লেখক: মুফতি খোন্দকার আমিনুল আবদুল্লাহ হাফিজাহুল্লাহ
নূর পার্টির উত্থান
মিসরের রাজনৈতিক ইতিহাসে নূর পার্টির আবির্ভাব ছিল এক নাটকীয় ঘটনা। ২০১১ সালে স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পতনের পর যখন মিসর রাজনৈতিক শূন্যতায় নিমজ্জিত, তখনই এই দলটি ইসলামপন্থার পতাকা হাতে আত্মপ্রকাশ করে। তাদের দাবি ছিল সরল—তৎক্ষণাৎ শরীআহ আইন প্রতিষ্ঠা। অথচ ইতিহাস সাক্ষী, তাদের এই উচ্চকণ্ঠ শ্লোগান ছিল শুধু প্রতারণার আড়াল।
ব্রাদারহুড বনাম নূর পার্টি
২০১২ সালে মিসরের জনগণ গণতান্ত্রিকভাবে মুহাম্মাদ মুরসিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করল। মুরসি ও তাঁর নেতৃত্বাধীন ব্রাদারহুড ধাপে ধাপে শরীআহমুখী রাষ্ট্র গঠনের পথে অগ্রসর হতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে নূর পার্টির কট্টর অংশ এবং কিছু উগ্র ইসলামি মুখপাত্র উচ্চকণ্ঠে চিৎকার তুলল—“এই মুহূর্তে শরীআহ চাই!”।
ফলাফল হলো, সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি এবং মুরসির বিরুদ্ধে আন্দোলনকে উসকে দেওয়া।
সেনা ক্যু ও নূর পার্টির ভূমিকা
২০১৩ সালে যখন সেনাপ্রধান আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসি অভ্যুত্থান করে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করলেন, তখন নূর পার্টি সেনাবাহিনীর পাশে দাঁড়িয়ে গেল। তারা সিসির ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দিল এবং ইসলামি শ্লোগানকে পাশে সরিয়ে রাখল। অথচ সিসির শাসনে হাজার হাজার ইখওয়ান নেতা-কর্মী শহীদ হলেন, অসংখ্য মানুষ জেলে গেলেন, কোটি মানুষ নিপীড়নের শিকার হলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—নূর পার্টির ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আসেনি, কোনো কারাগার তাদের জন্য খোলা হয়নি, তাদের রাজনীতি বরং আরাম-আয়েশেই চলতে থাকে।
দ্বিচারিতা ও বাস্তবতা
তাহলে প্রশ্ন আসে—যারা শুরুতে “শরীআহ চাই” বলে চিৎকার তুলেছিল, তারা কেন সিসির কাছে গিয়ে চুপ হয়ে গেল? কারণ তাদের লক্ষ্য ছিল শরীআহ প্রতিষ্ঠা নয়, বরং ইসলামি আন্দোলনকে বিভক্ত ও দুর্বল করা। তারা ব্রাদারহুডকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আঁতাত করেছিল।
এই প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশেও বারবার আমরা একটি কৌশল দেখি—“জামায়াত ঠেকাও” রাজনীতি। কখনো বলা হয়, জামায়াতের আকীদা খারাপ, তাই তাদের ঠেকাতে হবে; কখনো আবার বলা হয়, জামায়াত বিকল্প দিতে পারবে না। অথচ বাস্তবতা হলো, যারা ইসলামপন্থার নাম করে ময়দানে নামে, তারা শেষ পর্যন্ত ইসলামি শক্তিকেই দুর্বল করতে কাজ করে।
কুরআনের সতর্কবার্তা
কুরআনে আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট ভাষায় সতর্ক করেছেন:“হে ঈমানদারগণ! যদি ফাসেক ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে তা যাচাই করো, যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কাউকে ক্ষতি না কর এবং পরে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও।”
(সূরা হুজুরাত: ৬)
আমাদের করণীয়
নূর পার্টির ঘটনা আমাদের জন্য এক অমূল্য শিক্ষা—শুধু স্লোগান নয়, প্রকৃত অবস্থান ও কাজকর্মের মাধ্যমে কারো আসল রূপ চিনতে হবে। নাহলে আমরা আবারও প্রতারণার শিকার হবো।আজ যখন মুসলিম উম্মাহ নানামুখী ষড়যন্ত্রের মুখে দাঁড়িয়ে, তখন বিভাজন নয় বরং ঐক্যই আমাদের মূল শক্তি। যারা ইসলামপন্থার মুখোশ পরে ইসলামি আন্দোলনকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্র করে, তাদের চিনতে হবে, তাদের বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।
সমাপনী কথা
মিসরের নূর পার্টির দ্বিচারিতা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে। তারা একদিকে ইসলামপন্থার পতাকা তুলেছিল, অন্যদিকে ইসলামপন্থারই সর্বশ্রেষ্ঠ সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমীনকে ধ্বংস করতে সেনাশাসকদের হাতিয়ার হয়েছিল। ইতিহাস আজ সাক্ষী—যারা ইসলামকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে, আল্লাহ তাদের অপমানিত করেন।
