ইসলাম, কোরআন প্রবাহ,আতœশক্তি,স্বাধীনতা,চাষী,নয়া বাংলা, লাঙ্গল, নায়ক, প্রজাবাহিনী, কৃষক, জেহাদ, পল্লীবান্ধব, অভিযান, আমাদের দেশ প্রভৃতিসহ অসংখ্য পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হয়েছে। মাওলানা এম, সেরাজুল হক পশ্চিম বঙ্গীয় কৃষক ও রায়ত খাদক সমিতি এবং নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির সদস্য হন। জমিদারদের অত্যাচার ও অবিচারের হাত হইতে কৃষকদের রক্ষার উদ্দেশ্য কৃষক জাগরনের জন্য তিনি পাক বাংলার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত পরিভ্রমণ করিয়াছেন। অসংখ্য সভা সমিতি ও কনফারেন্সে জ¦ালাময়ী বক্তৃতা দিয়া উৎপীড়িত কৃষক প্রজাদের মধ্যে আশার সঞ্জীবনী সুধা বর্ষন করিয়াছেন। শীরদাড়া সোজা করিয়া উন্নত মস্তকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে পতিবন্ধ করিবার সাহস তাহাদের মনে সঞ্চার করিয়াছেন। এই রুপে তিনি জয় করিয়াছেন পাক বাংলার অসনিত কৃষকের অন্তর।
হক সাহেবের প্রচেষ্টায় ১৯৩২ সালের ৩ মার্চ তাড়াশের দক্ষিন মাঠে সিরাজগঞ্জ মহুকমা প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তা ছাড়া ১৩৩৯ সালের ৬ই ও ৭ই ফাল্পুন নাটোর এর চাচকৈড় যে নিখিল বঙ্গ রায়ত খাতক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় এতে হক সাহেব ছিলেন অর্গানাইজার ও জয়েন্ট সেক্রেটারী ও মওলানা তর্কবাগীশ ছিলেন সভাপতি এবং প্রধান উপদেষ্টা। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন ও তরুন ব্যারিষ্টার হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদ্দীসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সভায় যোগ দেন।
তা ছাড়া বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবি জীবনের প্রথম পর্যায়ে অনেক কাঠ মোল্লা তাকে“কাদের” বলিয়া বিরুপ মন্তব্য করেন। হক সাহেব তখন কলকাতায় থাকেন। এ ধরনের মন্তব্য দেখে হক সাহেব হ্নদয়ে দুঃখ পান। তিনি কাল বিলম্ব না করে সিরাজগঞ্জ ফিরে আসেন এবং সিরাজগঞ্জে বঙ্গীয় মুসলিম তরুন কনফারেন্স অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। জনাব আসাদউদ্দৌলাকে সভাপতি এবং সেরাজুল হক সাহেবকে সাধারন সম্পাদক করে কমিটি গঠন করা হয়। ১৩৩৯ সালেন ১৯ ও ২০শে কার্তিক সিরাজগঞ্জ শহরে বঙ্গীয় মুসলিম তরুন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কবি নজরুল ইসলাম সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। সুপ্রসিদ্ধ গায়ক আব্বাস উদ্দিন আহম্মেদ সম্মেলনে যোগদান করেন।
চনবিলাঞ্চলের কৃষক সন্তানদের শিক্ষিত করিয়া গড়িয়া তোলার জন্য অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বস্তুল ও তাড়াশ হাইস্কুলদ্বয়ের মাটিয়া মালিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। হক সাহেব শিক্ষা প্রচারের জন্য আজিবন চেষ্টা করে গেছেন। তিনি তাড়াশ থানা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন, তাড়াশ থানা পল্লী উন্নয়ন সমিতির সেক্রেটারী হিসেবে নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৯৩৬ সালে সিরাজগঞ্জের সালেহা ইসহাক গালর্স স্কুল প্রতিষ্ঠায় সাহায্যে কল্পে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে সাহায্য তোলেন। চলনবিলাঞ্চলে ১৩৩৮,১৩৪৩,১৩৬৯ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে মৃত্যু পথ যাত্রী জনগনকে সাহায্যের জন্য হক সাহেব দেশের সরকার,মন্ত্রবর্গ,পরিষদ সদস্য এবং বিভিন্ন সংস্থায় বহু লেখা -লেখি করেন এবং বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক সাহায্যে সংগ্রহ করিয়া দুঃস্থদের মধ্যে সাহায্যে বিতরন করেন। মাওলানা এম, সেরাজুল হক সাহেবের প্রিয় হাজার হাজার ভক্ত অনুরাগী ও তার হাতে গড়া বিদ্যাপীঠের শতসহ¯্র ছ্ত্রা-ছাত্রীর মধ্যে যুগ যুগ ধরে তিনি বেচে থাকবেন। ১৯৬৩ সালের ১৫ নভেম্বর শুক্রবার নিজ বাসভবনে তিনি শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন।
লেখক ঃ সহকারী অধ্যাপক, তাড়াশ ডিগ্রী কলেজ। সভাপতি. সেরাজুল হক স্মৃতি পরিষদ,তাড়াশ, সিরাজগঞ্জ। সাংবাদিক, দৈনিক করতোয়া।
সেরাজুল হকের জীবনে সিরাজী ও নজরুলের প্রভাব
আব্দুল লতিফ সরকার
বড় প্রতিভা সবসময় জন্মায়না, এ কথা ঠিক এবং প্রথম শ্রেণীর লেখকের সংখ্যা চিরকালই কম। মাঝারী শ্রেণীর লেখকের সংখ্যাই বেশী। আর সেই মাঝারী শ্রেণীর লেখকরাই বড় বড় প্রখ্যাত লেখকদের মাঝখানের ব্যবধান পূরণ করে সাহিত্যের ভান্ডার পরিপূর্ণ করে তোলেন।
মওলানা এম, সেরাজুল হক সাহেব ছিলেন নজরুল ও ইসমাইল হোসেন সিরাজীর সমসাময়িক এবং তাদের প্রভাবে প্রভাবিত। ব্যক্তিগত জীবনে হক সাহেব সিরাজী সাহেবের অত্যন্ত কাছের লোক ছিলেন। তার বাসস্থান সিরাজগঞ্জের বাণীকুঞ্জের সাপ্তাহিক সাহিত্য সভা এবং অন্যান্য বড় বড় জনসভায় হক সাহেব সিরাজী সাহেবের পাশেপাশে থাকতেন। অন্যদিকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ পত্র বিনিময়ে কাজী নজরুল ইসলামের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ অব্যহত রাখেন। একারণে হক সাহেবের মধ্যে নজরুলের বিদ্রোহী ও দেশাত্মবোধক মনোভাব এবং সিরাজীর অগ্নিপুরুষোচিৎ দৃঢ়তা ও ‘অনল প্রবাহের’ প্রবাহমান ধারা সঞ্চারিত হয়েছে। যদিও হক সাহেবের লেখার প্রচার ও প্রকাশ কম হয়েছে তথাপি গুণগত ও বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে উপরোক্ত দু’জন লেখকের রচনার সাথে সঙ্গতি রয়েছে। সে সম্পর্কে আমার অপক্ক রচনা থেকে যৎকিঞ্চিত উল্লেখ করছি। যেমন: নজরুল লিখেছেন:
ঐ রক্ত আঁখির ভয় দেখালে
টলবে নারে প্রাণ
পাষাণ কারার ভাঙ্গতে আগল
গাইবে মুক্তিরগান।
এবং সিরাজী সাহেবের কবিতায় ঃ
পরাধীন কাপুরুষ সেই জাতি ভূমন্ডলে
অন্তেও দহিবে তারা ভীষণ নরকানলে
অধীন জাতির তরে স্বর্গধাম কভু নয়
স্বাধীন জাতির তরে সে স্বাধীন স্বর্গালয়।
আর এম, সেরাজুল হক সাহেব লিখেছেন ঃ
স্বাধীনতা মনুষ্যত্ব
একত্র আবদ্ধ নিত্য
পরাধীন দেশ তাই মনুষ্যত্বহীন
কর্তব্য দলিত তথা হয় অনুদিন।
স্বাধীনতা অর্জনের জন্ম বোধনগান কবিতায় হক
সাহেব লিখেছেন ঃ
হয়োনা লুপ্ত, জাগো হে সুপ্ত
হতে যদি চাও অজেয় মুক্ত
বোধনগান কবিতায় হক সাহেব লিখেছেনঃ
বাজাও দুন্দুুভি, উড়াও নিশান
খোল জ্ঞান-আঁখি বাজাও বিষাণ
তৌহিদ বাণী করিয়া স্মরণ
কর্ম সাগরে হও ভাসমান।
এর সাথে কাজী নজরুলের-
“বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা
শির উঁচু করি মুসলমান
দাওয়াৎ এসেছে নয়া-জামানার
ভাঙ্গা-কেল্লায় ওড়ে নিশান”- এই চরণটি তুলনা
করা যেতে পারে।
“বিদ্রোহী কবির লেখা রাজবন্দীর জবানবন্দী পড়ে আমরা বিস্মিত হয়েছি। তেমনি হক সাহেবও ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে দাঁড়িয়ে নির্ভয় ও দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা করেছেন “আমি ইংরেজ শাসন পছন্দ করি না; বিদেশী শাসনে আমার বিশ্বাসও নাই। আমি তাদের উচ্ছেদ চাই।” এবং ২৭ বছর বয়সে তিন মাসের জেল তিনি হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছেন। সে-সময় কলিকাতার সেন্ট্রাল জেলে নজরুলও ছিলেন।
হক সাহেবও নজরুলের মত বাগ্মী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন কংগ্রেসী সভায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা করতেন। বর্তমান জেলার চুরুলিয়ার কাজী বাড়ীর দুখু মিয়া ও পাবনা জেলার তাড়াশ থানার মোরশেদগুণা গ্রামের চেরাগ আলীর কারও ভাগ্যেই সোনার চামচ জোটেনি; বরং উভয়েই অত্যন্ত দরিদ্রতার মধ্যে লালিত হয়েছেন। তাই উভয়েরই অন্তরে দু:খী-দীন মানুষের সুখ-দুঃখের ব্যাঞ্জনা বেজেছে।
আগেই বলেছি সিরাজী সাহেবের সাথে হক সাহেবের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল। হক সাহেব সিরাজী সাহেবকে প্রতি পদে অনুসরণ ও সঙ্গদান করতেন। তাই তিনি “সিরাজী চরিত” নামের সেই মূল্যবান ও তথ্যবহুল বইটি লিখতে পেরেছিলেন যা আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেফারেন্স বই হিসেবে ব্যবহৃত হয়। উপসংহারে বলা যেতে পারে, বাংলার ভাগ্যাকাশে যে তিনটি জ্যোতিষ্ক উদিত হয়ে সমগ্র দেশকে প্রদীপ্ত করেছিলো-তাঁরা একে অপরের নৈকট্য বজায় রেখে যে আলোকরশ্মি ছড়িয়ে গেছেন সেই ত্রিধারা পরস্পরের পরিপুরক ও সম্পর্কযুক্ত ছিল।
“আমাদের বিশ্বাস ও আচরণের দ্বারা হজরত মোহাম্মদ (সঃ) এর মানব প্রেমের বাণী জগতে প্রচার করাই হইবে শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এই অন্নবস্ত্রহীন,অসুখী ও দুঃখ-দৈন্যে কাতর জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠার ভিতর দিয়াই ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করিতে হইবে।” -এম, সেরাজুল হক
“সত্য প্রচার করা ও সত্যকে স্বীকার কথা উভয়ই গৌরবের বিষয়, সম্মানের বিষয়।” -এম, সেরাজুল হক
“মানুষ যখন নিজের নিজের ভোগবিলাস, আরাম-আয়েশ পরিত্যাগ করিয়া সকলের দুঃখের প্রতিকারের জন্ম ব্যাকুল হইয়া পড়ে, সকলের অন্তরেই তখন তাহার স্থান হইয়া থাকে। ঘরের প্রদীপ গ্রহবাসীদের জন্মই আলোকদান করে মাত্র; কিন্তু পথের বাতি সকলের জন্য। মওলানা এম, সেরাজুল হক।
মন্ত্রিত ঝংকারে উঠুক বাজিয়া
মহামিলনের গান,
শান্তিস্থাপিতে এগিয়ে আসুক
প্রতিটি তরুণ প্রাণ ।।
-এম, সেরাজুল হক (“শান্তিবাণী” কবিতায়)
লেখক ঃ বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক। সাবেক সাধারণ সম্পাদক, তাড়াশ প্রেস ক্লাব।
ইতিহাসের পাতায় তাড়াশের সেই মহামানব
আবদুর রাজ্জাক রাজু
কেউ যদি আজ শুনে চমকে ওঠেন-চলনবিলের অজ পাড়া গাঁ এই তাড়াশেও মহামানবের মতো বিরাট ও বিশাল প্রতিভাধর বহুমাত্রিক গুণী ব্যক্তিত্ব ছিলেন- সত্যি তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কিন্তু বাস্তব তথ্যের অবতারণা করলে, অনুসন্ধান আর গবেষণা চালালে জানা যাবে, প্রকৃতই এমন একজন মহা মানবের অস্তিত্ব এখানে ছিল। তিনি আমাদের অখন্ড ভারতের ইতিহাসের অন্যতম অংশ, গর্ব এবং চলনবিলের তথা তাড়াশের চির দেদীপ্যমান উজ্জল নক্ষত্র মাওলানা সেরাজুল হক।
অবশ্য তিনি বিদেহী হয়েছেন বহুদিন পূর্বে। এম. সেরাজুল হকের জন্ম ১৯০৩ সালের ১ নভেম্বর এবং মৃত্যু ১৯৬৩ সালের ১৫ নভেম্বর। আজ ১৫ নভেম্বর ২০২৪ তারিখ মরহুমের ৬১তম প্রয়াণ দিবস। তথাপি আমাদের ভক্তির বেদীতে তাঁর কীর্তির পূজো-অর্চনা চলছেই। তা চলবেই আগামীতেও। কারণ সর্বকালীন মানুষের জন্য সর্বজনীন যে বহুমুখী অবদান-স্থানীয়, জাতীয় এবং উপমহাদেশীয় পর্যায়ে তিনি রেখে গেছেন, তার আদর্শময় আস্বাদনে আমরা অপরিসীম গর্বিত, কৃতজ্ঞ এবং ঋণী। তবে অনুতাপ প্রকাশ না করে পারি নে, জাতীয় জীবনের চলমান অযুত অবক্ষয়ের সাথে নিজস্ব ইতিহাস আর ঐতিহ্যের প্রতি আমাদের নিদারুণ উদাসীনতা ও নির্লিপ্ততা সর্বোতভাবে অগ্রহণযোগ্য, অপ্রশংসিত। আর এরই ফলশ্রুতিতে আজ জাতীয় ঐতিহ্যগত যে কোন আদর্শিক দিক অনেকটাই উপেক্ষিত,অবমূল্যায়িত। যেমনটি হক সাহেবের জীবন ও কীর্তি আমরা আজ ভুলে যেতে বসেছি- তা খুবই অনুতাপের বিষয়।
এম.সেরাজুল হক। একটি নাম। একটি অনন্য উচ্চতার প্রতিভাময় সত্বা। একটি বৃটিশ-বিরোধী ধূমকেতু। একজন আজাদী-পাগল মানুষ। আজীবন সত্যানুসন্ধানী একজন একনিষ্ঠ সাধক। অখন্ড ভারতবর্ষের সাহিত্য-সাংবাদিকতার তদানীন্তন জগতে একজন নিবেদিতপ্রাণ কৃতি জ্যোতিস্ক। জনসেবা ও সমাজকর্মে উৎসর্গীত একটি বিরল দৃষ্টান্তের জীবন। সমাজ ও রাষ্ট্র সেবার আদিগন্ত আকাংখায় ভারত উপমহাদেশের প্রায় সর্বত্র পাগলের মতো সরব পদচারী একজন ঐতিহাসিক ক্ষণজন্মা পুরুষ। তাড়াশের অনুর্বর গর্ভ থেকে প্রাদুর্ভূত এই মহাজন হলেন মরহুম মাওলানা সেরাজুল হক। সেরাজুল হক যে কতবড় কৃতিকর্মী ছিলেন তার সম্যক পরিচয় ও নিদর্শন মেলে বিভিন্ন বই-পুস্তুক ও পত্র-পত্রিকা তথা ইতিহাসের পাতায়। তাঁর আলোকবিস্তারী নানামুখো গুণপনার স্বাক্ষর সেকালের অসংখ্য পত্র-পত্রিকায় ও ঐতিহাসিক গ্রন্থাদিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। মূলতঃ তা মনোনিবেশ করে অবলোকন,পর্যবেক্ষণ বা গবেষণা না করলে যথাযথ অনুধাবনের উপায় নেই।
তথ্য-প্রযুক্তির মোহাবিষ্টতায় জ্ঞান অনুসন্ধানে বা সাহিত্য ইতিহাস শিল্পকলা চর্চায় আমরা আজ অনেকটাই পিছিয়ে আছি, বলা যায় প্রায় বেমালুম অমানিশায় নিমজ্জিত। ফলে সক্রিয় ইচ্ছের নেত্রপাতে এতটুকু জানার অবকাশ পাইনে কিংবা ফিরে দেখিনে আপন কৃষ্টি-সংস্কৃতির ইতিকাহিনি। এ ব্যাধিই কাজ করছে-অজ্ঞানতার অচ্যুত চশমার আড়ালে নিজেদেরকে গুটিয়ে রাখার। তবুও মাঝে-মধ্যে নেশাগ্রস্থ সখ্যতার বশে পত্র-পত্রিকায় বা বইতে চোখ ফেরাতেই-আগ্রহ দাঁড়িয়ে গেছে থমকে। সেখানে সেরাজুল হকের ওপরে লিখিত দু’টি কথা বা তার কর্মময় জীবন প্রসঙ্গ দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে। জানবার জিজ্ঞাসা জেগেছে অধীর আগ্রহ-উদ্দীপনায়। কেননা বিশেষত: বর্তমান জমানার নতুন প্রজন্মের তাড়াশবাসীর কাছে আজো প্রায় অজানা যে, এই মহাপ্রাণ ব্যক্তিত্ব ইংরেজ শোষনের অক্টোপাশ হতে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের সংগ্রামের ইতিহাসের এক নায়ক, অপরিহার্য গর্বিত অংশীদার। সমগ্র চলনবিলে তার মতো উৎসর্গিত আকাশচুম্বি বহুমুখি গুণাবলীর স্বাক্ষর আর দ্বিতীয়টি নেই।
বিগত উনসত্তুর সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২য় বর্ষ মাসিক “পাবনা” পড়ছিলাম। ‘“বাংলা সাহিত্যে পাবনা জেলার অবদান”-শীর্ষক প্রবন্ধে দৃষ্টি নিবদ্ধ হল। অধিক মনস্কতার সাথে সন্ধানী উঁকিঝুঁকি দিচ্ছি ওর বুকে। জীবন চরিত্র, ধর্মীয় ও আদর্শমূলক পুস্তুক রচনার সারিতে অন্যান্যের মধ্যে তাড়াশ থানার একমাত্র এম. সেরাজুল হক এর নাম সুস্পষ্টরুপে বর্ণিত। অবশ্য মুন্সী শাফাতুল্লাহ্ নামে আরো একজন তাড়াশী লেখকের কথাও ঐ প্রবন্ধে উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি সেরাজুল হকেরও পূর্বসূরী এবং চলনবিলের অন্যতম প্রথমসারির শিক্ষার আলোকবর্তিকা।
কিন্তু ঐতিহাসিক মর্যাদার সোপানে ও মানের বিচারে সাহিত্যিক হিসেবে অত্র থানা এলাকায় স্থান দেয়া হয়েছে শুধমাত্র এম.সেরাজুল হককে। সাম্প্রতিক কালের কথা। রাজশাহী থেকে প্রকাশিত জাতীয় পত্রিকা “দৈনিক বার্তা”র দ্বিতীয় বর্ষ পূর্তির বিশেষ সাময়িকী সংখ্যা হাতে। ওটাতে প্রকাশ চন্দ্র কাব্যতীর্থের ‘রংপুরের অতীত ও বর্তমান’ প্রবন্ধের একস্থানে চোখে পড়লো- “এরপর ১৯২০-২১ সালে এখানে কংগ্রেসী আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনের প্রবক্তা ছিলেন রাম গোপাল চক্রবর্তী ও মৌলভী সেরাজুল হক প্রমূখ। বলাবাহুল্য রংপুরে আগত তৎকালীন ঐ কংগ্রেসী নেতা মৌলভী সেরাজুল হক সিরাজগঞ্জ চলনবিলের সূর্য সন্তান,এই তাড়াশেরই মাটির মানুষ। এটা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পরিভ্রমণশীলতার, ভারতের সর্বত্র ছুটে বেড়ানোর প্রেক্ষাপটে একটা প্রহর মাত্র। অনুরুপ তিনি ভারতবর্ষের প্রায় সর্বত্র চষে বেড়িয়েছেন সেকালের ব্রিটিশবিরোধী অন্যান্য ঐতিহাসিক নেতৃবৃন্দের সাথে রাজনৈতিক ও স্বদেশী আন্দোলন জোড়দার ও বেগবান করে গড়ে তোলার অদম্য নেশায় সাড়াটি জীবন। সেকারণে শুধু নিপীড়ন-নির্যাতনই সহ্য করেননি,বার বার বরণ করতে হয়েছে ব্রিটিশ শাসকের জেল-জুলুম পর্যন্ত, ইতিহাস তার জ্বলন্ত প্রমাণ। যদিও কোন অত্যাচার-নিগ্রহ তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
অন্যদিকে সিরাজগঞ্জের চিলগাছা নিবাসী এম. সফদার আলীর লেখা ‘তরুণের সাধনা’ বইখানিতে বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সংঘের সদস্যবৃন্দের যে গ্রুপ-ফটো প্রদত্ত হয়েছে- সেখানে সেরাজুল হক সাহেবকে উপবিষ্ট দেখেছি। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯২৫ খৃষ্টাব্দে সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত উক্ত সংঘের বিশেষ কর্মী বৈঠকে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তাড়াশের এম, সেরাজুল হক। এরপর এই সিরাজগঞ্জেই ১৯৩২ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম কনফারেন্সের সেক্রেটারী তাড়াশের কৃতি সন্তান এম. সেরাজুল হকের আমন্ত্রণেই কবি নজরুল সিরাজগঞ্জে এসেছিলেন। সেখানে আব্বাস উদ্দিন ও ইসমাইল হোসেন শিরাজীসহ সেকালের কতিপয় রাজনীতি ও সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের অমর বিপ্লবী দিকপাল উপস্থিত ছিলেন যা উক্ত একই পুস্তকে উল্লেখিত হয়েছে।
এরপরেই আসা যায় হক সাহেবেরই ভক্ত-শিষ্য শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আব্দুল হামিদ সাহেবের “চলনবিলের ইতিকথা” গ্রন্থে। বইটির বিভিন্ন পরিচ্ছদে ভিন্ন ভিন্ন দক্ষতা ও কৃতিত্বের সূত্রে গ্রন্থকার কর্তৃক এম.সেরাজুল হক উপস্থাপিত হয়েছেন বহুবার। এখানেও আমরা মরহুমের বিশাল প্রতিভার বেশ কিছু দিক তথা তথ্য-তত্ত্ব জেনে নিতে পারি।
১৯৩৩ খৃষ্টাব্দে চলনবিলাঞ্চলের চাঁচকৈড়ে সর্বপ্রথম যে বঙ্গ রায়ত খাতক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় তার উদ্যোক্তা ও পুরোভাগে ছিলেন মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশের সাথে আমাদের চলনেিলর অহংকার মাওলানা সেরাজুল হক। রাজনীতিতে দীক্ষিত সেরাজুল হকের স্বদেশী আন্দোলনে অবতীর্ণ হওয়ার প্রারম্ভকালীন সময়ে তিনি মাদ্রাসায় ছাত্র জীবনের অধিকারী ছিলেন। সেটা ১৯২১ সালের কথা হবে। এ সময়েই তিনি ‘অনল প্রবাহে’র প্রথম বিদ্রোহী কবি সৈয়ধ ইসমাইল হোসেন শিরাজীর সঙ্গ লাভ করে স্বদেশী আন্দোলন প্রচারে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ঢাকা হতে প্রকাশিত দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার ২২ জুলাই ১৯৮৩ এর ১৭৮তম সংখ্যা আমার হাতে। “শিরাজী ও রায়নন্দিনী” শীর্ষক হোসেন মাহমুদ লিখিত প্রবন্ধে নজর পড়ল। তৎকালীন মুসলিম চিত্ত-মানসে রায়নন্দিনী উপন্যাস কী রকম সাড়া জাগিয়েছিল তার ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত তুলে ধরার ইঙ্গিত প্রদানের অর্থে প্রবন্ধকার লিখেছেন:“শিরাজীর জীবনীকার এম. সেরাজুল হক তাঁর ‘শিরাজী চরিত’ গ্রন্থে “রায়নন্দিনী” উপন্যাস পাঠে তৎকালীন মুসলিম সমাজে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়ার কিছুটা পরিচয় তুলে ধরেছেন।”
এছাড়া তার বিস্তারিত সাহিত্য, সাংবাদিকতা, রাজনীতি, সমাজসেবা ধর্ম প্রচার তথা মহিমান্বিত জীবনের বিভিন্ন জ্ঞাতব্য দিক তুলে ধরে চলনবিলের ইতিকথার লেখক এম. এ হামিদ “কর্মবীর সেরাজুল হক” নামে যে জীবনী বই লিখেছেন, তা থেকে সেরাজুল হককে প্রায় সম্পূর্ণ রূপে জানা যায়। মরহুমকে বিশদ জানার জন্য এটাই সবচেয়ে নির্ভযোগ্য প্রকাশনা।
নিজের ঘর ফেলে যেমন অন্যের কক্ষের সাজসজ্জা দেখে বাহুল্য তৃপ্তি অর্জিত হলেও তা আত্মসার্থে ও আত্মকল্যাণে বড় একটা কাজে লাগে না। তেমনি নিজ গ্রাম, থানা, এলাকা থেকে শুরু করে সর্বাগ্রে স্বদেশীয় কৃষ্টিকালচার, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং এসবের মহান সেবকদের অবগত হওয়া ব্যতিত আমাদের জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্যের যথার্থ মূল্যায়িত হওয়ার অন্য কোন স্বতন্ত্র পথ নেই। তাই এম. সেরাজুল হকের মতো অতুলনীয় মনীষী এবং অবর্ণনীয় মানব দিশারী ও মানবতার সেবককে আমরা যেন ভুলে না যাই- সেদিকে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে সতর্ক এবং সযতœ দৃষ্টি রাখতে হবে। আমরা যদি এসব গুণীজনকে সম্মান ও কদর করতে এবং তাদের চির ভাস্বর মহৎ গুণাবলী অনুসরণ আর বাস্তবায়ন করতে পারি তবেই আমাদের দেশ ,সমাজ ও জাতি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতায় আরো এগিয়ে যাবে। (পূর্বে “চলনবিলের চেরাগ” পত্রিকায় প্রকাশিত। ঈষৎ পরিবর্তীত ও সংশোধিত)
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী – রাজনীতিক এম. সেরাজুল হক
অধ্যাপক শফিউল হক বাবলু
বিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্নিপুরুষ চলনবিলের কিংবদন্তি বিশিষ্ট রাজনীতিক,সমাজসেবক, সুসাহিত্যক ও সাংবাদিক এম, সেরাজুল হক আমাদেও অহংকার আমাদের গর্ভ। অযত œঅবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে তার অনেক স্মৃতিচিহ্ন নব প্রজন্মের ও কাছে এটি একটি অচেনা নাম। তাকে বাঁচিয়ে রাখার কোন উদ্দ্যোগ নেই । এম, সেরাজুল হক চলনবিল তথা তাড়াশের সন্তান।
১৯০৩ সালে তৎকালিন অবিভক্ত ভারতের পাবনা তথা সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ থানার অর্ন্তগত মোরশেদগুনা বর্তমান সেরাজপুর গ্রামে তার জন্ম। তার পিতার নাম শেখ মেছের উদ্দিন মাতা সবজান নেছা । এম, সেরাজুল হক বহু গুনে গুনান্বিত এক জন মানুষ। তিনি একাধারে একজন প্রতিতযশা সাংবাদিক, সাহিত্যিক,সমাজসেবী,অনল বষীর্ বক্তা ও বিশিষ্ট রাজনীতিক। তার জীবনকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গ তথা চলনবিল অনঞ্চলের সাংবাদিকতার প্রতিকৃৎ ছিলেন এম, সেরাজুল হক। তিনি তৎকালিন যে সকল পত্রিকায় লিখতেন তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-কৃষক, লাঙল, ইত্তেফাক,ইত্তেহাদ, সংবাদ,নবযুগ,নয়াজামানা ও ধুমকেত ুউল্লেখযোগ্য।
সাহিত্য ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। উনবিংশ শতাব্দির গোড়ারদিকে শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া সমাজকে এগিয়ে নিতে তিনি সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ গুলোর মধ্যে- শেরেকধবংস ঈমানরক্ষা, কেতাবুল ঈমান, পাকিস্তানের গজলগীতি, ইসলামপ্রভা ,আল্লাহরপানে ফিরেচাও, ভুতের বেগার, সুধার পেয়ালা, অমর জীবনকাহিনী ও সিরাজী চরিত। বিশেষকরে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর উপর লিখিত তাঁর সিরাজী চরিত গ্রন্থটি উচ্চ শিক্ষাগবেষনা ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করছে। নামী- দামি বিশ^বিদ্যালয়ে কর্মরত অধ্যাপক বৃন্দ তাঁর এই অনবদ্য গ্রন্থটি নিয়ে গবেষনা করে উচ্চতর পিএইচ ডি ডিগ্র ীলাভ করছে।
সমাজকর্মী হিসাবে এম সেরাজুলহকের অবদান অনস্কীকায। সাহিত্য- সাংবাদিকতার পাশা-পাশি এম, সেরাজুল হক উন বিংশ শতাব্দির পিছিয়ে পরাসমাজকে এগিয়ে নিতে নানাবিধ সংস্কার ও জনকল্যানমুলক কাজে অংশ গ্রহনকরেন। তিনি চলনবিল এলাকায় খালখনন, রাস্তা-ঘাট, স্কুুল- কলেজ মসজিদ – মাদরাসা, নৈশ্যবিদ্যালয়, খেলার মাঠ ্্্্্্ঈদগাঁমাঠ কবর¯াা’ন নির্মানে অগ্রণি ভূমিকা পালন করেন।তিনি চলনবিলাঞ্চলের মানুষেরজন্য দ্রুত পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করেন। যার ফলে তৎকালিন ব্রিটিশ সরকার ১৯৪২ সালে চলন বিলে খালখননের জন্য ৯ লক্ষাধিক টাকা বরাদ্দ করেন। এ খালটি বর্তমানে চলনবিল সাইটখাল নামেপরিচিত। তাঁর সমাজসেবায় সর্বশেষ অবদান হলো তাড়াশ- কাঁটাগাড়ী রাস্তা। তাড়াশ থানার মাধাইনগর ইউনিয়ন পরিষধের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তখন হাজারোও বাধা অতিক্রম করেও দীর্ঘ ১২ কিঃমিঃ এই রাস্তাটি নির্মান ুকরেন।
এম,সেরাজুল হকের রাজনৈতিক জীবন ছিল বিশাল ও বর্ণাঢ্যময়। তিনি যখন ১৯৩২ সালে রাষ্টদ্রোহী মামলায় বন্দি হন, তখন অবিভক্ত ভারতে সর্বাক্তক হরতাল পালিত হয়। এম, সেরাজুল হক কিশোর বয়সেই ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে মেতে উঠেন। কিশোর বয়সে উনি যখন মাদ্রাসার ছাত্র তখন থেকেই কংগ্রেসী ভাব ধারায় গড়ে উঠেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র কøাসে কখনও দ্বিতীয় হননি। ছাত্র জীবনে তাঁর মেধা দেখে এক জন স্কুল পরিদর্শক তাকে কৌতুহল বশত জিজ্ঞাসা করে ছিলেন বড়হয়ে উনিকি হতে চান? উত্তরে তিনি বলেছিলেন আমি বড় হয়ে মহাতœাগান্ধী হতে চাই। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে জীবনের অনেকটা সময়ই কেটেছে জেলখানায়। তিনি এত বড় মাপের নেতা ছিলেন যা ভাবতেই অবাক লাগে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকরতেগিয়েতৎকালিন অবিভক্ত ভারতেরবিভিন্ন জেলখানায়তিনিবন্দি থাকতেন। তাঁররাজনৈতিক গুরু ছিলেন সিরাজগঞ্জের কৃতিসন্তান গাজী এ বলকান সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী। মুলতঃ সিরাজীর আর্দশেই তিনি অনুপ্রানিত হয়েছিলেন। বিলাতি দ্রব্য বর্জন ও স্বদেশি আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি সিরাজগঞ্জ, পাবনা, জলপাইকুরি,আসাম,দিল্লি, কৃষ্ণনগর ও কলকাতার সেন্টাল জেলেবন্দি থাকতেন। মুলুতঃ জেলখানাতেই তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন শুরু হয়। জেলখানাতেই তিনি অবিভক্ত ভারতের বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের সাথে পরিচয় লাভ করেন।
তাঁর জেলজীবনের সঙ্গী ছিলেন বিশিষ্ট রাজনীতিক নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী,আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী, গায়ক আব্বাসউদ্দিন,কবি নজরুল ইসলাম,মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, চিত্তরঞ্জন দাস,খাজা নাজিমউদ্দিন সহ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তৎকালিন ব্রিটিশ সরকার কর্মবীর এম, সেরাজুল হককে বারবার জেলখানায় বন্দি রাখেন। কিন্তু হক সাহেব ব্রিটিশদের ভয়ে ঘরে বসে থাকতেন না। ব্রিটিশ সরকারও তাঁর ভয়ে সর্বদাই ভীত থাকত। তৎকালিন ব্রিটিশ সরকার ১৯৩২ সালে শেকসান ফোর অফ ইমারজেনসী অর্ডিন্যান্স জারি করে তাঁকে তাড়াশ উপজেলার নিজবাড়ী মোরশেদগুনা বর্তমান সেরাজপুর গ্রামে অবরুদ্ধ করে রাখেন। দীর্ঘ দিন বাড়ীতে গৃহবন্দি থাকার পরে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে তাকে মুক্তি দেন।
এম,সেরাজুল হক সারাজীবন অবহেলিত, শোষিত,নীপিরিত মানুষের জন্য সংগ্রাম করে এদেশের মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। অথচ নব প্রজন্মেও কাছে এটি একটি অচেনা নাম। এই মহান মানুষটির জীবন প্রদীপ নিভেযায় ১৯৬৩ সালের ১৫-ই নভেম্বর। এ বছর তাঁর ৬১ তম মৃত্যু বার্ষিকী। কর্মবীর এম, সেরাজুল হকের ৬১ তম মৃত্যু বার্ষিতে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আবারও জোর দাবী জানা”্ছ।ি অতিসত্বর তাঁর নামে তাঁরই চেষ্টার ফসল তাড়াশ- কাঁটাগাড়ী সড়কটি সেরাজুল হক সড়ক নামে নাম করন করা। তাড়াশ সদরে তাঁর নামে একটি সেরাজুল হক স¥ৃতি পাঠাগার, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সেরাজুল হক শিক্ষাবৃত্তি চালু করা। এতে নব প্রজন্মের কাছে তার আর্দশ চিন্তা-চেতনা পৌঁছে দেওয়া সহজ হবে দেশ সমাজ জাতি উপকৃত হবে আমরা হব ঋণ মুক্ত।
লেখক ঃ অধ্যাপক শফিউল হক বাবলু ,অধ্যাপক, তাড়াশ মহিলা ডিগ্রি কলেজ। সাংবাদিক ,দৈনিক মানবজমিন। সাবেক সাধারণ সম্পাদক, তাড়াশ প্রেসক্লাব ও সম্পাদক, সেরাজুল হক স্মৃতি পরিষদ।
মাওলানা সেরাজুল হক সেরাজী
সনজু কাদের
বিশিষ্ট সাহিত্যিক, সাংবাদিক ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা সেরাজুল হক সাহেবের জন্ম সোনার চামচ মুখে দিয়ে নয়। জন্মের পর পরই তিনি দেখেছিলেন শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের মুখ। এই দারিদ্র পীড়িত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যেই তিনি সারাটি জীবন নিজের সুখ চান নি। নিজেকে মোমবাতির ন্যায় দারিদ্রনালে প্রজ্জলিত করে সমাজকে আলোকিত করেছেন। বহুমুখি প্রতিভায় উজ্জ্বল চলনবিলের মহিয়সী পুরুষের জন্ম হয় তদানীন্তন অবিভক্ত ভারতের সিরাজগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত তাড়াশ থানার মোরশেদগুনা বর্তমান সেরাজপুর গ্রামে বাংলা ১৩০৯ সালের ১৫ই কার্তিক (ইং ১৯০৩ সালের ১লা নভেম্বর) তাং এক শুভ লগ্নে। তাঁর পিতার নাম মেছের উদ্দিন ও মাতার নাম সবজাহান নেছা।
বাল্যকাল থেকেই সেরাজুল হক অত্যন্ত মেধাবী হওয়ায় ভবিষ্যতে বড় কিছু হয়ে চেয়ারে বসবে বিধায় বাবা, মা সহ প্রতিবেশীরা তাকে আদর করে চেয়ার আলী বলে ডাকত। আর সে আশা নিয়েই বাবা মেছের আলী সাহেব সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের লোক হওয়ায় আরবী শিক্ষার পাশাপাশি ওয়াশিন প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করেন। পরবর্তীতে কাজিপুর প্রাইমারী স্কুল ও তাড়াশ সদর প্রাইমারী স্কুলে বালক সেরাজুলকে ভর্তি করা হয় এবং অত্র প্রাইমারী স্কুল থেকে মেধাবী সেরাজুল হক ১৯১৬ সালে পাবনা জেলা বোর্ডের বৃত্তি লাভ করেন।অতপর বালক সেরাজুলকে উল্লাপাড়া থানার তৎকালীন উল্লাপাড়া হাই ইংলিশ স্কুলে ভর্তি করা হয়। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান হিসেবে বাবা মার ইচ্ছা অনুযায়ী বালক সেরাজুল হককে ১৯২১ সালে উল্লাপাড়া থানার চৌবিলা মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্যে দিয়ে সেরাজুল হকের শিক্ষা জীবন শেষ হয়।
কর্মবীর সেরাজুল হক যখন মুক্ত বিহংগের মত দেশ ও জাতির ভাবনায় মশগুল ঠিক তখনই প্রকৃতির নিয়মে সংসারে স্থায়ী বন্ধন সৃষ্টির জন্য ভাড়াশ থানার অন্তর্গত লালুয়ামাঝিড়া গ্রামের বাহাদুর আলী সাহেবের ১ম কন্যা গুলজান নেছার সাথে বাংলা ১৩৩৩ সালে তাঁর শুভ পরিণয় ঘটে। ব্যক্তিগত জীবনে হক সাহেব ছিলেন ২ পুত্র ৫ কন্যার জনক। উল্লেখ্য, তাঁর জীবিত অবস্থায় ১ম পুত্র খালেদ ছাত্রাবস্থায় মারা যায়। পরবর্তীতে ২য় পুত্র মরহুম শামসুল হক পিতার উত্তরগুরী হিসেবে শিক্ষকতার পাশাপাশি সমাজ সংসারের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে হক সাহেবের ২ মেয়ে, ২ জামাতা সহ অসংখ্য নাতি-নাতনী জীবিত আছেন।
এই আজাদী সংগ্রামের বীর সৈনিক মুক্তি পাগল সেরাজুলকে সংসারের মায়া কিছুতেই যেন আটকিয়ে রাখতে পারেনি। তাই তো হক সাহেব মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে ঘরে বসে না থেকে তাঁর বড় জামাতা এম. মাহমুদুল হক এর নিকট অভাবী সংসারের দায়িত্বভার তুলে দিয়ে নির্ভাবনায় ছুটে বেড়িয়েছেন দেশ থেকে দেশান্তর। তাই তো ব্রিটিশ বেনিয়াদের হাত থেকে রক্ষা পাননি। জেল খাটতে হয়েছে বহুবার। ১৯২১ সালে কংগ্রেসে সদস্য পদের মধ্য দিয়ে হক সাহেবের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। তৎকালীন পাবনা জেলা বোর্ডের প্রচার বিভাগীয় সম্পাদক ছিলেন সেরাজুল হক। সুবক্তা ও সুলেখক হিসেবে অল্পদিনের মধ্যেই সেরাজুল হকের নাম ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৩০ সালে ২৮ আগস্ট হক সাহেবকে কারাবরণ করতে হয়। দরদী প্রাণ সেরাজুল হক ব্রিটিশদের বিভিন্ন লোভ লালসাকে উপেক্ষা করে মানব সেবায় ব্রতী হন। ফলে ইংরেজদের রোষানল থেকে তিনি মুক্তি পাননি। এরই জের ধরে ১৯৩২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সেরাজুল হককে নিজ বাড়ীতে গৃহবন্দি করা হয়। সেরাজুল হক ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের সদস্য হন এবং পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং ১৯৪৮ সালে পাবনা জেলা বোর্ডের নির্বাচনে তাড়াশ-রায়গঞ্জের পক্ষ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন। এই আজাদী সংগ্রামের বীর সৈনিক ব্রিটিশদের দ্বারা বিভিন্নভাবে কারাবরণ করলেও এই জেল খানাতেই তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের উন্নয়ন ঘটে। সে সময় শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, দেশ বন্ধু চিত্তরঞ্চন দাশ প্রমুখের সান্নিধ্য তিনি লাভ করেন।
সমাজ সেবার বহুমুখী প্রতিভায় উদ্ভাসিত হক সাহেব ছিলেন একজন আদর্শ সমাজকর্মী। তৎকালীন প্রচলিত সমাজের কুসংস্কারকে দূর করার জন্য তিনি সমাজের নানাবিধ কল্যাণকর কাজে অংশ নেন। তার উদ্যোগে চলনবিল তথা সারাদেশে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ঈদগাহ মাঠ, কবরস্থান, নৈশ্যবিদ্যালয় স্থাপিত হয়। তিনি নিজ হাতে কাজ করে বিভিন্ন রাস্তা, ব্রীজ, কালভার্ট নির্মাণে সহযোগিতা করেছেন। ১৯৩৭ সালে বিশিষ্ট সমাজকর্মী হিসেবে তৎকালীন সরকার সেরাজুল হককে গোল্ড মেডেল-এ ভূষিত করেন। পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে তাঁকে মাধাইনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়।
সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি সেরাজুল হক সাংবাদিকতায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। মুলতঃ সাহিত্য সাংবাদিকতায় ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। সাহিত্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধি করার জন্য তার অসংখ্য গ্রন্থ রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৮টি। এগুলো হলো- ১. সিরাজী চরিত ২. শেরেক ধ্বংস ঈমান রক্ষা ৩. পাকিস্তানের গজলগীতি ৪. টুটিল তিমির রাত্রি ৫. সুধার পেয়ালা ৬. কেতাবুল ঈমান ৭. আল্লাহর পানে ফিরে চাও ৮. অমর জীবন কাহিনী, উল্লেখিত বইগুলো ছাড়া তাঁর অপ্রকাশিত অসংখ্য প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা রয়েছে।
চলনবিলের সাংবাদিকতার পথিকৃত কর্মবীর সেরাজুল হক ছাত্রাবস্থায় লিখতেন। কলমের মাধ্যমে দেশ সেবাকেও তিনি বেছে নিয়েছিলেন। হক সাহেব বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় লিখতেন। তার মধ্যে দৈনিক ও সাপ্তাহিক কৃষক, নবযুগ, প্রজার কথা, নয়াজামানা, কৃষক-প্রজা, প্রজাবাহিনী, লাঙ্গল, ঘুমকেতু প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। উল্লেখ্য, তিনি শুধু সাংবাদিকই ছিলেন না তৎকালীন কলকাতা থেকে প্রকাশিত কৃষক ও লাঙ্গল পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হয়েছিলেন। মূলত: হক সাহেব ছিলেন বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী। ১৯৬৩ সালের ১৫ই নভেম্বর এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। রেখে যান প্রজন্মের জন্য অশেষ অনুপ্রেরণা।
লেখক: তাড়াশের বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক ও সমাজসেবী।
হক সাহেবের রাজনীতি : একাল ও সেকাল
আবদুর রাজ্জাক রাজু
এখানে হক সাহেব বলতে বাংলার ‘দ্বিতীয় বাঘ’ চলনবিলের অবিস্মরণীয় নেতা মরহুম মাওলানা সেরাজুল হক সাহেবকে বুঝানো হচ্ছে। তিনি ছিলেন চলনবিল তথা অবিভক্ত বাংলার এক সূর্য সন্তান। প্রথমটি ইতিহাস প্রসিদ্ধ, অবিভক্ত বাংলার অবিসংবাদিত জননেতা শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক। আর তাঁরই অনুজ সতীর্থ আমাদের আলোচ্য হক সাহেব শিরাজী’র মানসপুত্র, শুধু তাই নয় মহাত্মা গান্ধী থেকে বিপ্লবী কবি নজরুল ও গায়ক আব্বাস উদ্দিন পর্যন্ত বহু ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যপ্রাপ্ত এক মহান কর্মবীর বিপ্লবী স্মরণীয় বরণীয় বটে এই সর্বজন প্রদ্ধেয় মনীষী।
তাই শুরুতেই কিছু ব্যতিক্রমী সাদৃশ্য বা মিলের দিকে ইঙ্গিত করতে চাই এই ক্ষণজন্মা অনন্য প্রতিভার ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে। যেমন আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম। তিনি ছিলেন গোবরে পদ্মফুল, সীমার মাঝে অসীম ও সাধারণের মধ্যে বিকশিত অসাধারণ এক বিরল প্রতিভাধর, বিস্ময়কর, এমনকি সত্যি তুলনাবিহীন। অনুরূপ পরিবেশগত দিক থেকে মাওলানা সেরাজুল হক চলনবিলের এক নিভৃত পল্লীর দারিদ্র জর্জরিত, অখ্যাত, অশিক্ষা ও অন্ধকারাচ্ছন্ন আবর্ত থেকে উঠে আসা এক মলিন মাটির মানুষ অথচ বিশাল অনুপম অনন্য ধ্যানে-জ্ঞানে, গুণে ও কর্মে।
বড় কোন লেখাপড়া নেই, অভিজাত কোন বংশোদ্ভূত নয় এবং সোনার চামচ মুখে নিয়েও জন্মাননি তিনি। তথাপি তিনি তদানীন্তন অখন্ড বাংলায় কেবলি নয়, নিখিল ভারতের অসংখ্য জনপদে পদচারণা করে মজলুম জনতার স্বার্থে হয় সমাজ সংস্কার কর্ম অথবা মেহনতি জনতার ন্যায্য দাবী আদায়ের গণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে কিংবা সহযোগীতা করে ঘুরে বেড়িয়েছেন, ছুটেছেন দূর্বার দুরন্ত বৃটিশবিরোধী সংগ্রাম সংগঠিত বা গড়ে তোলার কাজে। জরাজীর্ণ ভাঙ্গা গ্রাম্য কুটির থেকে যেন ঐশ্বরিকভাবে আবির্ভূত এ-ও এক অবাক করা কীর্তিমান পুরুষ। তাই বলছিলাম, নজরুল অখ্যাত বিবর্ণ অবস্থা থেকে যেমনি চিরখ্যাতিমান তথা উজ্জল ভাস্বর হয়ে আছেন। পক্ষান্তরে হক সাহেবের পল্লী-প্রান্তর থেকে অমূল্য অবদান ও অক্ষয় কীর্তির স্বাক্ষর দীর্ঘকালীন দেদীপ্যম্যান। একজন কাব্য-সাহিত্যে, অন্যজন সমাজকর্ম এবং রাজনীতিতে এবং লেখালেখিতে তথা সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও বটে। মাওলানা সেরাজুল হকের আরো নিবিড় মিল খুঁজে পাওয়া যাবে বাংলার মজলুম জননেতা আর এক মাওলানা ভাসানীর সাথে। তিনিও সামান্য শিক্ষা ও গ্রামীণ কৃষ্টি-কালচার হতে উদিত বাংলার এক অনন্য সাধারণ রাজনৈতিক দিকপাল।
আমরা তাঁর সময়ের রাজনীতি চর্চ্চার একটি ধারা বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারি বিরাট কৃতিত্বের এই মহান নেতার জীবনাচরণ থেকে। একটা বিশেষ লক্ষণীয় যে, সে সময়ে রাজনীতিতে শিক্ষা-সংস্কৃতি যুক্ত ছিল, ছিল শালীনতা, নৈতিকতা ও সহিষ্ণুতা,ত্যাগ-উৎসর্গ, পারস্পারিক সম্মান ও সংবেদনশীলতা। আরো ছিল মানবতা-দেশপ্রেম এবং সর্বোপরি সেবা ও কল্যাণের মহতী ব্রত-আদর্শ। তখন চলছিল তেমনি ক্রান্তিকাল, যখন বৃটিশ ভারতে গান্ধীজীর অহিংস রাজনৈতিক চেতনা ও দর্শনের তরঙ্গ প্রবল প্রবাহমান। মানুষের অধিকার ও স্বাধিকার অর্জন, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও ন্যায় ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম ইত্যাকার তৎকালীন রাজনীতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মধ্যে নিহিত ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। হক সাহেবের জীবদ্দশায় তাঁর সাহচর্যে আসা অনেকে এখনো জীবিত। কিন্তু অদ্যাবধি তাঁকে উগ্র,গোঁড়ামীসূচক কোন দূষণমূলক আখ্যা বা অভিযোগে আক্রান্ত হতে শোনা যায়নি। দেখা যায়নি লেখালেখির কোন নিদর্শন বা প্রতিবেদনেও হীন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, কলুষিত হতে। তাঁর মত মুক্তচিন্তা ও উদার মানসিকতা তথা সত্যিকার আধুনিক প্রগতিশীল দৃষ্টিভংগির রাজনীতিক আজকে এই চলনবিলেই কেবল নয় সমগ্র দেশেই সন্ধান পাওয়া দুস্কর অথবা হতে পারে হাতে গোনা ক’জন। বৃটিশ উপনিবেশের সেই সামন্ত শাসনামলে রাজা-জমিদারগণ এই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বা পরগণায় এক ভয়াবহ লোমহর্ষক শোষণ পীড়ন ও নির্যাতন বঞ্চনার দোর্দন্ড রামরাজত্ব কায়েম করেছিল। অন্যায়-অবিচারের স্টিমরোলার চালিয়েছিল সমাজের প্রায় সর্বত্র বিশেষ করে দুর্বল ও দরিদ্র শ্রেণির উপর। এদের অনেকেই বা অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত জমিদার। তাদের সে দৌরাত্ম্য, নির্মমতা, বর্বরতা ও গণবিরোধী কার্যকলাপ ইতিহাসের কালো অধ্যায়ের অন্তর্ভূক্ত হয়ে অছে যা এখনো প্রবাদের মতো লোকমুখে শোনা যায়, দেখা মেলে পাঠ্য পুস্তকের পাতায়। এ সবের বিরুদ্ধে অবশ্য হক সাহেব সোচ্চার,উচ্চকন্ঠ ও দৃঢ় প্রতিবাদমুখর ছিলেন সদাসর্বদা। কিন্তু এমন প্রভাবশালী উঁচু স্তরের ক্ষমতাধর নেতৃত্বের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও হক সাহেব ধর্মের অপব্যবহার করে , সাম্প্রদায়িক অস্থির উম্মাদনার গোঁড়ামী আশ্রয়ে কোন অশোভনীয়, হিংসাত্মক ও হীন কার্যকলাপ রাজনৈতিকভাবে প্রশ্রয় দেননি। রাজনীতিতে সহমত-সহনশীলতা, সহিষ্ণুতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা অনুসরণেরও তিনি এক পথিকৃৎ। আজকের দিনের মত কালো টাকা ও পেশী শক্তিকে পুঁজি করে কলুষিত এবং দুর্বৃত্তায়িত হিংসা-হানাহানি ও প্রতিশোধের পলিটিক্স করার রীতিনীতি মনে হয় তাঁদের সময়ে ছিল কল্পনার বাইরে। কোন অবৈধ অস্ত্রের অস্তিত্ব সম্বল করে পেশী শক্তি র্নিভর এবং আত্মস্বার্থ সর্বস্ব রাজনৈতিক কালচার বা তৎপড়তা তাদের চিন্তা ও মনে-মননে ঠাঁই পায়নি কোন দিন। এখনকার দিনে রাজনৈতিক পক্ষ-প্রতিপক্ষের কুৎসা-কটুক্তি আক্রমন-প্রতিআক্রমণ ছাড়া আমাদের সমাজে নিত্য দিনের রাজনৈতিক অনুশীলনের দৃষ্টান্ত পাওয়া দুষ্কর। বিষোদ্বগার করাই যেন এখন পলিটিক্যাল কালচারের অঙ্গ। কে ফেরেশতা, কে শয়তান সেটাই প্রমাণের এবং পরস্পরকে জনতার মাঝে হেয় প্রতিপন্ন আর অপদস্থ করার প্রতিযোগীতা চলে প্রতিনিয়ত। সেখানে ন্যূনতম শিষ্টাচার,ভদ্রতা তথা মনুষ্যত্ব ও শালীনতা বির্বজিত। হক সাহেবের রাজনীতি করার মধ্যে আমরা তার গন্ধটুকুও টের পাই না, খুঁজে পাই না কোন অপরাজনীতি, দুর্বৃত্তায়ন। হতে পারে ইদানিংকার আর্থ-সামাজিক ও বিশ্ব প্রেক্ষাপট ভিন্ন তৎকালীন সমাজচিত্র অপেক্ষা। তাই বলে রাজনীতিতে ন্যূনতম রুচিবোধ ও স্বাভাবিক সৌজন্যতা এবং মৌলিক মানবিক গুণাবলি হারিয়ে যাবে তা মেনে নেয়া যায় না। উল্লেখ্য যে, মৌখিক হুমকিতো এখন নস্যি, বরঞ্চ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অর্থ-জীবন-সম্পদ বিনিয়োগ করে, প্রয়োজনে প্রাণে আঘাত করে পরপারে পাঠিয়ে দেয়ার মতো পাশবিক নির্মমতা আর নিষ্ঠুরতা যেন বর্তমানে স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এক দল তার প্রতিপক্ষ দলে ভাঙন ধরাবার হীন কূটচক্র আর রাজনীতিতে মাস্তানী ও সহিংসতা এখন প্রাত্যাহিক প্রধান খবর। এমনকি এ ধরনের অমানবিক হিং¯্র নৃশংসতা ও জিঘাংসার একটি বর্ণও হক সাহেবের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যে ও মানদন্ডে পাওয়া যাবে না। বর্তমানের এই নৈতিক বিচ্যুতি রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়ন না অবনতি সেটাই বিচার্য। অবশ্য আগেই বলেছি, সেকালের রাজনৈতিক দৃশ্যপট এবং একালের একই দিগন্তে সম্পূর্ণ আলাদা আবহাওয়া এবং পরিবেশ বিরাজমান। এই পরিবর্তনকে আমরা এক অর্থে বলতে পারি নেগেটিভ চেঞ্জ। যদিও যুগ এগিয়ে গেছে, যোগাযোগ তথ্য প্রযুক্তির প্রসার, এক কথায় বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতির সুবাদে মানুষ সেই মধ্যযুগীয় তিমিরাচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণার বেড়াজাল ছিন্ন করে এসেছে বিশ্বায়নের আলোকিত জগতে। তা সত্ত্বেও বিশেষত: উপমহাদেশের ক্ষুদ্রতম মানচিত্রের এই অল্প বয়সী দেশটিতে সম্প্রতি রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ঘটে চলেছে বিপরীত ঘটনা প্রবাহ যা সম্পূর্ণ সত্যকার সভ্যতার উৎকর্ষ ও উন্নয়নের পরিপন্থী। আমাদের এই অবনমন ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় তথা ধ্বস হক সাহেব বেঁচে থেকে স্বচক্ষে দেখলে হয়তো তিনি উচ্চ রক্তচাপে দিশেহারা হয়ে যেতেন। ফলে সাম্প্রতিক রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা বেড়েছে। এখন মানুষ রাজনীতিবিদদের বাটপার, টাউট, প্রতারক ও ধাপ্পাবাজ বলে অনেক ক্ষেত্রে মনে করে থাকে। ফলে হালে সুশীল সমাজ, সুশাসন, গণতন্ত্র, সাম্য, ন্যায় বিচার ও মানবাধিকারের কথা তথাকথিত রাজনীতিকদের শুধু মুখে শোনা যায়, বাস্তবে ক্ষমতা ও স্বার্থের ভন্ডামী ও নোংরামীর এমন নজির আগেকার দিনে ছিল বিরল।
এই হতাশাব্যাঞ্জক পটভূমিতে হক সাহেবের যুগের রাজনীতি সেবীদের অনান্য গুণ-বৈশিষ্ট্যের পর্যালোচনায় সামান্য যেতে চাই। সে সময়ে তিনি রাজনীতির পাশাপাশি করেছেন সাহিত্য-সংবাদ, সমাজকর্ম ,ধর্মীয় সংস্কারমূলক কর্মকান্ড বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা হিসেবে। হক সাহেব এ ব্যাপারে তাঁর শিক্ষা গুরু কবি ,লেখক, রাজনীতিক, দার্শনিক, সাহিত্যিক তথা বহুগুণবিশিষ্ট গাজীয়ে বলকান সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী কর্তৃক অনুপ্রাণিত ও দীক্ষিত ছিলেন। অর্থাৎ রাজনীতির সাথে সাথে অনান্য সুকোমল বৃত্তির শুদ্ধ অনুশীলন বা নান্দনিক চর্চার রেওয়াজ তখনকার দিনে বিদ্যমান ছিল তা প্রমাণিত। তাই তাঁর প্রণীত “অমর জীবন কাহিনী” অমরত্বের অনুসন্ধিৎসার প্রতি আগ্রহের পরিচয় বহন করে। তিনি আরো লিখেন সে যুগের অনবদ্য সাহিত্য সংযোজন ‘শিরাজী চরিত’ নামে বিখ্যাত জীবনী গ্রন্থ। মূলত এটা বাংলার দ্বিতীয় বিদ্রোহী কবি অমর প্রাণ পুরুষ সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজীর জীবন কাহিনি। আর সেই বিখ্যাত গ্রন্থ গবেষণা করে উল্লাপাড়া নিবাসী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক গোলাম সাকলায়েন সাহেব লাভ করেন পিএইচডি ডিগ্রি। চলনবিলের আর এক কৃতি সন্তান ও হক সাহেবের সুযোগ্য শিষ্য অধ্যক্ষ এম.এ.হামিদ রচনা করেন ‘কর্মবীর সেরাজুল হক’। এভাবে হক সাহেবের জীবন ও কর্ম কত বর্ণাঢ্য এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ তা বুঝা যায় সে বই থেকে। সে যুগের সেরাজুল হক এর যোগ্য আদর্শিক ভাবানুরাগী হিসেবে গড়ে ওঠেন অধ্যাপক এম.এ হামিদ ও তোফায়েল উদ্দিন সিদ্দিকী এবং এযুগের তাড়াশের সাংবাদিক রুহুল আমীন প্রমুখ সহ চলনবিলের এই নয়া প্রজন্মের কত না লেখক, সাংবাদিক,সাহিত্যিক,বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক,সমাজসেবী এবং উন্নয়ন কর্মী। পক্ষান্তরে আজকের রাজনীতিবিদদের সুযোগ্য উত্তররসূরী হচ্ছে ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ ‘গড ফাদার’ লেজুরবৃত্তি করা ছাত্র-শিক্ষক এবং তেলমারা তোষামোদী অনুগত তরুণ সমাজ। এক কথায় সভ্যতা ও মানবতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া অশুভ অপশক্তি। এই যে, দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত ও ভিন্নমূখী বৈসাদৃশ্যপূর্ণ ¯্রােতধারা যার একটা সুন্দর সুরুচীর দিকে ধাবিত অন্যটি মানববিধ্বংসী অভিশাপ, মিথ্যাচার ও পাপাচারের নামান্তর। এই ধরণের কুঝ্ঝটিকার কারণেই আমরা যেন হক সাহেবের মতো হিরা-মনি-মুক্তা তুল্য মানুষকে ভুলতে বসেছি। এখনকার নতুন প্রজন্মের প্রায় সবার কাছেই হক সাহেব আজো এক অজানা-অচেনা ব্যক্তিত্ব। তাঁকে চিনে জেনে অনুসরণ ও তাঁর নীতি- আদর্শ বাস্তবায়নের কোন ফলপ্রসু উপায় বোধ হয় আমরা বের করতে পারছি না। প্রবাদে আছে, যে জাতি গুণীজনের মর্যাদা দিতে জানে না সে জাতি কখনো বড় হতে পারে না।আর যেখানে গুণীর কদর নেই সেখানে গুণী জন্মায় না। এক্ষেত্রে আমাদের একটি অব্যাহত শুন্যতা বা দৈন্যতা থেকে যাচ্ছে বরাবরই। এখন গুণীদের জেনারেশন গ্যাপ চলছে। তাই ভবিষ্যত নাগরিকদের মধ্যে হক সাহেবের বহুমুখী জীবন ও কর্মকাহিনী তুলে ধরা অতি আবশ্যক তথা জরুরী। সেটা করতে ব্যর্থ হলে তা একদিকে যেমনি তার প্রতি যোগ্য সম্মান প্রদর্শন ও তাঁকে যথার্থ মূল্যায়নে আমাদের অক্ষমতার বা ব্যর্থতার সামিল। অপরদিকে তাঁর মতো মূল্যবান মানব সম্পদের কলাণকর নির্যাস গ্রহণ থেকে আমরা বঞ্চিত হয়ে জাতিগতভাবে পঙ্গুত্ব প্রাপ্তি ও পশ্চাদপদ থেকে যাবো।
মরহুম মাওলানা সেরাজুল হক স্মরণে বিগত বছরগুলোতে (প্রতি বছর ১৫ নভেম্বরে তাঁর ওফাত দিবস) প্রায়শঃ নিস্প্রাণ ও নিরানন্দ কর্মসূচীতে যেসব প্রস্তাব ও সুপারিশ উত্থাপিত হয়েছে তার কিছুই বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। সম্ভবতঃ এ দৈন্যতার দায়ভাগ পড়ে প্রধানতঃ তাড়াশবাসীর ওপর। যে অধ্যাপক এম.এ. হামিদ প্রতি বছর এই দিনে আমাদের অচেতন ঘুম ভাঙ্গিয়ে মাওলানাকে স্মরণ করতে স্বয়ং তাড়াশে এসে সবাইকে ডেকে ডেকে ঘুম ভাঙিয়ে জাগিয়ে তুলতেন, কয়েক বছর পূর্বে তিনিও আমাদের মাঝ থেকে বিদায় হয়ে চলে গেছেন। আমরা আজকের এই দিনে আমাদের ভাবাদর্শের প্রকৃত প্রতীক মরহুম এম সেরাজুল হকের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি মহান করুনাময়ের নিকট।
(পূর্বে “ধ্রুপদী” পত্রিকায় প্রকাশিত। ঈষৎ পরিবর্তীত ও সংশোধিত)
সেরাজুল হককে নিবেদিত কবিতা
সেরাজুল হক স্মরণে
সাইদুর রহমান সাজু
চলনবিলের প্রথিতযশা
সৈনিক সেরাজুল
তব জীবনের সকল মহিমায়
আজ মোরা মশগুল।
ঈঙ্গ-ফরাসীর ভয়াবহ ত্রাস
আপসহীন আন্দোলনে
তুমি জুলুমবাজদের ফন্দি গুড়িয়ে
জ্বালিয়েছ আগুন সিংহাসনে।
তুমি ব্রিটিশ বিরোধী অগ্নিপুরুষ
বঙ্গ-ভারতের মহা দুল দুল
তুমি বেনিয়াদের বুকে মেরেছ ছোবল
সেজে মহা ভীমরুল।
স্বাধীনতায় তুমি ছিলে অবিচল
তুচ্ছ জেনে সব প্রতিকূল
অনলবর্ষী জোস বাণী গেয়ে
শুধরালে সবার দিক ভুল।
তুমি সত্য সুন্দর ন্যায় পথে ছিলে
যেন উড়ন্ত বুলবুল
তুমি পরাধীনতার প্রাচীর ভেদিয়া
ফুটিয়ে গেছ লাল শিমুল।
ছিল না তোমার ভিন্ন ধারণা
ছিল না অবহেলা
মানুষ হয়ে মানুষের তরে
অবদান রেখেছ মেলা।
ছিলে সাংবাদিক ছিলে লেখক
ছিলে তুমি সমাজসেবী
তব পথ ধরে আজ মোরা সবে
করি সদা সেই দাবী।
সেদিন তোমাকে কেউ চিনে নি
চেষ্টাও করেনি চিনতে
কেবলি ওরা শিখেছিল সবে
স্বার্থের ফায়দা লুটতে।
বিপ্লবী চেরাগ আলী
সৈয়দ সাইদুর রহমান সাইদ (কবি রতœ)
দু’শ বছরের তমসা করতে দূর-
এপার বাংলা-ওপার বাংলায়
জ্বালিয়ে ছিলে সেদিন শত সহ¯্র কোটি
জনগণের মর্মে বিপ্লবী চেরাগ ।
আঁধারের বুক চিরে উদিত হয়েছিলো
নব-নতুন লাল ডগো-মগো ভবের ভানু
বেনীয়াদের বুকে দিয়েছিলে পুঁতে
অতি তপ্ত বজ্র লৌহ পেরাগ ।
ওরাও চক্রান্ত করে সেই সকালের সূর্যকে
ঢেকে দিয়েছিলো ঘন কুয়াশার চাঁদরে
পঁচিশ বছরের ঐ কুয়াশার চাঁদর
তোমার ভক্তরা পুড়িয়ে দিয়েছিল একাত্তরে।
এরপর বেনীয়া প্রেতাত্মারা তেপান্ন
বছর বরফ চাপায় ঢেকে রেখেছিলো
আলো ঝলমলে স্বচ্ছ শুভ্র বাংলার সূর্যকে
দু’হাজার চব্বিশে তোমার ভক্তরা জাগল সমস্বরে ।
চব্বিশের-পাঁচ আগষ্ট আর-একবার- তোমার
সমাধির আগ্নেয়গীরির-চেরাগ থেকে জ্বললো
আলো লক্ষ কোটি ছাত্র-জনতার মর্ম চেরাগে
বাংলার-সূর্যকে বরফ মুক্ত করল চেরাগালীদের চেরাগ ।
এই নব-সূর্য কি পারবে দ্যুতি ছড়াতে বাংলায়?
না-কি আগের দিনের মতই হয়ে যাবে নিঃষ্প্রভ?
ছাত্র-জনতা কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারবে
তাদের হিরক তুল্য দেশ প্রেমের অনুরাগ?
চেরাগ আলীর খ্যাতি
মোঃ জহুরুল হক
চলনবিলের অগ্রজ কবি সেরাজুল হক তাহার নাম
তাড়াশ থানায় জন্ম তাহার মোর্শেদগুণা গ্রাম।
সেরাজুল হক নাম ছিল বটে খেতাবে ‘কর্মবীর’
সমাজসেবায় খ্যাতিমান পুরুষ সত্যই মহাবীর।
‘চলনবিলের চেরাগ’ নামেও ছিল তাহারই খ্যাতি
সেযুগের সেই আঁধার সমাজে ছড়িয়ে ছিলেন জ্যোতি।
চলনবিলের সাহিত্য গগণে ছিলেন তিনি ধ্রুবতারা
তাহারই বিহনে সমাজসেবায় আজ হয়েছি দিশেহারা।
অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে করেছিলেন সংগ্রাম
বাংলা-ভারতে ছড়িয়ে পরেছিল জানি তাহারই সুনাম।
‘শিরেক ধ্বংস’, ‘ঈমান রক্ষায়’ সদা সর্বদা তৎপর যিনি
মুসলমানদের মাথার মুকুট সংস্কারকও ছিলেন তিনি ।
কাব্যগ্রন্থে লিখেছিলেন অনেক কবিতা ও গজল, বাণী
অনলবর্ষী বক্তাও ছিলেন জ্ঞানীদের কাছ থেকে জানি।
সাংবাদিকতার অগ্রনায়ক তিনি চির সত্যের প্রচারক
পত্রিকা পাঠে জানতো সে কথা এদেশের জ্ঞানীলোক ।
তাহার লেখা অমূল্য রতন পাঠ করি যে যখন
আবেশিত হই পাঠের মাঝে পুলকিত হয় মন।
‘সুধার পেয়ালা’ সাহিত্য সুধা পিপাসা মিটায় জানি
জীবনী গ্রন্থ ‘সিরাজী চরিত’ সুনাম দিয়েছিল আনি।
আজিকে মোদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা স্মরণীয় এই দিনে
তাহার আদর্শ বুকে করি লালন স্মৃতিময় প্রীতি ক্ষণে।
চির নিদ্রায় ঘুমিয়ে আছেন তিনি মোদের সে প্রিয়জন
স্বর্গীয় সুখ হয় যেন তার ¯্রষ্টা সকাশে করি নিবেদন।
আর একজন সেরাজুল হক কাম্য
আবদুর রাজ্জাক রাজু
আমাদের আর একজন
সেরাজুল হক দরকার
কবে পাবো দেখা তার ?
আমাদের আর একটা
সেরাজুল হক পাওয়া চাই
তানাহলে মুক্তি নাই।
আমাদের লাগবে পূনঃ
সেরাজুল হক উপহার
দূর হয় যেন এ সমাজের ক্যান্সার।
আমাদের আবার একটা
হক সাহেবের প্রয়োজন
পরিশুদ্ধ করতে মন-মনন।
আমাদের আরো দরকার
এমন চেরাগ আলী
যেন প্রকৃত জ্ঞানের আলো জ্বালি।
আমাদের দেশে জ্বলবে
কবে সেরাজের চেরাগ
মুছে যাবে অবক্ষয়ের দাগ।
আমাদের আর একজন
সেরাজুল হক কাম্য
যাতে সর্বত্র আসে সাম্য।
তাই আবারো থাকবো
একজন সেরাজুল হকের প্রতীক্ষায়
যেন নষ্ট এ সমাজকে বদলানো যায়।
তাড়াশের কবি-সাহিত্যিক -উপজিব্য যাদের চলনবিল
ড. মোঃ খায়রুজ্জামান মুননু
ছয়শত বছরের পুরোনো চলনবিল বয়সে ন্যূব্জ হলেও এখনও তা রুপে রসে ভরা যৌবনা। মাছের রাজ্য, ধানের ভান্ডার, রুপের রানী খ্যাত চলনবিল অপরকে দিয়েই শুধু শান্তি পায়, নিজের জন্য কিছুই রাখে না। যুগ যুগ ধরে দেয়া নেয়ার এই পালাবদলে তার এতোটুকু পরিবর্তন ঘটেনি। বরং নব সাজে সজ্জিত হয়ে সমৃদ্ধির সু-বাতাস ছড়িয়েছে সর্বত্র। শিশু চলনবিলের দুষ্টুমিতে যেমন ঘড়ছারা হয়েছে অনেকে, কুমারী চলনবিলের রুপ সৌন্দর্যে তেমনি আগমন ঘটেছে অনেক প্রকৃতি প্রেমীর। এ সকল প্রকৃতি প্রেমীরা চলনবিলকে উপজিব্য করে রচনা করেছেন কালজয়ী কাব্য, উপন্যাস, গল্প কথা। পনের শতকে সুফি সাধক শাহ শরীফ জিন্দানী (রঃ) এর আমন্ত্রণে চলনবিলে আসেন নন্দিত হিন্দি সাহিত্যিক মালিক মোহাম্মদ জায়সী ও মোল্লা দাউদ। মোল্লা দাউদ ছিলেন তত্ব রশিক সুফি অনুসারী কবি। তৎকালীন চলনবিলের রুপ বৈচিত্র্য, প্রেমাবেগ, জীবনাচারকে উপজিব্য করে তিনি রচনা করেন উল্লেখযোগ্য কাব্য “চান্দায়ন”। ভাবতে ভাল লাগে, পরবর্তিতে এদেশে (পাকিস্তান আমলে ) চান্দায়ন কাব্য অবলম্বনে “চান্দা” চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। চলনবিলের সুখ সমৃদ্ধি, সৌন্দর্য-সুষমায় আকৃষ্ট হয়ে এখানে স্থায়ী হযেছিলেন প্রেমগাঁথা কাব্যের প্রথম কবি মোস্তফা হাসেমী। তিনি চলনবিলের প্রমত্তা রুপের বর্ণনা তাঁর রচিত “শায়র” কাব্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। সুলতানী আমল থেকে শুরু করে জমিদারী শাসনামল পর্যন্ত চলনবিলে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন রাজ-রাজন্যবর্গ, রাজা-বাদশা, আমির ওমরা, শায়খ-ইমামজাদা, পীর মাশায়েখ, দরবেশ, মহারাজা ও জমিদারগণ। সুলতানী আমলে (১৫২৬) সুলতান নসরত শাহ এর পৃষ্ঠপোষকতায় “বেহুলা লক্ষিন্দর” গ্রন্থাকারে সম্পাদনার প্রয়াসে চলনবিল এর আনাচে কানাচে তথ্য সংগ্রহ করেন তৎকালীন লোক সাহিত্যিক দ্বিজ বংশি দাস।
চলনবিলকে নিয়ে যে বা যারা যতই লিখুক না কেন, চলনবিলে বসবাসকারী কাঁদা মাটি ঘনিষ্ট তাড়াশ থানার কবি বন্ধুদের মতো আন্তরিক লেখা খুঁজে পাওয়া যায় না। অর্থ প্রাচুর্যে সেরা না হলেও এখানকার মানুষ পুর্ব থেকেই জ্ঞান গড়িমায় শ্রেষ্ঠ ছিল। তাইতো তাড়াশের নিভৃত মোরশেদগুনা তথা সেরাজপুর গ্রামে বেড়ে ওঠা সাহিত্যিক সেরাজুল হক আগুন ঝরা বক্তব্য পেশ করেছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সামনে। একইভাবে দোবিলা গ্রামের স,ম আব্দুল জলিল প্রজাবর্গের পক্ষ অবলম্বন করে চলনবিল কেন্দ্রিক কাব্য রচনা করেছিলেন। তাড়াশের কাজিপুর গ্রামের সংগ্রামী কবি মমতাজ উদ্দিন সরকার “বৃটিশ খেদাও” আন্দোলনে “প্লাবনী” কাব্যগ্রন্থ রচনা করে সকল দায় নিজের মাথায় তুলে নিয়েছিলেন। আবার চলনবিলকে নিয়ে চমৎকার পুঁথি কবিতা রচনা করেন তাড়াশের সাহসী সাহিত্যিক আবদুর রাজ্জাক রাজু। পুঁথি সাহিত্যের জনক ফকীর গরিবুল্লাহ যদি বেঁচে থাকতেন, কম করে হলেও রাজু ভাইয়ের মাথায় তাঁর আশির্বাদের হাত পড়তো। কারণ ফকির গরীবুল্লাহ “গাজী কালু চম্পাবতী” পুঁথিখানি রচনা করেন চলনবিলের “কমলাপুরি” রাজ্যের অব্যক্ত ব্যথা বেদনার কাহিনী দিয়ে। কবি গুরু শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় এক যুগের বেশী সময় চলনবিলে চলাফেরা করেছেন। সে হিসেবে তিনি ছিলেন চলনবিলের মানুষ, আমাদের প্রতিবেশী। তাইতো রবী’দা চলনবিলকে নিয়ে লেখেন,
“বহু মানবের প্রেম দিয়ে ঢাকা
বহু দিবসের সুখে দুখে আঁকা
লক্ষ যুগের সংগীতে মাখা
সুন্দর ধরাতল——–”।
স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি চলনবিলকে উপজিব্য করে অনেক কবিতা, গান, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ইতিহাস রচনা করেছেন আমাদের তাড়াশ থানার শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক বন্ধুরা। যাদের কলমের ছোঁয়ায় চলনবিল ফিরে পেয়েছে তার হারানো ঐতিহ্য। তাড়াশের লেখক সাহিত্যিকগণ যারা চলনবিলকে নিয়ে বা উপজিব্য করে একক সাহিত্যকর্ম উপস্থাপন করেছেন সে সকল পুরোধা পুরুষগণের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এখানে তুলে ধরছি।
ক্রমিক
নং কবি-সাহিত্যিকগণের নাম ঠিকানা
প্রথম রচনা সময়কাল প্রকাশিত গ্রন্থের নাম
১. প্রয়াত মাওলানা এম, সেরাজুল হক মাধাইনগর, সেরাজপুর, তাড়াশ ১৯৫০ মোসলেম সমস্যা,সুধার পেয়ালা, সিরাজী চরিত, কেতাবুল ইমান
২. প্রয়াত আব্দুর রহমান বিনোদী মাগুড়াবিনোদ, তাড়াশ ১৯৬৪ পাকিস্তানের কথা
৩. প্রয়াত এম মমতাজ উদ্দিন সরকার কাজিপুর, তাড়াশ ১৯৬২ প্লাবনী
৪. প্রয়াত মুন্সী মোঃ সাফায়েত উল্লাহ কুসুম্বি, তাড়াশ ১৯৬৩ কর্মহারা
৫. প্রয়াত ফজলুর রহমান খাঁ বিনসারা, তাড়াশ ১৯৭৪ মনিহার, মুক্তির পথে(মোট ১৪ খানা)
৬. প্রয়াত ফসিউল আলম মালীপাড়া, তাড়াশ ২০০৮ গল্প নয় বাস্তব, দুই মনের কথা, বিরহ জীবন
৭. প্রয়াত ফজলার রহমান সাচানদিঘী, তাড়াশ ২০০৮ আলেয়া, দীনের দুনিয়া
৮. প্রয়াত এম রহমত উল্লাহ দোবিলা, তাড়াশ ২০১২ সামনের পৃথিবী, দুই জীবন
(মোট ২১টি)
৯. স ম আব্দুর জলিল দোবিলা, তাড়াশ বিলের নাম চলন,আমার প্রার্থনা,বেদে কাঁটা দিয়ার,কেমনে ভুলিব তোমারে,অপরূপ চলনবিল
১০. অধ্যাপক ড. হোসেন মনসুর চরকুশাবাড়ী, তাড়াশ ২০২১ মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য
১১. মোঃ সোলায়মান হোসেন দোবিলা, তাড়াশ ২০০৬ সেতু বন্ধন
১২. মোঃ আব্দুর রহমান মাহবুব মহিষলুটি, তাড়াশ ২০১২ বিসমিল্লাহ কবিতা সম্ভার
১৩. আবদুর রাজ্জাক রাজু আসানবাড়ী, তাড়াশ ২০১৫ প্রতিচ্ছবি, চলনবিল রতœ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় দিনগুলি, কোরআনের তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে কোরআনের ভাষ্য, সময়ের প্রতিধ্বনি
১৪. মুত্তালিব শিশির গুল্টা, তাড়াশ ২০১২ রঙ্গন
১৫. মফিজ উদ্দিন আহমেদ বৃ-পাচান, তাড়াশ ২০২৪ বড়গাঁয়ের কাব্য
১৬. স.ম. সাইফুল সাইফ চকজয়কৃষ্ণপুর, তাড়াশ ২০০৭ চলনবিলের সূফী সাধক
১৭. মোঃ জহুরুল হক লালুয়ামাঝিড়া, তাড়াশ ২০০৭ গ্রামের চিঠি
১৮. ফিরোজা বিউটি তাড়াশ সদর গ্রাম ২০২২ হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি, মেঘের পালক, মন তোমায় খোঁজে
১৯. ড.মোঃ খায়রুজ্জামান মুননুু নওগাঁ, তাড়াশ ২০১৯ হযরত শাহ শরীফ জিন্দানী (রঃ) জীবন ও কর্ম
২০. হোসনেয়ারা নাসরিন দোলা মাগুড়াবিনোদ, তাড়াশ ২০১৭ আর কতো তপস্যা
২১. এসএম সনজু কাদের সাচানদিঘী, তাড়াশ ২০০৫ নিরব ভালবাসা
২২. প্রকাশ কুমার জয় চর হামকুড়িয়া, তাড়াশ ২০০৮ প্রেম চিরকুমার
২৩. এস এম শিমুল নওগাঁ, তাড়াশ ২০১৭ ঐতিহাসিক নওগাঁ ও শাহ শরীফ জিন্দানী
২৪. মোঃ লিয়াকত আলী লেবু সোনাপাতিল, তাড়াশ ২০২১ জ্যোতি
২৫. এম,মনিরুল ইসলাম রুস্তম লস্করপাড়া, তালম, তাড়াশ ২০১১ রক্ত কনিকা
২৬. মোঃ সেলিম রেজা কাজিপুর,তাড়াশ ২০১২ বিজয়ের পথে
২৭. জর্জিয়াস মিলন রুবেল মাগুড়াবিনোদ, তাড়াশ ২০০৮ তাড়াশের ইতিহাস, প্রতিবাদের প্রথম কেতন,আর্ত, আজন্ম কৃতদাস, বর্ণ, আব্দুর রহমান বিনোদী জীবন ও কর্ম
২৮. মোঃ ছোরমান আলী নওগাঁ, তাড়াশ ২০১৮ শাহ শরীফ জিন্দানী ও নওগাঁ পরিচিতি
তাড়াশের এমন অনেক কবি সাহিত্যিক গন আছেন যারা একক গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেন নাই। অর্থাভাব, অনুকুল পরিবেশ, সদিচ্ছা প্রভৃতির কারনে একক ভাবে প্রকাশিত না হলেও যৌথ ভাবে অনেক গ্রন্থ সম্পাদিত হয়েছে। পনের /বিশ জন কবির সাহিত্যকর্ম একত্রে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত করন যৌথ গ্রন্থ প্রকাশের মুল ধারনা। এ ক্ষেত্রে একজন সম্পাদক থাকেন যিনি সম্পাদনার সার্বিক কাজটি করে থাকেন। আশির দশক থেকে চলনবিলাঞ্চলে যৌথগ্রন্থ সম্পাদনার প্রবনতা ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায়। এ ক্ষেত্রে তাড়াশের সনজু কাদের, অধ্যাপক মুত্তালিব শিশির, ফিরোজা বিউটি, ভাঙ্গুড়ার ময়দাদিঘী গ্রামের নুরুজ্জামান সবুজ, স্বাধীন মাহবুব, চাটমোহরের মনিরুজ্জামান আকাশ, পাবনার মানিক মজুমদার, উল্লাপাড়ার ডা: মোঃ সাইফুল ইসলাম, গুরুদাসপুরের মোহাম্মদ আজিজুল হক, সিংড়ার ডেইজি আহমেদ, ফরিদপুরের নুরুল ইসলাম বাবুল এবং রায়গঞ্জের স্বপন কুমার রায় অগ্রনী ভুমিকা পালন করেন। তাদের হাতে সম্পাদিত বিভিন্ন যৌথ গ্রন্থে তাড়াশের কবি বন্ধুরা মার্তৃভুমির টানে চলনবিলকে তুলে ধরেছেন বিন¤্র চিত্তে। তাড়াশের সেই সকল কবি বন্ধুরা যাদের পরিচয় ও গ্রন্থ পরিচিতি তুলে ধরা হলো।
ক্রঃ নাম পেশা ঠিকানা সময়কাল প্রকাশিত যৌথ গ্রন্থের নাম
১. ডা. এম এ সাত্তার ডাক্তার হামকুড়িয়া ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-৭৪
২. সাইদুর রহমান সাজু শিক্ষকতা বিনসারা ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-৩২
৩. টিপু সুলতান চাকুরী হামকুড়িয়া ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-৪০
৪. গোলাম কিবরিয়া উজ্জল শিক্ষকতা হামকুড়িয়া ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-৫৩
৫. জয়নুল আবেদীন সরকার ব্যবসায়ী তাড়াশ বাজার ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-৬৫
৬. মোঃ জাকির আকন শিক্ষকতা তাড়াশ বাজার ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-৬৬
৭. গোলাম মোস্তফা সাংবাদিকতা তাড়াশ বাজার ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-১৮১
৮. আছিয়া খাতুন রুমা গৃহিনী কুসুম্বি ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-৮০
৯. মোঃ সাইফুল ইসলাম ব্যবসা গৌড়িপুর ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-৮২
১০. সাবিনা ইয়াসমিন বিনু শিক্ষকতা তাড়াশ বাজার ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-৮৭
১১. গোপাল চন্দ্র ঘোষ ডাক্তার ঘড়গ্রাম ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-৯৮
১২. সাইদুর রহমান সাইদ ব্যবসা তাড়াশ বাজার ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-১০৮
১৩. নজরুল ইসলাম বাচ্চু জনপ্রতিনিধি হামকুড়িয়া ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-১১৬
১৪. নিলুফা ইয়াসমিন গৃহিনী ঘোষপাড়া ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-১৩৯
১৫. এসএম জাহাঙ্গীর জীবন ছাত্র পংরৌহালী ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-১৪৪
১৬. আমজাদুল হক মুন্নুু ব্যবসায়ী সেরাজপুর ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-১৫২
১৭ মোঃ আব্দুল লতিফ সাংবাদিকতা পাড়িল ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-১৬০
১৮. আইভি রহমান গৃহিনী বারুহাস ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-১৬২
১৯. মোঃ আজম আলী চাকুরী কালিদাসনিলী ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-১৬৪
২০. নিলুফা ইয়াসমিন ছাত্রী বারুহাস ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-১৬৬
২১. আব্দুল হান্নান নিপু ব্যবসা তাড়াশ ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-১৭১
২২. মোশারফ হোসেন মল্লিকী ব্যবসা তাড়াশ বাজার ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-১৭২
২৩. আসমা খাতুন গৃহিনী কাজিপুর ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-১৭৩
২৪. বিথী চাকুরী কাউরাইল ২০১৩ চলনবিলের কবি ও কবিতা পৃষ্ঠা-১৭৯
২৫. মোঃ জহির উদ্দিন চাকুরী বিষমডাঙ্গা ২০২২ চাঁদের হাট-পৃষ্টা-৬৯
২৬. প্রয়াত আজহারুল ইসলাম চাকুরী চরকুশাবাড়ী ২০০৬ ঝলক (সৃষ্টি সুখের উল্লাসে)পৃষ্টা-২৬
২৭. শিবানী সরকার বৃষ্টি গৃহিনী তাড়াশ ২০০৬ ঝলক (স্বাধনিতা কি এটাই)পৃষ্টা-৩৬
২৮. রেজাউল করিম ঝন্টু চাকুরী তাড়াশ ২০০৬ ঝলক (ইচ্ছে করে) পৃষ্টা-৩৭
২৯. খন্দকার সেলিম জাহাঙ্গীর উন্নয়ন কর্মী তাড়াশ ২০০৬ ঝলক (শেষ কোথায়)পৃষ্টা-৪৪
৩০. এম আতিকুর রহমান অধ্যাপনা তাড়াশ ২০০৬ ঝলক (মনে পরে)পৃষ্টা-৪৬
৩১. কে এম জাকি আজম চাকুরী তাড়াশ ২০০৬ ঝলক (বাংলার মা)পৃষ্টা-৫০
৩২. শহীদুল ইসলাম সুর্য অধ্যাপনা ধাপতেতুলিয়া ২০০৬ ঝলক (যমুনা সেতু)পৃষ্টা-৫০
৩৩ শামস ইয়াহিয়া সরকার অধ্যাপনা পেঙ্গুয়ারী ২০০৬ ঝলক (বৈশাখী তুমি)পৃষ্টা-৬১
৩৪. বিথীকা সান্যাল চাকুরী তাড়াশ ২০০৬ ঝলক (আমরা দুজনে ভাবি)পৃষ্টা-৬২
৩৫. আখতার হোসেন অধ্যাপনা দেওড়া ২০০৬ ঝলক (যুই)পৃষ্টা-৭৩
৩৬. মর্জিনা ইসলাম অধ্যাপনা তাড়াশ ২০১২ রঙ্গন (সমুদ্র সৈকত) পৃষ্টা-১৭
৩৭. ফেরদৌসি মৌরি ছাত্রী তাড়াশ ২০১২ রঙ্গন (আল্লাহর মত ইবাদত)পৃষ্টা-৩২
৩৮. কাইউম কবির ব্যবসা তাড়াশ ২০১২ রঙ্গন (মিস কল) পৃষ্টা-৪৭
তাড়াশের কবি বন্ধুরা একক গ্রন্থে যেমনিভাবে চলনবিলকে পাঠক সমাজে ব্যাপকভাবে তুলে ধরেছেন, একইভাবে যৌথ গ্রন্থেও সমানভাবে চলনবিলের রুপ রহস্য ফুটিয়ে তুলেছেন তাদের আন্তরিকতা ও ভালবাসা দিয়ে। কবি বন্ধুদের প্রতিটি লেখনি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারা একান্তই নিজেদের মতো করে চলনবিলের কাব্যিক বর্ননা দিয়েছেন।তাতে সাহিত্যের ছোঁয়া কতটুকু সেদিকের তোয়াক্কা করেন নি। বাক্য বিন্যাস, শব্দ চয়ন, উপস্থাপন রীতি একেবারেই সাদামাটা যা আলাদা নান্দনিকতার বৈশিষ্ট্য বহন করে। ভালবাসার টানে মাতৃভুমির প্রতি দায়বদ্ধতার এই যে দৃষ্টান্ত তা হরহামেশা খুঁজে পাওয়া যায় না। চলনবিলের মাটির সাথে মানুষের বন্ধন গড়ে তোলা সেই সব পেছনের কারিগরেরা – আমার তাড়াশের কবি-লেখক বন্ধুরা। বাস্তবিকই যাদের লেখালেখির প্রধান উপজীব্য চলনবিল।
লেখক ঃড.মোঃ খায়রুজ্জামান মুননু।পরিচালক,বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়,নওগাঁ,তাড়াশ,সিরাজগঞ্জ।ফোন ঃ ০১৭৫৭-৬৪৯৬১৯
উত্তরবঙ্গে উপদেষ্টার দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ
ডেস্ক রিপোর্ট ঃ অন্তবর্তী সরকারে উত্তরাঞ্চল থেকে উপদেষ্টা নিয়োগের দাবিতে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে রংপুরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ জনতা। গত বুধবার (১৩ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ১১টার দিকে রংপুরের লালবাগের সামনে শিক্ষার্থীরা জড়ো হন । সেখান থেকে তারা মিছিল নিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে রংপুরের মডার্ন মোড়ে দুপুর ২টা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় সড়কের দুই পাশে প্রায় ৪ কিলোমিটার রাস্তায়য় যানজটের সৃষ্টি হয়।
এ সময় সেখানে বক্তব্য দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রংপুরের অন্যতম সমন্বয়ক ইমরান আহমেদ, আশফাক আহমেদ, নাহিদ হাসান খন্দকার, ইমতিয়াজ আহমেদ, ইয়াসির আরাফাত প্রমুখ।বক্তারা অভিযোগ করেন, অন্তর্বর্তী সরকার রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের সঙ্গে বৈষম্য করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের ১৩ জন চট্টগ্রাম বিভাগের হলেও উত্তরাঞ্চল থেকে কাউকে নেওয়া হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার এভাবে চললে আঞ্চলিক বৈষম্য আরো বাড়বে। সূত্রঃ কালের কণ্ঠ ।
সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে তিন শূন্যের ধারণা – ড. ইউনূস
ডেস্ক রিপোর্ট ঃ জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে তিন শূন্যের ধারণা বিশ্ব নেতাদের সামনে তুলে ধরেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, মানব সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে হলে গ্রহণ করতে হবে ভিন্ন জীবনধারা। গড়ে তুলতে হবে ভিন্ন সংস্কৃতি। সেটা হতে পারে তার দীর্ঘদিনের লালিত ‘থ্রি জিরো’ বা ‘তিন শূন্য’ ধারণা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। গত বুধবার আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৯) বিশ্বনেতাদের সামনে এ ধারণা তুলে ধরেন তিনি।
ওয়ার্ল্ড লিডারস ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, প্রতিটি তরুণ এই তিন শূন্যের নীতি নিয়ে বেড়ে উঠবে- শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ, সম্পদের শূন্য পুঞ্জিভূতকরণ ও শূন্য বেকারত্ব। সেটা সম্ভব হবে কেবল সামাজিক ব্যবসা গড়ে তোলার মাধ্যমে। প্রতিটি মানুষ এই তিন শূন্যের নীতি নিয়ে বেড়ে উঠবে। সেই পথ ধরেই নতুন সভ্যতা গড়ে উঠবে। সূত্রঃ মানবজমিন।
তাড়াশে আজ ব্রিটিশ বিরোধী নেতা এম. সেরাজুল হকের স্মরণ সভা
স্টাফ রপোর্টার ঃ সিরাজগঞ্জের তাড়াশের কালজয়ী অকুতোভয় রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সমাজসেবক, ধর্ম সংস্কারক ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামী, বিদ্রোহী ও বিপ্লবী বাগ্মী জননেতা মাওলানা সেরাজুল হকের ৬১ তম মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণে তাড়াশ প্রেস ক্লাবের সামনে বাজারের মুক্ত মঞ্চে আজ ১৫ নভেম্বর বিকাল ৩টায় এক আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। স্থানীয় সেরাজুল হক স্মৃতি পরিষদ এর উদ্যোক্তা বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, ১৯০৩ সালের ১ নভেম্বর তাড়াশের সেরাজপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করে ১৯৬৩ সালের ১৫ নভেম্বর এই মনীষী ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে সৃষ্ট শূন্যতা কোনোদিন পূরণ হবার নয় তা প্রায় জোড় দিয়েই বলা যায়। বিশেষ স্মরণযোগ্য যে, এম. সেরাজুল হক শুধু স্থানীয় বা আঞ্চলিক পর্যায়ের নেতা নন, তিনি তদানীন্তন অবিভক্ত ভারতবর্ষের সর্বভারতীয় নেতৃত্বের আসনে উপনীত হন। তাঁর রাজনীতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, তা একান্ত গণমুখি, ব্রিটিশ কর্তৃত্ববাদ বিরোধী, সমাজের সেবা ও কল্যাণধর্মী, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার র্চ্চাশীলতা এবং ধর্মীয় সংস্কার প্রচেষ্টা ইত্যাকার বহুমাত্রিক গুণীজন তিনি। তাঁর মহান জীবন ও কর্ম থেকে আধুনিক প্রজন্ম অনেক কিছু শিখতে পারে।
তাড়াশে দলিল লেখক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মানববন্ধন
বিশেষ প্রতিনিধিঃ দলিল লেখকদের দুই যুগের সিন্ডিকেটের জিম্মিদশা থেকে মুক্তির দাবিতে বুধবার বেলা ১১ টার দিকে মানববন্ধন হয়েছে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ প্রেসক্লাব চত্বরে। মানববন্ধন শেষে জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম বরাবর স্বারকলিপি দেওয়া হয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুইচিং মং মারমার মাধ্যমে।
গোলাম মোস্তফা নামে একজন স্থানীয় সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী জনস্বার্থে এ মানববন্ধন আহ্বান করেন। এতে অংশ নেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ সাধারন লোকজন।এদিকে মানববন্ধন শুরুর আগে মানববন্ধনের মাইক ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেন দলিল লেখক সমিতির আহ্বায়ক ও সেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক শাহাদত হোসেন। মানববন্ধনে বক্তব্য দেন তাড়াশ পৌর বিএনপির সদস্য সচিব আব্দুল বারিক খন্দকার, পৌর জামায়াতে ইসলামের সভাপতি কাওছার আহমেদ, ইসলামী যুব আন্দোলনের সভাপতি মাহবুবুর রহমান, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক নীরব খান, চলনবিল উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মো. এম এ সাত্তার বিলচলনী প্রমূখ। বক্তারা বলেন, ভূমি রেজিস্ট্রেশন আইন ২০২৪ না মানার কারণে কবলা দলিলে প্রতি লাখে ছয় হাজার পাঁচশ টাকার স্থলে বিশ হাজার টাকা পর্যন্ত গুণতে হয় ভূমি ক্রেতাদের। দানপত্র দলিলে দিতে হয় দুই হাজার টাকার স্থলে চৌদ্দ হাজার টাকা। বিশেষ করে ৫ জুলাইয়ের পরে সিন্ডিকেটের হাতবদল হয়ে যায়। উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক জহুরুল ইসলাম ও সেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক সাহাদত হোসেন আহ্বায়ক কমিটি করে সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করেন। স্বাগত বক্তব্যে সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী গোলাম মোস্তফা বলেন, সাংবাদিকদের লেখায় দলিল লেখক সমিতির সভাপতি কামারুজ্জামানকে শোকজ করেছেন সিরাজগঞ্জ জেলা রেজিস্টার। তারপর তাড়াশ দলিল লেখক সমিতি ভেঙে দিতে বাধ্য হন সভাপতি কামারুজ্জামান। বক্তারা আরো বলেন, ভূমি ক্রেতাদের জিম্মি করে অনুরূপভাবে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন তাড়াশ দলিল লেখক অফিসের আহ্বায়ক কমিটি। ভূমি রেজিস্ট্রেশনের টাকা নিয়ে কোনো রশিদ দেওয়া হয়না ভূমি ক্রেতাদের। তাড়াশ দলিল লেখক অফিসের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি। বিধি মোতাবেক অভিযুক্তদের বিরুদ্দে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তুলছি।
তাড়াশ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সাব-রেজিস্ট্রার আব্দুর রহমান বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুর পরে অফিসে আসেন কথা বলবো। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সুইচিং মং মারমা বলেন, সাব-রেজিস্ট্রার আব্দুর রহমানের সাথে কথা বলবো সিন্ডিকেট ভাঙার বিষয়ে। এ প্রসঙ্গে সিরাজগঞ্জ জেলা রেজিস্টার শরীফ তোরাব হোসেন বলেন, তাড়াশ দলিল লেখক অফিসের খোঁজ খবর জেনে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা
তাড়াশের ভাইস চেয়ারম্যান গ্রেফতার হলো ঢাকা
স্টাফ রিপোর্টার ঃ সিরাজগঞ্জের তাড়াশে বিএনপি মনোনিত সংসদ সদস্য প্রার্থীর গাড়ি বহরে হামলা করে তাকে হত্যা চেষ্টা ও নাশকতা মামলায় তাড়াশ উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মোঃ আনোয়ার হোসেন খাঁনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
গত সোমবার বিকেলে ঢাকা সাভারের একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত আনোয়ার হোসেন খানঁ তাড়াশ পৈর শহরের খান পাড়া এলাকার বাসিন্দা।জানা গেছে, ২০১৮ সালে ১১ সেপ্টেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনিত প্রার্থী ও সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নান তালুকদারের নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালে বারুহাস ইউনিয়নের বিনোদপুর বাজারে তার গাড়ি বহরে হামলা, ভাঙচুর ও তাকে হত্যা চেষ্টা করা হয়। এ মর্মে গত ১১ সেপ্টেম্বর বারুহাস ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি অসাদুজ্জামান বাদী হয়ে তাড়াশ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় তিনি ৭ নং নামীয় আসামী থাকায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়াও অন্য একটি নাশকতা মামলায় তিনি ১০ নং নামীয় আসামী
তাড়াশে পকুর খননের মহামারী জলাবদ্ধতায় কৃষক দিশেহারা
গোলাম মোস্তফা, বিশেষ প্রতিনিধিঃ ভূমি ব্যবস্থাপনা নীতিমালার তোয়াক্কা না করে উর্বর কৃষি জমিতে যত্রত্রত পুকুর খনন করা হয়েছে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায়। মৎস্য অফিসের দেওয়া তথ্য মতে চার হাজার দুইশ পুকুর রয়েছে। বিশেষ করে, পুকুর খননের ফলে পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে গেছে। কয়েক হাজার বিঘা আবাদযোগ্য জমি এখন জলাবদ্ধ। এদিকে কৃষি অফিসের তথ্য মোতাবেক চৌদ্দ হাজার নয়শ চল্লিশ বিঘা কৃষি জমিতে পুকুর খনন করা হয়েছে। খাদ্য উৎপাদন কমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনকহারে।
বৃহস্পতিবার দেখা গেছে, মাধাইনগর ইউনিয়নের সরাপপুর গ্রাম, ঝুরঝুরি গ্রাম ও তাড়াশ সদর ইউনিয়নের বোয়ালিয়া গ্রামের বিস্তীর্ণ মাঠের কৃষি জমিতে পানি আটকে আছে। ঘাসে ভরে গেছে জমিগুলো।কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, পুকুর বাড়ছে। কিন্তু একদশকে কৃষি জমি কমেছে চৌদ্দ হাজার নয়শ চল্লিশ বিঘা। বিশেষ করে ধান উৎপাদন আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে।এ প্রসঙ্গে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, কৃষি জমিতে জলাবদ্ধতার বিষয়টি আমি দেখব।
তাড়াশে ভাড়ায় চলে ঈদগাহ মাঠ
বিশেষ প্রতিনিধিঃ সিরাজগঞ্জের তাড়াশে কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠের মিনারের মধ্যে বসে গাছের চারা বিক্রি করছেন ফরিদুল ইসলাম ওরফে ফটিক নামে একজন ব্যবসায়ী। তাকে মিনার ভাড়া দিয়েছেন তাড়াশ বাজারের ইজারাদার ও খাজনা আদায়কারী আব্দুস সালাম।এদিকে ইজারাদার আব্দুস সালাম বলেন, আমার বিরুদ্ধে মিনার ভাড়া দেওয়ার অভিযোগ সত্য নয়। আমি শুধু প্রতিদিন ২০ টাকা খাজনা আদায় করি।
সরেজমিনে গতকাল শনিবার সকালে দেখা গেছে, ঈদগাহ মাঠের মিনারের ভেতরে রীতিমত চৌকি পেতে বসেছেন ফরিদুল ইসলাম ওরফে ফটিক নামের ঐ গাছের চারার ব্যবসায়ী। মিনারের ভেতরেই খানাপিনা করেন, মিনারের ভেতরেই চলে ধূমপান ও লোকজন নিয়ে আড্ডা। গাছের চারার ব্যবসায়ী ফরিদুল ইসলাম ওরফে ফটিক বলেন, আমার এত সাহস নাই ঈদগাহ মাঠের মিনারে বসে ব্যবসা করার। আমাকে ইজারাদার বসিয়ে দিয়েছেন।তাড়াশ পৌর শহরের বাসিন্দা ও তাড়াশ পৌর বিএনপির সদস্য সচিব মো. আব্দুল বারিক খন্দকার বলেন, ঈদগাহ মাঠে ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। ফলে ঈদগাহর সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে ও পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও পৌর প্রশাসক খালিদ হাসান বলেন, কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠ থেকে ব্যবসায়ীদের সরিয়ে দেওয়া হবে।
চলনবিলে শামুক নিধন পরিবেশ ধ্বংস
স্টাফ রিপোর্টার ঃ চলনবিলে বর্ষা মৌসুমে শামুক নিধন করা হয় অবাধে। বিগত চার বছর ধরে চলছে এই প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস যজ্ঞ। বেচা-কেনায় কোনো বাধা না থাকায় রীতিমতো শামুকের হাট বসিয়েছেন নিধনকারীরা। এদিকে শামুক নিধনের ফলে জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়েছে। এ বছর বড় শামুক ও ঝিনুেেকর দেখা মিলছেনা চলনবিলে।
জীববৈচিত্র হল প্রাকৃতিক সম্পদ। সুস্থ-সন্দরভাবে জীবনধারণের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা অপরিহার্য। এ জন্য সরকারিভাবে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়াতে করতে হবে। সরেজমিনে দেখা গেছে, চলনবিল অধ্যূষিত তাড়াশ উপজেলার তাড়াশ-গুরুদাসপুর মৈত্রী সড়কের খালের পাশে কামারশন গ্রাম ও মাকরশন গ্রাম এলাকার দুইটি স্থানে শামুক বেচাকেনা চলছে। লোকজন শ্যালো মেশিনের নৌকায় করে শামুক নিয়ে এসেছেন বেচার জন্য। চলনবিলের শামুক হাঁসের খাদ্য হিসাবে সারাদেশে বিক্রি হচ্ছে। অপরদিকে তাড়াশ ডিগ্রি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক মর্জিনা ইসলাম বলেন, চলনবিল থেকে অতিমাত্রায় শামুক নিধন করা হচ্ছে। এর বিরুপ প্রভাব পড়বে কৃষিতে। শামুক নিধনের ফলে মাটির ক্যালসিয়াম কমে যাবে। ফসলহানির সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া মাছসহ অনেক জলজপ্রাণি বেঁচে থাকে শামুক খেয়ে।এ প্রসঙ্গে তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, শামুক নিধনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
তাড়াশ চলনবিলে সোঁতি বাঁধ ব্যাপক চাষাবাদ ব্যাহতের আশঙ্কা
গোলাম মোস্তফা, তাড়াশ ঃ চলনবিলে এ বছর সোঁতি জালের ছড়াছড়ি। সোঁতির বাঁধ স্থাপন করে পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। সোঁতি জালে নিধন হচ্ছে মা মাছ ও পোনা মাছসহ সকল জলজপ্রাণী।এদিকে বিলের উজানের পানি সোঁতি বাঁধে আটকে প্রায় দেড় হাত উঁচুতে রয়েছে। দ্রুত সোঁতি বাঁধ অপসারণ করা না হলে রবিশস্য আবাদ করা সম্ভব হবেনা বলে মনে করছেন চলনবিলের কৃষক।
চলনবিল অধ্যূষিত তাড়াশ উপজেলার সগুনা ইউনিয়নের কুন্দইল গ্রামের নুরুল ইসলাম ও মোয়াজ্জেম হোসেন নামে দুইজন কৃষক বলেন, কাটা গাঙ, সাইট খাল ও ভদ্রাবতী নদীতে ৭টি সোঁতি দেওয়া রয়েছে। এসব সোঁতির বাঁধ স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্থ করছে। দেড় হাত পর্যন্ত উঁচু-নিচু হয়ে আছে বিলের উজান-ভাটির পানি। বিশেষ করে চলনবিলের তাড়াশ অংশের পানি কাটা গাঙ ও সাইট খাল ছাড়া অন্য কোনো দিকে নামার সুযোগ নাই। সোঁতিগুলোর বাঁধ অপসরণ করা জরুরি। পানি প্রবাহ বাধামুক্ত থাকলে কুন্দইল, ভেটুয়া, সগুনা ও রুহাই গ্রামের বিস্তীর্ণ মাঠে আটকে থাকা অল্প পানি দুই থেকে তিন দিনে নেমে যাবে। পনের থেকে বিশ দিনের মধ্যে সরিষার আবাদ করা যাবে। দেড়িতে সরিষার ফলন ভালো হয়না। সরিষা তুলে বোরো ধানের আবাদ করতে দেড়ি হয়ে যায়। বোরোর ফলেনও বিরূপ প্রভাব পড়ে।উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, চলতি রবিসশ্য মৌসুমে এগাড় হাজার তিনশ বিশ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। সোঁতি বাঁধে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে ভেস্তে যেতে পারে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মসগুল আজাদ বলেন, ইউএনও স্যারের সাথে কথা হয়েছে সোঁতি বাঁধ অপসারণ ও সোঁতি জাল উচ্ছেদ বিষয়ে। এ প্রসঙ্গে তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) খালিদ হাসানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অভিযান পরিচালনা করার জন্
তাড়াশে চলনবিল উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের কমিটি গঠন
তাড়াশ প্রতিনিধিঃ তাড়াশে চলনবিল উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়েছে। চলনবিলের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় ভূমিকা রাখাই মূল লক্ষ্য এ কমিটির। এগার সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম আব্দুর রাজ্জাক সভাপতি ও ড. খায়রুজ্জামান মুননুকে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করা হয়।
গত রবিবার বিকালে এসো দেশ গড়ি অফিসে চলনবিল উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্টাতা সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. এম এ সাত্তার বিলচলনী উপস্থিত থেকে পারস্পারিক মতামতের ভিত্তিতে চলনবিল উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়।
চলনবিলে অবাধে পাখি নিধন কর্তৃপক্ষের নজর নেই
বিশেষ প্রতিনিধিঃ হালকা শীতের আমেজে অতিথি পাখি আসতে শুরু করেছে চলনবিলে। কিন্তু বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের নূন্যতম প্রয়োগ না থাকায় পাখি শিকারিদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে শীতের শুরুতেই। পাখি শিকারিরা দিনে ও রাতে অবাধে অতিথি পাখি নিধন করে চলেছেন।
এদিকে চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটির তাড়াশ উপজেলা শাখার আহ্বায়ক আব্দুর রাজ্জাক রাজু বলেন, পাখি শিকার করে ও শিকারিদের কাছ থেকে পাখি কিনে অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করেন অন্যদের দেখানোর জন্য। এতে বুঝা যায় ‘ পাখি শিকার করা দন্ডনীয় অপরাধ, শিকারি বা ক্রেতাদের এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র ভীতি নাই। চলনবিলের পাখি বাঁচাতে আইন প্রয়োগের পাশাপশি লোকজনের মধ্যে ব্যপকহারে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। ’ স্থানীয় স্বাধীন জীবন নামে একটি জীব বৈচিত্র প্রকৃতি সংরক্ষণ কাজের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক নাছিম বলেন, অতিথি পাখি নিধন বন্ধে সচেতনতা বাড়াতে হবে। তাছাড়া শিকারিদের ফাঁদ থেকে চলনবিলের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়া অতিথি পাখি রক্ষা করা সম্ভব নয়। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি লোকজনের সচেতনতার জন্য তিনি চলনবিল অধ্যূষিত তাড়াশ উপজেলার আটটি ইউনিয়নে মাইকিং করার পরামর্শ দেন। উপজেলা বন কর্মকর্তা কামরুজ্জামান বলেন, বেশীরভাগ শিকারি রাতে পাখি শিকার করেন। বিশাল চলনবিলের মধ্যে তাদের খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তবে সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, পাখি শিকারিদের অবস্থান জানা গেলে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অনুযায়ী অভিযান পরিচালনা করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে রাজশাহী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এস. এম. সাজ্জাদ বলেন, তাড়াশ উপজেলা প্রশাসনের সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনে যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে পাখি শিকারিদের আইনের আওতায় আনা হবে।
তাড়াশ-খালকুলা সড়ক জন চলাচলে ভোগান্তি
গোলাম মোস্তফা , বিশেষ প্রতিনিধিঃ সিরাজগঞ্জের তাড়াশে সড়ক ও জনপদ (সওজ) বিভাগের খালকুলা সড়ক খানাখন্দে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে তাড়াশ পৌর শহরের মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন থেকে খুটিগাছা মোড় পর্যন্ত একেবারে বিধ্বস্ত অবস্থা। এদিকে স্থানীয়দের অভিযোগ, উপজেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। কিন্তু সঠিকভাবে সংস্কার করা হয়নি কখনো।
সরেজমিনে বৃহস্পতিবার দেখা যায়, খালকুলা সড়কের অধিকাংশ স্থানে কার্পেটিং উঠে গেছে। ছোট-বড় অসংখ্য গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি হলে গর্তের মধ্যে পানি বেঁধে থাকে। এ সড়ক দিয়ে বাস, ট্রাকসহ সব যানবাহন চলছে ঝুঁকি নিয়ে। কেনো-কোনো যানবাহন গর্ত এড়িয়ে সড়কের পাশের ফাঁকা জায়গা দিয়ে চলাচল করছে।
ভোরের আলো বাসের চালক মন্টু হোসেন বলেন, এ বাসটি প্রতিদিন গুল্টা বাজার থেকে তাড়াশ ও মহিষলুটি হয়ে সিরাজগঞ্জ চলাচল করে। কিন্তু খালকুলা সড়কের ভাঙাচোরার কারণে খুব ধীর গতিতে গাড়ি চালাতে হয়। যাত্রীদের সময় মতো গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারিনা। জানা গেছে, তাড়াশ থেকে মহিষলুটি হয়ে ঢাকা, রাজশাহীসহ সারা বাংলাদেশে যাতায়াতের একমাত্র সড়ক হলো খালকুলা সড়ক। খালকুলা সড়ক দিয়ে সারা দিন ও রাতভর বহু যানবাহন চলাচল করে।
তাড়াশ জিকেএস হাসপাতালের পরিচালক ও সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির উপদেষ্টা খন্দকার মো. সেলিম জাহাঙ্গীর বলেন, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনের পাশে জিকেএস হাসপাতাল। এ হাসপাতালের সামনে সওজ বিভাগের সম্পূর্ণ সড়কের কার্পেটিং উঠে গেছে। চলাচলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে রোগীদের।এ প্রসঙ্গে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইমরান ফারহান বলেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ছয় কিলোমিটার খালকুলা সড়কের গর্ত ও ভাঙাচোরা সংস্কার করে নির্বিঘেœ চলাচল নিশ্চিত করা হবে।
তাড়াশের গ্রামাঞ্চলে হ্রাস পাচ্ছে দেশি মুরগি পালন
বশেষ প্রতিনিধিঃ সিরাজগঞ্জের তাড়াশে গ্রামীণ জনপদের গৃহস্থ বাড়িতে দেশি জাতের মুরগি পালন কমেছে আঙ্কাজনকহারে। এক সময় প্রতিটি গ্রামের বাড়িতে-বাড়িতে দেশি মুরগি পালন করা হতো। এখন অধিকাংশ বাড়িতে জনপ্রিয় এ মুরগি দেখতে পাওয়া যায়না।এদিকে দেশি মুরগির মাংসের স্বাদ ও পুষ্টির জন্য এক শ্রেণির ক্রেতা বাজারে দেশি মুরগি খুঁজে বেড়ান। লেয়ার, ব্রয়লার ও সোনালী মুরগির দাম তুলনামূলক কম হলেও তাদের পছন্দের তালিকায় প্রথমে দেশি মুরগি। কিন্তু বেশিরভাগ হাট-বাজারে দেশি মুরগি পাওয়া যায়না।
তাড়াশ পৌর এলাকার আসানবাড়ী গ্রামের রিনা খাতুন নামে একজন গৃহিনী বলেন, আগে দেশি মুরগি পালন করতাম। তখন গ্রামের সব বাড়িতে দেশি মুরগি ছিলো। পরে উন্নত জাতের মুরগি পালন শুরু করি। এসব মুরগি অল্প দিনের মধ্যে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু উন্নত জাতের মুরগি যেনতেনভাবে পালন করা যায়না। বিশেষ করে খাদ্য ব্যবস্থাপনা, রোগ নির্নয় ও চিকিৎসা দেওয়া।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, আগে মানুষ দেশি মুরগি ও মুরগির ডিমের উপর অনেকটা নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু বানিজ্যিকভাবে মুরগি পালনের ফলে হাতের কাছে সব পাওয়া যায়। তারপরও উন্নত জাতের মুরগির চেয়ে দেশি মুরগির চাহিদা অনেক বেশি। গৃহস্থরা বাড়িতে দেশি মুরগি পালন করে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি আয় করতে পারেন।
তাড়াশে যুবদলের ৪৬তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে র্যালি
স্টাফ রিপোর্টার ঃ সিরাজগঞ্জের তাড়াশে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদল তাড়াশ উপজেলার শাখার আয়োজনে ৪৬তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে এক বর্ণাঢ্য র্যালি পৌর সদরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিন করে। তাড়াশ উপজেলার ৮ টি ইউনিয়ন ও একটি পৌর সভার যুব দলের সকাল নেতা- কর্মী ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা- কর্মীরা ওই র্যালিতে অংশ গ্রহন করেন।বুধবার বিকেলে তাড়াশ কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ মাঠে উপজেলার সকল ইউনিয়ন থেকে আসা যুব দলের নেতা- কর্মীরা দুপুর থেকে জড়ো হতে শুরু করেন। পরে বিকেল ৪ ঘটিকার সময় বিভিন্ন ফেস্টুন, ব্যানার,জাতীয় ও দলীয় পতাকা হাতে নিয়ে ওই বর্ণাঢ্য র্যালি বের হয়। এ সময় নেতা-কর্মীদেন বিভিন্ন শ্লোগান শ্লোগানে মূখরিত হয়ে ওঠে র্যালি।
র্যালিতে নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদল তাড়াশ উপজেলার শাখার সদস্য সচিব রাজিব আহমেদ মাসুম। এ সময় র্যালিতে উপস্থিত ছিলেন, উপজেলা যুবদলের যুগ্ন আহবায়ক মো. শুক্কুর মির্জা, মো. মিলন খাঁন, পিএম নজরুল ইসলাম, মো. নুরুল ইসলাম, মো. রুহুল আমিন, মো. আব্দুল লতিফ,রয়েল মির্জা,তালম ইউনিয়নের যুবদলের আহবায়ক রেজাউল করিম, বারুহাস ইউনিয়নের আহবায়ক আল আমিন শেখ, সগুনা ইউনিয়নের আহবায়ক মওদুদ হোসেন সবুজ, মাগুড়াবিনোদ ইউনিয়নের আহবায়ক নাজমুল হুদা রবি, নওগাঁ ইউনিয়নের আহবায়ক এনামুল হক, তাড়াশ সদর ইউনিয়নের আহবায়ক শরিফুল ইসলাম, মাধাইনগর ইউনিয়নের আহবায়ক এনামুল হক আকন্দ ও দেশীগ্রাম ইউনিয়নের আহবায়ক হাফিজুর রহমানসহ যুবদলের নেতা কর্মীরা। র্যালি শেষে যুবদল নেতা তাড়াশ উপজেলার শাখার সদস্য সচিব রাজিব আহমেদ মাসুম নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন,সকল ভেদাভেদ,হিংসা বিদ্বেশ ভুলে গিয়ে আপনারা দলকে সুসংগঠিত করুন, তারেক জিয়ার হাতকে শক্তিশালী করুন। সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ান। সর্বপরি দেশকে ভালবাসুন।
তাড়াশে প্রগতিশীল নারী আন্দোলন ফাউন্ডেশন পরিদর্শন
স্টাফ রিপোর্টার ঃ সিরাজগঞ্জের তাড়াশে কর্মরত ‘প্রগতিশীল নারী আন্দোলন ফাউন্ডেশন’ পরিদর্শন করেন তাড়াশ মহিলা কর্মকর্তা কার্যালয়ের প্রতিনিধি দল। এ সময় কর্মকর্তার প্রতিনিধি হিসেবে তার অফিসের প্রশিক্ষক ডিউটি খাতুন ও সহকারী আবু বকর তাড়াশ সদর খান পাড়ায় অবস্থিত ফাউন্ডেশন এর কার্যালয় পরিদর্শন করেন। এসময় প্রতিনিধিবৃন্দসমিতির কার্যকরী কমিটির সদস্যদের সাথে মতবিনিময় ও অফিসিয়াল রেকর্ড পত্র পর্যবেক্ষণ করেন। পরিদর্শনকালে প্রগতিশীল নারী আন্দোলন ফাউন্ডেশনের সভানেত্রী মাজেদা খাতুন ও সম্পাদিকা রোকসানা খাতুন রুপা উপস্থিত ছিলেন। আরো উপস্থিত ছিলেন এ সমিতির প্রায় ৫০ জন সদস্যবৃন্দ। উল্লেখ্য, এ ফাউন্ডেশন তাড়াশ উপজেলার মহিলা অধিদপ্তরের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবে নারী উন্নয়ন এবং নারী কল্যাণমূলক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। চলতি বছরে সংস্থাটি প্রাপ্ত সরকারি অনুদানের অর্থে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
চলনবিল সাহিত্য পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত
আব্দুল কুদ্দুস তালুকদারঃ গত শনিবার বেলা এগারটায় তাড়াশ উপজেলা পাবলিক লাইব্রেরী মিলনায়তনে চলনবিল সাহিত্য পরিষদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয় কবি শহিদুল হক শাকিলের সভাপতিত্বে। সভায় বক্তব্য রাখেন সংগঠনের জিএস কবি সনজু কাদের, ক্যাশিয়ার কবি জহির উদ্দীন মাস্টার, প্রফেসর শহিদুল ইসলাম, সাহিত্যিক সাইফুল ইসলাম প্রমূখ। সভায় সংগঠনের উন্নয়নকল্পে বিভিন্ন প্রস্তাাব গৃহীত হয়।
আন্দোলনে হারানো দৃষ্টি শক্ত ফিরে পাননি তাড়াশের আমিনুল
সাব্বির আহম্মেদ ঃ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে চোখসহ শরীরের ১৮টি স্থানে গুলি বিদ্ধ আমিনুল ইসলাম টুটুল সুস্থ্যতা ফিরে পেলেও এখনুও ফিরে পাননি দৃষ্টি শক্তি। গুলিতে ক্ষতি গ্রস্ত তার বাঁ চোখের রেটিনা। গত ১৬ জুলাই সিরাজগঞ্জ শহরের ইসলামীয়া কলেজ মাঠে গুলিবিদ্ধ হন তিনি।জানা গেছে, তাড়াশ উপজেলার বারুহাস ইউনিয়নের কুসুম্বী গ্রামের আলম হোসেন ও আনেছা দম্পতির একমাত্র ছেলে আমিনুল। তিনি সিরাজগঞ্জ সরকারী কলেজের রসায়ন বিভাগের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র।
দৃষ্টি হারানো আমনিুল ইসলাম বলেন, ভারতে আমার চোখের ক্ষতি গ্রস্থ রেটিনায় সিলিকনের ওয়েল সংযোজন করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও বিশেষ লাভ হয়নি। এর মাঝে একবার ফলো-আপে গিয়েছিলাম। চিকিৎসকগণ আবারও যেতে বলেছেণ। এদিকে আমার অর্থের সংকট রয়েছে। আবার শরীরে এখনোও কয়েকটি গুলি রয়ে গেছে। কিছুটা সুস্থ্যতা ফিরে পেলেও পূর্ণ দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাইনি।
প্রতিবন্ধী জাহিদুল পেলেন জাতীয় যুব পুরুস্কার
স্টাফ রিপোর্টারঃ সিরাজগঞ্জের তাড়াশে প্রতিবন্ধকতাকে হারিয়ে আত্মপ্রত্যায়ী জাহিদুল অর্জন করেছেন জাতীয় যুব পুরুস্কার। গত শুক্রবার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জাতীয় যুব দিবসে যুব ক্রীড়া মন্ত্রনালয়ে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর তাঁকে এ সম্মানে ভূষিত করেন। তাড়াশ উপজেলা যুব উন্নয়ন দপ্তরের সহযোগীতায় নিজ প্রচেষ্টার দ্বারা আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে সফল যুবকে পরিনত হওয়ায় তিনি এ পুরুস্কার পান। জাহিদুল হাসান উপজেলার সগুনা ইউনিয়নের চরকুশাবাড়ি গ্রামের মৃত এন্তাজ আলী প্রামানিকের ছেলে।
এ ব্যাপারে তাড়াশ উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী জানান, তাড়াশ উপজেলায় কোন আত্ম প্রত্যয়ী যুবকের এ ধরণের পুরুস্কার এই-ই প্রথম। শারীরিক সমস্যা তাঁর অদম্য মনবলকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। জাহিদুল হাসানের সফলতা আমাদেরও গর্বিত করেছে। সে এখন উপজেলার বেকার যুবকদের অনুপ্রেরণার প্রতীক।
তাড়াশে বিনামূল্যে ছাগল বিতরণ ছবি
তাড়াশ প্রতিনিধি ঃ তাড়াশে অসহায় দুঃস্থদের মাঝে বিনামূল্যে ছাগল বিতরণ করা হয়েছে। গত সোমবার সকালে উপজেলা পরিষদ চত্বরে এসডিএফর আয়োজনে ও বাংলাদেশ জাতীয় সমাজ কল্যাণ পরিষদের অর্থায়নে বিনামূল্যে ছাগল বিতরণ করা হয়। এসডিএফর পরিচালক হাবিবুর রহমানের (হাবিব) সভাপতিত্বে বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুইচিং মং মারমা। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন- উপজেলা প্রাণিসস্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আমিনুল ইসলাম, উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা মোহাম্মাদ আব্দুস সালাম জাকারিয়া, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. সোহানুর রহমান, সিডিএমএস এর পরিচালক আব্দুল মালেক, এসডিএফ- এর সুপারভাইজার, মো. মাসুদুর রহমান, পশু চিকিৎসক মো. রেজাউল করিম প্রমুখ।
তাড়াশে বৃক্ষ চারা রোপন
তাড়াশ প্রতিনিধি ঃ সিরাজগঞ্জের তাড়াশে বৃক্ষ চারা রোপন করা হয়েছে। গত ১১ নভেম্বর সোমবার সকালে গ্রীন বাংলাদেশ ক্লিন বাংলাদেশ এই প্রতিপাদ্য সামনে নিয়ে ভিলেজ ভিশন বাংলাদেশ এর উদ্যোগে উপজেলার দিঘি সগুনা টু লালুয়ামাঝিড়া আঞ্চলিক সড়কে এই বছরের বৃক্ষ চারা রোপন করার শেষ ইভেন্ট ৬০টি গাছ রোপণ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অর্জুন, বহেরা, নিম, বট ,পলাশ, জারুল ,কৃষ্ণচূড়া ,কাঠ বাদাম, জাম, আমলকি । উক্ত গাছ রোপন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন লালুয়ামাঝিড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আসাদুজ্জান সহ অন্যান্য শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রী বৃন্দ, ভিলেজ ভিশনের উপদেষ্টা বিশিষ্ট সমাজসেবী সাইফুল ইসলাম, ভলেন্টিয়ার তুহিন সরকার, আপন ও ভিলেজ ভিশন বাংলাদেশ এর পরিচালক শরীফ খন্দকার।
রায়গঞ্জে বিএনপির সাধারণ সম্পাদকসহ ৪ নেতাকে অব্যাহতি
রায়গঞ্জ প্রতিনিধি ঃ দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ভিপি আয়নুল হকসহ চার নেতাকে দল থেকে তিন মাসের জন্য অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। একই ঘটনায় আরও চারজনকে সতর্ক করেছে জেলা বিএনপি। গত রোববার (১০ নভেম্বর) রাতে জেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক তানভীর মাহমুদ পলাশের স্বাক্ষরিত চিঠিতে তাদেরকে অব্যাহতি দেওয়া ও সতর্ক করা হয়।
এতে বলা হয়েছে, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, ভোট ডাকাতি, জালিয়াতি ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে নির্বাচিত চান্দাইকোনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান খানকে ইউনিয়ন পরিষদে অবৈধভাবে দায়িত্বভার গ্রহণে সহযোগিতা করার অভিযোগে গঠিত জেলা বিএনপির তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী রায়গঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আয়নুল হক, চান্দাইকোনা ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু হানিফ খান, সাবেক সভাপতি হাফিজুর রহমান আকন্দ ও উপদেষ্টা কামরুল ইসলাম বাবলুকে দলের সব পদ থেকে তিন মাসের জন্য অব্যাহতি দেওয়া হলো।