সলঙ্গা বিদ্রোহ ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্তসিঁড়ি

Spread the love

মোঃ আবুল কালাম আজাদ

১৯২২ সাল। জানুয়ারী মাসের কোন এক মঙ্গলবার।বর্তমান সিরাজগঞ্জ-বগুড়ার সিমান্তবর্তী চান্দাইকোনা হাটের মধ্যে অসহযোগ তথা বিদেশী পণ্য বর্জন আন্দোলনের কর্মীরা দলবদ্ধ হয়ে বিদেশী পণ্য বর্জন করার জন্য প্রচারাভিযান চালাতে লাগলে স্থানীয় চান্দাইকোনা থানায় এ খবর পৌছে। ব্রিটিশ পুলিশের একটি দল রাইফেল নিয়ে ছুটে এসে আন্দোলন কর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।এতে পুলিশ আর আন্দোলনকর্শীদের মধ্যে শুরু হয় ধস্তাধস্তি। এ পরিস্থিতিতে পুলিশ বাহিনী প্রথমে রাইফেলকে লাঠি হিসেবে ব্যবহার করে। আন্দোলনকর্মীরা বাঁশের লাঠি, ইট-পাটকেল নিয়ে পুলিশ বাহিনীকে প্রতিহত করার এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে পুলিশ জনতার ওপর মুহুর্মুহু গুলিবর্ষন করে।এতে কয়েকজন কর্মী আহত হন।পুলিশের বাড়াবাড়িতে হাটের লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে চারিদিক থেকে জনতা গগনবিদারী শ্লোগান দিতে দিতে পুলিশ বাহিনীকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে। মুহুর্তের মধ্যে হাটের বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশের ওপর চড়াও হয়ে তাদের রাইফেলগুলি ছিনিয়ে নেয়। রাইফেল চালানোর অভিজ্ঞতা না থাকায় জনতা ছিনিয়ে নেওয়া রাইফেল হাটসংলগ্ন ফুলজোড় নদীতে ফেলে দেয়।জনতার হাতে মার খেয়ে প্রাণ নিয়ে পুলিশ পালিয়ে যায়। কিন্ত পুলিশও দমার পাত্র নয়।তারা ব্রিটিশ সরকারের বাহিনী। আন্দেলোনকর্মী, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও জনসাধারণের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকে। কয়েকদিনের মধ্যে সে সুযোগও তারা পেয়ে যায়।
১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারী, শুক্রবার। সলংগা হাটের দিন। উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে সলংগা হত্যাকান্ডের ঘটনা যেমন সবচেয়ে নৃশংস ও পাশবিক, তেমনি নিহত – আহতের সংখ্যা সর্বাধিক । বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সলংগা হত্যাকান্ডের তথ্যাবলী জানা একান্ত প্রয়োজ। কেননা সলঙ্গা আন্দোলন ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে “ রক্তসিঁড়ি” হিসেবে পরিচিত। সলংগা বিদ্রোহের মূল নায়ক ছিলেন চলনবিলের বাগ্মীনেতা ২২ বছরের টসবগে তরুণ যুবক মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ।
সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার সলঙ্গা হাট ছিল অত্র এলাকার তৎকালিন বাংলার বিখ্যাত বড় হাট। শুধু সিরাজগঞ্জই নয় , সমগ্র উত্তরবঙ্গ তথা পাবনা,যশোর, কুষ্টিয়া,রাজশাহী, নাটোর,নওগাঁ টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ধান-পাট,ভূষিমাল গো-মহিষসহ নানা পণ্যাদি ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য আমদানী হতো। প্রতি শুক্রবার আর সোমবার এই প্রসিদ্ধ হাটটি বসতো।

১৯২২ সাল, তখন মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে চলছিল অসহযোগ এবং বিলেতী পণ্য বর্জন অভিযান। শুক্রবার সলঙ্গার হাট খুব জমজমাট অবস্থানে থাকার প্রাক্কালে তর্কবাগীশ তিন শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক কর্মীবাহিনী নিয়ে‘ বিলেতী দ্রব্য বর্জন কর, এ দেশ থেকে বৃটিশ খেদাও’শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত করেন । সলঙ্গার মাটিতে যখন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে , ঠিক তখনই এই আন্দোলন রুখতে ছুটে আসে পাবনা জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মি. আর এন সাহা, পাবনার পুলিশ সুপার এবং সিরাজগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক মি. এস কে সিনহা ৪০ জন স্বশস্ত্র পুলিশ নিয়ে সলঙ্গা হাটে উপস্থিত হয়ে কংগ্রেস অফিস থেকে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকে গ্রেফতার করেন। পুলিশ সুপার তা্রঁ উপর বর্বরোচিত নির্যাতন করে। নির্যাতনে তর্কবাগীশের নাক, কান ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসে। দেহের নানা স্থানে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে সলঙ্গার মাটি রক্তে ভিজে যায় । সঙ্গে সঙ্গে হাটের জনতার মধ্যে অগ্নীস্ফুলীঙের ন্যায় বারুদ জ্বলে উঠে । বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের প্রিয় নেতা মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকে ছাড়িয়ে নিতে পুলিশ সুপার, ম্যাজিষ্ট্রেট এবং মহকুমা প্রশাসককে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে ঘিরে ধরে । উত্তেজিত জনতার ঢল আর আক্রোশ থেেেক বাঁচার জন্য জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ম্যাজিষ্ট্রেট পুলিশকে গুলি চালাতে নির্দেশ দেন । নির্দেশ পেয়ে পুলিশ সাথে সাথে ৪০ টি রাইফেল থেকে উত্তেজিত জনতার উপর নির্মমভাবে গুলি চালালে হাটে আসা বহু নিরিহ লোক নিহত এবং আহত হয় । যার প্রকৃত কোন হিসাব কেউ দিতে পারে নাই । সরকারী হিসেবে ৩৭৯ জন কিন্তু বেসরকারী হিসেবে ১৫-২০ হাজারেরও অধিক বলে কথিত আছে।সিরাজগঞ্জ শহরের উপকন্ঠে রহমতগঞ্জে একটা গণকবর আছে। এই গণকবরে কতজন মানুষকে কবর দেওয়া হযেছিল আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারে নাই ।
১৯২২ সালে ২৭শে জানুয়ারী শুক্রবার সলঙ্গা বিদ্রোহে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ পুলিশ সুপারের নির্মম নির্যাতনে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন । সাথে সাথে তর্কবাগীশ মারা গেছেন মর্মে খবর ছড়িয়ে পড়ে । যুবক তর্কবাগীশের দাদা ও পিতার মুরিদ এবং জনতা একত্রিত হয়ে লাঠি-সোটা, তীর-ধনুক, সড়কি,বল্লম,দা-কুড়াল নিয়ে সজ্জিত হয়ে নাড়ায়ে তাকবির ধ্বনি দিতে দিতে পুলিশ, মহকুমা প্রশাসক, ্এসপি এবং ম্যাজিষ্ট্রেটদের ওপর চড়াও হলে অবস্থা বেগতিক দেখে তারা মাওলানাকে আত্মরক্ষার কাজে ব্যবহার করে বিক্ষুব্ধ জনতার হাত থেকে তাদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশের কাছে আকুল আবেদন করেন। তারা তর্কবাগীশকে ছেড়ে দিয়ে মারমুখী জনতার কবল থেকে রক্ষা পান।অহিংস নেতা মাওলানা তর্কবাগীশ সেদিন অহিংস আন্দোলনের নেতা হিসেবে জনতার কবল থেকে বৃটিশের এসপি, ম্যাজিষ্ট্রেট, মহকুমা প্রশাসক , পুলিশসহ সকলের প্রাণরক্ষায় বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন । তা নাহলে ঘটনা আরো ভয়ঙ্কর হতে পারতো । বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনেরউপমহাদেশের ইতিহাসে সলঙ্গার ভয়াবহ ঘটনার সাথে তুলনা করা হয় ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল জালিয়ান বাগের হত্যাকান্ডের ।
তর্কবাগীশকে জীবিত দেখতে পেয়েই হাজার হাজার জনতা প্রচন্ড উল্লাস ধ্বনীতে মুখরিত হয়ে উঠে ।অতঃপর উত্তেজিত বিক্ষুব্দ জনতাকে শান্ত থাকা ও ধৈর্য্য ধারনের জন্য মাওলানা সাহেব তাঁর স্বভাবসুলভ বাগ্মিতা দিয়ে আহবান জানালে মুহুর্তে সে জনসমুদ্র শান্ত হয়ে যায় । বৃটিশ বাহিনীর এই গণহত্যার খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে খেলাফত আন্দোলন এবং কংগ্রেসের বহু নেতা-কর্মী , মেডিক্যাল টিম, সাংবাদিক এবং স্বেচ্ছাসেবক টিম ঘটনাস্থলে যান । স্বেচ্ছাসেবকেরা বহু আহতকে সিরাজগঞ্জ বা আশেপাশে চিকিৎসা করার উপায় না দেখে কোলকাতায় নিয়ে যায়। ঘটনার ভয়াবহতার বিবরণ দিয়ে সাংবাদিকরা বিস্তারিত খবর পাঠালে দেশ- বিদেশের সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে খবর ছাপা হলে চারিদিক থেকে তদন্তের জোড় দাবী উঠে । যদিও দাবির প্রেক্ষিতে তদন্ত হলেও তদন্তের রিপোর্ট আজও বিস্তারিত ও নিরপেক্ষভাবে জনসমক্ষে প্রকাশ পায়নি। পরবর্তীতে এবছরই বৃটিশ বাহীনি এই বাগ্মী চলনবিলের গণমানুষের নেতা মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকে গ্রেফতার করে। ১৯২৩ সালের শেষের দিকে প্রায় এক বছর পর তিনি জেলা থেকে মুক্তিলাভ করেন ।
উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে রক্তাক্ত সলঙ্গা বিদ্রোহ তিনটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। কিন্তু বৃটিশ-ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পুর্ববাঙলার তীর্থভুমি সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা বিদ্রোহের রক্তাক্ত ইতিহাস আজো লেখা হয়নি। প্রথমতঃ এদেশের মাটিতে স¦াধীনতা সংগ্রামীদের গণকবর রচিত হয়।দ্বীতিয়তঃ সিপাহী বিদ্রোহের পরে এই বিদ্রোহে সর্বাধিক পরিমাণ স্বধীনতাকামী বুকের তাজা রক্ত দিয়ে গর্বিত শহীদ হন ।তৃতীয়তঃ অসহযোগ আন্দোলনের মূলমন্ত্র অহিংসার এক অসামান্য ত্যাগ স্বীকার উপমহাদেশের একমাত্র সলঙ্গাতেই রক্ষা করা হয়েছে ।আজ যে স্বাধীনতা সার্বভৌম বাংলার বুকে স্বাধীন নাগরিকদের অবাধ বিচরন তার পেছনে রয়েছে অনেক রক্তাক্ত ইতিহাস । সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের যাঁরা মহা নায়ক তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন চলনবিলের কৃতি সন্তান মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ । তাঁর দীর্ঘ জীবনের শেষমুহর্ত পর্যন্ত এই মহান নেতা জাতির কল্যাণে সুচিন্তা করেছেন । জাতিকে বৃটিশ শোষনের হাত থেকে মুক্তির ঐতিহাসিক কান্ডারী হিসেবে দেশ ও জাতিকে পথ নির্দেশনা দিয়েছেন এসব ক্ষনজন্মা প্রাণপুরুষেরা ।মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ তাঁর মেধা, মনন,দক্ষতা ,যোগ্যতা, সততা, নিষ্ঠা ও কঠোর পারিশ্রম দিয়ে এ দেশের বিপদসংকুল রাজনৈতিক অঙ্গনকে করে গেছেন মসৃন ।
মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ দু‘দুটি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সম্মুখ পানে এগিয়ে গেছেন। পরাজয়কে তিনি কঠোর হস্তে জয় করেছেন ।তিনি কখনো হতাশ হননি । আর হতাশ হননি বলেই তিনি উপমহাদের ঐতিহাসিক দলিলে গুরুত্বপুনণ স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছেন । সেই অবস্থান থেকে তাঁকে কেউ অদ্যাবধি সরাতে পারে নাই,পারবেনা । বৃটিশ হটাও আন্দোলনের ইতিহাসে তিনি চিরকাল অম্লান হয়ে থাকবেন ।

লেখক: মোঃ আবুল কালাম আজাদ, সভাপতি, চলনবিল প্রেসক্লাব, গুরুদাসপুর, নাটোর, # ০১৭২৪ ০৮৪৯৭৩

 

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d bloggers like this:

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD