শাহজাহান সাংবাদিক : চলনবিলের চাটমোহর উপজেলায় চলনবিলে নৌকাডুবির ঘটনায় নিখোঁজ পাঁচজনের মধ্যে তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে এক শিশু ও দু’জন নারী। গত শুক্রবার রাত থেকে গত শনিবার দুপুর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে তাদের লাশ উদ্ধার করে রাজশাহী থেকে আসা ডুবুরি দল। নিহতদের সবার বাড়ি পাবনার ঈশ্বরদীতে। শুক্রবার পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা নৌকায় আনন্দ ভ্রমণে বের হয়েছিলেন ২২ জন। সন্ধ্যায় চাটমোহরের হা-িয়াল পাইকপাড়া ঘাট এলাকায় চলনবিলে নৌকাটি ডুবে গেলে এ আনন্দ ভ্রমণ রূপ নেয় কান্নায়। ১৭জনকে রাতেই জীবিত উদ্ধার করা হয়। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন দু’জন। ডুবুরি দলের প্রধান মো. নুরুন্নবী জানান, শুক্রবার রাতে উদ্ধার করা হয় ঈশ্বরদী আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বিল্লাল হোসেন গণির স্ত্রী মমতাজ পারভীন শিউলীর (৪৫) লাশ। গতকাল পাওয়া যায় ঈশ্বরদীর আমবাগান এলাকার ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম স্বপনের মেয়ে সওদা মনি (১২) ও সলিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মোশাররফ হোসেন মুসার স্ত্রী শাহনাজ পারভীনের (৪৫) লাশ। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন নিহত শিউলির স্বামী বিল্লাল হোসেন গণি ও নিহত সওদা মনির বাবা রফিকুল ইসলাম স্বপন। উদ্ধার কাজ অব্যাহত রয়েছে বলে ডুবুরি নুরুন্নবী জানিয়েছেন।
নৌকাডুবিতে আহত মোশাররফ হোসেন মুসা জানান, ঈশ্বরদী ও কুষ্টিয়া থেকে সঙ্গীতশিল্পী, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ীসহ পরিবার-পরিজন নিয়ে ২৪ জন শুক্রবার ছুটির দিনে নৌকায় চলনবিলে আনন্দভ্রমণে বের হন। দু’জন মাঝপথে নেমে যান। বাকি ২২ জন চলনবিলের বিভিন্ন স্থানে নৌকায় ঘুরে বেড়ান। সন্ধ্যা ৭টার দিকে পাইকপাড়া এলাকায় নৌকাটির সঙ্গে শক্ত কিছুর ধাক্কা লাগে। এ সময় তলা ফুটো হয়ে নৌকাটি ডুবে যায়। নৌকার আরোহীদের চিৎকারে আশপাশের লোকজন এসে তাদের উদ্ধার করে। নিখোঁজ হন পাঁচজন। রাতেই রাজশাহী থেকে ডুবুরি দল এসে উদ্ধার কাজ শুরু করে। গত শনিবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও উদ্ধার তৎপরতার খবর নেন পাবনার জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন। নিহত তিনজনের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে অনুদান দেন তিনি। এ ছাড়া উদ্ধার কাজে প্রথম অংশ নেওয়া কিশোর সুমন হোসেনকে পাঁচ হাজার টাকা দেন ও তার লেখাপড়ার দায়িত্ব নেন জেলা প্রশাসক। শুক্রবার রাতেই ঘটনাস্থলে ছুটে যান চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরকার অসীম কুমার ও সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (চাটমোহর সার্কেল) তাপস কুমার পাল। নৌকাডুবিতে বেঁচে যাওয়া কুষ্টিয়ার সঙ্গীতশিল্পী তারিফ হোসেন জানান, তাদের আনন্দযাত্রা শেষ সময়ে এসে নিরানন্দ হয়ে পড়ে। সুখস্মৃতির বদলে বাড়ি ফেরেন শোকের আবহে।
এদিকে গতকাল তিনজনের মরদেহ ঈশ্বরদীতে পৌঁছলে এলাকার পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। নিখোঁজ স্বপনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। একমাত্র সন্তান সওদা মনির লাশ দেখে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন স্বপনের স্ত্রী মুসলিমা খাতুন। স্বজন ও প্রতিবেশীরা তাকে কোনোভাবেই বোঝাতে পারছিলেন না। সওদা মনি ঈশ্বরদীর এসএম মডেল সরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ছিল। স্বপন ছিলেন সবার প্রিয়মুখ :প্রতিদিন সন্ধ্যায় পকেটভর্তি চকলেট কিংবা বাদাম নিয়ে ঈশ্বরদী প্রেস ক্লাব ও ঈশ্বরদী সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিষদ চত্বরে আসতেন রফিকুল ইসলাম স্বপন। পরিচিত যার সঙ্গেই দেখা হতো তার হাতে চকলেট কিংবা বাদাম দিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন। ঈশ্বরদী বাজারের ক্রীড়াসামগ্রী বিক্রেতা তরুণ ব্যবসায়ী স্বপন ছিলেন স্থানীয় সাংবাদিক ও সাহিত্যপ্রেমীদের প্রিয়মুখ। শুক্রবার সন্ধ্যায় পাবনার চাটমোহরে চলনবিলে নৌকাডুবির ঘটনায় এখনও নিখোঁজ দু’জনের একজন তিনি। ওই নৌকাডুবিতে নিখোঁজ পাঁচজনের মধ্যে তিনজনের লাশ উদ্ধার করেছেন ডুবুরিরা। তাদের মধ্যে স্বপনের মেয়ে স্কুলছাত্রী সওদা মনিও রয়েছে। গতকাল শনিবার দুপুরে সওদার লাশ উদ্ধার করা হয়। ঈশ্বরদী সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিষদের ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন স্বপন। ঈশ্বরদী প্রেস ক্লাব ও সাহিত্য পরিষদের অবস্থান একই চত্বরে হওয়ার সুবাদে সাংবাদিক ও সাহিত্যমনাদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন নিবিড়ভাবে। স্বপন চাইতেন তার একমাত্র সন্তান সওদা মনিও সাহিত্যচর্চা করুক। তাই মেয়েকে প্রায়ই নিয়ে আসতেন সঙ্গে করে।
শুক্রবার সকালে মেয়েকে নিয়ে স্বপন যখন চলনবিলে আনন্দ ভ্রমণে বের হন তখন তাদের যেতে একবার বাদ সেধেছিলেন তার স্ত্রী মুসলিমা খাতুন। সে কথা মনে করে গতকাল বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন মুসলিমা। একমাত্র সন্তানের লাশ উদ্ধার ও স্বামীর নিখোঁজের ঘটনায় পাগলপ্রায় হয়ে গেছেন মুসলিমা খাতুন। গতকাল মেয়ে সওদা মনির মৃতদেহ দেখে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। পরে স্বজনের প্রচেষ্টায় জ্ঞান ফিরলেও আবারও মূর্ছা যান তিনি। ঈশ্বরদী প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি মোস্তাক আহমেদ কিরণ বলেন, স্বপন ছিলেন সজ্জন। প্রতিদিন প্রেস ক্লাব চত্বরে তার উপস্থিতি সবাইকে মুগ্ধ করত। ঈশ্বরদী সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট মুস্তাফিজুর রহমান কামাল বলেন, স্বপন ছিলেন একজন ভালো ক্রীড়া সংগঠক। সাপ্তাহিক প্রথম সকালের সম্পাদক মহিদুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন অপেক্ষা করতাম কখন স্বপন আসবেন, চকলেট দেবেন। নৌকাডুবির প্রত্যক্ষদর্শী প্রকৌশলী মো. সুমন হোসেন জানান, নৌকাডুবির পর যখন স্থানীয়দের উদ্ধার তৎপরতা চলছিল, তখন স্বপন মেয়েকে তলিয়ে যেতে দেখে ফের ডুব দেন। কিন্তু মেয়েকে বাঁচাতে পারেননি। নিজেও আর উঠে আসতে পারেননি।