বাহার আজ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেছে। ক্লাস না থাকলে সাধারণত সে এত সকালে ঘুম থেকে ওঠে না। আজ ক্লাস নেই। ক্রিসমাসের ব্যস্ততা থাকলেও আজকে সে পিৎজা ডেলিভারি থেকে বসকে অনেক বলে কয়ে ছুটি নিয়েছে।
আজ ১৬ ডিসেম্বর। বিজয়ের দিন। গত বছরের এই দিনটিতে সে দেশে ছিল। এই বছরই ফেব্রুয়ারিতে সে ইকোনমিকসে এমএস করতে সিডনিতে এসেছে। ইউনিভার্সিটির ডরমিটরিতে থাকতে তার দম বন্ধ হয়ে আসে। তাই সুযোগ পেলেই সে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ে।
আজ বিকেলে অলিম্পিক পার্কের স্পটলেস স্টেডিয়ামে বিসিবি একাদশ বনাম সিডনি থান্ডার্সের মধ্যে টি টুয়েন্টি ম্যাচ আছে। এ ছাড়া ওয়ালি পার্কের হরিজন থিয়েটারে সারগাম আয়োজিত বিজয়ের গান ও কবিতার আয়োজন আছে।
বিজয়ের এই দিনে আজ সারা দিন সে সিডনির পথে পথে হাঁটবে। ঢাকার মতো এখানে মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকান থাকলে ভালো হতো। একটু পর পরই চা খাওয়া যেত। বাহার তার ব্যাগে প্রিয় ক্যামেরা ও বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে ডরমিটরি থেকে বেরিয়ে পড়ল।
আজ সিডনিতে সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। তাই বিজয়ের এই ভোরে বাহার অ্যাশফিল্ডের শহীদ মিনারে তেমন ভিড় দেখতে পেল না। সে তার ব্যাগ থেকে লাল সবুজের পতাকা বের করে শহীদ মিনারের পাশে একটি গাছে বেঁধে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। সকালে পার্কে হাঁটতে আসা কিছু স্থানীয় ও বিদেশি পতাকার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
বেলা বাড়লে বাহার উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে হাঁটতে একটি পার্কের বেঞ্চিতে এসে বসল। হঠাৎ সে দেখল পার্কের অপর পাশের দোতলা ফ্ল্যাটের একটি ব্যালকনিতে একটি লাল সবুজের পতাকা উড়ছে। বাহার উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে ফ্ল্যাট বাড়িটার নিচে এসে দাঁড়াল। আধা ঘণ্টার মতো দাঁড়িয়ে থাকার পরও ব্যালকনিতে কাউকে দেখা গেল না। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল পতাকার মালিককে না দেখে সে যাবে না।
কিছুক্ষণ পরে অবাক হয়ে সাদা শাড়ি পরা একজন বাঙালি বৃদ্ধাকে ব্যালকনিতে পতাকার সামনে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। বাহার ব্যাগে রাখা তার পতাকা বের করে সামনের একটা লাইট পোস্টে বেঁধে দিল। কিছুক্ষণ পরে বৃদ্ধা লাইট পোস্টে উড়তে থাকা বাংলাদেশের পতাকা দেখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ইশারায় বাহারকে ডাকলেন।
—বাবা তোমার নাম কি?
—জি, চাচি আমার নাম বাহার।
তারপর দুজনেরই মুখ দিয়ে কিছুক্ষণ কথা বেরোল না। সংবিৎ ফিরে বেয়ে বৃদ্ধাই প্রথমে বললেন, তোমার সঙ্গে পরিচিত হতে খুব ইচ্ছে করছে। ওপরে আসতে তোমার কোনো আপত্তি নেই তো বাবা।
বাহার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলে বৃদ্ধা দরজা খুলে দিলেন। সে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে ভেতরে ঢুকল। বাহার তার পরিচয় জানাল।
বৃদ্ধার স্বামী একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। দুই ছেলেমেয়েকে রেখে তিনি বিজয়ের মাসেই বিধবা হয়েছেন। তারপর এই ছেলেমেয়েদের বড় করতে, মানুষ করতে তিনি কঠিন সংগ্রাম করেছেন। গত মাসে তিনি সিডনিতে ছোট ছেলের বাসায় বেড়াতে এসেছেন। ছেলে–বউ দুজনেই কাজে গেছে। বৃদ্ধা আজ সকাল থেকেই ব্যালকনিতে লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে বুকে কান্না চেপে বসে আছেন।
বিকেলে বাহার অলিম্পিক পার্কের স্পটলেস স্টেডিয়ামে বিসিবি একাদশ বনাম সিডনি থান্ডার্সের টি টুয়েন্টি ম্যাচ দেখতে এসেছে। চারদিকে হই চই আর উল্লাস। এত পতাকা আর এত সবুজ দেখার পরও তার আজ কিছু ভালো লাগছে না। সে এক সময় স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে আবার হাঁটতে থাকে। বুকের ভেতরে চিনচিন করে একটা ব্যথা অনুভব করে। ব্যাগ থেকে পতাকা বের করে চোখ মুখ ঢেকে সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। এই কান্না সে কাউকে দেখাতে চায় না।
নাইম আবদুল্লাহ: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
.