চলনবিলে “প্রকৃতির লাঙল কেঁচো”র সর্বনাশ

Spread the love

চলনবিলের মাটিতে মাত্রারিক্ত সার কীটনাশক প্রয়োগে
এম.আতিকুল ইসলাম বুলবুল : চলনবিল অঞ্চলের মানুষ প্রাচিনকাল থেকে কেঁচো সংগ্রহ করে বঁড়শিতে গেঁধে মাছ শিকার করতেন। মাছ শিকারের বাহিরে কেঁচো যে,প্রাণ,প্রকৃতি, মানুষ,পাখির বহুবিধ উপকার করে তার ধারনা তাঁরসহ অনেকেরই নেই। এমনটি বলছিলেন, লালুয়া মাঝিড়া গ্রামের কৃষক মো.ফরিদুল ইসলাম (৬৪)। তবে এখন কেঁচো গেঁথে মাছ শিকারের দিন প্রায় ফুরিয়ে আসছে। কারণ চলনবিলের মাটিতে বেশি বেশি রাসানিক সার, কীটনাশক প্রয়োগে চলনবিলের মানুষ অজান্তেই কেঁচোর সর্বনাশ ডেকে আনছেন। সেই সাথে কল্পনাতীত ভাবে কমে যাচ্ছে “প্রকৃতির লাঙল” কেঁচো।
অথচ ৮০- ৯০ দশকে চলনবিলের শত শত গ্রামের আনাচে- কানাচে, খড়ের গাঁদায়, গরু, মহিষের গবরের স্তুপে, ফসলি জমির নরম মাটি, সেখানকার খড়- কুটার তলায কোঁদালের এক কোঁপে যে পরিমান কেঁচো (যা চলনবিল অঞ্চলে চেঁড়া নামে পরিচিত) পাওয়া যেত তা ওই সময়ের চেয়ে চার ভাগের দুই ভাগই বিলের মাটিতে কেঁচো আর নেই। অথাৎ চলনবিলের মাটিতে “প্রকৃতির লাঙল” খ্যাত অতি উপকারি কেঁচো এখন হুমকির মুখে বলছেন প্রাণিবিদরা।
কেঁচোর শরীরের আটালো লালা মাটির মিশ্রণে উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখে। কেঁচো মাটি খেয়ে আবার মাটিতে ফেরত দেয়, এতে মাটির মধ্যে অক্সিজেন ও বাতাসের পরিমাণ ৮-৬৭ শতাংশ বেড়ে যায়। কেঁচো পঁচা পাতা এবং গোবরকে বিভাজিত করে। যা মাটির পুষ্টি গুন বাড়ায়। কেঁচো মাটির পানি শোষণের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। মাটির সুষম গুণ সমৃদ্ধ করে। কেঁচোর মল থেকে কম্পোস্ট তৈরি হয়। যা কৃষি কাজে উপকারী। কেঁচো পরিবেশ থেকে অপ্রয়োজনীয় জৈব পদার্থ খেয়ে পরিবেশ পরিষ্কার রাখে। সার্বিক খাদ্য শৃঙ্খলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিক ারাখে। অথচ প্রকৃতির বন্ধু কেঁচো হারিয়ে যাচ্ছে যা ভাবনার বিষয় বলে মন্তব্য করেন, তাড়াশ উপজেলা অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল মমিন।
সাম্প্রতিক বছর গুলোতে আবহাওয়া জলবায়ুর পরিবর্তন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন চলনবিল জনপদের মানুষ। যেমন- চলনবিলের হাজার হাজার হেক্টর জমিতে বোরো, রবিশষ্যসহ সকল আবাদে মাত্রারিক্ত রাসানিক সার, কীটনাশক প্রয়োগ করায় ফসল, পাখি, শৈবাল, পদ্ম, ঘেচু, শাপলা, চেঁচিয়া, ফনি, মসনার মতো জলজও জীবও বৈচ্যিত্র বিপন্ন। সাথে কেঁচোও আজ হুমকির মুখে পড়ছে। সেই সাথে জলবায়ুর চলমান বিরুপ প্রভাবে মাটি শুকিয়ে যাচ্ছে, এতে কেঁচোর প্রজাতির প্রাণির সর্বনাশ করে তাদের ধ্বংস তরান্বিত হচ্ছে বলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রানিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলামের অভিমত। তিনি বলেন, কেঁচো অবশ্যই অতি হুমকির মুখে পড়া একটি প্রাণি। যা পরিবেশর জন্য অশনি সংকেত। কারণ কেঁচো মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে। আবার চলনবিলাঞ্চলে থাকা দেশীয় ও শীতের মৌসুমে আসা অতিথি পাখির খাদ্য হিসেবে কেঁচোর প্রয়োজনীয়তা সব সময়ই প্রকৃতিতে আছে। যা অনেকেই জানেন না। কিন্তু পরিবেশ রক্ষায় কেঁচোর বংশ বিস্তারের প্রয়োজনীয়তা জানাটা জরুরি এমন ভাষ্য এ প্রাণীবিদের। নিকট অতীত ১৯৮০ সালের দিকেও চলনবিল সমৃদ্ধ ভূ- প্রকৃতিতে প্রকৃতির বন্ধু এমন উদ্ভিদ, প্রাণি, পাখি, ফসল, জীবও বৈচিত্র্যে ঠাসা ছিল। প্রাণ প্রকৃতির কারণেই দেশের সর্ব বৃহত এ জলাভূমির মাটি খুবই উর্বর ছিল। আবার হরেক রকম বোনা আমন ধান যেমন- মাটিয়া গড়ল, বরণ, লাউজাল, সরসরিয়া, সাদাদিঘা, কাজলদিঘার মত নানা জাতের রাসানিক সার, কীটনাশক মুক্ত পুষ্টিকর ধান, রঙ- বেরঙের পাখি, শৈবাল, শিংঘুট, শ্যাওলা,পদ্ম, ঘেচু, শাপলা, চেঁচিয়া, ফনি, মসনাসহ নানা জলজউদ্ভিদ এবং জীবও বৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল। ছিলো ফসলি জমির প্রায় ২৫ শতাংশ ফসল উৎপাদনে ভূমিকা রাখা কেঁচো। তা এখন কিছু বিপন্ন। এমন ভাষ্য, তাড়াশ ডিগ্রি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মর্জিনা ইসলামের।
চলনবিলের হান্ডিয়াল এলাকার প্রবীণ কৃষক মো. ইলিয়াস আলী জানান, ৯০ দশকে বোরো, সরিষা, গম, ছোলা, ভূট্রাসহ নানা ফসলের আবাদে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একজন কৃষক সব মিলে এক বিঘা জমিতে ২৫ থেকে ৩০ কেজি ইউরিয়া, পটাশ, ডিএপির মতো রাসানিক সার ও খুব হলে একবার কীটনাশক প্রয়োগ করতেন। সেখানে বর্তমানে ওই আবাদেই প্রকার ভেদে ৭০- ৮০ কেজি রাসানিক সার ও আগাছা, বালাইনাশকসহ নানা ধরনের কীটনাশক তিন- চার বার ব্যবহার হচ্ছে।
চলনবিলের বাসিন্দা কৃষিবিদ মো.নাঈম আহসান জানান, চলনমান এ সময়ে অঞ্চলে উচ্চ ফলনশীল ও হাইব্রিট ফসলের নানা আবাদে মাত্রারিক্ত রাসানিক সার, কীটনাশক প্রয়োগের তেলেসমাতিতে ফলন বাড়ছে এটা ঠিক। কিন্তু এ গুলো কম প্রয়োগ করে প্রকৃতি ও ফসলের বন্ধু কেঁচো, পাখির কিষ্ঠা, জৈবসার ব্যবহারের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে অধিক ফসল উৎপাদন সম্ভব। পাশাপাশি এতে কেঁচোসহ অনেক জল- স্থলের উপকারি প্রাণি বংশ বিস্তারে বাঁধা বাঁধা পেত না এবং স্বাচ্ছন্দে বাঁচতে পারতো। যে দরকারি বিষয়টি না ভাবছেন কৃষক, না সংশ্লিট কৃষি বিভাগ।
এ প্রসঙ্গে তাড়াশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শমিষ্ঠা সেন গুপ্তা জানান, কেঁচোর উপকারিতা অনেক। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, মাটির প্রাকৃতিক উপায়ে উর্বরতা শক্তি বাড়াতে, পাখির খাদ্য হিসেবে কেঁচোর প্রয়োজনীয়তা আছে। তাই প্রাকৃতির বন্ধু কেঁচোনহ অনান্য জীবও বৈচ্যিত্র রক্ষায় ফসলি জমিতে মাত্রারিক্ত রাসানিক সার, কীটনাশক প্রয়োগএখনই সিমিত করা প্রয়োজন।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD