ভাষা আন্দোলনের সূচনা ১৯৪৭ সালের পূর্ব থেকেই

Spread the love

আবুল কালাম আজাদ

১৯৪৭ সালের বেশকিছু পুর্বেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে এক বিতর্কের সূচনা হয়েছিল।তৎকালিন আলিগড় মুসলিম বিশ^বিদ্যালয়ের এক উর্দুভাষী ভাইস চ্যান্সেলর ডক্টর জিয়াউদ্দিন উর্দু ভাষাকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণের সুপারিশ করে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেন।তখন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালী ভাষাবিদ ও বাঙলা ভাষার অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লহ উক্ত বিবৃতির প্রতিবাদে পাল্টা আরেক বিবৃতির মাধ্যমে প্রস্তাবিত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে ‘বাংলা’র দাবিকে তুলে ধরেন। সে সময়ে বহুভাষাবিদ ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বগুড়ার বেসরকারী আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ পদে ছিলেন এবং একই সাথে কলেজের বাঙলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন ।
ইতিহাসবিদদের মতে ভাষা আন্দোলনের সূচনা ১৯৪৭ সালে। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত পুর্ব পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলনে গনতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়।উক্ত সম্মেলনে ভাষা বিষয়ক কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এসব প্রস্তাব পাঠ করেন। প্রস্তাবে বলা হয়- “পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে,বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক।সমগ্র পাকিস্তানের ভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য জনসাধারণের উপড় ছাড়িয়া দেওয় হউক এবং জনগনের সিদ্ধান্তই চ’ড়ান্ত বলিয়া গৃহিত হউক।”
১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। করাচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভার ( কন্সটিটুউয়েন্ট এ্যাসেম্বলি) বৈঠকে রাষ্ট্রভাষা কী হবে সেই বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল। মুসলিমলীগের নেতারা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী।পুর্বপাকিস্তানের অধিকাংশ মুসলিমলীগ সদস্যেরও একইমত। কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবী করলেন, বাংলাভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক।কারণ পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু মানুষের ভাষা হলো বাংলা। মুসলিমলীগের সদস্যরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। বাংলা বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরাট ষড়যন্ত্র চলছিল। তখন পুর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস এর প্রতিবাদ করে দাবী জানায় যে, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। এই সময়ে পুর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমুদ্দুন মজলিস যুক্তভাবে সভা আহবান করে ‘ রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। সভায় ১১ মার্চকে ‘ বাংলাভাষা দাবি দিবস’ ঘোষণা করা হলো। এদিন ভাষার দাবিতে প্রথম হরতাল পালিত হয়। এটাই হলো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম হরতাল। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্য অবিস্মরণীয় দিন।
১১ মার্চ ভোর বেলায় শত শত ছাত্র ইডেন বিল্ডিং,জেনারেল পোষ্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করে। জেনারেল পোষ্ট অফিসের সামনে ছাত্রদের ওপড় ব্যাপক লাঠিচার্জ করে পুলিশ। একদল মার খেয়ে স্থান ত্যাগ করে আর এক দল হাজির হয়। এইভাবে গোলমাল মারপিট চলতে থাকে। খালেক নেওয়াজ খান,বখতিয়ার,শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ ওয়াদুদ,কাজী গোলাম মাহাবুব, শওকত মিয়া ও আরো অনেক ছাত্র আহত হয়। এসময় ছাত্রনেতা শেখ মুজিব,শামসুল হক, তোহা, তাজউদ্দিন, অলি আহাদসহ প্রায় সত্তর-পঁচাত্তর জন গ্রেফতার হন।
১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত এক জনসভায় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনষ্ঠানে তদানিন্তন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কায়েদে আযম মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন যে, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা”। তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে বক্তৃতা করতে উঠে তিনি যখন আবার বললেন “ উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে”-তখন ছাত্ররা নো, নো বলে চিৎকার করে ওঠেন। এসময় জিন্নাহ প্রায় ৫ মিনিট চুপ করে ছিলেন। এই প্রথম জিন্নাহর মুখের ওপড় প্রতিবাদ করে বাংলার ছাত্ররা। এরপর জিন্নাহ যতদিন বেঁচে ছিলেন আর কোন দিন বলেন নাই‘ উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’ ।‘ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে সর্বপ্রথম আন্দোলন শুরু করে পুর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে এই আন্দোলনের সুচনা করেন ডঃ মোহাম্মাদ শহীদুল্লাহ, ডঃ কাজী মোতাহার হোসেন ও অধ্যাপক আবুল কাশেমসহ আরো অনেকে। পাকিস্তান গণপরিষদে প্রস্তাব উঠেছিল যে, শুধু উর্দু ও ইংরেজীতে বক্তৃতা করতে হবে।গণপরিষদ সদস্য ধীরেন বাবু প্রথম এর প্রতিবাদ করেছিলেন।
১৯৪৮ সালে পুর্ববঙ্গ আইন পরিষদে ‘বাংলাকে’ অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থনে একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ,খয়রাত হোসেন, মিসেস আনোয়ারা বেগম, মি. মনোরঞ্জন ধর, আলি আহম্মদ খান এবং ওসমান আলিসহ মাত্র কয়েকজন সদস্য প্রস্তাবিত এই দাবীর প্রতি সমর্থন করেন। এরপর ১৯৪৯,৫০ ও ৫১ সাল পর্যন্ত বাঙলা ভাষা আন্দোলন ছাত্র ও শিক্ষিত সমাজে সীমাবদ্ধ থাকে এবং ক্রমে ক্রমে সাধারণ মানুষের মনে এই আন্দোলন আলোড়ন সৃষ্টি করতে থাকে।
১৯৫২ সাল।বাঙলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের লক্ষ্যে তৎকালিন পুর্ব পাকিস্তানের ছাত্র, বুদ্বিজীবি ও রাজনীতিক সমাজে দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলন গড়ে উঠে। ১৯৪৮ সালের শুরু থেকেই এই আন্দোলন চলে আসছিল।‘৫২-র শুরুতে তা প্রবল রূপ ধারন করে।মুসলিম লীগ বরাবরই এর বিরোধীতা করে আসছিল। সেই মুসলিম লীগের পরিষদ সদস্য একমাত্র মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশই রাষ্ট্রভাষা বঙলার পক্ষের আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে আসছিলেন।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারী পুরানা পল্টনে মুসলিম লীগ আয়োজিত এক সভায় তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পুনরোক্তি করে ঘোষণা করেন “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা” । এর ফলে ৩১ জানুয়ারি পুর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও বুদ্ধিজীবিসহ সকল মহলে প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং বাঙলা ভাষার দাবীকে প্রতিষ্ঠার জন্য ঢাকা জেলা বার এসোসিয়েশনের হলে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ছাত্র, শিক্ষক বুদ্ধিজীবিসহ সর্ব শ্রেণির কর্মীদের এক সমাবেশে সর্বদলীয় “ কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মীপরিষদ” গঠন করা হয়।সমগ্র দেশব্যাপী বাঙলা ভাষার দাবীতে ব্যাপক গণ আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা কাজী গোলাম মাহবুবকে এই কর্ম পরিষদের আহবায়ক করা হয়। ১৫০, মোগলটুলী(চকবাজার) পুর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সর্ব দলীয় বাঙলা ভাষা কর্ম পরিষদের অন্যতম সদস্য এস এম নূরুল আলম (তৎকালে মুসলিম সলিমুলাøহ হলের ছাত্র) ২১ শে ফেব্রুয়ারী দেশব্যাপী“ বাঙলাভাষা দিবস” পালনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী। অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আবুল হাশেম, আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শামসুল হক,খালেক নেওয়াজ খান, আব্দুল আজিজ, শওকত আলী, মো. তোহা,আলী আহম্মদ খাঁ, আব্দুল ওদুদ, শামসুল হক চৌধুরী, এম এ আওয়াল, অলি আহাদ প্রমুখ।সভায় সর্ব সম্মতিতে উক্ত প্রস্তাব গৃহিত হয়।
১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী সভা, সমাবেশ ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারী করা হয়। ৯৪, নবাবপুর রোডে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সর্বদলীয় বাঙলা ভাষা কর্ম পরিষদের এক সভা অনষ্ঠিত হয়। ঐ সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা নিয়ে আলোচনা হয়। কিছু কিছু আওয়ামী লীগ নেতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরোধীতা করেন। কিন্তু ছাত্র নেতাদের চাপে অবশেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে,আগামী কাল ২১শে ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আমতলার সাধারণ ছাত্র সভায় চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এবং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আন্দোলনের পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এই সভায় আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শামসুল হক, মানিক মিয়া, অলি আহাদ, খালেক নেওয়াজ খান, আব্দুল আজিজ, শওকত আলী, গাজিউল হক, আব্দুল মতিন, তোহা, এস এম নুরুল আলম, এম এ আউয়াল, ওদুদ,সহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন। ২০শে ফেব্রুয়ারী রাতে সমস্ত শহরে বেশ উৎসাহ উদ্দিপনা ও গুজব ছড়াতে থাকে, আগামীকাল কিছু একটা হবে।এও গুজব রটে যে, নুরুল আমিন সরকার হাসপাতালে বেড খালি করে রেখেছেন ও বাঙালী পুলিশদের নিরস্ত্র করা হয়েছে।
‘৫২-এর ফেব্রুয়ারী মাসে ঢাকার রাজপথ ভাষার দাবীতে উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এ সময় মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ গুরুতর অসুস্থ হয়ে সিরাজগঞ্জে অবস্থান করছিলেন। ভাষার দাবীতে ছাত্র সমাজের জঙ্গী মনোভাব ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগের নুরুল আমিন সরকারের অসহিঞ্চুতা দেখে তিনি ঢাকায় চলে যান। এদিকে ২১শে ফেব্রুয়ারী থেকেই প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশন আহবান করা হয়।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী। চারিদিকে সাজ সাজ রব। গণ-জাগরনের উত্তাল তরঙ্গে তদানিন্তন স্বৈরাচারী সরকারের গদি টলটলায়মান প্রায়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় সহ সকল এলাকায় ছাত্র সমাজের পুর্ব নির্ধারিত সভা সমাবেশ ও মিছিলের ওপর সরকার ১৪৪ ধারা ও কারফিউ জারি করে ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে জঘন্য এবং ঘৃন্যতম চক্রান্তে মেতে উঠে। এর প্রতিবাদে রনাঙ্গনে পরিণত হয় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এলাকা। বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতার বাঁধভাঙ্গা প্রতিবাদ রুখে দেওযার জন্য মোতায়েন করা হয় রনসাজে সজ্জিত পুলিশ ও সেনাবহিনীকে। তারপরও ভাষাসৈনিক উত্তাল ছাত্রজনতা ঢাকা ,নারায়নগঞ্জ হতে মিছিল সহকারে পুর্ব নির্ধারিত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হয়। বেলা অনুমান ১০টায় আমতলায় ছাত্র সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় শামসুল হক, অলি আহাদ, তোহা, গাজিউল হক, এস এম নুরুর আলম, আব্দুল মতিন, খালেক নেওয়াজ খানসহ হাজার হাজার ছাত্র-জনতা উপস্থিত ছিলেন। সর্বসম্মতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, শান্তিপুর্ণভাবে ৫ জন ৫ জন করে ক্ষুদ্র ক্ষদ্র দলে মিছিল সহকারে স্বৈরাচারী সরকারের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৫ জন করে গেট হতে বের হয়ে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে চুরমার করে দুর্বার গতিতে পার্লামেন্ট ভবনের দিকে (বর্তমানে জগন্নাথ হল) ছুটে চলে।তাদের মুখে ছিল গগনবিদারী শ্লোগান-‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। প্রথম ৫ জনের দলকে পুলিশ গ্রেফতার করে ট্রাকে তুলতে লাগলে পুলিশের সাথে ছাত্রদের ধস্তাধস্তি হতে থাকে । এক পর্যায়ে বেলা ১টার সময় মিছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের আমতলাতে পৌছামাত্রই পুলিশ নৃশংসভাবে গুলি চালায় ছাত্র জনতার বিক্ষুব্ধ মিছিলের ওপর।শহীদ হলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এম এ শেষ পর্বের ছাত্র আবুল বরকত,জব্বার, রফিক,শফিক, সালামসহ আরো নাম না জানা অগুনতি ছাত্র যুবক। আহত হলেন কয়েকশত।এই খবর সমস্ত শহরে ছড়িয়ে পড়লে দাবানলের মত দাউ দাউ করে জ¦লতে থাকে চতুর্দিক।।সমস্ত অফিস আদালত কোর্ট কাচারী বন্ধ হয়ে যায়।সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে একজন শহীদের ছবি ছাপা হলে নুরুল আমিন সরকার গভীর রাতে ইত্তেফাকের সমস্ত কপি সীজ করে। সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের সেই সংখ্যা আর আলোর মুখ দেখতে পায় নাই।
পাকিস্তানী স্বৈরাচারী সরকারের নৃশংসতার শিকার ভাষা আন্দোলনের এই অকুতোভয় বীর শহীদদের রক্তে রঞ্জিত হলো ঢাকার পিচঢালা রাজপথ।ছাত্র জনতার মিছিল ক্ষনিকের জন্য ছত্রভঙ্গ হলো।ভাষা শহীদের রক্তাক্ত নিথর দেহ রাজপথে রক্ত শয্যায় শায়িত। বিভিন্ন স্থানে ছাত্র জনতা আর পুলিশের সংঘর্ষ, লাঠি চার্জ, কাঁদুনে গ্যাস , গ্রেফতার, ইট নিক্ষেপ আর তুমুল হৈ চৈ এর মধ্যেও পুর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশন শুরু হয় নির্ধারিত সময়ের কিছুক্ষন পরে। মন্ত্রী এবং পরিষদ সদস্যদের সেদিকে কোন ভ্রƒক্ষেপ নাই। সিংহের মত গর্জ্জে উঠলেন তখনকার দিনে একমাত্র চলনবিলের কৃতিসন্তান বাংলার শার্দুল অকুতোভয় সংগ্রামী নেতা মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ । তিনি চিৎকার করে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন ‘ মাননীয় স্পিকার এসব হচ্ছে কী? আমাদের ছেলেরা ভাষার দাবীতে গুলি খেয়ে রাজপথে লুটিয়ে পড়ছে, আর আমরা কি-না আমাদের বেতনভাতা বৃদ্ধি নিয়ে আইন পাশে মশগুল? এসবের মধ্যে আমি নেই। বন্ধ করুন এ প্রহসনের এ্যাসেম্বলী।’ তাঁর কথায় কেউ কর্নপাত করলো না।সরকারী সদস্যদের আচরনে মাওলানা তর্কবাগীশ ক্ষুব্ধ হয়ে বলিষ্ঠ কন্ঠে ঐ পৈশাচিক হত্যাকন্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করে বাইরে আসেন। বিরোধী দলের সদস্যরাও তাঁকে অনুসরণ করেন। পরিষদের বাইরে রাজপথে বেরিয়ে এসে তীব্র পদক্ষেপে হাজার হাজার পুলিশ, ইপিআর ও পাঞ্জাবী সেন্যদের নিñিদ্র বেষ্টনী ভেঙ্গে ছুটে গেলেন ঢাকা মেডিকের কলেজ হাসপাতালে। দেখেন, ছাত্ররা চিৎকার করছে, আহতরা আর্তনাদ করছে। শত শত ছাত্র-যুবক আহাজারী আর আর্তনাদ করছে। তিনি দেখলেন, পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছেন অনেক ছাত্র। মাওলানা আব্দুর রশীদ ন্থীর থাকতে পারলেন না। তিনি নিজ হাতে আহতদের সেবা করলেন এবং ছাত্র জনতার আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানালেন। এই মর্মান্তিক ও নৃশংস দৃশ্য দেখে তীব্র বেদনা মাখা ক্ষোভের আগুনে দগ্ধ হয়ে অশান্ত মন নিয়ে পুনরায় ফিরে আসেন পরিষদ কক্ষে। তখনও পরিষদের কার্যক্রম চলছিল।
স্পীকার আব্দুল করিম আসন গ্রহন করার সাথে সাথে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ পরিষদ কক্ষে প্রবেশ করে সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন স্পীকারের সামনে। পরিষদে তখন মুখ্যমন্ত্রী নুরুর আমিন অন্য প্রসঙ্গের ওপর বক্তব্য রাখছিলেন। মাওলানা তর্কবাগীশকে বিক্ষুব্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ‘ স্পীকার অর্ডার অর্ডার বলে হাতুড়ি পিটিয়ে মাওলানাকে নিজ আসনে বসার আহবান জানান। তারপরও বিক্ষুব্ধ মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ দাঁড়িয়ে ছাত্রদের উপড় গুলিবর্ষনের তদন্ত দাবী করে বলেন-“জনাব স্পীকার সাহেব,পশ্নোত্তরের পুর্বে আমি আপনার কাছে একটি নিবেদন করতে চাই। যখন দেশের ছাত্ররা যারা, আমাদের ভাবী আশা-ভরসার স্থল, পুলিশের গুলির আঘাতে জীবন লীলা সাঙ্গ করেছে, সেই সময় আমরা এখানে বসে সভা করতে চাই না।” ‘ প্রথমে ইনকোয়ারী , তারপর হাউস চলবে।’
মাওলানা তর্কবাগীশ মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে আগে নিজ চোখে এই ঘৃন্য- জঘন্য পৈশাচিক ঘটনা দেখে আসার দাবী জানান। এনিয়ে তুমুল তর্কবিতর্ক শুরু হয়। এক পর্যায়ে স্পীকার অধিবেশন মুলতবী ঘোষনা করতে বাধ্য হন। পরিষদের অধিবেশন ১৫ মিনিট মুলতবীর পর আবার শুরু হলে মাওলানা তর্কবাগীশ আবেগাপ্লুত হয়ে উচ্চকিত কন্ঠে বলেন-“ যখন আমাদের বক্ষের মানিক, আমাদের রাষ্ট্রের ভাবী নেতা ৬ জন ছাত্র রক্তশয্যায় শায়িত, তখন আমরা পাখার নীচে বসে হাওয়া খাব, এ আমি বরদাশত্ করতে পারি না।আমি জালেমের এই জুলুমের প্রতিবাদে পরিষদ সদস্যপদে পদত্যাগ করছি এবং মানবতার দোহাই দিয়ে আপনার মধ্যস্থতায় সকল মেম্বরের কাছে পরিষদ গৃহ ত্যাগের আহবান জানাচ্ছি।” (ইস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলী প্রসিডিংস এর ৫৫,৫৬,৫৭ ও ৬০ নম্বর পৃষ্ঠায় ইংরেজীতে এই বিবরণী লিপিবদ্ধ আছে।)
শুরু হলো স্পীকার আব্দুল করিম এবং মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের মধ্যে বাদানুবাদ। স্পীকার বার বার তাঁকে আসন নিতে ও শান্ত থাকার যতই আদেশ দিতে থাকেন , ততোই মাওলানা উচ্চকন্ঠে বলতে থাকেন Ñ‘আগে তদন্ত, তারপর পরিষদ চলবে, অন্যথায় পরিষদ চলতে দেওয়া হবে না।স্পীকার তখন তাঁর হাতের শেষ অস্ত্রটি ছুড়ে দিয়ে বলেন, আপনি শান্ত হোন, নইলে আমি পরিষদের ১০ -এর ক ধারা প্রয়োগ করতে বাধ্য হবো। চির বিপ্লবী মাওলানা তর্কবাগীশও ক্রোধের আগুনে ফেটে পড়েন এবং বলেন-আমি শান্ত হবো না, এ পরিষদ চলতে দিব না।’ এক পর্যায়ে স্পীকার কয়েক মিনিটের জন্য পরিষদ মুলতবী ঘোষনা করেন।মাওলানা তর্কবাগীশ তখন ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে চিরদিনের জন্য মুসলিম লীগ ত্যাগের কথা ঘোষনা করে তাৎক্ষনিক পরিষদ কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে যোগ দিলেন ছাত্র-জনতার কাতারে। ঐদিনই ছাত্র-জনতার সমাবেশে তিনি মর্মস্পর্শী ভাষন দানের একপর্যায়ে যে কোন মুল্যে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের বর্ধমান হাউসকে ‘বাঙলা একাডেমিতে’ রূপান্তরিত করা হবে বলে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারী ২১শের বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের প্রেক্ষিতে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ তাঁর মুলতবী প্রস্তাব অর্থাৎ তদন্তানুষ্ঠানের দাবী পুনরায় উত্থাপন করেন। অধিবেশন মুলতবীর এই প্রস্তাবের প্রতি ৩৫ জন সদস্যের সমর্থন আছে কিনা তা সদস্যদের কাছে স্পীকার জানতে চাইলেন। কিন্তু খয়রাত হোসেন,খান সাহেব ওসমান আলী,আলি আহম্মদ খান,আনোয়ারা খাতুন,মনোরঞ্জন ধর, ধীরেন দত্ত,গোবিন্দ বল্লভ ব্যানার্জি,বসন্ত কুমার দাস,আকবর আলী আকন্দ,শামসুদ্দিন আহম্মদ,ডা. ভোলানাথ বিশ^াস ও শ্রী হারান চন্দ্র বর্ম্মন ছাড়া আর কেউ এই প্রস্তাবেসমর্থন করলেন না। ফলে মুলতবী প্রস্তাব স্পীকার নাকচ করে দিলেন। অতঃপর মাওলানা তর্কবাগীশ নুরুল আমিন সরকারের প্রতি ছাত্র হত্যার অভিযোগ তুলে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারী অধিবেশন মুলতবী রাখা হয়। ঘোষনা দেওয়া হয়, ২৫ তারিখে মুলতবী অধিবেশনে নুরুল আমিনের প্রতি অনাস্থ প্রস্তাব আলোচিত হবে। ২৩ ফেব্রুয়ারী শনিবার মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ পত্রটি ছিল নি¤œরূপ-
“বাঙলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান করিতে হইবে, পুর্ব পাকিস্তানের জনগনের এই সর্বাত্বক দাবীর আওয়াজ তোলার অপরাধে নুরুল আমিন সরকার বিগত ২১শে ফেব্রুয়ারী হইতে রাজধানী ঢাকার বুকে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর দ্বারা বেপরোয়ভাবে গুলিবর্ষন করাইয়া শিশু,কিশোর,যুব,প্রৌঢ় নির্বিশেষে যে হত্যাকান্ড চালিয়েছেন,সভ্য জগতের ইতিহাসে এরূপ দৃষ্টান্ত বিরল।আমার বিবেচনায় জনগনের প্রতিনিধি হিসেবে এই সরকার গদিতে প্রতিষ্ঠিত থাকিতে পারে না- সেই অধিকার আর তাদের নাই। এই সম্পর্কে পরিষদ ভবনে আমি যে প্রতিকার দাবী করিয়াছিলাম, সরকার পক্ষ তাহাতে কর্নপাত করেন নাই। কাজেই এই সরকারের সমর্থক সদস্য হিসেবে নিজেকে যুক্ত রাখিতে আমি আর ইচ্ছুক নই।আমি ঢাকার এই নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে মুসলিম লীগ পরিষদ দল হইতে অদ্য পদত্যাগ করিলাম।সবচাইতে মজার ব্যাপার হইল, যে দাবী উত্থাপন করিতে যাইয়া আজ আমাদের ছেলেরা পুলিশের গুলিতে শহীদ হইয়া চলিয়াছে, নুরুল আমিন সরকার গতকল্য পরিষদে সেই দাবীই যে কোন কারনেই হউক ন্যায়সঙ্গত কারনে মানিয়া লইয়াছে।তবে কি আমাদের ইহাই মনে করিতে হইবে যে, একই কথা মন্ত্রী সাহেবেরা বলিলে হইবে ‘পবিত্র’ আর দেশের লোক বলিলেই হইবে অপবিত্র ও অপরাধ, আর তাহার বদলা দিতে হইবে অসংখ্য তরুন-তাজা প্রাণ দিয়া? এই পরিস্থিততে একটা কথাই পরিস্কার হইল যে, ন্যায্য অধিকার বা মানবীয় অধিকার বলিতে কোন কিছুর অস্তিত্ব এই সরকার দেশে রাখিতে চাহেন না। আমি শহীদানের ও আহতদের উদ্দেশ্যে গভীর শ্রদ্ধা এবং সমবেদনা জ্ঞাপন করিতেছি এবং জনগনের এইসব দাবীর যৌক্তিকতা ঘোষনা করিয়া মুসলিম লীগ হইতে বিদায় গ্রহন করিতেছি।”
এদিকে ঢাকাসহ সারা দেশে নুরুল আমিন সরকারের বিরুদ্ধে দাউ দাউ করে আগুন জ¦লছে। ভাষার দাবীতে আন্দোলনের গতি তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। এ প্রস্তাব প্রত্যাহারের জন্য তাঁকে নানারকম প্রলোভন এবং ভয়ভীতি দেখানো হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারী ইস্কান্দার খান একই প্রস্তাব নিয়ে আবারো আসেন। প্রস্তাবের মধ্যে ছিল সরকারের রিকুইজিশন করা কয়েকটি বাড়ি এবং মোটা অংকের টাকার লোভ।সরকারের পক্ষ হতে এ লোভের প্রস্তাব মাওলানা তর্কবাগীশের অন্যতম বন্ধু প্রধান মন্ত্রী নুরুল আমিনের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী এস্কান্দার আলী খান মাওলানাকে দেন। বন্ধু এস্কান্দারের প্রস্তাবে মাওলানা তর্কবাগীশ বিস্মিত এবং চরমভাবে ক্ষুব্ধ হন এবং ঘৃনাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। কিছুতেই এই চির বিপ্লবী অকুতোভয় নেতাকে বাগে আনতে না পেরে নুরুল আমিন সরকার ভীত হয়ে ২৪শে ফেব্রুয়ারী রাত তিনটায় গভর্নর ফিরোজ নুন বিশেষ ক্ষমতা বলে অর্ডিন্যান্স জারী করে ব্যবস্থাপক পরিষদের অধিবেশন বন্ধ ঘোষনা করেন এবং ঐ রাতেই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আইনে মাওলানা তর্কবাগীশকে এবং তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছাত্রনেতা সৈয়দ মো. নুরুল আলম, তাঁর পাশের কামরায় অবস্থানরত খয়রাত হোসেনকে গ্রেফতার করে কোতোয়ালী থানায় এবং পরে নিয়ে যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। একই রাতে আরো গ্রেফতার করা হয়, শ্রী মনোরঞ্জন ধর,গোবিন্দ বল্লভ ব্যানার্জী,নারায়নগঞ্জ থেকে নির্বাচিত খানসাহেব ওসমান আলীসহ বহু ছাত্রকর্মীকে।
‘৫২র ভাষা আন্দোলন ওই সময়ের শুধু প্রতিবাদ, বিদ্রোহ এবং বীর ভাষা শহীদদের আত্মাহুতির মধ্য দিয়েই শেষ হয়ে যায় নাই। ভাষার জন্য এদেশের মানুষকে সব সময় আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়েছে, এখনও হচ্ছে। সংগ্রাম করতে হয়েছে রাজপথে, সংগ্রাম করতে হয়েছে পার্লামেন্টে। মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ এক্ষেত্রে অসাধারন সাহসী ভুমিকা পালন করেছেন। তৎকালীন একমাত্র এবং প্রথম সদস্য যিনি নুরুল আমিন সরকারের পার্লামেন্টে বাংলায় বক্তৃতা করেন এবং পরিষদের অন্যতম ভাষা হিসাবে ‘ বাংলা’কে গ্রহন করার জন্য জোর দাবী উত্থাপন করেন।

# লেখক আবুল কালাম আজাদ, সভাপতি, চলনবিল প্রেসক্লাব, গুরুদাসপুর, নাটোর # ০১৭২৪,০৮৪৯৭৩ # ১৫/২/২২

 

 

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD