দেশী প্রজাতি মাছ বিলুপ্তির পথে

Spread the love

ভাঙ্গুড়া(পাবনা)প্রতিনিধি:  গ্রামবাংলার ঐতিহ্য পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু আর গোলা ভরা ধান। এসব এখন অনেকটাই কল্পনা। কালের বিবর্তনে ঐতিহ্যগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। একইভাবে খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, নদীতে সঠিক পরিবেশ না থাকায় দেশীয় প্রজাতির মাছগুলো বিলুপ্ত হতে চলেছে। একসময় গ্রামবাংলায় পৌষ-মাঘ মাসে পুকুর, খাল, ডোবা, হাওর-বাঁওড়ে পানি কমতে থাকলে মাছ ধরার ধুম পড়ে যেত। বর্ষাকালে ধানের জমিতে জাল, বড়শি ও চাঁই পেতে মাছ ধরার রীতিও এখন খুব একটা দেখা যায় না। একসময় দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ যেমন কই, শিং, মাগুর, পাবদা, ট্যাংরা, পুঁটি, চাঁন্দা, খলিসা, ডানকিনা, মলা, ঢেলা, চেলা, শাল চোপরা, টাকি, শোল, বোয়াল, আইড়, ভ্যাদা, বুড়াল, বাইম, ফলি, চিংড়ি, মালান্দা, খরকাটি, গজার, শবেদা, চ্যাং, চিতল, গতা, পোয়া, বেলে, উপর চকুয়া, কাকিলা, গুতুম, বৌরানির আগমনে গ্রামগঞ্জের মাছের বাজারগুলো সরব থাকত। এখন আর সেসব মাছ খুব একটা দেখা মেলে না। জেলেদের জালেও তেমন ধরা পড়ে না।

দেশ থেকে গত কয়েক দশকে বেশ কয়েক প্রজাতির পরিচিত দেশীয় মাছ বাজার থেকে ‘প্রায় নেই’ হয়ে গেছে। মৎস্য অধিদপ্তরের সূত্রমতে, হারিয়ে যাওয়া দেশি প্রজাতির মাছের সংখ্যা আড়াইশোর বেশি। তাই হাট-বাজার, পুকুর, খাল, বিল কোথায়ও এখন মিঠাপানির বহু সুস্বাদু মাছের দেখা মিলছে না। দেশি মাছের বদলে এখন বাজারে জায়গা দখল করে নিয়েছে চাষের পাঙাস, কই, শিং, মাগুর, পাবদা, ট্যাংরা, তেলাপিয়া, ক্রস ও কার্পজাতীয় মাছ। যারা একসময় পুকুর, খাল-বিল, ডোবা, নালায় মাছ ধরে পরিবারের চাহিদা পূরণ করতেন, তাদের অনেকেই এখন বাজার থেকে চাষের মাছ কিনে খেতে বাধ্য হচ্ছেন। নদীতে পানি না থাকায় আর খাল-বিল লিজ দেওয়ায় অনেক মৎস্যজীবীও বদলে ফেলেছেন তাদের পেশা।

গ্রামের মাছ বাজারের ক্রেতারা জানান, আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগেও মাছ কিনে খাওয়ার তেমন রেওয়াজ ছিল না। কেনার মধ্যে শুধু ইলিশ মাছ কেনা হতো। মাছের প্রয়োজন হলে সবাই বাড়ির সামনে খালে বা নদীতে চলে যেতেন। খালে, পুকুরে তখন এত মাছ ছিল যে, পানিতে নেমে খালি হাতেও মাছ ধরা যেত। এখন দেশি মাছ বাজারে নেই বললেই চলে, তবে যা আছে তা ন্যূনতম ৮০০-১০০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশীয় মাছ ক্রমেই হারিয়ে যাওয়ার জন্য মূলত অনেকগুলো কারণই দায়ী। এরই মধ্যে জলবায়ুর প্রভাব, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, কারেন্ট জালের অবৈধ ব্যবহার, ফসলি জমিতে অপরিকল্পিত কীটনাশক ব্যবহার, জলাশয় দূষণ, নদণ্ডনদীর নাব্যতা হ্রাস, উজানে বাঁধ নির্মাণ, নদীসংশ্লিষ্ট খাল-বিলের গভীরতা কমে যাওয়া, ডোবা ও জলাশয় ভরাট করা, মা মাছের আবাসস্থলের অভাব, ডিম ছাড়ার আগেই মা মাছ ধরে ফেলা, ডোবা-নালা-পুকুর ছেঁকে মাছ ধরা, বিদেশি রাক্ষুসে মাছের চাষ ও মাছের প্রজননে ব্যাঘাত ঘটানো। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এসব কারণেই ৫০টির বেশি দেশি প্রজাতির মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষি ও চাষাবাদ ব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। একই সঙ্গে পোনা আহরণ, নেটজাল ও মশারি জাল ব্যবহার করে খালে-বিলে মাছ ধরার কারণেও দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।হারিয়ে যাওয়া দেশি মাছ রক্ষায় ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তবে আশার কথা, বিলুপ্ত হওয়া প্রায় ৩০ প্রজাতির দেশীয় মাছ এখন বিশেষ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হচ্ছে। তা ছাড়া নদী-হাওর-বিলে দেশীয় মাছের পোনা অবমুক্তকরণ এবং মৎস্য অধিদপ্তর কর্র্তৃক অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় মাছের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এ ক্ষেত্রে মৎস্য হ্যাচারিগুলোও কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দেশি মাছের পোনা উৎপাদন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন মাছ চাষের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। এ ব্যাপারে উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি সরকারকেও উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করার জন্য প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি দেশীয় মাছের স্বাদণ্ডগন্ধ পুনরুদ্ধার করা যায় কি না- তারও গবেষণা হওয়া উচিতl

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD