সলঙ্গা(সিরাজগঞ্জ) থেকে ফারুক আহমেদঃ
শষ্য শ্যামলা সবুজ বাংলার কৃষিভান্ডার খ্যাত সিরাজগঞ্জের তিনটি উপজেলা তাড়াশ, উল্লাপাড়া ও রায়গঞ্জে চলতি ইরি বোরো মৌসুমের চাষকৃত ধানের যখন সবুজে পরিণত হয়ে বিস্তীর্ণ মাঠে প্রাকৃতিক অপরূ শোভায় সোনালী ধানের শীষে হেমন্তের বাতাসে দোলা খাচ্ছে ছিল। যা নয়নাভিরাম স্নিগ্ধমনোরমদৃশ্য চোখে না দোখলে বিশ্বাস করা যেত না। তখনি তিনটি উপজেলার কৃষকেরা কৃষিতে নানান স্বপ্ন বোনেছিলেন। স্বপ্ন শেষ হতে না হতেই কৃষকদের কাপালে চিন্তার ভাজ জন্ম দেয় ইঁদুরের, মাজরা পোকা, ব্লাস্টসহ, ব্যাকটেরিয়া মত নানান রোগের আক্রমণ।তা থেকে বিভিন্ন ভাবে যুদ্ধ করে রক্ষা করলেও যখনই বিস্তীর্ণ ইরি বোরো ধানের ক্ষেত সোনালী বর্ণ ধারণ করেছিল। দুই চার দিনের মধ্যে পুরোদমে মাঠের ধান কাটা মাড়াই শুরু হওয়ার কথা ছিল। দিগন্ত মাঠ জড়ে পাকা ধানের ক্ষেত দেখে কৃষককুলের মন প্রাণ আনন্দিত হয়েছিল ঠিক তখনি কালবৈশাখী অশিন ঘুর্ণঝড় ও একটানা শিলাবৃষ্টির এবং বন্যার প্রভাবে কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ না হয়ে কাল হয়ে তার আক্রাশানি আক্রমণ ও কালো থাবা থেকে রক্ষা না পেয়ে এই তিনটি উপজেলার কৃষকদের সোনালি স্বপ্ন সকল জল্পনাকল্পনা পানির নিচে। রায়গঞ্জের, তাড়াশ ও উল্লাপাড়ার এই তিনটি উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসহায় কৃষকদের তলিয়ে যাওয়া ধানের জমিতে দাঁড়িয়ে বিলাপ করতে দেখা গেছে।
রায়গঞ্জ উপজেলার সলঙ্গা থানার ৩নং ধুবিল ইউনিয়নের আমশড়া গ্রামের বর্গা চাষি ফারুক আহমেদ তার কষ্টার্জিত জমানো টাকায় একটুক নিচু জমিতে ২ বিঘা বোরো ধান লাগিয়ে ছিল। কামলা সংকটের কারণে ক্ষেতের ধান কাটতে একটু দেরি হওয়ায় কালবৈশাখী অশিন ঘুর্ণঝড় তার তান্ডবে ও একটানা বৃষ্টির উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে তার এবং ওই এলাকার অনেক কৃষকের জমির ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছেছিল। এ বছর তার উৎপাদন ব্যয় উঠবেনা। তিনি আরো এই প্রতিনিধিকে জানান, সে আর ধান চাষ করবেন না এ অঞ্চলে তার মতো চাষির সংখ্যা অনেক। কৃষকদের ভাষা চাষাবাদ করে কোনো লাভ নেই, পুরোটাই লস। তিনি আরো বলেন, এবার আমার উৎপাদন ব্যয় হয়েছে প্রতি বিঘায় ১৬০০০ হাজার টাকা। আমার ২২ ডিসিমাল জমিতে এবার ইরি বোরো ধান হয়েছিল ২ মণ ৬ দড়া।
তাড়াশ উপজেলার রানিদিঘি গ্রামের কৃষক মোমতাজ উদ্দিন সরকারসহ ওই এলাকার অনেক কৃষকের জমির ধান অর্ধেক মূল্যের তো দূরের কথা ১০ বিঘার দুই বিঘা মালিকের আর বাকি ৮ বিঘা কামলার জন্য মালিক পক্ষ থেকে ঘোষনা আসার পরও সেই জমির ধান কামলারা না কাটায় চোখের সামনে জমিতে তা নষ্ট হয়ে গেছে। ধান নিয়ে কৃষকেরা হতাশ ধান চাষ করেও কৃষকদের গলায় বিষ ফোড়া । না পারছেন মাঠে ধান ফেলে আসতে, না পারছেন ঘরে তুলতে। ফলে মাঠে পচছে ধান। পচে ধান গজানোে পর চারাগাছে পরিণিত হয়েছিল। যেন মনে হচ্ছেছিল পাতো ক্ষেত। উল্লাপাড়া উপজেলার ক্ষুদ্রশিমলা গ্রামের সুলতান মাহমুদ এই প্রতিনিধিকে জানান যে, ধান মাঠে ফেলে আসতেও পারছিলাম না, আবার বাড়ি আনতে গেলে যে, খরচ হয় তা ধান বিক্রি করেও সে দাম হবে না। তিনি ১৬ বিঘা জমিতে ধান করেছিলেন কিছু ধান এখনও পানিতে বাড়ি আনতে পারেন নি।প্রতিদিন মাথা প্রতি ষোলোশত থেকে দুই হাজার টাকায় শ্রমিক নিয়ে পানি থেকে ধান ডাঙায় তুলেছেন। ধানে রোদ না পেয়ে ইতিমধ্যে সকল ধান পল গজিয়ে গেছে। এই ধান খাওয়াও যাবে না, আবার বিক্রিও হবে না। কিন্তুু আবার জমিতে ফেলে আসতে মন চাচ্ছে না। ইতোমধ্যে ধানের চারা গজিয়ে গেছে। রানিদিঘি গ্রামের শিপন সরকার ঘোষণা দিয়েছিলেন,তার জমির ধান যার ইচ্ছা সে কেটে নিয়ে যাক। পরিস্কার করে অল্প কিছু দিলেই হবে এই এলাকার শফিকুল ইসলাম মেম্বরের অর্ধেক ধান ইউসুফ আলী নামের এক ব্যক্তি কেটে নিয়েছে। কোন কোন এলাকার কৃষকেরা এক মণ ধানও ঘরে তুলতে পারে নাই। অনেককে আবার কামলা সংকটের কারণে প্রফেসর, শিক্ষক, সাংবাদিক, দোকানদারদের নিজেরাই নিজেদের ধান কাটতে দেখা গেয়েছে। পাকা ধানে মই দেয়ার মত হঠাৎ ঢলের পানিতে ওই এলাকার বর্গা ও প্রন্তিক শত শত কৃষকের সোনালি স্বপ্ন এখন পানির নিচে তলিয়ে গেছে বলে ক্ষেতের মধ্যে দাঁড়িয়ে কৃষকদের এমন বক্তব্য দিতে দেখা গেয়েছিল। তাছাড়া কোভিড ১৯ তথা করোনা থাবায় বদলে গেছে দেশের অর্থনীতি কেড়ে নিয়েছে বহু মাসুষের জীবন – জীবিকা। ব্যবসা – বাণিজ্য, চাকরি – কাজ হারিয়ে বহু মানুষ দিনাতিপাত করছে কষ্টে – যা নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মত অবস্থা হয়ে গেছে। দেশে ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনী পণ্যের দাম লাগামহীন ঊর্ধ্বমুখী সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস মধ্যবিত্ত মানুষদের কৃষিপণ্য সবজি ও ধান ছাড়া আর কোনো আয় না থাকার কারণে এসব পণ্য ক্রয় ক্ষমতার বাইরে সাধ থাকলেও সাদ্দ্যয়ের বাইরে। তাই দেশের মাধ্যবিত্ত লোকগুলো দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। চরম বিপাকে এ তিনটি উপজেলার নিম্ন আয়ের মানুষ। প্রান্তিক ধান চাষি আব্দুল হাকিম জানান, যারা কৃষক,খুব বিপদে আছে। যারা সুদের উপর টাকা নিয়ে অথবা বিভিন্ন দোকানির কাছ থেকে বাকি করে বোরো ধানের চাষবাদ করে ছিল কিন্তুু সেই কৃষক কি ভাবে লোকসান পূরণ করবে। ধান উঠলেই প্রতিটি দোকানে হালখাতা শুরু হবে। পাওনাদাররা বাড়িতে আসবে। দেনা দেব কিভাবে। এ লোকসান কাটিয়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। প্রত্যেক কৃষকের মাঝে চলছে এমন হাহাকার আর হতাশা। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে প্রায় ৭০ ভাগ কৃষক তাদের ধান গোছাতে পারেনি। ক্ষেত্র বিশেষ কিছু জায়গায় ৯০ ভাগ কৃষকের ধান মাঠে নষ্ট হয়েছে। তাড়াশ উপজেলা চলবিল এলকায় প্রায় ৮০ ভাগ কৃষকের ধান নষ্ট হয়েছে। তবে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এখনও ক্ষতির হিসাব করেনি।
সরেজমিনে এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কৃষকের অধিকাংশ জমিতে ধান কাটা ছিল। টানা বর্ষণের ফলে রোদ না পেয়ে যে সব ধান পাওয়া যাবে তা সিদ্ধ করে চাল বানিয়ে খাওয়া যাবে না। আবার বিক্রিয় হবে কিনা তা নিয়েও সংশয় দেখা দেয়েছে। ফলে কৃষকের ইরি ধান পুরোটাই নষ্ট হয়েছে। এতে করে মারাত্মকভাবে অর্থসৈতিক সংকটে পড়বে কৃষকরা। বিশেষজ্ঞদের মতে বৈরি আবহাওয়া উজান থেকে ঢল ও টানা বর্ষণের কারণে কৃষকেরা ফসল আবাদ করেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ঋণের জালে আটকে যাচ্ছে গ্রামাঞ্চলের মানুষ।
