জাতীয় জীবনে একুশের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

Spread the love

আলহাজ¦ এ্যাড. মোঃ আব্দুল ওহাব

আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ। মাতৃভাষা বাংলা। বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে মর্যাদা দান করা হয়েছে। ভাষার জন্য পৃথিবীর কোন জাতি রক্ত দান বা জীবন দেয় নাই। বাংলার দামাল ছাত্ররা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে। তাই একুশে ফেব্রুয়ারী ভাষা শহীদ দিবস পালন করা হয়। ভাষা শহীদদের রক্তের উজ্জলতা এতো যে আজ একুশে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বের সকল রাষ্ট্র মর্যাদা দিয়েছে ও কর্মসূচী পালন করা শুরু করেছে।
জাতীয় জীবনে একুশের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনেক ব্যাপক, অনেক গভীর। যে জন্য আজ আমরা মাতৃভাষা দিবস আন্তর্জাতিকভাবে পালন করছি, তার পটভূমি আলোকপাত করা দরকার। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা।৯৯ ভাগ মানুষ বাংলায় কথা বলে। কিন্তু গত এক হাজার বছরে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকার করা হয়নি। সেন বংশের শাসন কালে সংস্কৃতি ভাষা, মুসলিম সুলতান আমলে তুর্কি, আরবী ও ফার্সী ভাষা এবং ইংরেজ আমলে ইংরেজি ভাষা সর্বশেষ পাকিস্তান আমলে প্রশাসনিক বা রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে উর্দ্দুকে চাপিয়ে দেওয়া হয়। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দিলে আমরা জাতীগতভাবে অনেক উন্নয়ন করতে পারতাম।

১৭৪৭ সালে ভারত বর্ষে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ভারত ও পাকিস্তান মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়। পূর্ব বাংলা-পূর্ব পাকিস্তান নামে সৃষ্টি হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ৪টি প্রদেশ। তাদের ভাষা উর্দ্দু। শুরু থেকেই পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাতে ছিল। গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথম গণপরিষদের ভাষনে বলেন টৎফঁ ধহফ টৎফঁ রিষষ নব ংঃধঃব ষধহমঁধমব ড়ভ চধশরংঃধহ. গনণপরিষোদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রথম প্রতিবাদ করেন। মি. জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে জনসভায় আবার বলেন, টৎফঁ ধহফ টৎফঁ রিষষ নব ংঃধঃব ষধহমঁধমব ড়ভ চধশরংঃধহ. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তীব্র প্রতিবাদ জানায় তমদ্দুন মজলিশ রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে পুস্তক প্রচার ও প্রকাশ করেন। বাংলা ভাষার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন।
এজন্য ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তর্পণ করতে গেলে “তমদ্দুন মজলিশ” সংগঠনের নাম শ্রদ্ধার সংগে স্মরণ করতে হয়। মাওলানা ভাষানী ১৯৪৮ সালের ১১ ই মার্চ “প্রতিবাদ দিবস” ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, শামসুল হক, ওলি আহমদকে পিকেটিং করা কালে গ্রেফতার করা হয়। গণপরিষদে বাংলার কৃতি সন্তান মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত রাষ্ট্র ভাষা বাংলার পক্ষে জোরালো প্রতিবাদ করেন।১৯৫১ সালে ১১ মার্চ ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনকে আহবায়ক করে রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। শত শত ছাত্রছাত্রী রাষ্ট্রভাষার জন্য প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পরেন।
মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারীর ঘোষণা দেন। রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত মতে ১৯৫২র ২১শে ফেব্রুয়ারী ১০জন করে ছাত্র মিছিল বাহির হতে থাকে। পুলিশ লাঠি চার্জ , টিয়ার গ্যাস ছোঁড়ে। ছাত্র জনতা ইট পাটকেল মারতে থাকে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. কোরেশীর নির্দেশে পুলিশ মেডিকেল কলেজের উল্টোদিক থেকে গুলি বর্ষন করে। ফলে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য শহীদ হলেন বরকত, রফিক, জব্বার, শফিক সহ নাম না জানা অনেক বাঙ্গালী সন্তান।
বাংলার দামাল ছেলেদের রক্তে সেদিন ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল।ভাষা শহীদদের রক্ত বৃথা যায়নি।
আমাদের জাতীয় জীবনে একুশের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সুদুরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। একুশের রক্তের পথ ধরেই বাঙ্গালীরা ধাপে ধাপে এগিয়ে গেছে। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারীর সকালে বাঙ্গালীরা শহীদ মিনারে সমবেত হয়ে ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শপথ নিয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে।১৯৫৪ সালের যুক্ত ফ্রন্ট নির্বাচনে বাঙ্গালীরা বিজয় লাভ করলেও বেশীদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ১৯৫৬ সালে বাংলাকে অন্যতম পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। একুশের রক্তের চেতনায় স্বাধীনতার বীজ লুকায়িত ছিল। একুশের চেতনায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙ্গালীরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে নৌকা প্রতীকে ভোট দিরে জাতীয় পরিষদে ও প্রাদেশিক পরিষদে বিপুল ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পাকিস্তানী সরকার বাঙ্গালীদের ঐক্যবদ্ধ বিজয় দেখে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গরিমসি করে। বঙ্গবন্ধু মুজিব ১৯৭০ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসমুদ্রে ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম”। তার আহবানে বাঙ্গালী জাতি দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়। আজ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক।একুশের আলোকেই বাঙ্গালী জাতি স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস, ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস, ৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধি দিবস, ৬ জুন পরিবেশ দিবস পালন করছে। একুশের রক্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গত ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ একুশে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এখন একুশে ফেব্রুয়ারী বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস। জাতিসংঘভূক্ত সকল দেশ এদিবস পালন করছে। জাপান ইতিমধ্যে শহীদ মিনার স্থাপন করেছে। অনেক বিদেশী নারী পুরুষ ও শিশুরা কন্ঠে গাইছে, “ আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি”। শুনে পুলকিত হই। আমার মাতৃভাষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য কতদুর বিস্তৃত হয়েছে তা গবেষণা করলেই বোঝা যায়। দেশে মাতৃভাষা গবেষণা ইনষ্টিটিউট স্থাপিত হয়েছে। এখন বাংলা ভাষা আমাদের রাষ্ট্র ভাষা। এই ভাষার মর্যাকে উচ্চে তুরে ধরতে হবে। দেশের মধ্যে সর্বত্র বাংলা ভাষার প্রচলন ও চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে। ইংলিশ সাইন বোর্ড থাকলেও বাংলার ভাষার সাইন বোর্ড লিখতে হবে।
মাতৃভাষার মাধ্যমে রাশিয়া, ফ্রান্স, জাপান, চীন সহ অনেক দেশ মাতৃভাষায় জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা করে আত্ম প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আমাদেরকেও বাংলা ভাষায় গবেষণা করতে হবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে, আইন বিজ্ঞানে বাংলা ভাষার ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ করে বাংলায় অনুবাদ করে নতুন প্রজম্মের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। আশার খবর, মাননীয় হাইকোর্ট কিছু কিছু রায় বাংলা ভাষায় প্রকাশ করছে। একুশে ফেব্রুয়ারীর গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। বই মেলার মাধ্যমে বই লেখক, প্রকাশক, কবি, সাহিত্যিক পাঠকের মিলন মেলা হয়ে থাকে। ভাবের বিনিময় হয়। শিশুর হাতে বাংলা ভাষার বই কিনে দিয়ে চমৎকার আনন্দ প্রকাশ করা হচ্ছে। শুধু রাজধানী নয় জেলা উপজেলা পর্যায়ে মাতৃভাষা দিবস স্মরণে “বই মেলার আয়োজন শুরু হয়েছে। ফলে জাতীয় জীবনে একুশের গুরুত্ব ছড়িয়ে পড়েছে।

ফলে একুশের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ভাষা শহীদের মাস এলেই আমি কবি হয়ে যাই, আমি লেখক হয়ে যাই, আমি মঞ্চে গান গাই, আমি দেশকে ভালোবেসে ভেষে যাাই।

অন্য একজন কবি বলেছেনÑ
“ নানান দেশের নানা ভাষা
বিনে স্বদেশী ভাষা পুরে কি আশা”।

মাতৃভাষা একটি জাতির প্রাণের ভাষা। মায়ের কোল থেকে যে ভাষা দিয়ে জীবনের যাত্রা শুরু হয়, সেই ভাষাতেই জীবন গড়বো, দেশ গড়বো, ইনশাআল্লাহ। পরিশেষে আমি বলবো, হে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিক তোমাদের রক্ত বৃথা যায় নাই। তোমরা শহীদের মর্যাদা নিয়ে ঘুমাও। বাঙ্গালী জাতী এগিয়ে যাচ্ছে, তোমাদের রক্তের পথ ধরে।

শৈশব থেকে ফুল দিয়ে প্রভাত ফেরী করেছি
শিশির সিক্ত পথ ধরে হেঁটেছি
লক্ষ শহীদ মিনার!
হাজারো মানুষের শোক মিছিলে গেয়েছি,
“ আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি”।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট আইনজীবি, রাজনীতিক, কবি ও সমাজসেবী।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d bloggers like this:

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD