মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং প্রতিবেদন মে ২০২৩

Spread the love

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)

৩১ মে, ২০২৩

 বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী মে, ২০২৩ সময়কালে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ মাসেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড অব্যাহত রয়েছে। দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, তাদের পরিচয়ে অপহরণ, গায়েবি মামলা, গ্রেফতার, রিম্যান্ডে নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটেই চলেছে। রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ধর্ষণসহ নারী ও শিশুদের উপর সহিংসতার ঘটনা উদ্বেগজনক ভাবে বেড়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে মতামত প্রকাশের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার মত ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে হুমকি ও হামলা তথা সাংবাদিকতা এবং মত প্রকাশের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার মত ঘটনা ক্রমাগত ঘটছে। কারা- হেফাজতে মৃত্যু, সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিংসতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেড়েছে, সীমান্তে হতাহতের মতো ঘটনা বন্ধ হয়নি বরং উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। অপরদিকে গণপিটুনির মত আইন হাতে তুলে নেয়ার ঘটনাও কমেনি । মানবাধিকার লংঘনের এই ঘটনাগুলো ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এসব ঘটনা রোধে সরকারের নিষ্ক্রিয়তার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে।

এ প্রতিবেদন সম্পর্কিত বিস্তারিত ঘটনা পরিশিষ্টতে দেয়া হলো।

 আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক বন্দুকযুদ্ধ

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী মে, ২০২৩ সময়ে বন্দুকযুদ্ধের

১টি ঘটনা ঘটেছে। কথিত গোলাগুলির ঘটনায়একজন নিহত ও অপর দুইজনকে আটক করা হয়েছে।

১৫ মে, বিকেলে কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ১৭ নম্বর ক্যাম্পে এপিবিএনের সঙ্গে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় এপিবিএন এর গুলিতে ঘটনাস্থলে একজন রোহিঙ্গা নিহত ও দুজন গ্রেফতার হয়। ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) সৈয়দ হারুন অর রশীদের দাবি, অভিযান চলাকালে এপিবিএনকে লক্ষ্য করে দুষ্কৃতকারীরা গুলি ছোড়ে। সরকারি সম্পদ আত্মরক্ষায় পুলিশ পাল্টা গুলি চালায়। এতে একজন মারা যায় ও কথিত দুইজন দুষ্কৃতকারীকে গ্রেফতার করা হয়।

এমএসএফ মনে করে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড কোনভাবেই আইনসিদ্ধ নয় যা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপতৎপরতা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ/নিখোঁজ

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের নামে যে অপতৎপরতা চলছে তা অন্যায়, ক্ষমতার অপব্যবহার, মানবাধিকারের চরম লংঘন। যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং নাগরিক জীবনে চরম উৎকন্ঠা ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি ক্রমাগত আস্থাহীনতার সৃষ্টি করছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী মে মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার ৩টি ঘটনায় ৫ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

২০ মে, রাজধানীর বেইলি রোডের কেএফসি দোকান থেকে ২টার দিকে প্রথমে দুইজন ও পরে আরো একজন মোট তিনজন তরুণকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় । পরবর্তীতে তাদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ ঘটনার শিকার সম্রাট নামক একজনের স্বজনরা রোববার রমনা মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে গেলে তা নেওয়া হয়নি। তবে মৌখিক অভিযোগ শুনেছে পুলিশ। রমনা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবু আনসার জানান, প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি, ওই তিন তরুণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে আছে।

২৪ মে রাতে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যরা রাজশাহী জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন আহমেদ শামীম সরকারকে ঢাকা থেকে তুলে নিয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক তাকে আটকের বিষয়টি স্বীকার না করায় তার পরিবার উৎকন্ঠার মধ্যে রয়েছে। বিএনপি’র পক্ষ থেকে অবিলম্বে সালাউদ্দিন আহমেদ শামীম সরকারকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান।

১ মে, ঢাকার নবাবগঞ্জ থেকে স্বর্ণ ব্যবসায়ী কৃষ্ণ সাহা সকালে নগদ আড়াই লাখ টাকা, দেড়শ ভরি স্বর্ণ ও আড়াইশ ভরি রুপা নিয়ে রিকশা যোগে দোকানের দিকে যাচ্ছিলেন। এ সময় একটি প্রাইভেটকার তার গতিরোধ করে, ভেতরে থাকা ৭-৮ জন ব্যক্তি নিজেদের পুলিশ পরিচয় দিয়ে থানায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে এমন কথা বলে হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে মুখ ও পা বেধে তুলে নিয়ে যায়। এরপর তার কাছে থাকা নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার লুটে নিয়ে নবাবগঞ্জের পার্শ্ববর্তী মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইরে সায়েস্তা ইউনিয়নের চঙ্গপাড়া চকে তাকে ফেলে চলে যায়। সিংগাইর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল ইরমান এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

এমএসএফ মনে করে, আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের নামে যে অপতৎপরতা চলছে তা অন্যায়, ক্ষমতার অপব্যবহার ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক, যা ঠেকানোর দায়িত্ব আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর। এ নিয়ে নাগরিক জীবনে চরম উৎকন্ঠা ও আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি ক্রমাগত আস্থাহীনতা বেড়ে যাচ্ছে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু

মে ২০২৩ মাসে আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে আসামির মৃত্যুর বিষয়টি অনাকাঙ্খিত ও অগ্রহণযোগ্য। যা জনমনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করে। এমএসএফ মনে করে প্রতিটি হেফাজতে মৃত্যুর নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া আবশ্যক।১৩ মে, মৌলভীবাজার মডেল থানা পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক শাকির আহমদ শহরের চৌমুহনা থেকে মোবাইল চুরির জিডির প্রেক্ষিতে জসিম উদ্দিনকে সন্দেহজনকভাবে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। সে রাতেই মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে জসিমের মৃত্যু হয়। পুলিশের দাবি আটকের পর জসিম উদ্দিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি মারা যান। মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা. বিনেন্দু ভৌমিক জানান, রোগীকে মুমূর্ষু অবস্থায় পুলিশ সদস্যরা হাসপাতালে নিয়ে আসেন। ইসিজি রিপোর্ট আসার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়।

 আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে নির্যাতন ও অপতৎপরতার অভিযোগ

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী, মে ২০২৩ মাসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের বিরুদ্ধে ১টি নির্যাতন ও ১টি অপরাধের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।

১৩ মে, সিরাজগঞ্জ সদর থানর এসআই আবুল হোসেন ও এসআই শহিদুল ইসলাম শহিদ দুজন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে উপজেলার রতনকান্দি ইউনিয়নের একডালা গ্রামের ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী লাভলু ইসলামের দোকানে যান। সেখানে স্থানীয় প্রায় ৪০-৫০ জন লোকের উপস্থিতিতে তার দোকানে তল্লাশি চালানো হয়। কোনো কিছু না পেয়ে লাভলু ইসলামকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার উত্তরে মহিষামুড়া বাজারের পূর্ব পাশের মহিলা মাদরাসার পেছনে নিয়ে আটকে রাখে তার কাছে থাকা ৩০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় ও লাভলুর চোখ বেঁধে রেখে আরো ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। পরে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ করলে তদন্তে সত্যতা পাওয়া সাপেক্ষে দুই উপপরিদর্শককে প্রত্যাহার করা হয়। প্রত্যাহার করাই হচ্ছে পুলিশের অপরাধের দৃশ্যমান শাস্তি!

১৭ মে, রাতে মোহাম্মদ করিম বাদশা ঢাকার কমলাপুর থেকে ঠাকুরগাঁওয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপে যাচ্ছিলেন। ট্রেনটি ছাড়ার কিছুক্ষণ পরে তার চেয়ারের সামনে একটি বাড়তি চেয়ার এনে একজন যাত্রীকে বসান এক পুলিশ কর্মকর্তা। এ সময় মোহাম্মদ করিম বাদশা দুটি ছবি তুলে নিজেদের গ্রুপে পোষ্ট করে। এরপরই সহকারী উপপরিদর্শক শহিদুল ইসলাম তার কাছে আসেন, বাসার ঠিকানা জানতে চান এবং তাকে জোর করে ট্রেনের ক্যান্টিনে নিয়ে যান। সেখানে দরজা লাগিয়ে দিয়ে হাত থেকে ফোনটি কেড়ে নেন। পরে তোলা ছবি ও ফেসবুক পোস্টে দেওয়া ছবিগুলো ডিলেট করে দেন। অতিরিক্ত চেয়ার বসানো অনিয়ম ও দৃষ্টিকটু। এ কারণে ছবিগুলো পোস্ট করেছি। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনজন রেলওয়ে পুলিশ সদস্য তাকে পেটাতে থাকেন। পরে তাঁরা ফোনটি আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলেন। এরপর ভাঙা ফোনসহ তাকে সিটে পাঠিয়ে দেন। সিটে বসার পরও কয়েক দফা হুমকি দেন। এএসআই শহিদুল কিছুক্ষণ পরপর এসেছেন আর বলেছেন, ঘটনাটি যেন কাউকে না জানানো হয়। এ বিষয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে মাদকের মামলায় কোর্টে চালান করে দেওয়াসহ ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ারও হুমকি দেন। পরে ভোরের দিকে দিনাজপুরের পার্বতীপুর স্টেশনে তাঁরা নেমে যান। এ সময় নাম-ঠিকানা ও ফোন নম্বর নিয়ে সহকারী উপপরিদর্শক শহিদুল ইসলাম  জানান, সব নাম-ঠিকানা নেওয়া হয়েছে, বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সব ব্যবস্থা করবেন।

এমএসএফ মনে করে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যে অপতৎপরতা চলছে তা অন্যায়, ক্ষমতার অপব্যবহার, মানবাধিকারের চরম লংঘন ও ন্যায়বিচারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনেরই নামান্তর । যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং যা নাগরিক জীবনে চরম উৎকন্ঠা ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি ক্রমাগত অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার জন্ম দিচ্ছে। কোনো পুলিশ এ ধরণের অপরাধ করে কোনো শাস্তি পেয়েছে কি না তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে।

 কারা হেফাজতে মৃত্যু

এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী মে ২০২৩ মাসে কারা হেফাজতে মোট ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত মাসে এর সংখ্যা ছিল ১৬ জন। এ মাসে ৭ জন হাজতি ও ৪ জন কয়েদির মৃত্যু হয়েছে। যাদের মধ্যে ২ জন নারী রয়েছেন। মৃত নারী হাজতিদের মধ্যে একজন ময়মনসিংহ কারা অভ্যান্তরে টিনের চালা ঘরের পেছনের অংশের আড়ার সঙ্গে গলায় নিজের ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।

কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৬ জন, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে একজন নারীসহ ২ জন, ময়মনসিংহ কারগারে ১ জন নারী, সিরাজগঞ্জ কারাগারে ১ জন ও রাজবাড়ী কারাগারে ১ জনের মৃত্যু হয়। উল্লেখ্য, সকল কারাবন্দিকে বাহিরের হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তৃব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।এমএসএফ মনে করে, কারা অভ্যন্তরে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি, হেফাজতে মৃত্যুর কারণ সঠিকভাবে তদন্ত করা গুরুত্বপূর্ণ।

 রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সহিংসতায় হতাহত, মামলা ও সমাবেশে যোগদানে বাধা

গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী মে, ২০২৩ সময়ে বিরোধীয় দলীয় রাজনৈতিক কর্মসূচী বাস্তবায়ন, নির্বাচনী সহিংসতা, আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক বল প্রয়োগ, শান্তিপূর্ণ সভা, মিছিলে বাধাদান অব্যহত ছিল। সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী এ মাসে রাজনৈতিক, নির্বাচনী সহিংসতা ও সভা সমাবেশে বাঁধার ৩৫ টি ঘটনায় সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৫৪৯ জন। যার মধ্যে নির্বাচনী, রাজনৈতিক সহিংসতা ও সভা সমাবেশে বাধার ঘটনায় মোট ৫৪৪  জন আহত ও ৫ জন  নিহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে ১১ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, অপরদিকে নিহত ৫ জনের মধ্যে  ২ জন ক্ষমতাসীন দলের অন্তর্দ্বন্দে ‍ ও ১ জন সাবেক ইউপি সদস্য ও ২ জন বিএনপির কর্মী।

মে ২০২৩ মাসে বিএনপির বিরুদ্ধে ২৪টি রাজনৈতিক মামলা হয়েছে, যার মধ্যে ৫৬৫ জন নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। রাজনৈতিক কর্মকান্ড চলমান অবস্থায় গ্রেফতার করা হয় ১১৭জন, বাড়ি ও বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার হয় ৩৩৯ নেতাকর্মী এবং আদালতে জামিন প্রার্থনাকালে জামিন না দিয়ে ১০৯ নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ৫৫৫ জন বিএনপি ও সমমনা দলের ‍এবং ১০ জন জামায়েত ইসলামী কর্মী।

এ মাসে রাজনৈতিক কর্মকান্ড চলমান অবস্থায় ১৩৭জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয় অপরদিকে আদালতে জামিন প্রার্থনাকালে জামিন না দিয়ে ৩৩ নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ১১২ জন বিএনপি ‍ও এর সহযোগী অঙ্গসংগঠনের এবং ৫৮ জন জামায়েত ইসলামীর কর্মী।

গনমাধ্যম সূত্র অনুযায়ী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দাবি করেছে, ১৯ মে থেকে ২৪ শে মে পর্যন্ত ছয়দিনে সারা বাংলাদেশে অন্তত ৬৫০ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময়ে বিএনপির ৫ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অন্তত ১৪৮টি মামলা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি

১৯ মে,  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য আবু সাইদ ওরফে চাঁদ এবং দলের অন্যন্য কর্মীর বিরুদ্ধে দেশের ৮ টি জেলায় (রাজশাহী,  নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর, ফরিদপুর, মাগুরা, সাতক্ষীরা, রাজবাড়িতে) ১ টি করে  এবং  নোয়াখালিতে ২টি মোট  ১০ টি মামলা হয়েছে।  এর মধ্যে ২ টি মামলা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে । আবু সাঈদের বক্তব্য দেওয়ার পর বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে রাজশাহীতেই আটটি মামলা হয়েছে। যার মধ্যে ৩টি মামলার আসামি আবু সাঈদ। গত ২৫ মে পুলিশ রাজশাহী নগরীর ভেড়ীপাড়া মোড় থেকে আবু সাঈদ চাঁদকে সন্ত্রাস দমন আইনের মামলায় গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে বিজ্ঞ আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মন্জুর করেন। রিমান্ড শেষে ৩০ মে তাকে আবারও আদালতে আনা হলে, গোয়েন্দা পুলিশ আবু সাঈদ চাঁদের ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত শুনানি শেষে ৩ দিনের রিমান্ড মন্জুর করেন। গুরুত্ব বিবেচনায় জেলা পুলিশ সুপার মামলাটি তদন্তের জন্য জেলা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। পুলিশের গায়েবি মামলা দায়েরের উৎসাহে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়ছে না। চট্রগ্রামে কারাগারে রয়েছে এমন দুজনের নামেও নুতন মামলা দেওয়া হয়েছে যা ভয়াবহ পুলিশি অপতৎপরতা।

 অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার

মে, ২০২৩ মাসের অত্যন্ত উদ্বেগ-আতঙ্কের বিষয় অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের ঘটনা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী মে, ২০২৩  সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১ জন শিশু, ৭ জন নারী ও ১৮ জন পুরুষ, মোট ২৬ জনের অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে যা ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত এবং নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ, গত মাসে এর সংখ্যা ছিল ২৩ জন।  দুই-একটি ঘটনা ছাড়া সব কয়টি লাশের পরিচয় অজ্ঞাতই থেকে যাচ্ছে। যা অত্যন্ত ভয়ংকর, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ। কাজেই এসব ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। সরকারকেই এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এ বিষয়ে দৃশ্যত সম্পুর্ণ নির্বিকার। এসব অজ্ঞাতনামা লাশ বেশীর ভাগই নদী বা ডোবায় ভাসমান, মহাসড়ক বা সড়কের পাশে, ব্রীজের নীচে, মাজার ও পরিত্যক্ত এলাকায়, বিল বা ফসলী ক্ষেতে গলায় ওড়না পেচানো, আঘাতের চিহ্ন সম্বলিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। মৃতদের মধ্যে ১৫ বছরের শিশু একজন, কিশোরী তিন জন, যুবক আট জন, ৪০-৫০ বয়সের ১১ জন ও ৫০ উর্দ্ধ ৩ জন রয়েছে।

এমএসএফ মনে করে, শুধুমাত্র অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে জানিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা যত ক্ষমতাবানই হোক, সব অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের জন্য জরুরি কিন্তু পুলিশের সে বিষয়ে তেমন আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

সীমান্তে হত্যা ও পরিস্থিতি

সীমান্তে হত্যা ও নির্যাতন বন্ধ করতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না বরং বেড়েই চলেছে। এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী এ মাসে সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক গুলিতে ২ জন নিহত, ১ জনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার, ১ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত, ভারতীয় সীমান্তে এক বাংলাদেশী যুবকের রহস্যজনক মৃত্যু, বিএসএফ বাংলাদেশ সীমান্তে ঢুকে এক কিশোরকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতনে করে ফেরত দিয়ে দু:খ প্রকাশ ও পিটিয়ে হত্যার নয় মাস পর মরদেহ ফেরত দেয়া যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অপরদিকে বান্দরবানের রুমা উপজেলার মিয়ানমার সীমান্তবর্তী শূন্যরেখায় পুতে রাখা দুই দফায় মাইন বিস্ফোরণে ২ জন বাংলাদেশী নাগরিক নিহত ও অপর ২ জন বাংলাদেশী গুরুতর আহত হয়েছেন। এতে সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।

এমএসএফ মনে করে, সরকার সীমান্ত হতাহতের প্রতিবাদ ও প্রতিকারে যে ব্যর্থতা দেখাচ্ছে তা জনমনে ক্রমাগত প্রশ্নের সৃষ্টি করছে। অপরদিকে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সীমানা আইনের লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। সীমান্তে এ ধরনের ঘটনা কখনোই কাম্য হতে পারে না।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার/অপব্যবহার

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রবলভাবে সমালোচিত হওয়া সত্বেও এ আইনে মামলার নামে হয়রানণ অব্যাহত রয়েছে ও এর যথেচ্ছ অপব্যবহারের বিষয়টি ক্ষোভ ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। কর্তৃপক্ষ বারবার এ আইনের সংশোধনীর  কথা বললেও কিছু দিন আগে আইন মন্ত্রী জানিয়েছে, বর্তমান বাস্তবতায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী মে ২০২৩ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮ টি মামলায় ২৮ জন গ্রেফতার হয়েছেন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ২৭ জন বিএনপি কর্মী এবং ১ জন যুবক রয়েছেন। মে মাসে মামলার সংখ্যা ছিল ৭টি এবং গ্রেফতারের সংখ্যা ছিল ৮ জন। এ মাসে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের জেরে  ১ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করে আদালত। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অশালীন মন্তব্য করার অভিযোগে কানাডা প্রবাসী ১ ও আমেরিকায় প্রবাসী ২ জন ও গাইবান্ধার ১ জন সহ মোট ৪ জনের নাম উল্লেখসহ ৮ থেকে ১০ জনকে অজ্ঞাতনামা  আসামি করে রংপুরের সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে রাজশাহীর বিএনপি নেতা আবু সাঈদ চাঁদসহ দলটির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ফরিদপুর এবং রাজবাড়িতে ১ টি করে মোট ২টি  ডিজিটাল নিরাপত্তা  আইনে মামলা হয়েছে। এ মামলাগুলোতে ৫ জনের নাম উল্লেখসহ আরো ৩০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৬ টি মামলা হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি, ক্ষমতাসীন দলের নেতা কর্মী ও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষূন্ন হয় এ ধরনের সমালোচনামূলক পোস্ট/শেয়ার/ কমেন্ট করার কারণে, ১ টি মামলা হয়েছে ফেসবুকে কটূক্তি এবং ১ টি মামলা হয়েছে প্রতারণার অভিযোগে ।

এ আইনের যথেচ্ছ অপব্যাবহারের মাধ্যমে মানুষকে তাঁর মতামত প্রকাশে বাঁধাগ্রস্ত করা ও ভয় দেখানো এবং সকলের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার একটি ভয়ংকর তৎপরতা চালানো হচ্ছে। এম এস এফ এই আইনের বাতিল দাবী করছে।

 সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের অধিকারের লংঘন

স্বাধীন সাংবাদিকতা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় এ মাসে অন্তত ৪৫ জন সাংবাদিক নানাভাবে হুমকি, নিপীড়ন, হয়রানি, নির্যাতন শিকার হয়েছেন, যা মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে। শারীরিকভাবে আক্রমণ, হয়রানি, হুমকি ও লাঞ্ছিত করা হচ্ছে তা শুধুমাত্র অনাকাঙ্খিতই নয় বরং তার মাধ্যমে সৎ সাংবাদিকতার কন্ঠরোধ করে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ ছাড়া এ মাসে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে মানবাধিকার লংঘনের চিত্র ছিল অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী মে, ২০২৩ মাসে ২ জন সাংবাদিকের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। অপরদিকে এ মাসে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় ৩৪ জন সাংবাদিক হয়রানি, ৩ জন সংবাদিককে হত্যার হুমকি ও ৮ জন সাংবাদিক স্বার্থান্বেসী মহলের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়ে আহত হয়েছেন। এছাড়া, সংঘর্ষ চলাকালীন সময়ে সংবাদ সংগ্রহকালে ৩ জন সাংবাদিক আহত ও জনসমাবেশে সংবাদকর্মীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। হয়রানির শিকার ৩৪ জনের মধ্যে ৩০ জন সাংবাদিককে অবরুদ্ধ ক‌রে রাখার অভিযোগ উঠে‌ছে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা‌দের বিরু‌দ্ধে ব‌রিশা‌ল সি‌টি কর‌পো‌রেশন নির্বাচ‌নে আওয়ামী লী‌গের প্রার্থী আবুল খা‌য়ের আব্দুল্লাহ খোকন সের‌নিয়াবা‌তের সঙ্গে সদর উপ‌জেলার জনপ্রতি‌নি‌ধি‌দের মত‌বি‌নিময় সভায়। সভা শে‌ষে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলী‌গের দুই গ্রু‌পের ম‌ধ্যে হাতাহা‌তির ঘটনার সময় ছ‌বি ধারণ কর‌তে গি‌য়ে তো‌পের মু‌খে পড়তে হয় বি‌ভিন্ন টে‌লি‌ভিশন চ্যানেলের ক্যামেরাপারসন ও প‌ত্রিকার ফ‌টো সাংবাদিকদের।

এমএসএফ মনে করে, যেভাবে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করছে যা শুধুমাত্র অনাকাঙ্খিতই নয় বরং এভাবে বাঁধার সৃষ্টি করে সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার ও বাকস্বাধীনতাকে সংকুচিত করা হচ্ছে।

 নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা

নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতারোধে দেশে যথেষ্ট কঠোর আইন থাকা সত্বেও অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভুমিকা লক্ষ্ণীয় নয়। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী মে ২০২৩ মাসে দেশে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা যেমন: ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, হত্যা, আত্মহত্যা ও পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা গত মাসের তুলনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেড়েছে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী মে মাসে ৪৫৭টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ৯৩টি, গত মাসের তুলনায় ৪৫টি বেশী, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৪টি, যা ৫টি বেশী, ধর্ষণ ও হত্যা ৪টি। এর মধ্যে ১৪ জন প্রতিবন্ধি নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। গত মাসে ৭ জন প্রতিবন্ধি নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। গণমাধ্যমের সূত্র অনুযায়ী গত মাসে ২৮৬টি নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতার ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল।

উল্লেখ্য যে ধর্ষণের শিকার ৯৩ জনের মধ্যে ৩২ জন শিশু, ৩৪ জন কিশোরী রয়েছে, অপরদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১জন শিশু ও ৫ জন কিশোরী এবং ধর্ষণ ও হত্যার শিকার ২ জন শিশু, ১ জন কিশোরী ও ১ জন নারী। ধর্ষণের চেষ্টা ১৮টি, যৌন হয়রানি ২৭টি ও শারীরিক নির্যাতনের ৯৫টি ঘটনা ঘটেছে। এসময়ে ১জন শিশু, ৩২ জন কিশোরী ও ৪১ জন নারীসহ মোট ৭৮ জন আত্মহত্যা করেছেন।

অ্যাসিড নিক্ষেপে আক্রান্ত হয়েছেন ২ জন নারী। এ মাসে ১ জন শিশু, ৪ জন কিশোরী ও ১ জন নারী নারী অপহরণের শিকার হয়েছেন। অপরদিকে ১ জন শিশু, ১০ জন কিশোরী ও ২ জন নারী নিখোঁজ রয়েছেন। এছাড়াও মে মাসে ৯ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যুসহ মোট ৯১ জন শিশু, কিশোরী ও নারী হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। যার মধ্যে ৩১ জন শিশু ও কিশোরী রয়েছেন। এপ্রিল মাসে হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিলেন ৫৬ জন। গণমাধ্যম সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রতিশোধ, পারিবারিক বিরোধ, যৌতুক, প্রেমঘটিত, অভিমান, পরিক্ষায় অকৃতকার্য্য হওয়া ইত্যাদি কারণে এ হত্যাকান্ডগুলো সংঘটিত হয়েছে। এ মাসে শারীরিক নির্যাতন ও পারিবারিক কলহের বিষয়ে ৩টি ঘটনা সালিশে মীমাংসা ও ধর্ষণ ও ধর্ষণের চেষ্টার  ৩টি ঘটনা সমাজপতিরা আপোস করেছেন যা প্রচলিত আইনকে অবজ্ঞা করে বেআইনি ভাবে সালিশে মীমাংসার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।

এ মাসেও ৬ জন মৃত ও ৪ জন জীবিত মোট ১০ জন নবজাতক শিশুকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিত্যাক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে যা অমানবিক ও নিন্দনীয়। এ সমস্ত শিশুদেরকে কি কারণে পরিত্যাক্ত অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা নিরূপনের চেষ্টা করছে না।

 সংখ্যালঘু নির্যাতন

গণমাধ্যমসূত্রে পাওয়া ও এমএসএফ’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ মাসে বিভিন্ন পর্যায়ে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ৭ টি ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে ২টি ঘটনায় হিন্দু ধর্মাম্বলীদের উপাসনালয় ও  মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে এবং জমি দখলের ঘটনা, ১ টি ঘটনায় হরিজন সম্প্রদায়ের মেয়েকে অপহরণ ও এ বিষয়ে থানায় মামলা দিতে গেলে মিমাংসার নামে সেটা নেওয়া হয়নি, ১টি ঘটনায় লালন আখড়ার সাধুসঙ্গে হামলা চালিয়ে বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুরের অভিযোগ রয়েছে।  অন্যদিকে আদিবাসী সম্প্রদায় চাকমাদের পানির সংকট এবং  খাসিয়াদের পান ও সুপারি গাছ কেটে ফেলার অভাবে কষ্টে জীবনযাপন করছে।

 গণপিটুনি

গণমাধ্যমসূত্রে পাওয়া এমএসএফ’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী মে, ২০২৩ মাসে একই ধারাবাহিকতায় উদ্বেগজনকভাবে গণপিটুনিতে হতাহতের ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রচলিত আইন অবজ্ঞা করে গণপিটুনির ঘটনাগুলোকে বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড হিসেবেই গণ্য করা যায়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ মাসে অন্তত ১৩টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, যেখানে একজন কিশোরসহ ৬ জন নিহত ও একজন শিশুসহ ৮ জন গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। ২ জনকে আহতাবস্থায় পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে, একজনকে সড়ক দূ:র্ঘনায় আহত বলে হাসপাতালে ভর্তি  করানো হয়েছে। সন্দেহজনক চুরি, বা বাকবিতণ্ডার জেরের অভিযোগে এসব গণপিটুনির ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়েছে। এমএসএফ মনে করে, আইন অবজ্ঞা করে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা অবশ্যই ফৌজদারী অপরাধ। গণপিটুনির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব।

 তথ্যসূত্র: প্রথম আলো, দি ডেইলি ষ্টার, নিউএইজ, কালের কন্ঠ, যুগান্তর, সংবাদ, জনকন্ঠ, আমাদের সময়, বাংলাদেশ প্রতিদিন, দৈনিক মানবজমিন, সমকাল, ইত্তেফাক, আজকের পত্রিকা, ঢাকা ট্রিবিউন, বিডি নিউজ ২৪, বাংলাদেশ জার্নাল, যায়যায় দিন, জাগো নিউজ ও অন্যান্য জাতীয় দৈনিকসমূহে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে উপরোক্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। তাছাড়াও প্রায় প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই স্থানীয় হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডারদের মাধ্যমে ভেরিফাই করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে ১ মে ২০২৩ থেকে ৩১ মে ২০২৩ পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনার ভিত্তিতে এ রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।

প্রতিবেদন সম্পর্কিত বিস্তারিত ঘটনার পরিশিষ্টসমূহ

 পরিশিষ্ট – ১ কারা হেফাজতে মৃত্যু

৮ মে, কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বিডিআর বিদ্রোহের কারাদন্ড কয়েদি আনোয়ার হোসেন কামরুল অসুস্থ হয়ে পড়লে কারারক্ষী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে আসেন। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরিক্ষার পর তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

৮ মে, গাজীপুরে কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে হাজতি যমুনা বেগম (৩৫) অসুস্থ হলে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

১৪ মে, রাজবাড়ী জেলা কারাগারে আঃ লতিফ (৫২) নামে এক হাজতি অসুস্থ হয়ে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়। আঃ লতিফ বেশ কিছুদিন কারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

১৪ মে, সিরাজগঞ্জ জেলা কারাগারে হাজতি নুরুল ইসলাম (৫৫) হঠাৎ করে অসুস্থ বোধ করলে জরুরিভাবে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। একই দিনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।

১৫ মে, দুপুরের দিকে কারাগারের অভ্যন্তরে টিনের চালা ঘরের পেছনের অংশের আড়ার সঙ্গে গলায় নিজের ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন ফারজানা আক্তার (২২) নামের এক হাজতি। তাকে উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। জেল সুপার জানান, ফারজানা আক্তার কারাগারে আসার পর থেকেই মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত ছিল।

২০ মে, ঢাকা কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের হাজতি মহসিন উল মুলক (৬৮) অসুস্থ হয়ে পড়লে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভোরে কারারক্ষীদের পাহারায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেয়া হলে চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

১৯ মে, কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে সুমন ঢালী ওরফে ডাকু সুমন (৪৪) নামের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক কয়েদি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

২৩ মে, ঢাক কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে হাজতি রাজু (২২) অসুস্থ হয়ে পড়লে কারারক্ষীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

২৮ মে, কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আতিকুর রহমান (৪২নামে এক হাজতিকে অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে মৃত ঘোষণা করেন।

২৮ মে, ঢাকার কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের কয়েদি রজিত কুমার সাহা (২৮) কে অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ২৩ মে বিকেলে কারা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে রজিত কুমারকে কারাগার থেকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

২৯ মে, ঢাকা কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে কয়েদি ইসমাইল মোল্লা (৫৭) কে রাতে অচেতন অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

 পরিশিষ্ট – ২ অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার

১ মে, হবিগঞ্জ শহরের আরডি হল এলাকার একটি পুকুর থেকে পঞ্চাশোর্ধ্ব অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. গোলাম মর্তুজা জানান, পুকুর থেকে উদ্ধার হওয়া লাশের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। তাঁর বয়স ৫০-এর ওপর হবে। পরিচয় শনাক্ত করার পাশাপাশি তাঁর মৃত্যুর কারণ উদ্‌ঘাটনে কাজ করছে পুলিশ।১ মে, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় বৈরাগ ইউনিয়নের রাজছিলা ফকির মাজারের পূর্বপাশে পিএবি সড়কের পাশে এক অজ্ঞাত (৪৫) ব্যক্তির রক্তাক্ত

 

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD