ডাঃ আমজাদ হোসেন উল্লাপাড়া প্রতিনিধিঃ ইতিহাসে কতো ঘটনাই তো ঘটে, সেই ঘটনা যাঁরা ঘটায় ইতিহাস তাদের সবার নামই কি বুকে ধারণ করতে পারে? ইতিহাসের সেই পাতা থেকে মানুষ তাদের সবার নাম কি স্মরণে রাখতে পারে? দাস বিদ্রোহ হয়েছে, সমাজের উঁচু শ্রেণির গুটিকয়েক মানুষের দ্বারা সৃষ্ট দাস প্রথা হতে অসংখ্য মানুষ মুক্তি পেয়েছে। অসংখ্য মানুষ সে বিদ্রোহে অংশ নিয়েছে, অসংখ্য মানুষ সে বিদ্রোহে জীবন দিয়েছে। কিন্তু ইতিহাস মনে রেখেছে শুধু স্পার্টাকাসকে। ফরাসি বিপ্লব হয়েছে, রুশ বিপ্লব হয়েছে, ভিয়েতনামে যুদ্ধ হয়েছে, চীনা বিপ্লব হয়েছে। মানবসভ্যতার ইতিহাস পরিবর্তনকারী এসব যুদ্ধ-বিপ্লবের মাঝখান থেকে উঠে এসেছে শুধু কয়েকটি নাম- লেলিন, হো চি মিন, মাও সেতুং। আর বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে কিংবা হারিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে অনেক নাম। ইতিহাস বড়ই নিষ্ঠুর, কাল বড় নির্মম- এটাই ইতিহাস আর কালের স্বভাব।
মানব ইতিহাস পরিবর্তনকারী, পৃথিবীর মানচিত্রের নকশা পরিবর্তনকারী এমনই আরেকটি মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে। ইতিহাসে যা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের এক স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। বীর বাঙালির অসীম সাহসিকতায় সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ নামের ছোট্ট একটি স্বাধীন দেশের।
মাত্র ষোল-সতের বছর বয়সের সদ্য কৈশোর থেকে যৌবনে পা রাখা এক তরুণ এই যুদ্ধে অংশ নিয়ে, দীর্ঘ নয় মাস ধরে যুদ্ধ করে বাঙালিকে উপহার দেয় বাংলাদেশ নামের এক স্বাধীন ভূ-খণ্ড। ইতিহাসের সেই তরুণ নায়ক আলী আকবরের কথা স্মৃতির ক্যানভাসে ভেসে উঠছে বার বার। হয়তো অনেকেই জানে না কে এই গণনায়ক? কে এই আলী আকবর?
ইতিহাস বড় নির্মম! ইতিহাসের নির্মমতায় বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে বসা এক গণনায়কের মুখচ্ছবি কেন জানি বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকবে জাতির যেকোনো ক্রান্তিকালগ্নে। আজকের এই দিনে মেঘাচ্ছন্ন বিশাল আকাশের নিচে ঝুল বারান্দায় বসে মেঘ ও রৌদ্রের লুকোচুরি খেলা দেখতে দেখতে বার বার মনে হচ্ছিল : কী এমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল সে সময়ে সেই সদ্য কৈশোর পেরুনো যুবক আলী আকবরের মনে? কোন প্রেরণায় সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অমন ভয়ংকর যুদ্ধে? ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর। ইতিহাসের কঠিন শুষ্ক পাতা থেকে বিস্মৃতির অতলে সে নাম হারিয়ে গেলেও জনগণমনে তাঁর স্মৃতি এখনও অম্লান।
মাত্র ছয় বছর বয়সে আকবর পিতৃহারা হলো। এতিম শিশুকে নিয়ে মায়ের সেকি দুশ্চিন্তা। সেই পরম জননীও মাত্র নয় বছর বয়সে আকবরকে রেখে ধরণী ত্যাগ করল। পিতা-মাতাহীন এতিম বালক লালিত-পালিত হতে থাকল দাদা মকবুল সরদারের কাছে।
সেদিনকার সেই মকবুল সরদার কি জানতো- তার এই ছোট্ট নাতিটি একদিন দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করবে, দেশেকে স্বাধীন করবে, দেশের মানুষের মুখে ছড়িয়ে দেবে স্বাধীনতার উজ্জ্বল হাসি?
দেশে তখন পাকিস্তানি শাসন-শোষণ চলছে। মাত্র ছয় বছর বয়সে আকবর দাদার সাথে মাঠে গরুল রাখালি শুরু করে।
অদ্ভুত রোমান্সে ভরা ছিল আকবরের শৈশব-কৈশোরের দিনগুলি। একদিকে ছিল নিষ্ঠুর দারিদ্র্য, জীবন জীবিকার চরম সংকট, খাদ্য সংকট, অস্থির সময়। অন্যদিকে ছিল বিদেশি শাষণ-শোষণের করালগ্রাস।
চব্বিশ জোড়া গরুর একটি পাল আকবর সেই ছোট্ট বয়সে পালন শুরু করে। দিগন্ত জোড়া বিস্তীর্ণ মাঠের সবুজ ঘাসে আকবর আর তার গরুর পালের বেড়ে ওঠা।
সকালে গরুকে খাওয়ানো, দুপুরে গোসল করানো আর সন্ধ্যায় গরুর পালকে বাড়িতে আনা, গোয়াল ঘরে গরুকে রাখা- মোটামুটি এই ছিল আকবরের ছকে বাঁধা কৈশোর জীবন। তবু এই ছকে বাঁধা কৈশোর জীবনে প্রতিক্ষণে কত বৈচিত্র্যই না আকবর সৃষ্টি করে চলতো- সেসব ঘটনা কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়