স্কুলে ঢুকতেই বিরাট বড় একটা মাঠ৷ তার একদিকে কোথাও নানা ফলের গাছ, তো কোথাও হরেক কিসিমের ফুল গাছের বাগান৷ বাগানের একদিকে হচ্ছে আনাজের চাষ৷ পাশেই আবার রয়েছে ভেষজ উদ্যানও৷ স্কুলের ভেতরেও রয়েছে চমক৷ মনীষীদের ছবিতে ভরে থাকা স্কুল বাড়ির একটি ঘরে তৈরি হয়েছে লাইব্রেরি, মিউজিয়াম, বিভিন্ন মডেল দিয়ে কৃত্রিম চিড়িয়াখানাও৷
এইটুকু শুনে মনে হতেই পারে, এটা কোনও নামকরা বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল৷ একটা সরকারি প্রাথমিক স্কুলের চিত্র এটা৷ কিন্তু আদতে এর পিছনে রয়েছেন স্কুলেরই শিক্ষক-শিক্ষিকারা। নিজেদের প্রতি মাসের বেতন থেকে কিছু টাকা কেটে ফান্ড গড়েছেন তাঁরা। সেখান থেকেই ছাত্রছাত্রীদের জন্য তাঁদের এমন উদ্যোগ। কোনও শহরেও নয়, জলপাইগুড়ির গ্রামের এই স্কুলটায় যে কেউ গেলেই চমকে উঠতে বাধ্য৷
জলপাইগুড়ির বেলাকোবা পঞ্চায়েতের রামকৃষ্ণপল্লি এলাকার স্কুলটির নাম বিবেকানন্দ প্রাথমিক বিদ্যালয়৷ স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষিকার উদ্যোগে অনেক ক’বছর থেকেই টবে গাছ লাগানোর একটা ব্যবস্থা চালু হয়েছিল স্কুলটিতে৷ যার প্রসার হতে হতে বর্তমানে এমনই একটি রূপ নিয়েছে স্কুলটি৷
১৯৬৯ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়৷ বর্তমানে ৮৯জন ছাত্র-ছাত্রী ও স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে ছ’জন শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন৷ স্কুল সূত্রের খবর, ৯০-এর দশকে স্কুলটিতে কাজে যোগ দেন বর্তমান প্রধান শিক্ষিকা রমা দাশগুপ্ত৷ চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরে তিনি কিছু টব কিনে ফুলের গাছ লাগাতে শুরু করেন৷ তাঁর এই উদ্যোগে পরবর্তী কালে আকৃষ্ট হন অন্য শিক্ষক-শিক্ষিকারাও৷ ধীরে ধীরে সবার উদ্যোগে গত চার-পাঁচ বছরে স্কুলে ফুল ও ফলের বাগান থেকে শুরু করে কিচেন গার্ডেন ও ভেষজ উদ্যান গড়ে ওঠে৷ জৈব সার দিয়ে চাষ হওয়া কিচেন গার্ডেন থেকে উৎপাদিত আনাজ দিয়ে পড়ুয়াদের মিড ডে মিলের রান্না হচ্ছে৷ ভেষজ উদ্যানের থানকুনি, বাসক, তুলসি, অ্যালোভেরা, গুলঞ্চ, পাথরকুচি বা কালোমেঘ গাছগুলি আরও চমকপ্রদ৷ স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা জানালেন, প্রতিদিন দুপুরের পর পড়ুয়া ও শিক্ষক-শিক্ষিকারা মিলে একসঙ্গে এই সব গাছের পরিচর্যা করেন৷ আর স্কুল ছুটির পর দেখভালের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেন গ্রামবাসীরাই৷
তবে এগুলির পাশাপাশি সম্প্রতি স্কুলের একটি ঘরে ঘরে আলাদা আলাদা কাঠের আলমারির সাহায্যে লাইব্রেরি, মিউজিয়াম ও কৃত্রিম চিড়িয়াখানা গড়ে তুলেছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা৷ লাইব্রেরিতে যেমন রয়েছে ছোটদের গল্পের বই৷ তেমনই মিউজিয়ামে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দের ছোট মূর্তির পাশাপাশি ছবির মাধ্যমে নানা শিক্ষামূলক উদ্ধৃতি তুলে ধরা রয়েছে৷ পড়ুয়াদের শেখার জন্য কৃত্রিম চিড়িয়াখানায় থাকা পশু-পাখির নাম বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতেও লিখে রেখেছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা৷ স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা রমাদেবীর কথায়, ‘‘শুধুমাত্র পুথিগত বিদ্যাতেই ছাত্র-ছাত্রীরা আটকে থাকুক, সেটা আমরা চাই না৷ সে জন্যই এই আয়োজন৷’’ স্কুলের শিক্ষক অভিজিৎকুমার রায়, শিক্ষিকা বলাকা দেবনাথরা বলেন, ‘‘প্রতি মাসে মাইনে থেকে কিছু কিছু টাকা আলাদা একটি ফান্ডে জমাই৷ সকলে প্রাণখুলে সেখানে টাকা দিই৷’’
বিবেকানন্দ প্রাথমিক স্কুলটি জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের মধ্যে পড়েছে৷ এই ব্লকের বিডিও তাপসী সাহা বলেন, ‘‘শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এই উদ্যোগ অসাধারণ৷ অন্য স্কুলের কাছে এই স্কুলটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে৷’’