চলনবিল হতে পারে পর্যটন শিল্পের নতুন সম্ভাবন

Spread the love
নয়নাভিরাম সুন্দর্যের আধার আমদের চলনবিলই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল। মৎস্য ভাণ্ডার খ্যাত এই বিল শুধু বিলই নয়, এ যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি। ভ্রমণ পিপাসু মানুষ এই বিলের সৌন্দর্য দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায়ই এখানে ছুটে আসেন। পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর এই তিন জেলার সংযোগস্থলে যে বিশাল নিম্ন জলাভূমি, এরই নাম চলনবিল। দেশের সবচেয়ে বড় এ জলাভূমি এককালে মাছ ও দেশি-বিদেশি পাখির জন্য বিখ্যাত ছিল। এখন মুক্ত জলাশয়ের মাছের পরিমাণ কমে এলেও একেবারেই ফুরিয়ে যায়নি।

যে বিশাল এলাকা নিয়ে এই বিলাঞ্চল তার মধ্যে রয়েছে সিংড়া, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, চাটমোহর, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, সলঙ্গা, উল্লাপাড়া ও তাড়াশ উপজেলা। বর্ষায় এই বিলের কূল-কিনারাহীন ঢেউ ভ্রমন পিয়াসি মানুষকে মুগ্ধ করে। চলনবিলের মধ্যে দিয়ে হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কে বর্ষা মৌসুমের প্রায় প্রতিদিন দেশি বিদেশি পর্যটক চলনবিলের মুগ্ধতা অনুভব করে। অনেকেই মনে করেন, এখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হলে তা কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন বা কুয়াকাটার চেয়েও দর্শনীয় হবে। চলনবিল অঞ্চলে প্রচলিত প্রবাদ বাক্যে আছে, ‘বিল দেখতে চলন-গ্রাম দেখতে কলম-আর শিব দেখতে তালম’। দেখার ও জানার এই তিনটি বিষয় একই সাথে পাবেন চলনবিলের পর্যটকরা।

এক সময় এই বিলাঞ্চলে কোন মানুষের বসবাস ছিল না। কালক্রমে নদী বাহিত পলিমাটির চর গড়ে ওঠে বিলের নানা জায়গায়। আর সেখানে দুর্দান্ত প্রকৃতির সাহসী মানুষ মাছ ও পাখির লোভে চলনবিলের মাঝে পুকুর বা দীঘি খনন করে তার পাড়ে গড়ে তোলে বসতি। সেখান থেকেই সৃষ্টি হয়েছে গ্রাম।

এখানকার বিশাল বিশাল দীঘির মধ্যে রয়েছে জয়সাগর দীঘি, উলিপুর দীঘি, তাড়াশের কুঞ্জবন, নওগাঁয় ভানুসিংহ দীঘি, বাজার দীঘি,মথুরা দীঘি, ধানচালা দীঘি, দেবীপুরের ভটের দীঘি, মুনিয়া দীঘি, শীতলাই জমিদার বাড়ীর দীঘি, সগুনা দিঘী, সুলতানপুর দিঘী, ভায়াটের দীঘি, উনুখার দীঘিসহ বড় বড় আরো অনেক পুকুর রয়েছে। এসব দীঘি এখন মৎস্য চাষের খামারে পরিণত হয়েছে। চলনবিল থেকে জেলেদের আহরিত মাছ বিক্রি করার জন্য চাটমোহর ও তাড়াশ উপজেলার বিভিন্ন বাজারে এবং বিলের এক প্রান্তে বিশ্বরোডসংলগ্ন মহিষলুটি বাজারে গড়ে উঠেছে বিশাল আড়ৎ। সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এ আড়তে মনোমুগ্ধকর বিভিন্ন প্রজাতির মাছ- যেমন পবা, কৈ, বাচা, চিতল, কাতল, বেলে, বৌ মাছ, বাঁশপাতা, শোল-গজার, রুই, মাগুর, টেংরা, পুঁটি, আইড়, বোয়াল, ফলি, চিংড়ি, টাকি, বাইন মাছ পাওয়া যায়। বিলের আকাশে রাতের তারা মানুষকে প্রাণবন্ত করে।

বিলের আকাশে রাতের তারাগুলো মানুষকে প্রাণবন্ত করে। চলনবিল অঞ্চলের আরো দেখার মত নিদর্শন চাটমোহরের শাহী মসজিদ, হরিপুরে প্রমথ চৌধুরীর জন্মস্থান, জোনাইলে খ্রিস্টান গির্জা, শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ী, শাহ মুখদমের মাজার, তাড়াশের লাল মন্দির, তালমের শিব মন্দির, বিনসাড়ায় বেহুলার কূপ, হান্ডিয়ালের জগন্নাথ মন্দির, তাড়াশের দক্ষিণে ষোড়শ শতাব্দিতে তৈরি নশরত শাহের আমলে পাথরের তৈরি মসজিদ, নওগাঁয় শাহ শরীফ জিন্দনী (রঃ)-র মাজার, পাশেই পশ্চিমে আরো একটি ভাঙ্গা মসজিদসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন। এসব স্থাপত্য এতটাই কারুকার্যে তৈরি যা পর্যটককে মুগ্ধ না করে পারে না।

বর্ষায় পানিতে যেমন ডুবে টইটুম্বুর থাকে এই চলনবিল, আর শুকনো মৌসুমে মাঠজুড়ে ফুটে থাকে সরিষা ফুল আর বোরো ধানের সবুজের সমারোহ, এ যেন এক টুকরো বাংলাদেশ । মাঝ খানে গাড়ো সবুজের বুকে হলুদের ছিটা। এই সৌন্দর্য খুব কাছ থেকে দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসে ছোট বড় নানা বয়সের ভ্রমন পিপাসুরা। কাজের ফাকে ক্লান্তি দূর করতেই এশিয়ার এই সর্ব বৃহৎ বিলে নিত্যদিনই ছুটে আসে হাজার হাজার মানুষ।

সরিষা ফুলের সমারোহে নয়নাভিরাম চলনবিলের সুন্দর্য বহুকাল ধরেই মানুষকে মুহিত করেছে। বর্ষাকালে চতুর্দিকে শুধু পানি আর পানির বিপরীতে শুষ্ক মৌসুমে চারিপাশ জুড়ে থাকে শুধুই সরিষার ক্ষেত। বিল নয়, এ যেন এক  ভূ-স্বর্গ। প্রকৃতির এই অপার সুন্দর্যে মুগ্ধ হতে প্রতিদিনই ছুটে আসছে ছোট বড় নানা বয়সের ভ্রমণ পিপাসু হাজারো মানুষ।

দেশের বৃহত্তম বিল চলনবিলকে ঘিরে বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্তেও সরকারি বেসরকারিভাব বিনিয়োগের উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনার অভাবে সেখানে পর্যটন শিল্প গড়ে উঠছে না। পর্যটকদের জন্য খাদ্য, নিরাপত্তা, যাতায়াত, আবাসন সুবিধাসহ কয়েকটি দর্শনীয় স্পটের অবকাঠামোগত উন্নয়ন চলনবিলকে দেশের অন্যতম পর্যটন এলাকায় পরিনত করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ১০০ কোটি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২২ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ২০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। আর বিপুলসংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৭৫ শতাংশ ভ্রমণ করবেন এশিয়ার দেশগুলোতে। ২০২৪ সালের মধ্যে এ শিল্প থেকে ২৯ কোটি ৭০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখবে ১০ দশমিক ৫ শতাংশ (সূত্র: WTTC)। বাংলাদেশ যদি এ বিশাল বাজারে টিকে থাকতে পারে, তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে দেশের অর্থনীতির রূপরেখা।

উন্নত বিশ্বে ভ্রমণপিপাসু মানুষ সারা বছরই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে থাকে। বিগত এক দশকে (২০০৮-২০১৮) সারা বিশ্বে পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ (সূত্র:WTTC)। ক্রমান্বয়ে পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি আজ পর্যটননির্ভর হয়ে উঠছে। ভ্রমণপিপাসুদের আকৃষ্ট করতে আন্তর্জাতিক মানের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বিভিন্ন দেশ। ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি পর্যটক ভ্রমণ করেছেন ফ্রান্স, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইতালি। এর মধ্যে ফ্রান্সে ৮৯ দশমিক ৪ মিলিয়ন, স্পেনে ৮২ দশমিক ৮ মিলিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রে ৭৯ দশমিক ৬ মিলিয়ন, চীনে ৬২ দশমিক ৯ মিলিয়ন, ইতালিতে ৬২ দশমিক ১ মিলিয়ন পর্যটক (সূত্র: UNWTO)।

বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এই শিল্পকে প্রাধান্য দিয়ে দেশীয় অর্থনীতিকে গতিশীল করেছে অথচ এখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অনুযায়ী পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন করতে পারেনি বাংলাদেশ। উল্লেখ্য, সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫, তাইওয়ানের ৬৫, হংকংয়ের ৫৫, ফিলিপাইনের ৫০ এবং থাইল্যান্ডের ৩০ শতাংশ পর্যটনের অবদান। মালদ্বীপের জাতীয় অর্থনীতির অধিকাংশ ও মালয়েশিয়ার জিডিপির ৭ শতাংশ পর্যটনশিল্পের অবদান। দেশে ২০১৯ সালে জিডিপিতে পর্যটনের অবদান ছিলো ৩.০ শতাংশ।  ২০২৩ সাল নাগাদ তা ৬ দশমিক ৮ শতাংশে পৌঁছাবে। পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার রোল মডেল।

বর্তমান বিশ্বে পর্যটন শিল্প অর্থনৈতিক ভাবে একটি অন্যতম খাত এবং এ কথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে যে কোন দেশের অর্থনীতিতে আর্শীবাদ হয়ে কাজ করছে সর্বজন সমাদৃত এই খাত। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পেরও আছে অপার সম্ভাবনা। সম্ভাবনাময় এই খাতকে টিকেয়ে রাখতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, নিরাপত্তা ব্যবস্থার নিশ্চিতকরণ, রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আরও নজরদারি বাড়ানো গেলে বাংলাদেশ হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার একটি আদর্শ পর্যটন নগরী। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে আরাে উন্নত করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়ােজন। সপ্তম শতকে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ বাংলাদেশ ভ্রমণে এসে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, “A sleeping beauty emerging from mists and water.” এমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসাকে সর্বদা ধরে রাখার মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের ক্রমবর্ধমান বিকাশে এগিয়ে আসার দায়িত্ব আমাদের সকলের। সরকারের পাশাপাশি আমরা বেসরকারি উদ্যোগে নানা ভাবে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটাতে পারি। আমরা সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা চালালে অচিরেই পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশ স্থান করে নিবে বিশ্ব দরবারে। আসুন আমরা সকলে মিলে আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিকে অনিবার ভালােবাসায় ভরিয়ে তুলি। আর জগদ্বাসীকে আপন করে  নিই নিজ দেশের পরম আতিথেয়তায়।
যে বিশাল এলাকা নিয়ে এই বিলাঞ্চল তার মধ্যে রয়েছে সিংড়া, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, চাটমোহর, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, সলঙ্গা, উল্লাপাড়া ও তাড়াশ উপজেলা।
বর্ষায় এই বিলের কূল-কিনারাহীন ঢেউ ভ্রমন পিয়াসি মানুষকে মুগ্ধ করে। চলনবিলের মধ্যে দিয়ে হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কে বর্ষা মৌসুমের প্রায় প্রতিদিন দেশি বিদেশি পর্যটক চলনবিলের মুগ্ধতা অনুভব করে। অনেকেই মনে করেন, এখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হলে তা কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন বা কুয়াকাটার চেয়েও দর্শনীয় হবে। চলনবিল অঞ্চলে প্রচলিত প্রবাদ বাক্যে আছে, ‘বিল দেখতে চলন-গ্রাম দেখতে কলম-আর শিব দেখতে তালম’। দেখার ও জানার এই তিনটি বিষয় একই সাথে পাবেন চলনবিলের পর্যটকরা।

এক সময় এই বিলাঞ্চলে কোন মানুষের বসবাস ছিল না। কালক্রমে নদী বাহিত পলিমাটির চর গড়ে ওঠে বিলের নানা জায়গায়। আর সেখানে দুর্দান্ত প্রকৃতির সাহসী মানুষ মাছ ও পাখির লোভে চলনবিলের মাঝে পুকুর বা দীঘি খনন করে তার পাড়ে গড়ে তোলে বসতি। সেখান থেকেই সৃষ্টি হয়েছে গ্রাম।

এখানকার বিশাল বিশাল দীঘির মধ্যে রয়েছে জয়সাগর দীঘি, উলিপুর দীঘি, তাড়াশের কুঞ্জবন, নওগাঁয় ভানুসিংহ দীঘি, বাজার দীঘি,মথুরা দীঘি, ধানচালা দীঘি, দেবীপুরের ভটের দীঘি, মুনিয়া দীঘি, শীতলাই জমিদার বাড়ীর দীঘি, সগুনা দিঘী, সুলতানপুর দিঘী, ভায়াটের দীঘি, উনুখার দীঘিসহ বড় বড় আরো অনেক পুকুর রয়েছে। এসব দীঘি এখন মৎস্য চাষের খামারে পরিণত হয়েছে। চলনবিল থেকে জেলেদের আহরিত মাছ বিক্রি করার জন্য চাটমোহর ও তাড়াশ উপজেলার বিভিন্ন বাজারে এবং বিলের এক প্রান্তে বিশ্বরোডসংলগ্ন মহিষলুটি বাজারে গড়ে উঠেছে বিশাল আড়ৎ। সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এ আড়তে মনোমুগ্ধকর বিভিন্ন প্রজাতির মাছ- যেমন পবা, কৈ, বাচা, চিতল, কাতল, বেলে, বৌ মাছ, বাঁশপাতা, শোল-গজার, রুই, মাগুর, টেংরা, পুঁটি, আইড়, বোয়াল, ফলি, চিংড়ি, টাকি, বাইন মাছ পাওয়া যায়। বিলের আকাশে রাতের তারা মানুষকে প্রাণবন্ত করে।

বিলের আকাশে রাতের তারাগুলো মানুষকে প্রাণবন্ত করে। চলনবিল অঞ্চলের আরো দেখার মত নিদর্শন চাটমোহরের শাহী মসজিদ, হরিপুরে প্রমথ চৌধুরীর জন্মস্থান, জোনাইলে খ্রিস্টান গির্জা, শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ী, শাহ মুখদমের মাজার, তাড়াশের লাল মন্দির, তালমের শিব মন্দির, বিনসাড়ায় বেহুলার কূপ, হান্ডিয়ালের জগন্নাথ মন্দির, তাড়াশের দক্ষিণে ষোড়শ শতাব্দিতে তৈরি নশরত শাহের আমলে পাথরের তৈরি মসজিদ, নওগাঁয় শাহ শরীফ জিন্দনী (রঃ)-র মাজার, পাশেই পশ্চিমে আরো একটি ভাঙ্গা মসজিদসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন। এসব স্থাপত্য এতটাই কারুকার্যে তৈরি যা পর্যটককে মুগ্ধ না করে পারে না।

বর্ষায় পানিতে যেমন ডুবে টইটুম্বুর থাকে এই চলনবিল, আর শুকনো মৌসুমে মাঠজুড়ে ফুটে থাকে সরিষা ফুল আর বোরো ধানের সবুজের সমারোহ, এ যেন এক টুকরো বাংলাদেশ । মাঝ খানে গাড়ো সবুজের বুকে হলুদের ছিটা। এই সৌন্দর্য খুব কাছ থেকে দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসে ছোট বড় নানা বয়সের ভ্রমন পিপাসুরা। কাজের ফাকে ক্লান্তি দূর করতেই এশিয়ার এই সর্ব বৃহৎ বিলে নিত্যদিনই ছুটে আসে হাজার হাজার মানুষ।

সরিষা ফুলের সমারোহে নয়নাভিরাম চলনবিলের সুন্দর্য বহুকাল ধরেই মানুষকে মুহিত করেছে। বর্ষাকালে চতুর্দিকে শুধু পানি আর পানির বিপরীতে শুষ্ক মৌসুমে চারিপাশ জুড়ে থাকে শুধুই সরিষার ক্ষেত। বিল নয়, এ যেন এক  ভূ-স্বর্গ। প্রকৃতির এই অপার সুন্দর্যে মুগ্ধ হতে প্রতিদিনই ছুটে আসছে ছোট বড় নানা বয়সের ভ্রমণ পিপাসু হাজারো মানুষ।

দেশের বৃহত্তম বিল চলনবিলকে ঘিরে বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্তেও সরকারি বেসরকারিভাব বিনিয়োগের উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনার অভাবে সেখানে পর্যটন শিল্প গড়ে উঠছে না।পর্যটকদের জন্য খাদ্য, নিরাপত্তা, যাতায়াত, আবাসন সুবিধাসহ কয়েকটি দর্শনীয় স্পটের অবকাঠামোগত উন্নয়ন চলনবিলকে দেশের অন্যতম পর্যটন এলাকায় পরিনত করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ১০০ কোটি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২২ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ২০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। আর বিপুলসংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৭৫ শতাংশ ভ্রমণ করবেন এশিয়ার দেশগুলোতে। ২০২৪ সালের মধ্যে এ শিল্প থেকে ২৯ কোটি ৭০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখবে ১০ দশমিক ৫ শতাংশ (সূত্র: WTTC)। বাংলাদেশ যদি এ বিশাল বাজারে টিকে থাকতে পারে, তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে দেশের অর্থনীতির রূপরেখা।

উন্নত বিশ্বে ভ্রমণপিপাসু মানুষ সারা বছরই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে থাকে। বিগত এক দশকে (২০০৮-২০১৮) সারা বিশ্বে পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ (সূত্র:WTTC)। ক্রমান্বয়ে পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি আজ পর্যটননির্ভর হয়ে উঠছে। ভ্রমণপিপাসুদের আকৃষ্ট করতে আন্তর্জাতিক মানের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বিভিন্ন দেশ। ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি পর্যটক ভ্রমণ করেছেন ফ্রান্স, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইতালি। এর মধ্যে ফ্রান্সে ৮৯ দশমিক ৪ মিলিয়ন, স্পেনে ৮২ দশমিক ৮ মিলিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রে ৭৯ দশমিক ৬ মিলিয়ন, চীনে ৬২ দশমিক ৯ মিলিয়ন, ইতালিতে ৬২ দশমিক ১ মিলিয়ন পর্যটক (সূত্র: UNWTO)।

বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এই শিল্পকে প্রাধান্য দিয়ে দেশীয় অর্থনীতিকে গতিশীল করেছে অথচ এখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অনুযায়ী পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন করতে পারেনি বাংলাদেশ। উল্লেখ্য, সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫, তাইওয়ানের ৬৫, হংকংয়ের ৫৫, ফিলিপাইনের ৫০ এবং থাইল্যান্ডের ৩০ শতাংশ পর্যটনের অবদান। মালদ্বীপের জাতীয় অর্থনীতির অধিকাংশ ও মালয়েশিয়ার জিডিপির ৭ শতাংশ পর্যটনশিল্পের অবদান। দেশে ২০১৯ সালে জিডিপিতে পর্যটনের অবদান ছিলো ৩.০ শতাংশ।  ২০২৩ সাল নাগাদ তা ৬ দশমিক ৮ শতাংশে পৌঁছাবে। পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার রোল মডেল।

বর্তমান বিশ্বে পর্যটন শিল্প অর্থনৈতিক ভাবে একটি অন্যতম খাত এবং এ কথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে যে কোন দেশের অর্থনীতিতে আর্শীবাদ হয়ে কাজ করছে সর্বজন সমাদৃত এই খাত। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পেরও আছে অপার সম্ভাবনা। সম্ভাবনাময় এই খাতকে টিকেয়ে রাখতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, নিরাপত্তা ব্যবস্থার নিশ্চিতকরণ, রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আরও নজরদারি বাড়ানো গেলে বাংলাদেশ হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার একটি আদর্শ পর্যটন নগরী। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে আরাে উন্নত করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়ােজন। সপ্তম শতকে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ বাংলাদেশ ভ্রমণে এসে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, “A sleeping beauty emerging from mists and water.” এমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসাকে সর্বদা ধরে রাখার মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের ক্রমবর্ধমান বিকাশে এগিয়ে আসার দায়িত্ব আমাদের সকলের। সরকারের পাশাপাশি আমরা বেসরকারি উদ্যোগে নানা ভাবে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটাতে পারি। আমরা সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা চালালে অচিরেই পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশ স্থান করে নিবে বিশ্ব দরবারে। আসুন আমরা সকলে মিলে আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিকে অনিবার ভালােবাসায় ভরিয়ে তুলি। আর জগদ্বাসীকে আপন করে  নিই নিজ দেশের পরম আতিথেয়তায়।

লেখকঃ সবুজ আহমেদ
শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সদস্য, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। 

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD