পাহাড়ের কোলে লেপচাখা

Spread the love

ভুটানের কাছে ছোট্ট গ্রাম লেপচাখা। ট্রেক করতে করতে যেখানে প্রকৃতির অপরূপ শোভায় হারিয়ে যাওয়া যায়। সবুজ পাহাড়ে ঘেরা সেই গ্রাম ঘুরে এসে লিখছেন সুমন চট্টোপাধ্যায়

আলিপুরদুয়ার থেকে চলেছি ৩২ কিমি দূরের সান্তারাবাড়ি। দু’পাশে সেগুন আর মেহগনি গাছের জঙ্গলের মাঝ বরাবর মসৃণ রাস্তা। বাঁ দিকে রাজপথের সমান্তরালে রেলপথ চলে গিয়েছে ডুয়ার্সের বুক চিরে নিউ জলপাইগুড়ির দিকে। রেলকর্মী হওয়ার সুবাদে এই পথের কথা আগেই জানতাম। ডান দিকে ঘন জঙ্গলের ভিতরে চোখে পড়ল হাতির করিডোর। বেশ কিছু পথ পেরিয়ে গাড়ি থামল রাজাভাতখাওয়া চেকপোস্টে। এখানে প্রবেশমূল্য জমা দিয়ে চলে এলাম সান্তারাবাড়ি। এখানকার ছোট চেকপোস্টে প্রবেশপত্র দেখিয়ে হাঁটা শুরু করলাম বক্সার উদ্দেশে। তিন কিলোমিটার পর্যন্ত গাড়ি ঢুকতে পারে। তার পরে দুই কিলোমিটার পায়ে হেঁটে যেতে হয়। আমরা ক’জন পুরোটাই হাঁটব বলে মনস্থ করলাম। কারণ, রাস্তা আমাদের টানছিল। দু’পাশে শাল, সেগুনের জঙ্গল। মাঝ বরাবর ঢালাই চওড়া রাস্তা।

সদরবাজার পেরিয়ে বক্সাদুয়ার আসতেই কৌতূহলী চোখ আটকে গেল জরাজীর্ণ বক্সা দুর্গের ধ্বংসাবশেষের দিকে। একটি দোকানে স্যাক নামিয়ে খাবারের অর্ডার দিয়ে এগিয়ে গেলাম দুর্গের দিকে। কী করুণ অবস্থা! এই দুর্গে অনেক বিপ্লবী বন্দি ছিলেন। এর ইট, পাথরের সঙ্গে অনেক অত্যাচারের কাহিনি জড়িয়ে আছে। এমন দুর্গের এই হাল! একটি প্রাচীন বটগাছ তার শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে প্রায় ঢেকেই দিয়েছে এই বন্দিগৃহ। বড়ছোট গাছে ভরে গিয়েছে দুর্গের ধ্বংসাবশেষ।

বক্সা দুর্গের এই শোচনীয় হাল দেখে আশাহত হয়ে আবার স্যাক তুলে নিলাম। এখান থেকে আরও দুই কিলোমিটার ট্রেক করব। গন্তব্য, লেপচাখা গ্রাম। সুন্দর বনানীর মধ্য দিয়ে চওড়া পথ। ভদ্রস্থ চড়াই পথ। যে কোনও বয়সের মানুষ এ পথে আরামে চলতে পারবেন। পথের মাঝে দু’ধারে নানা রঙের ফুলের গাছ। পথের দু’পাশের দৃশ্য চলার কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। ক্লান্তির অনুভবই আসে না। এ ভাবে হাঁটতে হাঁটতে উঠে এলাম সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিন হাজার ফুট উচ্চতায় বাংলা ও ভুটান সীমান্তের রূপসী গ্রাম, লেপচাখায়। গ্রামটি পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত হলেও এটি আদতে একটি ভুটানি গ্রাম। এখানকার সকল অধিবাসীই ডুকপা সম্প্রদায়ের। প্রায় সত্তর-আশি ঘর লোক। আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করেন। এই গ্রামের মানুষের প্রধান জীবিকা হল চাষাবাদ। ভুট্টা, আদা, আলু, বাঁধাকপি, স্কোয়াশ, লেবু ইত্যাদি চাষ হয়। গ্রামের মাঝে তিব্বতি গুম্ফা। চারধারে প্রার্থনা পতাকা। ভুটান পাহাড় দিয়ে ঘেরা ডুয়ার্সের উচ্চ তরাই অঞ্চল। পাহাড়ের ও পাশেই ভুটান। এ পাশের গ্রামগুলি হল ফুলবাড়ি, আদমা, গোপ্তা, নামনা, চুনাভাটি, সদরবাজার, বক্সা, লেপচাখা, তাসিগাও, অংচুলুং। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পরে চিনা ও তিব্বতিরাও এ সব অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে।

বক্সাদুর্গের ধ্বংসাবশেষ।

আমাদের হোম স্টে-র ব্যবস্থা করা ছিল। সবুজ রঙের কাঠের দো’তলা ডুকপা ট্রেকার্স হাট আমাদের আশ্রয়স্থল। সামনে উন্মুক্ত দিগন্ত। সবুজ পাহাড়, ছোট ছোট গ্রাম, সোপান খেত, নদীধারা, বৃক্ষরাজি। বাংলার উচ্চ তরাইয়ের এই অখ্যাত গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে চোখ জুড়িয়ে দেয়। আগে থেকে জানতাম, সূর্যোদয় মিস করা যাবে না। সূর্যোদয় দেখার জন্য যেতে হবে রোভার্স ভিউ পয়েন্ট। হোম স্টে-র মালকিনের হাতে বানানো গরমাগরম পুরি-তরকারি নিয়ে আবছা অন্ধকারেই বেরিয়ে পরলাম। ঠান্ডাটা বেশ উপভোগ্য। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চড়াই পথ। দু’কিলোমিটার পথ পেরিয়ে চলে এলাম তাসিগাও। এখানেও একটা গুম্ফা আছে। তিব্বতি পোশাক পরে পুরুষেরা তীরন্দাজিতে মেতেছে। গ্রামের মহিলারা পুজোর প্রসাদ ও খাবারদাবার বানিয়ে এনেছেন। জানলাম, সাত দিন ধরে এখানে উৎসব চলবে। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে সময় কাটিয়ে আবার হাঁটা লাগালাম।

কী ভাবে যাবেন

•  ট্রেনে নিউ আলিপুরদুয়ার বা আলিপুরদুয়ার জংশন। সেখান থেকে গাড়িতে ৩২ কিলোমিটার দূরে সান্তারাবাড়ি। বড় গাড়ির ভাড়া প্রায় ১২০০ টাকা। রাজাভাতখাওয়া চেকপোস্টে জন প্রতি ৬০ টাকা প্রবেশমূল্য লাগে। গাড়ি পিছু লাগে ২৫০ টাকা। লেপচাখা চার কিলোমিটার দূরে। ট্রেক করে যাওয়া যায়। রাস্তা বেশ চওড়া।

 

কোথায় থাকবেন

• লেপচাখায় থাকার জন্য গোটা পাঁচেক হোম স্টে আছে। ব্যবস্থা বেশ ভাল। থাকা খাওয়া জন প্রতি, প্রতি দিন ৮০০ টাকা। বক্সায় থাকার জন্য সাধারণ মানের দু’-একটি হোম-স্টে রয়েছে।

 

কী দেখবেন

• প্রধান আকর্ষণ লেপচাখার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। লেপচাখা থেকে ছোট ছোট ট্রেক করে ঘুরে আসা যায় চুনাভাটি, অংচুলুং ও তাসিগাও। ভুটান পাহাড় দিয়ে ঘেরা টেবিলের মতো একচিলতে লেপচাখায় দিন দুয়েক কাটানোর অভিজ্ঞতা এক কথায় অসাধারণ। অতি উৎসাহীরা রূপম ভ্যালি ট্রেক করতে চাইলে সঙ্গে টেন্ট ও রেশন থাকা বাঞ্ছনীয়।

এখান থেকে রোভার্স ভিউ পয়েন্ট আরও চার কিলোমিটার হাঁটাপথ। ধীরে ধীরে গ্রাম ছাড়িয়ে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলাম। চেস্টনাট, শাল, সেগুন, বাঁশের ঘন জঙ্গল। চলতে চলতে যথারীতি আমার গতি বেড়ে গেল। মোবাইলে গান শুনতে শুনতে সঙ্গীদের ছাড়িয়ে আমি বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলাম। আর তখনই নিস্তব্ধতা ভেঙে দু’পাশের জঙ্গল থেকে বিচিত্র রকমের আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল আমার কানে। এক অজানা ভয় চেপে বসল মনে। হয়তো যে কোনও সময়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে বুনো শুয়োর, লেপার্ড বা ভল্লুক। পড়িমড়ি করে ছুট লাগালাম সঙ্গীদের কাছে। আমাকে ও ভাবে ছুটে আসতে দেখে গাইড প্রকাশ কারণ জিজ্ঞেস করল। সব শুনে মুচকি হেসে নিদান দিল সকলকে এক সঙ্গে চলার। গহন অরণ্যের মধ্য দিয়ে ক্রমে আমরা উঠে এলাম রোভার্স ভিউ পয়েন্টে। উচ্চতা চার হাজার ফুট। এখান থেকে দূরের লেপচাখা, অংচুলুং, তাসিগাও, বক্সা, চুনাভাটি নজরে আসছে। এই ভিউ পয়েন্টের সমতলভূমিতে বসে সারা হল নাস্তা। এই পথে আরও দশ কিলোমিটার দূরে সিনচু লা পেরিয়ে রূপম উপত্যকা। এটা একটা বহু পুরনো রেশমপথ। আগে ভুটানের যাতায়াত ছিল এই পথেই। গহন অরণ্য, সবুজ ভুটান পাহাড়, ভুটান-বাংলা সীমান্তে এ পথের শেষ গ্রাম তাসিগাও ছেড়ে আমরা ফিরে চললাম লেপচাখার পথে।

ছবি: লেখক।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD