স্বপ্নের মতো তবু স্বপ্ন নয়

Spread the love

মোমের মতো নরম আলোয় ডোবা একটি প্রভাত। আকাশটা ঘোলাটে নীল। আর সেই নীল ছুঁয়ে ভেসে আসছে শুভ্র সুন্দর তুষারের ফুল। হাজার-লাখ-কোটি। ওরা দল বেঁধে ঢলে পড়ছে সবুজ ঘাসের জমিনে। আলগোছে বিছিয়ে দিচ্ছে ফিনফিনে কাশফুল রঙা চাদর। ঢেকে দিচ্ছে ঘরবাড়ির বাঁকা ছাদ। পথঘাট, খোলা প্রান্তর। চটুল হাতে সাজিয়ে দিচ্ছে বৃক্ষলতার থরথর কম্পিত অবয়ব।

আরোরা হিলসের আমাদের বাড়ির জানালায় হাত রেখে আমি অপলক চেয়ে আছি। বছরের প্রথম তুষারপাত। বাড়ির পেছনের পত্রহীন ধু ধু করা বাগানটা চোখের পলকে বদলে গেছে। শুষ্ক বিবর্ণ বৃক্ষ ডালে এখন লহরির পর লহরি মুক্তো মালার সাজ! যেন ওরা সবাই রাজ রাজেশ্বরী। অপার্থিব একটি দৃশ্য! স্বপ্নের মতো তবু এত স্বপ্ন নয়।
দেখছি আর আবেশে আবেগে বিহ্বল আমি আরেকটি দিনের কথা ভাবছি। সেদিনও তুষার ঝরছিল। আজকের মতো মিষ্টি হালকা চালে নয়। সে একেবারেই অন্যরকম, দুরন্ত, দুর্বিনীত, অবিশ্রান্ত, অন্তহীন তুষারপাত। ওয়াশিংটন মেট্রো এলাকার শত বছরের ইতিহাসের ভয়ানকতম তুষারঝড়।
আমি তুষার ভালোবাসি বলেই বুঝিবা সেদিনের সেই ভয়ংকর সুন্দরের রূপে আপাদমস্তক ডুবে গিয়েছিলাম। সেই বিহ্বলতা আজও কাটেনি। মুগ্ধ বিহ্বল আমি, তুষারকন্যা, তোমাকে একটি চিঠি লিখেছিলাম সেদিন। সে ছিল খোলা চিঠি। এই চিঠিটি কী আরেকবার পড়ে শোনাব! কারণ সব তুষারপাতের রূপইতো এক রকম। তখন ফেব্রুয়ারি মাস।

প্রিয় স্নো ফ্লেক্স,
ভালোবাসা নিয়ো। আচ্ছা তুমি কী জান, আমি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম সেই ডিসেম্বর থেকে? অপেক্ষা ঠিক নয় আসলে আমি তোমার প্রতীক্ষায় ছিলাম। ভালোবাসার অধীর অপেক্ষার নাম প্রতীক্ষা। কিন্তু এই তুমি কী সেই তুমি!
আর মাত্র কটা দিন। তারপরই আমি ঢাকায় যাচ্ছি। একটু লম্বা থাকব। ফিরে আসতে আসতে তুমি যাবে পালিয়ে। তাই যাওয়ার আগে তোমার সঙ্গে দেখা হবে না, এ আমি ভাবতেই পারি না। কিন্তু এ তুমি কী করলে স্নো ফ্লেক্স!
এবার তুমি তোমার চিরাচরিত রূপে এলে না। তুমি এলে ঝড় হয়ে। এমন এক ঝড়, যা পূর্বাঞ্চলের মানুষ এর আগে কখনো দেখেনি। দেখবেইবা কী করে, গত এক শ বছরেওতো তুমি এমন ভয়াল তুফান তুলে আসনি।
শীত এসেছে সেই কবে!
গাছগাছালির রং তো হেমন্তেই গেছে মুছে। তরুলতায় একটি পাতাও অবশিষ্ট নেই। ন্যাড়া গাছের সারি শুকনো খটখটে ডালপালা মেলে প্রাণহীন দাঁড়িয়ে আছে। ওদের ফাঁকে ফাঁকে কিছু এভারগ্রিন গাছ অবশ্য আছে। একটুখানি মায়ার অঞ্জন চোখে পরাবে বলে। ভুবন ভোলানো রঙের এই দেশে এখন আর কোনো রংই অবশিষ্ট নেই। শীতের উত্তরীয় উড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে গোটা পৃথিবী তাপস বেশে।
শুধু তোমারই অপেক্ষায়। ওরা জানে তুমি আসবে। হয়তো তুষারের ফুল হয়ে। নয়তো আসমানের দরজা খুলে অমল–ধবল স্নোবলের মতো ভেসে ভেসে এই ধরিত্রীর বুকে। একটি–দুটি নয়, হাজার, লাখ, কোটি স্নোবল। শুভ্র সুন্দর শব্দহীন অহংকারে।
হিম চূর্ণ গায়ে মেখে। কী কোমল কী নরম তোমার শরীর। যেন বাস্তব নও। যেন ঘুমঘোরে দেখা কোনো স্বপ্ন। টোকা দিলেই উড়ে যাবে। মিলিয়ে যাবে হাওয়ায়।
তুমি ধরণিতে এসেই ঝাঁপিয়ে পড়বে সবুজ ঘাসের বুকে। তৃণকুল এখনো বেঁচে আছে শুধু তোমারই পরশ তরে। তুমি এলেই ওদের ছুটি। ওরা ঘুমোবে দীর্ঘ শীত জুড়ে।
তোমায় দেখে মৃতপ্রায় কঙ্কালসার গাছগুলো বাতাসের উল্লসিত ঘূর্ণিতে খটখট করে কেঁপে উঠবে। পাইন, ফার আর হেমলক ট্রিগুলোর শীর্ণ শুষ্ক ডাল তুমি ভরে দেবে শ্বেত শুভ্র ফুলে। আলতো হাতে জড়িয়ে দেবে মুক্তোর মালা। ঝুলিয়ে দেবে মণি-মাণিক্য কাঞ্চন ঝরোকা। যেন ওরা সবাই রাজ রাজ্যেশ্বরী।
আমরা মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখব আকাশের শব্দহীন কারুকাজ। কী শান্ত উদার হাতে সে পাঠাচ্ছে তুষার পালক। একের পরে এক।
আর সেই পালক হয়ে আসছ তুমি!
তুমি নীরবে নিঃশব্দে সাদা চাদরের ভাঁজে ভাঁজে মুড়ে দেবে মাঠঘাট, গাছপালা, বাড়িঘর, পথপ্রান্তর। রংহীন পৃথিবী সেজে উঠবে চোখ ধাঁধানো সাদা রঙে। যে রঙের কাছে হার মেনে যাবে রাম ধনুকের সাতটি রং।
ওসব কথা থাক এখন।
তুমিতো তোমার চেনা সেই রূপে আসনি এবার। এবারের তোমাকে নিয়েই নাহয় দুকথা বলি। শীতের শুরু থেকে যে প্রতীক্ষা ছিল প্রকৃতি ও মানুষের তার অবসানে তুমি এলে।
তোমার আসার আগে থেকেই কত কত সাবধান বাণী শুনছিলাম আমরা।
তাই স্নো শুরু হওয়ার আগের দিন গ্রোসারি স্টোর থেকে ব্রেড–বাটার ইত্যাদি সব উধাও হয়ে গেল।
হবেইতো। মানুষজন পিঁপড়ার সারির মতো ছুটেছে দুর্দিনের খাবার সঞ্চয় করতে। সাবধানবাণী ছিল বিদ্যুৎবিভ্রাট ঘটতে পারে। লাইট, পানি, চুলা, হিটার চলে যেতে পারে। সবকিছুর জন্যই তৈরি ছিলাম আমরা।

২২ জানুয়ারি, শুক্রবার দুপুর থেকে তুমি এলে।
তোমার নাম দেওয়া হয়েছে ‘জোনাস’। বলা হলো গত এক শ বছরেও নাকি আমরা তোমার এই রূপ দেখিনি। তুমি কতটা ভয়াল হতে পার তাও বলা হলো বারে বারে। আমরা যেন সাবধান থাকি। আমরা সাবধানই ছিলাম।
এবং নিজের চোখে দেখলাম এবার আর আগের মতো নরম আলতো পায়ে নয়, তুমি এলে বড় বেশি বেপরোয়া ও বড় বেশি খামখেয়ালি হয়ে। প্রথমে মৃদু তারপর ক্রমেই বেড়ে গেল তোমার তীব্রতা। ক্ষিপ্র বেগে নেমে এলে। তুষারের তুলতুলে বল নয়, তীক্ষ্ণ ফলা হয়ে।
আহাহা! তবু তুষার বলেই না কথা। সে তুমি বল হও আর ফলাই হও, তুষার মানেইতো কোমলতা। রেণু রেণু মুগ্ধতা!
আমি কী অস্বীকার করতে পারি যে এত কিছুর পরও আমি বা আমরা মুগ্ধ চোখে জানালায় দাঁড়িয়ে তোমাকে দেখিনি!
ফেসবুকের পাতা ভরে গেল তোমার ভয়ংকর সুন্দর ছবিতে।
আর তুমিতো চিরকালই নিঃশব্দে চলাফেরা করো। আমরা স্তব্ধ হয়ে আবারও দেখলাম, আকাশ বেয়ে অবিশ্রান্ত নেমে আসছে শুভ্র সুন্দর তুষার। শব্দহীন শুভ্রতায় ঢেকে দিচ্ছে বিশ্ব চরাচর।
শুক্র গেল, শনিবার এল। সকাল, দুপুর, রাত পেরিয়ে তবে তুমি ক্ষান্ত হলে। ততক্ষণে তুষারের স্তূপের অতলে তলিয়ে গেল উত্তর পূর্ব ও মিড-আটলান্টিকের শহরগুলো।
তোমার অবিরল বর্ষণে নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, কানেকটিকাট আর ওয়াশিংটনে স্থবির হয়ে গেল স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। বিশ থেকে চল্লিশ ইঞ্চি পর্যন্ত তুষার পড়েছে নানা জায়গায়।
ঝড় শেষ হতেই দুয়ার খুলে বেরিয়ে দেখি, ওমা একি কাণ্ড! এ যে দেখছি দুনিয়া জোড়া তুষার! যেদিকে চোখ যায় সবই ধবধবে সাদা। দিগন্ত বিস্তৃত তুষার দেখে আমরা মেট্রোবাসীরা অভ্যস্ত। প্রতি শীতেই বার কয়েক তোমার দেখা পাই। কিন্তু এবারের দৃশ্যটা ভিন্ন। কারণ এর উচ্চতা কয়েক ইঞ্চি নয়। কয়েক ফুট।
ভয়ংকর সুন্দরের এই বিষম পাহাড় ডিঙিয়ে ঘরের বাইরে যাওয়ার সাধ্য কার! তবে ভাগ্য ভালো এত ঝড়েও অন্তত আমাদের এই ওয়াশিংটন ডিসি মেট্রো (ডিসি, মেরিল্যান্ড ও ভার্জিনিয়া) এলাকার কোথাও বিদ্যুৎবিভ্রাটের খবর পাওয়া যায়নি।
বিদ্যুৎবিভ্রাট হোক বা না হোক স্নোজিলার কবলে পড়ে গৃহবন্দী হয়ে গেলাম আমরা সবাই।
হাইওয়েগুলোতে স্নো স্টর্মের মাঝেও স্নো-ট্রাক ঘুরছে অবিরত। তুষার পরিষ্কার করছে। কমিউনিটির ভেতরের রাস্তাগুলোতে স্নো–ট্রাক আসতে শুরু করল ঝড় থামার পরে।
রোববার সকাল।

আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। আকাশে সোনারবরণ সূর্য। কী তার তেজ! কী যে কিরণ! শীতকালের সূর্যে আগুনের রেণু ছোটে। সেই সোনালি কিরণ বরফের ধবধবে সাদা চাদরে প্রতিফলিত হয়ে ঠিকরে উঠছে রাম ধনুকের জ্যোতি। ঝলমলিয়ে জ্বলছে চতুর্দিক।
ছুটির দিন। বেলা করে ঘুম থেকে উঠেই শুরু হয়ে গেল যার যার ড্রাইভওয়ে ক্লিন করার ধুম।
স্নো পড়া শেষ হলে শীতও যায় কমে। আরামদায়ক আবহাওয়া। শিশু–কিশোরেরা স্নোবল আর স্নোস্কেটিং করতে নেমে গেছে। বাতাসে ভাসছে তাদের হাসি আর আনন্দ–উচ্ছ্বাস।
শীতের সময় বর্ণ গন্ধের মতোই ধ্বনিও প্রখর হয়। ওদের হাসির হি হি! হা হা! তরঙ্গ তাই দূর থেকেও স্পর্শ করা যাচ্ছে।
ওয়াশিংটন ডিসি মেট্রো এরিয়া জুড়ে স্নো পড়েছে প্রায় চৌত্রিশ ইঞ্চি (সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট)। শাবল ঠুকে ঠুকে সেই বরফ সরানো কী আর চাট্টিখানি কথা!
তারপরও সবাই এই কঠিন কাজটা করছে এবং হাসি মুখেই। ফেসবুকের কল্যাণে তাদের হাসি মুখের ছবিগুলোও আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম। কার ড্রাইভওয়ে কখন পরিষ্কার হলো তাও জানা হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের উল্টো দিকের বাসার মাঝবয়সী জুলি আর অ্যাড অনেকক্ষণ ধরে শোভেল করছিল। মাঝে মাঝে ব্লোয়ার দিয়ে বরফ কুঁচি ওড়াচ্ছে। একসময় দেখি তুষারের নিচে থেকে বেরিয়ে এল তাদের সুরমা আর কালো রঙের দুখানা গাড়ি। হাতের গ্লাভস থেকে বরফ কুঁচি ঝাড়তে ঝাড়তে ওরা দুজন হা হা করে এমন জোরে হেসে উঠল যেন সাগর তলা থেকে এইমাত্র টাইটানিক উদ্ধার করে ফেলেছে।
সোমবার রাতের বেলা গ্রোসারি স্টোরে যাওয়ার পথে একটু শহর তথা বরফ দেখতে বের হলাম। বেরিয়েতো অবাক!
যেদিকে দুই চোখ যায় শুধু ধবধবে সাদা পুঞ্জীভূত তুষার আর তুষার। এতটুকু ফাঁক নেই। অরণ্য জোড়া গাছগুলো তুষার ফুলে ফুলে ছাওয়া।
আদিগন্ত বিস্তীর্ণ সেই সাদা প্রান্তরের বুক চিরে চলে গেছে ঝাঁ ঝকঝকে পিচঢালা কালো পথ। পথের দুপাশে খাঁড়া বরফের উঁচু প্রাচীর। প্রাচীরের দুই পার শুভ্র সমুজ্জ্বল।
রাত্রির আলো আঁধারিতে সবকিছু বড় মায়াবী লাগছে! আহ! কি ভয়ংকর সুন্দর!
আকাশের দিকে চোখ গেল, শীতার্ত পৃথিবীর তারারা আগুনের ফুলকি হয়ে জ্বলছে আর নিভছে। চন্দ্রিমায় ঝরছে আলোর শিহরণ। আমি জানি এই রকম সময়ে ঝরনা আর লেকের জল তরল রূপা হয়ে যায়।
ছোট ছোট গাছের ঝাড়ে বরফের ঝুলন্ত ক্রিস্টাল ঝাড়বাতি দুলছে। শাণিত কচকচে শীতের বাতাস।
এরই মাঝে হঠাৎ দেখি বরফ ডোবা পথের ধারে বাঁকা ছাদের নিচে দাঁড়িয়ে এক দীর্ঘকায় যুবক ঝনঝনিয়ে ইলেকট্রিক গিটারে সুর তুলে গাইছে-ওহ! দ্য ওয়েদার আউটসাইড ইজ ফ্রেইটফুল/বাট দ্য ফায়ার ইজ সো ডিলাইটফুল/অ্যান্ড সিন্স উই হ্যাভ নো প্লেস টু গো/লেট ইট স্নো! লেট ইট স্নো! লেট ইট স্নো…। ডিন মার্টিনের অমর সংগীত।
আমরা কেউই এই মুহূর্তে আর বাড়তি স্নো চাই না। কিন্তু তারপরও গানটা শুনতে অদ্ভুত ভালো লাগছে। গুণ গুণ করে আমিও গেয়ে উঠি—লেট ইট স্নো! লেট ইট স্নো! লেট ইট স্নো!

নাজমা রহমান: মেরিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD