নাটোরে সাথী ফসল চাষে লাভবান হচ্ছেন কৃষক

Spread the love

আবুল কালাম আজাদ

আখ বা কুশ্যাল দেশের খাদ্য ও শিল্পে ব্যবহার্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্থকরী ফসল । চিনি ও গুড় তৈরী এবং মুখে চিবিয়ে খাওয়ার জন্য আখ (‘কুশ্যাল’) চাষ করা হয়ে থাকে। নাটোরে আখ চাষে লাভবান হচ্ছেন কৃষক। বিশেষ করে আখের সাথে সাথী ফসল হিসেবে দুই সারি আখের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানে বিভিন্ন ধরণের সবজি, পেঁয়াজ ,ধনে, সরিষা, তিসি, তিল,বাদাম, মুগ, মসুর,ছোলা,, মসলা, রসুন, ও সবজি ফসল আবাদ করে কৃষকের জীবন মান উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। নাটোর জেলা সদর, গুরুদাসপুর,বড়াইগ্রাম, নলডাঙ্গা. বাগাতিপাড়া, সিংড়া এবং লালপুর উপজেলায় আখ চাষ করা হয়।
বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই) কর্তৃক কৃষকদের জীবনমান উন্নয়ন ও তাদেরকে সহায়তাকল্পে ‘আখের সাথে সাথী ফসল হিসেবে ডাল, মসলা, তৈল ও সবজি জাতীয় ফসল উৎপাদন প্রকল্প’ নামে ৩ বছর মেয়াদি প্রকল্পটি ২০২১-২২ অর্থ বছরে দেশের ১৫টি সুগার মিল এলাকায় এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এবার রোপণ মৌসমে ৫০টি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হয়।নাটোর কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, জেলায় এবার ১৪ হাজার ৭শ ৩৭ হেক্টর জমিতে আখ আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে আখের সাথে স্বল্প মেয়াদী বিভিন্ন ধরণের সাথী ফসল আবাদ করেন কৃষকরা।বিএসআরআই সুত্রে জানা যায়,২০২১-২২ রোপষ মৌসুমে নাটোর জেলার নাটোর এবং গোপালপুর সুগারমিল যোনে নাটোর সদর, বড়াইগ্রাম, লালপুর ও বাগাতিপাড়া ৪ উপজেলায় এই প্রকল্পে মোট ৭০টি (প্রতিটি প্লট ১বিঘা) প্রদর্শনী প্লট রয়েছে যা প্রায় ১০ হেক্টর এবং ২০২২-২৩ রোপন মৌসুমে জেলায় ১৭৫টি (প্রায় ২৩ হেক্টর) প্রদর্শনী প্লট স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। প্রতিটি প্লটের জন্য কৃষককে প্রকল্প হতে আখবীজ , সাথী ফসলের বীজ, সার ও কীটনাশক সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়াও সেচ, জমি তৈরি, নালা তৈরি ইত্যাদি কাজের জন্য শ্রমিক খরচ দেয়া হচ্ছে। এর ফলে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন । এতে আখ চাষও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বড়াইগ্রাম উপজেলার মহিষভাঙ্গা গ্রামের কৃষক কাশেম সরকার জানান, তিনি ১ বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে আখের সঙ্গে সাথি ফসল পেঁয়াজ চাষ করে ৫০ মণ পেঁয়াজ পেয়েছেন, যার বাজার মূল্য প্রায় ৫০ হাজার টাকা। পেঁয়াজ উত্তোলনের পর ২য় সাথি ফসল মুগডাল চাষ করে ৩ মণ মুগডাল পেয়েছেন। এছাড়াও ১ বিঘা জমি থেকে বিএসআরআই আখ ৪২ (রং বিলাশ) জাতের ৮০০০ টি মুখে চিবিয়ে খাওয়া আখ ১ লাখ ৫০ হাজার টাকায় পাইকারদের কাছে বিক্রি করেছেন। কাশেম সরকার আরো বলেন, আখের সাথে সাথী ফসল চাষে অতিরিক্ত সার-সেচ এবং পরিচর্যার খরচ হয় না। আখের জন্য যে সার,সেচ ও পরিচর্যা ব্যয় হয় একই খরচে সাথী ফসল চাষ করে কৃষক অতিরিক্ত লাভবান হচ্ছেন। ফলে বেশী লাভের আশায় কৃষকেরা একই খরচে আখের সাথে সাথী ফসল চাষের দিকে ঝুঁকছে। নলডাঙ্গা উপজেলার হরিদা খলসি গ্রামের কৃষক আব্দুল হামিদ জানান, এ বছর প্রথম ১ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে এই প্রকল্পের সহায়তায় আখের সঙ্গে সাথি ফসল আলু চাষ করে ৪০ মণ আলু পেয়েছেন, যার বাজার মূল্য প্রায় ৪০ হাজার টাকা। আলু উত্তোলনের পর ২য় সাথি ফসল মুগডাল চাষ করে ২.৫ মণ মুগডাল পেয়েছেন। এছাড়াও ১ বিঘা জমি থেকে বিএসআরআই আখ ৪২ (রং বিলাশ) জাতের ৭০০০ টি মুখে চিবিয়ে খাওয়া আখ ১ লাখ টাকায় পাইকারদের কাছে বিক্রি করেছেন।
নাটোর সদর উপজেলার তেলকুপি গ্রামের কৃষক আব্দুস সামাদ প্রামানিক বলেন,তিনি এই প্রকল্প থেকে সাথি ফসল ও আখ চাষের যাবতীয় খরচ পেয়েছেন। ১ বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে আখের সঙ্গে সাথি ফসল আলু চাষ করে প্রায় ৪০ মণ আলু পেয়েছেন, যার বাজার মূল্য অর্ধ লক্ষ টাকার উপরে। এছাড়াও আখ বিক্রি করে ভালো লাভবান হবেন বলে তিনি মনে করেন।এছাড়াও উপকারভোগী অন্য কৃষকরা বলছেন, এ প্রকল্প চলমান থাকলে অনেকেই আখ চাষে উদ্বুদ্ধ হবেন এবং আখের আবাদ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।
গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হারুনর রশিদ জানান , গুরুদাসপুর উপজেলা সুগারমিলের আওতায় নয়। উপজেলার কৃষকরা নিজ উদ্যোগে বাণিজ্যিকভাবে শুধুমাত্র চিবিয়ে খাওয়ার আখ চাষ করেন। তারা আখের সাথে সাথী ফসল হিসেবে রসুন , পেঁয়াজ, সরিষা, মুগ, মসুর , ধনেসহ বিভিন্ন সব্জীজাতীয় ফসলের চাষ করে অধিক লাভবান হচ্ছেন।অতিরিক্ত কৃষি অফিসার মতিয়ার রহমান জানান, উপজেলায় গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩০ হেক্টর জমিতে মুখে চিবিয়ে খাওয়ার আখ চাষ হয়েছিল। আখের সাথে সাথি ফসল চাষ করে অধিক লাভবান হওয়ায় ২০২২-২৩ অর্থ বছরে আখ চাষ বৃদ্ধি পাবে। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে আখের জমি ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন কারিগরি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই) প্রকল্পের সহায়তা পেলে আখ চাষে কৃষকরা আরও উদ্বুদ্ধ হবেন।এবিষয়ে প্রকল্প পরিচালক ড. আবু তাহের সোহেল বলেন, সার, কীটনাশক, বীজ, মসলাসহ চাষাবাদ সামগ্রী আলাদা আলাদাভাবে ক্রয় করে কৃষককে সরবরাহ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে কৃষক নিজেই শ্রমিকের কাজ করেন সেক্ষেত্রে কীটনাশক ও সার প্রয়োগ, নালা তৈরিসহ ফসল সংগ্রহে শ্রমিকের মজুরী বাবদ যে অর্থ সেটি কৃষককে দিয়ে দেয়া হয়। সাথী ফসল চাষ করিয়ে কৃষকদের আর্থিকভাবে লাভবান করানোই হচ্ছে এই প্রকল্পের মুল লক্ষ্য।
এ ব্যাপারে রাজশাহীর কৃষি তথ্য সার্ভিসের টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, আখ একটি দীর্ঘমেয়াদি ফসল, যা জমিতে প্রায় ১৩-১৪ মাস থাকে। দেশে খাদ্যাভাব যখন কম ছিল, তখন আখ চাষ বেশ জনপ্রিয় ছিল। এখন খাদ্য শস্যসহ অন্যসব জিনিসের বাজারমূল্য অনেক বেশি। অথচ তুলনামূলকভাবে কৃষক ভাইয়েরা আখ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। আখের সাথে সাথী ফসল হিসেবে আমরা ডাল জাতীয় ফসলের মধ্যে মটরশুঁটি, ছোলা, মশুর, মুগ ইত্যাদি মসলা জাতীয় ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ, রসুন ও তেল ফসলের মধ্যে তিল, তিসি, সরিষা, বাদাম ইত্যাদি চাষ করা প্রয়োজন। এতে অর্থ এবং পুষ্টি দুটোতেই লাভবান হবে জাতি।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট। সাবেক সভাপতি, গুরুদাসপুর প্রেস ক্লাব, নাটোর।

 

 

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD