গতকাল শনিবার শেরপুরের সোহাগপুর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে আলবদর কমান্ডার কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে পাকবাহিনী নির্বিচারে হত্যাকান্ড চালায় শেরপুরের নালিতাবাড়ীর সোহাগপুর গ্রামে।
এ সময় নিহত হন ১৮৭জন। বিধবা হন ৬৪ নারী। বর্তমানে জীবিত ৩২ বিধবার মধ্যে ১৩ জন বীরাঙ্গনা রয়েছেন। এরপর থেকেই ওই গ্রাম বিধবা পল্লী হিসেবে পরিচিত। সোহাগপুরের বিরঙ্গনাদের মধ্যে পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হলেও বাকি আটজন এখনও নাম লেখাতে পারেননি। ফলে তারা সরকারি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্ছিত হচ্ছেন।
আট বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা ও বিধবা এবং শহিদ পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় শহিদ পরিবারের সন্তানরা। কামারুজ্জামানের ফাঁসি হলেও সেদিনের ভয়াবহতার কথা এখনও ভুলতে পারেনি সোহাগপুরের মানুষ। পাক বাহিনীর দালাল কাদের ডাক্তারসহ স্থানীয় রাজাকার আল বদরদেরও বিচারের দাবি জানান বীরাঙ্গনারা।
বীরাঙ্গনা হাফিজা বেওয়া বলেন, মুক্তিযুদ্ধ অইছে ৪৪ বছর অইছে। অহন আমরা হুনতাছি সরকার বীরাঙ্গনা গোরে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিছে। এইডা হুইনা মনডা খুশি হইছে। কামারুজ্জামানের ফাঁসি হইছে আমগড় স্বামীর খুনের বিচার হইছে তা শুইনা আমি কিছু খুশি হইছি।
দুঃখে কষ্টে দিন যাইতাছে। অহন কীভাবে চলবাম,শান্তি মতো চলবার জন্য যে পর্যন্ত বাঁচি সরকার আমগড়ে ব্যবস্থা কইরা দেক। স্থানীয় এক গারো পরিবারে কাজ করেন বিধবা জরিতন বেওয়া।
তিনি বলেন, বিধপা হওনের পরে গারো বাড়িতে কাজ করছি। ক্ষেতের নারা কাটছি। নিজে না খেয়ে পোলা মাইয়ার লাইগা ভাত জোগাড় করছি। আমি অহনা আগের নাহালা চলবার পাইনা, খাটবারও পাইনা। পইড়া গেছিগা অহন সরহার আমার চিহিৎসা করুক।
বীরাঙ্গনা মহিরণ বেওয়া বলেন,এতদিন পেটের ভিতরে রাইখা আগুন তাপাইলাম। অহন পরিচয় প্রকাশ অইয়া যাওয়াতে লোকের কাছে কলংকি অইয়া গেছি। অহন কারো বাসায় কাজ করবার গেলেও কাজে নেয় না। কলংকি কইরা ডাহে। এহন বাদ বাহি জীবন যেন আমরা সুহে থাকবার চাই, কলংকি জীবন মুছন করইরা কারও কাছে যাতে হাত পাতুন না লাগে সেই জন্যে আমরা মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতির কার্ড চাই।
জুবেদা বেওয়া বলেন, পাকবাহিনীরা আমগোরে সোহাগপুর গ্রাম ডারে চিনতো না। কিন্তু আমগোর গ্রামে কাদের ডাক্তার পাক বাহিনীরে পথ দেহাইয়া নিয়াইছে। কামারুজ্জামালের মতো কাদের ডাক্তারের ফাঁসি অইলে আরও খুশি অইতাম।
কামারুজ্জামানের ফাঁসি অইছে খুশি হইছি। যে কাদের ডাক্তার পাক বাহিনীরে পথ দেহাইছে তার ফাঁসি অইলে আরও খুশি অমু, বলেন বিরাঙ্গনাবা অজুফা বেওয়া।
নালিতাবাড়ী শহিদ পরিবার কল্যাণ সমিতির সভাপতি জালাল উদ্দিন সোহাগপুর বিধবা পল্লীতে সরকারর পক্ষ থেকে স্মৃতি সৌধ নির্মাণের দাবি করেন। তিনি বলেন, সোহাগপুর বিধবা পল্লীর ব্যক্তি মালিকানাধীন যে স্মৃতি ফলক ও গোলঘর রয়েছে সে জায়গায় সরকারের তরফ থেকে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হউক। তবে শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে।
নালিতাবাড়ী উপজেলা গণজাগরণ মঞ্চের সভাপতি নাজিম উদ্দিন আহমেদ বলেন, পাঁচজন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হলেও আটজন এখনও বাকি আছেন। এ কারণে তারা সরকারি সব সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সরকার যেন তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। শেরপুরের জেলা প্রশাসক এএম পারভেজ রহিম বলেন, ২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবরের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য অনলাইনে আবেদন করার সময় ছিল। এর মধ্যে আবেদন করে সোহাগপুর বিধবা পল্লীর পাঁচজন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার সনদ পেয়েছে। বর্তমানে অনলাইনে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার আবেদন করার সুযোগ নেই। তাই সরাসরি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল বা মুক্তিযোদ্ধা সংসদে আবেদন করতে হবে তাদের। জেলা প্রশাসক আরও বলেন, বিধবা ও শহিদ পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসনের বিষয়টি চলৎ রয়েছে। খাস জমিসহ সরকারের অনুদান ও অন্যান্য উৎস থেকে তাদেরকে পর্যায়ক্রমে সাহায্য সহযোগিতা করা হবে। নতুন করে সোহাগপুরে আর কোনো স্মৃতিসৌধ করার পরিকল্পনা আপতত নেই বলে জানান তিনি।