সুজন কুমার মাল
আজ ২১শে ফেব্রুয়ারী মহান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আর আমরাই পৃথিবীর একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি। তাই জাতি হিসেবে আমাদের ভাষার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ভক্তি ভালোবাসার জন্য ইউনেস্কো ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল সেই ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বরে।
২০০০ সাল থেকে প্রতি বছরই জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত দেশগুলো ২১ শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে যথাযথ সম্মানের সাথে পালন করে আসছে। ২১ শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের নাম আর এই জাতির ভাষার উপর প্রবল ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশও ঘটেছে বলে অনেকেই মনে করেন। তাই তো বলা হয় ‘মোদের গরব মোদের আশা- আ মরি বাংলা ভাষা’। আর দিনটি বাংলাদেশের জনগণের গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। এটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সর্বত্রই সুপরিচিত।
বাঙালী জাতির নিজের মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠিত করার ভাষা আন্দোলনের মর্মান্তিক ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি বিজড়িত একটি দিন হিসেবে ইতিহাসের পাতায় চিহ্নিত হয়ে আছে। আর সঠিকভাবে বাংলা ভাষা চর্চার অভাবে বাঙ্গালীর ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের অনেকেই হয়তো তেমন কিছুই জানে না বা জানতে পারেনা । তাই এই লেখার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আর বাঙালি জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ইতিহাস জানানোর একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র।
তৎকালীন পাকিস্তান শাসনামলে বাংলা ভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালির মনে প্রাণে যে ভাষা চেতনার প্রকাশ ঘটে, তারই সূত্র ধরে বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভাষা নিয়ে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। ১৯৪৮ সালের মার্চে এ আন্দোলন সীমিত পর্যায়ের থাকলেও তা ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী তারিখে চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কি এমন ঘটেছিল সেই দিনটিতে এই প্রশ্ন হয়তো অনেকের ?
তথ্যানুসন্ধান করে জানা যায়, দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার ৮ ফাল্গুন, ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী। ওইদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এলে তৎকালীন পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়। এতে আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালম সহ নাম না জানা আরো কয়েক জন ভাষার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন।
এ ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল হোস্টেলে সমবেত হয়। নানা নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারী আবারও রাজপথে নেমে আসে। তারা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গনে শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায় অংশগ্রহণ করে। ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারী এক রাতের মধ্যে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল চত্বরে গড়ে তোলেন স্মৃতিস্তম্ভ। যা তৎকালীন সরকার ২৬ ফেব্রুয়ারী ভেঙ্গে দেয়। ফলে একুশে ফেব্রুয়ারীর এই ঘটনার মধ্য ভাষা আন্দোলন আরও জোরদার ও বেগবান হয়।
এদিকে ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয় লাভ করলে ৯মে অনুষ্ঠিত গণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় । আর এরই মাধ্যমে লাভ হয় ভাষা আন্দোলনের স্বার্থকতা।ইন্টারনেট সুত্রে আরো জানা যায়, ইউনেস্কোর স্বীকৃতি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ১৯৯৮ সালে কানাডার ভ্যানকুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙ্গালী প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়ে ছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ।
এদিকে ১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘ। ঘোষণার পর ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশ সমূহে যথাযথ মর্যাদার সাথে পালিত হচ্ছে। বাংলা ভাষা আর বাঙালি জাতির ইতিহাস যতদিন এই পৃথিবীতে সমুন্নত থাকবে ততদিন বাঙালি জাতি এই মহান ভাষা সৈনিকদের বিন¤্র চিত্তে স্মরণ করবে ‘‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’’ । ফেব্রুয়ারীর এ বসন্তেই ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল। তাই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতার ইতিহাস আর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস একই সূত্রে গাঁথা
লেখক : নবীন লেখক, কলামিস্ট ও সাংবাদিক, তাড়াশ , সিরাজগঞ্জ।