ফাওজিয়া ফারহাত অনীকা: একজন নারীর স্বাভাবিক শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়া হলো ঋতুস্রাব বা পিরিয়ড। প্রতি মাসে নির্দিষ্ট সময় অন্তর এই প্রক্রিয়াটির পুনরাবৃত্তি হয়। একজন সুস্থ নারীর শারীরিক সুস্থতার লক্ষণও প্রকাশ পায় নিয়মিত পিরিয়ড চক্রের মাধ্যমে। যার ফলে, পিরিয়ড একজন নারীর স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবন-যাপনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শরীরের প্রতিটি ক্রিয়ার সাথেই সংযুক্ত রয়েছে প্রতিদিনের জীবন-যাপনের অভ্যাস। বিশেষত, শরীরের সেই ক্রিয়াটি যদি হয়ে থাকে পিরিয়ডের মতো স্পর্শকাতর একটি ব্যাপার, তখন বুঝতে হবে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
একজন নারীর নিত্যদিনের অভ্যাসের প্রভাব পড়ে থাকে তার পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে। দুঃখজনক ব্যপার হলো, পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে একজন নারীর কী করা উচিৎ এবং কোন কাজগুলো এড়িয়ে চলা উচিৎ অনেকেই সেটা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখেন না। এছাড়াও বেশীরভাগ নারী পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে বেশ কিছু ভুল কাজ করে থাকেন। যার ফলে, নারী স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার প্রাদুর্ভাব বেশী দেখা দেয় আমাদের দেশে। তাই নিজের শারীরিক সুস্থতার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে নিজেকেই। জানতে হবে পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে কী করা উচিৎ ও উচিৎ নয়। একইসাথে পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে কোন অভ্যাসগুলো পরিহার করা উচিৎ সম্পুর্ণভাবে।
রক্তের রং সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে
শরীরের অন্যান্য অংশ এবং শরীরের অন্যান্য খুঁটিনাটি ব্যাপারের মতো পিরিয়ডের রক্তের রং সম্পর্কে খুব ভালোমতো সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। কখনোই পিরিয়ডে রক্তের রং এর ব্যাপারে হেলাফেলা করা যাবে না। পিরিয়ড শুরু হওয়ার সময়ে রক্তে রং থাকবে বাদামী বর্ণের এবং সময়ের সাথে সাথে সেটা হয়ে থাকে উজ্জ্বল লাল রঙের। পিরিয়ডের শেষের দিকে সেটা সাধারণত হয়ে যাবে গাড় বাদামী বর্ণের- অনেকটা কালো রঙের মতো। যেটা স্বাভাবিক রক্তের রঙের চক্র। কিন্তু পিরিয়ডের রক্তের রং যদি শুধুমাত্র লাল অথবা শুধুমাত্র বাদামী বর্ণের থাকে পুরোটা সময় জুড়ে, তবে দ্রুত কোন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
পিরিয়ডের সময়সূচী সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা
বেশীরভাগ নারী মনে করেন, পিরিয়ডের সময়সূচী সম্পর্কে অবগত হওয়া প্রয়োজন গর্ভধারনের পরিকল্পনার জন্য। কিন্তু এটা মোটেও সঠিক নয়। লুকিয়ে থাকা বিভিন্ন ধরণের শারীরিক সমস্যার কারণে পিরিয়ড অনিয়মিত হয়ে থাকে। যেটা ভালমতো বুঝতে পারার জন্যে প্রয়োজন, সঠিক সময়ের পিরিয়ডের সময়সূচী সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখা।
নিয়মিত স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ট্যাম্পন বদলানো
শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার জন্যে এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার জন্যে নিয়মিত ও যথাসময়ে ব্যবহৃত স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ট্যাম্পন বদলানো জরুরি। অনেকেই এই ব্যাপারে একেবারেই সচেতন নয়। আমাদের দেশের বেশীরভাগ নারী স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে থাকেন। বিধায় দেখা যায়, অনেকেই একই স্যানিটারি ন্যাপকিন টানা এক-দিন দিন পর্যন্ত ব্যবহার করে থাকেন। যা স্বাস্থ্যের জন্যে হুমকিস্বরূপ। কারণ, স্যানিটারি ন্যাপকিনে খুব দ্রুত ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত হয়ে থাকে। যে কারণে, প্রতি ৬-৭ ঘন্টা অন্তর ব্যবহৃত স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ট্যাম্পন বদলাতে হবে।
খাওয়া-দাওয়া না করা
পিরিয়ড শুরুর আগে এবং পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে অনেক নারী বিভিন্ন ধরণের শারীরিক সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকেন। এর মাঝে থাকে, জ্বর ভাব, বমি ভাব, কোষ্ঠ্যকাঠিন্য, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন ধরণের উপসর্গ দেখা দিয়ে থাকে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তলপেটে প্রচণ্ড ব্যাথাভাব তৈরি হয় পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে। এই সকল কারণে, পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে খাওয়ার প্রতি অনীহা তৈরি হয় এবং অনেক নারী একেবারেই না খেয়ে থাকেন। যেটা করা একেবারেই উচিৎ নয়। বরং, পিরিয়ডের সময়ে একজন নারীর প্রয়োজন বিভিন্ন ধরণের পুষ্টির। যা স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভব। তাই, পিরিয়ড শুরু হবার আগে এবং পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে যথাসম্ভব স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণের চেষ্টা করতে হবে।
ডাউচিং
ডাউচিং হলো, হ্যান্ড শাওয়ার ব্যবহারের মাধ্যমে যৌনাঙ্গ পরিষ্কার করা। পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে বেশীরভাগ নারী প্রয়োজনের তুলনায় বেশী ডাউচিং করে থাকেন পরিষ্কার থাকার জন্যে। কিন্তু এটার যে একেবারেই প্রয়োজন নেই সেটা অনেকেই জানেন না। কারণ, নারীদের যৌনাঙ্গে পিরিয়ডের সময় প্রাকৃতিকভাবে পরিষ্কার রাখার কাজটি হয়ে থাকে। বেশী পরিমাণে ডাউচিং করার ফলে উপকারী ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হয়ে যায়। যার ফলে ভ্যাজাইনাল ইনফেকশনের মতো সমস্যা তৈরি হয়ে থাকে।
অরক্ষিত সহবাস
অনেকেই পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে সহবাসকে সুরক্ষিত বলে মনে করে থাকেন। কিন্তু সত্য হচ্ছে, এই সময়ে অরক্ষিত অবস্থায় যৌন সম্পর্ক স্থাপনে STD (sexually transmitted disease) এর সম্ভবনা বেড়ে যায় তুলনামূলক অনেক বেশী। এ কারণে, যেকোন অবস্থাতেই অরক্ষিত যৌন সহবাস থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করতে হবে।
অতিরিক্ত পেইনকিলার গ্রহণ করা
পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে বেশীরভাগ নারীর প্রচণ্ড তলপেটে ব্যথাভাব তৈরি হয়। যার ফলে অনেকেই বিভিন্ন ধরণের পেইনকিলার গ্রহণ করেন। তবে অতিরিক্ত পেইনকিলার গ্রহণে কিডনি ও লিভার এর ক্ষতি হবার সম্ভবনা প্রবল হয়ে ওঠে। যে কারণে, গরম পানির ভাপ ও গ্রিন টি পানের মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে পেটে ব্যথাভাব দূর করার চেষ্টা করতে হবে।
চলাচল না করা
সাধারণত, পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে নারীরা খুব একটা চলাচল করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। এর ফলে বেশীরভাগ সময় তারা বিছানায় শুয়ে-বসে কিংবা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেন। কিন্তু একটা ব্যাপার জেনে অবাক হবেন, পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে তলপেটের ব্যথা কমানোর ক্ষেত্রে হাঁটাচলা করা খুবই কার্যকরী ভূমিকা রাখে। এছাড়াও, রক্তের প্রবাহ ঠিক রাখার জন্যেও, স্বাভাবিক ও পর্যাপ্ত হাঁটাচলা করা প্রয়োজন একজন নারীর। অবশ্যই পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে বিশ্রামের প্রয়োজন, তবে সেটার জন্য যেন হাঁটাচলার নিয়মে ব্যঘাত না ঘটে সেই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
একজন নারীর স্বাভাবিক শারীরিক সুস্থতার অনেকটাই নির্ভর করে সুস্থ পিরিয়ড এর উপরে। যে কারণে, প্রতি মাসের এই গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সময়টির ব্যাপারে সতর্ক ও সম্যক ধারনা থাকা প্রয়োজন প্রতিটি নারীর।
সূত্র: Curejoy