প্রয়াত কবি শ্রদ্ধেয় শামসুর রাহমানের ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা’ আর ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতা দুটি সেই শৈশব থেকেই কতবার যে পড়েছি, সেই হিসাবের ভেতর কখনো যাওয়ার চেষ্টা করি না। তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতা তুমি না পড়ে মনের তৃপ্তি মেটে না। কবিতা দুটি যেন একই সুতোয় গাঁথা একটা অবিচ্ছিন্ন আত্মা। কবি নিজেই মজা করে কবিতা দুটিকে যমজ কবিতা বলতেন। কবিতা দুটি পড়ার পর বুকের ভেতরের কষ্টের কণাগুলো উথাল পাথাল করে।
আমার পরিচিত এক বাঙালি ভদ্রলোক এই অস্ট্রেলিয়াতেই বসবাস করেন। তাঁকে একদিন প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলাম, কবিতা দুটি পড়লে আমার বুকের ভেতর একধরনের কষ্ট হয়। ভদ্রলোক আমার দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন, কবিতা দুটিতে দুটি লাইন আছে, লাইন দুটির মানে বোঝেন?
আমি মিনমিন করে বলি, লাইন দুটি কি ভাই?
—একটা লাইন তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা কবিতার—আর কতোবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন? অন্যটা স্বাধীনতা তুমি কবিতার—স্বাধীনতা তুমি রবিঠাকুরের অজর কবিতা অবিনাশী গান। ভদ্রলোক লাইন দুটি বলে আবারও জিজ্ঞাসা করলেন, খাণ্ডবদাহন আর রবিঠাকুরের অজর কবিতার মানে বোঝেন, কেন কবি কবিতা দুটিতে শব্দ দুটি ব্যবহার করেছেন?
আমি গলার স্বর কমিয়ে আরও নিচে এনে বলি, ভাই আমি কবিতা বুঝি না। কিন্তু এই কবিতা দুটি পড়ি, পড়ার পর বুকের ভেতর কষ্ট হয়। আমি বারে বারে চলে যাই সুদূর অতীতে, আমার বাবা-মায়ের কাছে।
একটু থেমে আমি নিচু গলাতেই ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করি, ভাই, আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহনের আগের লাইনটা যেন কি? ভদ্রলোক নির্লিপ্ত গলায় গম্ভীরভাবে বললেন, লাইনটা মনে নেই, তবে আমি অসংখ্যবার কবিতা দুটি পড়েছি। কবিতা দুই পড়ে আপনার যেমন কষ্ট হয়, আমার হয় না। কারণ স্বাধীনতা তুমি কবিতায় কবি বাঙালি জাতিকে একটি দেশের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আমি সেই স্বপ্নই দেখি!
ভদ্রলোককে আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন লাইনের আগের লাইনটা কী জিজ্ঞাসা করার সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথার ভেতর একের পর এক কবিতার পঙ্ক্তিমালা আবৃতি হয়ে যাচ্ছে। আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়, অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর, মোল্লাবাড়ির এক বিধবা দাঁড়িয়ে আছে নড়বড়ে খুঁটি ধরে দগ্ধ ঘরের। ভদ্রলোক কী বলছেন আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না, আমি দেখতে পাচ্ছি।
অগ্নিদেব খাণ্ডব বন দাহ করতে কৃষ্ণ ও অর্জুনের সাহায্য চাইলেন। কৃষ্ণ ও অর্জুন দুই রথে আরোহণ করলে, অগ্নি খান্ডব বন দগ্ধ করতে লাগলেন। পশুপাখি চিৎকার করে পালাতে গেল, কিন্তু অর্জুনের বাণে কোনো প্রাণী নিস্তার পেল না। ইন্দ্র ব্রজ নিয়ে খান্ডব বন রক্ষায় এগিয়ে এল আর অন্যান্য দেবগণ নিজ নিজ অস্ত্র নিয়ে এলেন। ইন্দ্র মন্দর পর্বতের একটি বিশাল শৃঙ্গ তুলে অর্জুনের দিকে নিক্ষেপ করলেন। অর্জুনের বাণে পর্বত শৃঙ্গ সহস্রখন্ড হয়ে খান্ডব বনে আছড়ে পড়ল। ফলে অসংখ্য প্রাণী নিহত হলো। ইন্দ্রাদি দেবগণের পরাজয়ে অগ্নি পনেরো দিন ধরে খাণ্ডব বন দগ্ধ করল। কেউ জীবিত রইল না!
মহাভারতে খাণ্ডব দাহ পর্ব এভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে। মহাভারতে বর্ণিত কাহিনি আমরা পড়েছি মাত্র, দেখিনি! কিন্তু একটি বন নয়, একটি পুরো দেশ জ্বলছে, শুধুই বনের প্রাণী নয়, প্রাণীদের থেকেও বেশি মানুষ মরছে, এটা কোনো গল্প থেকে ধার করা নয়, কোনো কবিতা উপন্যাস বা ছায়াছবি থেকে আবৃতি, বর্ণনা বা কাহিনি ধার করে নয়। বইয়ে পড়া ঘটনা নয়। কচি মনে, কচি বয়সে মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেঁথে যাওয়া দৃশ্যাবলি। নয় দশ বছরের একটি বালক আমি, আমার চারপাশে, আমার পরিচিতের, আমার পরিবারের ভেতর স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালের ঘটনাগুলো।
আমার চোখে ভেসে ওঠে আমার ষোলো সতেরো বৎসর বয়সের বিবাহিত চাচাতো বোনের স্বামীকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আর রাজাকার-আলবদরের মানুষরূপী পিশাচেরা কোনো গুলি খরচ করে নয়, মাথার খুলিতে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মগজসহ মাথারচুল উপড়িয়ে হত্যার উল্লাস। আমার বড় চাচার দুই দুটি সন্তান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চ পদমর্যাদায় চাকরিরত থাকা অবস্থায়ও শুধুমাত্র বাঙালি হওয়ার অপরাধে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধকে নির্মমভাবে হত্যা আর লাশ চিরতরে গুম। আমার বড় বোনের দেবর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কারণে তার বড় ভাইয়ের বুকের পাঁজরের হাড় বুটের আঘাতে অসংখ্য টুকরো করে দেওয়া। আমার মায়ের নিজের স্বাধীন সার্বভৌম সংসার যুদ্ধের আগুনে পুড়ে ছারখার। স্বামী হারিয়ে আমার মায়ের আমৃত্যু নিঃশব্দ হাহাকার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও মায়ের সন্তানদের মানুষ করার সংগ্রাম আমার চোখে কোনো স্বপ্ন আনার চেয়ে, কবিতার পঙ্ক্তিমালা মাথার ভেতর আনাগোনার চেয়ে, কল্পনার কোনো ছবি নয়, নিজের জীবনে কচি মনের দগদগে ঘটনাগুলো চলমান হয়ে যায়, আমি যন্ত্রণায় ছটফট করি, আজও, এই এত বৎসর পরেও।
এপ্রিল মাস, ১৯৭১ সাল! পাকিস্তানি মিলিটারিদের ভয়ে ছোট শহর ছেড়ে গ্রামে পালাচ্ছি। কখনো জঙ্গলে, কখনো গর্তে লুকিয়ে থেকে প্রায় এক মাস ধরে হেঁটে, গ্রামের বাড়িতে মে মাসে এসে আশ্রয় নিলাম! জুন মাসের দিকে বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মহকুমা, থানা, গ্রাম কোথাও কোনো ডাক্তার নেই। বাজারের ওষুধের দোকানসহ সব ধরনের দোকানপাট পাকিস্তানিরা জ্বালিয়ে দিয়েছে। মহকুমার হসপিটাল, ক্লিনিক পুড়িয়ে দিয়েছে। ঢাকায়, এমনকি বড় কোনো জেলা শহরে বাবাকে নিয়ে যাওয়ার আর্থিক সামর্থ্য, উপায়, সংগতি কোনোটাই নেই। আমরা জানি না বাবার কী হয়েছে! অবস্থার ক্রমাবনতি হতে হতে বাবা শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন। বাবা তখনো আস্তে আস্তে কথা বলতে পারেন। একদিন মাকে বললেন, আমি বোধ হয় আর বাঁচব না। মা সারাক্ষণ বাবার কাছে বসে থাকেন। মায়ের চোখে সব সময়ই পানি। বাবা দেখলে কষ্ট পাবেন, মা বসেন বাবার মাথার পেছনে। মা বাবার কপালে আলতো করে বাম হাতটি রাখেন, ডান হাতে তাঁর কোরআন শরিফ। মা মৃদু স্বরে বলেন, আল্লাহ না করুক! এমন অলক্ষুনে কথা কখনো বলবে না। ইনশা আল্লাহ তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। চাকরিতে জয়েন করবে। আমরা আবার আমাদের বাসায় ফিরে যাব! একটু থেমে মা আবার বলেন, আমার মা ছিল না, কোনোদিন কারও আদর যত্ন পাইনি। সারা জীবন আমি আল্লাহর কাছে শুধু একটা সুন্দর সংসার চেয়েছি। আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। আল্লাহ আমার এত বড় সর্বনাশ হতে দেবেন না! যশোরে আমাদের নিজের বাড়ি হবে! ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে, ওদের বিয়ে দেব, নাতি-নাতনি হবে। মা আর কিছু বলতে পারেন না। মায়ের দু চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। পানির ফোটাগুলো বাবার কপালে পড়ার আগেই মা নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে ফেলেন।
আগস্টের ১৪ তারিখ, কাক ডাকা ভোর। চারদিকে তখনো হালকা অন্ধকার। বাবার শেষ সময়। আগের রাত থেকেই বাবার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। গত দুই দিন ধরে তিনি সম্পূর্ণ অচেতনতার ভেতর চলে গেছেন। ফুসফুস প্রতিটি নিশ্বাস নিচ্ছে মিনিট ধরে, ফুসফুসের বাতাসের অভাবের যন্ত্রণার শব্দ আমরা শুনতে পাচ্ছি। আমরা সবাই তাঁর চারদিকে বসে আছি। আমরা বুঝতে পারছি তিনি চলে যাচ্ছেন। একজন মানুষ, যে আমাদের বাবা, আমার মার সারা জীবনের সঙ্গী, পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, সবাই মাথার কাছে বসে অসহায়ের মতো তাঁর চলে যাওয়ার প্রতিটা সেকেন্ড দেখতে পাচ্ছি। ফুফু কোরআন তিলাওয়াত করছেন, ‘ইয়া-সিন অল কুরানিল হাকিম,,,।’ আমরা অঝোরে কেঁদে যাচ্ছি। মার উন্মত্ত চেহারার দিকে তাকানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। মা বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে উদভ্রান্তের মতো কেঁদে যাচ্ছেন—‘শোন, তুমি আমাকে, আমার বাচ্চাদের কার কাছে রেখে যাচ্ছ।’ ‘শোন, তুমি আমাদের কোথায় রেখে যাচ্ছ?’ ‘এই, শোনো…।’ আমার মার বুকফাটা আকুতি বাবা শুনতে পাচ্ছিলেন কিনা জানি না, বাবার শরীর নিথর, চোখ দুটি বন্ধ, কিন্তু দুই চোখের কোণা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। বাবা চলে গেলেন! মা শূন্যের দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন, ‘আল্লাগো, এখন আমি কোথায় যাব, এই দুধের বাচ্চাদের কীভাবে বাঁচাব?’
এর আগে আমরা কখনো গ্রামে থাকিনি। আমরা কেউ কখনো মৃত্যু দেখিনি। প্রথম মৃত্যু দেখলাম। এমন একজনের মৃত্যু আমাদের দেখতে হলো যিনি আমাদের প্রিয় বাবা। একজন সুস্থ মানুষ মিনিটে ১২-১৬ বার শ্বাস-প্রশ্বাস নেন। বাবা মৃত্যুর আগে আধা মিনিট ধরে শ্বাস নিচ্ছেন, আর আধা মিনিট ধরে শ্বাস ফেলছেন। ফুসফুসের বাতাস নেওয়ার এই যন্ত্রণার শব্দ আমরা অসহায়ভাবে দেখছি। মৃত্যুর এই বিভীষিকা আমার ওই বয়সের মন থেকে কখনই দুর করতে পারিনি। গ্রামে মৃত্যুটাও যে একটা আনুষ্ঠানিকতায় রূপ পায় তাও জানা ছিল না। বাবা মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষজন আসতে শুরু করল। বাবার মৃতদেহটা মাথা থেকে পা পর্যন্ত সাদা চাদরে ঢাকা। ছোট, বড়, ছেলে, মেয়ে, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা যে আসছে, সেই বাবার মুখ থেকে চাদর সরাতে বলছে। মুখ দেখবে। ছোট বাচ্চা কোলে কোনো একজন নারী এসেছেন। তিনি নিজে মৃত বাবার মুখটা দেখেন, কোলের সন্তানটিকে দেখিয়ে বলেন, ওই যে দেখো মরা মুখ। আমাদের প্রিয় বাবা তাদের কাছে মরা মুখ!
চেনা অচেনা, পরিচিত, অপরিচিত মানুষে ঘর ভরা, উঠোন ভরা, বাইরের খোলা জায়গা ভরা। বাবার মাসব্যাপী অসুস্থতার সময়ে যে মানুষটির কাছে আমরা সবাই সারাক্ষণ আষ্টেপৃষ্ঠে বসে থেকেছি। আজ সেই মানুষটির কাছে যেতে পারছি না। শেষ কবে খেয়েছি মনে নেই। বাবার ভয়াবহ শারীরিক অবনতির সময় মা নিজের নাওয়া খাওয়া ভুলে গিয়েছিলেন। সন্তানদের দিকে তাকাতে ভুলে গিয়েছিলেন। মরা বাড়ি চুলা জ্বালাতে নেই, মৃতদেহ কবর না দেওয়া পর্যন্ত খেতেও নেই। তারপরেও উঠোনের এককোণে একটু গর্ত মতো করে তিন পার্শ্বে তিনটি ইট দিয়ে চুলো বানিয়ে বড় অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে পানি গরম হচ্ছে। পানির ভেতর দেওয়া হয়েছে কচি বেল পাতা, বরই পাতা, নিম পাতা আর কর্পূরের গুঁড়া। বাবার ঘরে আগর বাতি জ্বালানো হয়েছে, কেউ একজন জ্বালিয়েছে। আগর বাতির ধোঁয়ার গন্ধের সঙ্গে গরম পানিতে মেশানো বেলপাতা, বরই পাতা, নিম পাতা আর কর্পূরের গন্ধে এক বিষাদের গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। একটা সাদা রঙের বাটিতে দুটি মোড়ক খোলা নতুন হাবিব সাবান, আর পরিষ্কার ন্যাকড়া ধরনের কাপড়।
জানি বাবা মারা গেছেন। বাবা তো ঘরেই আছেন! বাবা যে সারা জীবনের জন্য আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, এই বোধশক্তি বোধ হয় তখন আমার আর ছিল না। ক্ষুধায়, ক্লান্তিতে, ঘুমের অভাবে হয়তো বোধশক্তি লোপ পেয়েছিল। সবাই কাঁদছে, আমিও কাঁদছি। আমি শোকের কান্নার চেয়ে মনে হয় খিদের কষ্টে বেশি কাঁদছিলাম। মার কাছে ঘেঁষতে পারছি না, মাকে ঘিরে পাড়ার বহু নারী। ভাইবোনদের সঙ্গে কাঁদি, আবার একটু বাইরের খোলা উঠোনে গিয়ে মানুষজন দেখি। তাঁদের কর্মকাণ্ড দেখি। পুকুর পাড়ে আমাদের পারিবারিক গোরস্থানে কিছু লোক লম্বা আয়তাকারের মতো গর্ত করছে কোদাল দিয়ে। সদ্য খোঁড়া মাটির গন্ধ, পাশেই বাঁশঝাড়ের গুমোট গন্ধ, আর চারদিকের বুনো জঙ্গলরে গন্ধ এক হয়ে ওই গর্ত খোঁড়া মানুষগুলোকে কেমন যেন নিশ্চুপ রেখেছে।
উঠোনে দাঁড়িয়ে বড় পাতিলে পানি গরম করা দেখছি। হঠাৎ দেখি কিছু লোক আমাদের পারিবারিক গোরস্থান থেকে মোটা মোটা লম্বা, গাঢ় সবুজ রঙের বাঁশ কেটে উঠোনে রাখছে। ওই গাঢ় সবুজ রঙের বাঁশগুলো দেখে হঠাৎ মনে হলো, আমার বাবা মারা গেছেন! আর একটু পরেই বাবাকে ঘর থেকে নিয়ে যাবে। চুলোয় বেল পাতা, বরই পাতা, নিম পাতা আর কর্পূর মিশিয়ে যে পানি গরম হচ্ছে ওই পানি দিয়ে বাবাকে গোসল করানো হবে। মোড়ক খোলা হাবিব সাবান দিয়ে তাঁর শরীর পরিষ্কার করা হবে। গোসল করিয়ে বাবার শরীর, মাথা মুছে দিয়ে, বাবার বড় বড় ব্যাক ব্রাশ করা চুলগুলো আঁচড়িয়ে দেবে। চোখে সুরমা দিয়ে বাবার শরীরটি সাদা ধবধবে কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে, বাঁশ কেটে বানানো খাটিয়ার করে কবরস্থানে যে আয়তাকার গর্ত খোঁড়া হচ্ছে সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে বাবাকে শোয়ানো হবে! বাবা চলে যাবেন। সারা জীবনের জন্য, আর কোনো দিন তিনি আমাদের মাঝে ফিরবেন না। আর কোনো দিন আমরা বাবাকে দেখব না! আমি দৌড়ে ঘরে এসে সবাইকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলি, মা দেখো ওরা বাঁশ কেটে এনেছে। ওরা বাবাকে নিয়ে যাবে! আমি ভুলে যাই আমার বাবা মৃত। বাবার শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দুহাতে তাঁর দেহটি প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে চিৎকার করি, আমার বাবাকে নিয়ে যেতে দেব না! ও মা, তুমি ওদের ঠেকাও!
তারপর দেশ স্বাধীন হলো। সাত কোটি মানুষ স্বাধীনতা পেল। আর আমার মা! নিজের স্বাধীন সংসার হারিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁর বাচ্চাদের স্বাবলম্বী করার কঠিন সংগ্রামে! মার সেই হাসিখুশি মাখা, প্রাণোচ্ছলে ভরা চেহারা আমরা আর কখনো দেখিনি। আমার মা আর কখনো স্বপ্ন দেখেননি যশোর শহরে নিজের সেই স্বপ্নের বাড়ির!
শ্রদ্ধেয় কবি শামসুর রাহমান বেঁচে থাকলে তাঁকে অনুরোধ করে একটা চিঠি লিখতাম।
বলতাম, প্রিয় কবি, আপনি তো স্বাধীনতার কবি! আপনি কি আমার একটা অনুরোধ রাখবেন? দয়া করে নিচের লাইন তিনটি আপনি কি আপনার বিখ্যাত তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা অথবা আপনার অন্য একটি কবিতার কোনো এক জায়গায় ঢুকিয়ে দিতে পারবেন, অথবা সংযোজন?
‘স্বাধীনতা তুমি, পিতার জন্য একটি বালকের বুক ছেঁড়া দীর্ঘশ্বাস!
স্বাধীনতা তুমি স্বাধীন নারীর স্বপ্নভাঙা আমৃত্যু পরাধীনতা,
স্বাধীনতা তুমি অব্যক্ত যন্ত্রণায় গুমরে মরা একটি মায়ের লাশ।’
* সাদিক আওয়াল: মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া।