কথা সাহিত্যিকঃ ডাঃ আমজাদ হোসেন মিলন
ঐতিহাসিক রক্তাক্ত প্রান্তর সলঙ্গা বিদ্রোহের মহানায়ক, ভাষা আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের আগামীকাল ২০ আগষ্ট বৃহস্পতিবার ৩৪তম মৃত্যু বার্ষিকী। বিগত ১৯৮৬ সালের আজকের দিনটিতে তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ১৯০০ সালের ২৭ নভেম্বর সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার তারুটিয়া গ্রামে সম্ভ্রান্ত পীর পরিবাওে জন্ম গ্রহণ করেন। বড় পীর হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রঃ) এর বংশধর শাহ সৈয়দ দরবেশ মাহমুদ ১৩০৩ সালে ইসলাম ধর্ম প্রচারে বাগদাদ থেকে এ দেশে আসেন। সে বংশেরই সন্তান মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের পিতা হলেন মাওলানা সৈয়দ আবু ইসহাক। সিরাজগঞ্জের তাড়াশের বারুহাস গ্রামের খ্যাতনামা জমিদার মৌলভী দেলোয়ার আলী খান চৌধুরীর মেঝ জামাতা মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের স্ত্রীর নাম হলো বেগম নুরুন্নাহার তর্কবাগীশ।
এখন যেভাবে রয়েছে তর্কবাগীশের নিজস্ব বসত ভিটাবাড়ি
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার হাটিকুমরুল ইউনিয়নের তারুটিয়া গ্রামটিতে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের নিজস্ব বিশাল বসত ভিটা বাড়ি রয়েছে। এখানে তার বংশধরদের কেউ আর বসবাস করেন না। একজন কেয়ার টেকার এখানে রয়েছেন। মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের তিন ছেলে ও তিন মেয়ে সন্তানদের মধ্যে দু’ ছেলে ও এক মেয়ে মারা গেছেন। তার ছেলে সন্তান তিনজন হলেন-সৈয়দ নুরুল আলম, সৈয়দ শামসুল আলম ও সৈয়দ বদরুল আলম। এদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল আলম ঢাকায় বসবাস করছেন। তিনি বয়সের ভারে এখন আর তেমন চলাফেরা করতে পারেন না বলে জানা যায়। সরেজমিনে তারুটিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, বিশাল ভিটা বাড়ি জুড়ে একেবারেই নীরবতা। গ্রামের মাঝে হলেও নেই কোন কোলাহল। ভিটা বাড়ির এক কোণায় রয়েছে শাখা পোষ্ট অফিস ভবন। গ্রামের বসতিদের দু’একজন কে আবাদী মাঠে কিংবা অন্যত্র এ ভিটা বাড়ি হয়ে পায়ে হেঁটে চলাচল করতে দেখা গেছে। এখানে বড় ধরনের দুটি পুকুর রয়েছে। পুকুরের চালাসহ ভিটা বাড়িতে রয়েছে বহু সংখ্যক বিভিন্ন ফলের গাছ। জানা গেছে, পুকুর দুটি সহ পুরো বসতভিটা বাড়ির জমির পরিমান প্রায় ৬০ বিঘা। এখানে বসত ভিটায় বেশ কয়টি বসত ঘর রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে একটি পাকা একতলা ভবন। এ ভবনেই মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ বসবাস করতেন। এর আগে পাকা ভবনের ভিটাতেই টিনের দোতলা বসত ঘর ছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে পাকবাহিনী সেটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার পর পাকা ভবনটি নির্মান করা হয় বলে কেয়ার টেকার জানান। এ ভবন ছাড়াও ভিতরে আরো বড় ছোট চারটি টিনের ঘর রয়েছে। বাড়ির ভিতরে উঠোন আঙ্গীনা গাছগাছালীর জঙ্গলে ভরপুর হয়ে আছে। ঘর গুলোর দরজা জানালা গুলো প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে। ভেতরের ঘর গুলো পরিত্যাক্ত অবস্থায় রয়েছে। সেখানে ঘর গুলো দেখতে সেদিকে কেউ যায় না তা দেখে বোঝা গেছে। পাকা ভবনে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের ব্যবহৃত খাট সহ অন্যান্য আসবাবপত্রাদি বিভিন্ন কক্ষে রয়েছে। প্রায় ১০ বছর ধরে তারুটিয়া গ্রামের মোঃ তাহাজ উদ্দিন এখানে কেয়ার টেকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার বয়স এখন প্রায় ৫৪ বছর। এর আগে বহু বছর তার পিতা তমিজ উদ্দিন কেয়ার টেকার হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন বলে তিনি জানান। এ প্রতিবেদককে কেয়ার টেকার তাহাজ উদ্দিন বলেন, এখানকার আবাদী জমিজমা সহ পুরো ভিটা বাড়ি সবকিছুই তিনি দেখাশোনার পুরো দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি রাতে এখানকার পাকা ভবনের একটি রুমে থাকেন। তিনি আরো বলেন, মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকে বহুবার দেখেছেন। তার পিতার সাথে তিনি আসতেন। তাকে খুব আদর করতেন বলে জানান। তখন তার কম বয়স হলেও দেখা ও স্মৃতিতে আছে, ঢাকা থেকে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ বাড়ি আসলে বিভিন্ন এলাকার সাধারণ শ্রেণির লোকজন সহ নানা পেশার লোকজন তার সাথে দেখা করতে আসতেন।মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ একেএকে সবার কথা শুনতেন। পরামর্শ দেয়া ও বিভিন্ন রকমের সাহায্যে সহযোগিতা করতেন। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত ছিল না বলে বেশির ভাগ সময় তিনি ট্রেন পথে জামতৈল রেলষ্টেশনে নেমে গরু কিংবা মহিসের গাড়ী চড়ে তারুটিয়া গ্রামের বাড়িতে আসতেন।
এখানে উলেখ্য, এখন উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা হয়েছে। ঢাকা- বগুড়া মহাসড়কের পাচিলা বাসষ্ট্যান্ড হতে তারুটিয়া গ্রামের দুরত্ব প্রায় সোয়া এক কিলোমিটার। এরমধ্যে প্রায় অর্ধেক অংশ পাকা সড়ক আর বাকী অংশ ইট বিছানো ও কাঁচা সড়ক।
কেয়ার টেকার তাহাজ উদ্দিন আরো জানান, আগে সৈয়দ শামসুল আলম মাঝে মধ্যেই এখানে এসে বেশ কয়দিন করে থাকতেন। এখন বয়সের ভারে তিনি আর আসেন না। মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের মৃত্যু বার্ষিকীতে স্থানীয় মসজিদে তাদের আয়োজনে মিলাদ মাহফিল ও দোয়া অনুষ্ঠান করা হয়ে থাকে। এছাড়া এখানে আর কোন অনুষ্ঠান হয় না বলে কেয়ার টেকার জানান। তবে প্রতি বছর ফ্লাগুন মাসে মাওলানা আব্দুর রশীদ তকবাগীশের পুর্ব পুরুষদের একজন পীর সাহেব সৈয়দ দেওয়ান এর ওরশ শরীফ হয়। তারুটিয়া গ্রামের মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের বসত বাড়ি দেখতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা পেশার লোকজন আসেন। তারা এখানে এসে সব ঘুরে ফিরে দেখে যান বলে জানানো হয়।
মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের এক সন্তান সৈয়দ বদরুল আলম স্বাধীনতা পরবর্তী স্থানীয় হাটিকুমরুল ইউনিয়ন পরিষদে এক মেয়াদে প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি প্রায় ১০ বছর আগে মারা গেছেন। তার নামে এলাকায় পাচলিয়া বদরুল আলম উচ্চ বিদ্যালয় ও ধোপাকান্দি বদরুল আলম প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দুটির প্রতিষ্ঠাতা বলে জানানো হয়। সৈয়দ বদরুল আলমের তিন সন্তানের একজন হলেন-সৈয়দ হাদি তর্কবাগীশ। তিনি ঢাকায় বসবাস করেন। এলাকার খোজখবর রাখেন। মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের নাতি হাদি তর্কবাগীশ জানান, এবারে পারিবারিক আয়োজনে তারুটিয়া গ্রামে দাদার নিজস্ব বসতভিটায় মৃত্যুবার্ষিকীতে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। করোনা ভাইরাসের কারণে তা বাতিল করে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকজন নানা সমস্যা, চিকিৎসা ও অন্যান্য সাহায্যে সহযোগিতা পেতে ঢাকায় তার কাছে আসেন। তিনি সাধ্যমত তার সমাধান ও সহযোগিতা করে থাকেন। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, তার দাদা মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ আজীবন লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন। ন্যায় ও সত্যেও পথে থেকেছেন। দেশের কল্যানে আপোষহীন ও নিবেদিত প্রাণের একজন ব্যক্তি ছিলেন। তারুটিয়া গ্রামে তার স্মুতিচিহ্ন ধরে রাখা দরকার রয়েছে। যাতে করে এ প্রজন্ম সহ আগামী প্রজন্মের পর প্রজন্ম সব সহজে জানতে পারবে। উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত হাটিকুমরুল গোল চত্ত্বর এলাকা এবং দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বড় ধরনের সেবা মূলক প্রতিষ্ঠান মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের নামে নামকরণ করার বিষয়ে দাবি আকারে জানান।
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় পাটধারী মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ উচ্চ বিদ্যালয়, চড়িয়া মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ বিজ্ঞান মাদরাসা ও রায়গঞ্জ উপজেলায় বেগম নুরুন্নাহার তর্কবাগীশ সরকারি কলেজ রয়েছে। তারুটিয়া গ্রামের বসতি মোঃ আব্দুল মালেক জানান, তিনি মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকে দেখেননি। গ্রামের মুরুব্বিদের কাছে ও ইতিহাস থেকে তার সব কিছু জেনেছেন। তারুটিয়া গ্রামের একজন সন্তান হিসেবে তিনি গর্ববোধ করেন।
উল্লাপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের আহবায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা জানান, মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ একজন আপোষহীন নেতা ছিলেন। তারুটিয়া গ্রামে তার জন্ম ভিটায় স্মৃতিচিহ্নের সব কিছু সংরক্ষণ করা দরকার রয়েছে বলে তিনি জানান।
বিশিষ্ট লেখক ও মুক্তিযোদ্ধা মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, ঐতিহাসিক সলঙ্গা বিদ্রোহের মহানায়ক মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ভাষা আন্দোলন ও ৬ দফা কাঠামো গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন। আজীবন সংগ্রামী এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জন্ম ভিটা বাড়িতে একটি লাইব্রেরী স্থাপন করা দরকার আছে। সেখানে ইতিহাস ও ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ সহ সকল ধরনের বই থাকবে। তারুটিয়ায় তার স্মুতি চিহ্নের যা কিছু আছে তা সংরক্ষণ করে আগতদের দেখার জন্য যথাযথ পরিবেশ ও ব্যবস্থা থাকার জরুরী প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
সলঙ্গা মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ পাঠাগারের কার্যকরী কমিটির সদস্য স্থানীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি মোঃ কোরবান আলী বলেন, বিগত ১৯৯৫ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের মৃত্যু দিবস ও সলঙ্গা বিদ্রোহ দিবসে পাঠাগারের আয়োজনে আলোচনা, মিলাদ মাহফিল ও দোয়া অনুষ্ঠান করা হয়ে আসছে। করোনা পরিস্থিতিতে সামাজিক ও শারীরিক দুরত্ব বজায় রেখে এবারেও তার মৃত্যু বার্ষিকী পালন করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলেন