চাঁদ পরিভ্রমণরত অবস্থায় পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে এলে পৃথিবীর মানুষদের কাছে কিছু সময়ের জন্য সূর্য আংশিক বা কখনো সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যায়। এ অবস্থাকে সূর্যগ্রহণ বলে। আরবীতে এর নাম কুসুফ। ইংরেজীতে একে Solar eclipse বলে। আর পৃথিবী তার পরিভ্রমণ অবস্থায় চাঁদ ও সূর্যের মাঝখানে এলে কিছু সময়ের জন্য পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্য একই সরল রেখায় অবস্থান করতে থাকে। তখন পৃথিবী-পৃষ্ঠের মানুষ/প্রাণীদের থেকে চাঁদ কিছু সময়ের জন্য অদৃশ্য হয়ে যায়। এটাকে চন্দ্রগ্রহণ বলে। আরবীতে খুসুফ এবং ইংরেজীতে Lunar eclipse বলে।
গ্রহণ মানেই একাধিক বাড়তি কাজ। সঙ্গে নানা কুসংস্কার। এই ‘করতে নেই’ বা ‘করতে হবে’র মধ্যে এমনই সব প্রথা প্রচলিত রয়েছে গ্রহণকে কেন্দ্র করে। মনে করা হয়, গ্রহণের সময় বিশেষ কিছু নিয়ম মেনে না চললে, গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষতি হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ভ্রান্ত ধারণার কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। বহু যুগ ধরে চলে আসা মুখের কথাই রয়ে গিয়েছে শুধুমাত্র।
গ্রহণের সময় যা যা করতে নেই গর্ভবতী মহিলাদের-
১. বাড়ির বাইরে বেরতে নেই। এর ফলে গর্ভস্থ শিশুর ক্ষতি হতে পারে।
২. গ্রহণ চলাকালীন রান্না বা খাওয়া উচিত নয়।
৩. সংসারের কোনও কাজ করা উচিত নয়।
৪. গ্রহণের সময় কোনও ধারালো বস্তু, যেমন ছুরি, কাঁচি, বঁটি ব্যবহার নয়। মনে করা হয়, গর্ভস্থ শিশুর শরীরে এর ফলে কাটা দাগ থাকে।
বিজ্ঞান জানাচ্ছে, শুধুমাত্র গর্ভবতী মহিলাই নয়, গ্রহণে ক্ষতি হতে পারে যে কোনও মানুষেরই। তবে উপরোক্ত চারটি পয়েন্টের মধ্যে ২টি সমস্যার ব্যাখ্যা দিয়েছে বিজ্ঞান।
১. গ্রহণের সময় বাড়ির বাইরে না বেরনোই ভাল- কারণ, এই সময় সূর্যের দিকে তাকানো একেবারেই ঠিক নয়। সূর্য়ের তেজস্ক্রিয়তার ফলে চোখের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
২. গ্রহণ চলাকালীন, রান্না বা খাওয়া উচিত নয়- কারণ, গ্রহণের সময় সূর্যের তেজ কমে যায়। এর ফলে, জীবাণুর প্রকোপ বেড়ে যায় খাদ্যের উপর। যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। কিন্তু, খুব অল্প সময়ের জন্য গ্রহণ হলে সে ভয়ও নেই বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
চিকিৎসকদের মতে, বর্তমানে খাবার বেশিরভাগ সময় রেফ্রিজারেটরে থাকে। এর ফলে ক্ষতির কোনও ভয় থাকে না এবং গ্রহণের জন্য গর্ভস্থ শিশুর কোনও ক্ষতি হয়েছে কি না, তাও সঠিকভাবে বলা যায় না।
কাত হয়ে শুতে বারণ
সূর্যগ্রহণে গর্ভবতী মায়েদের শান্তি নেই। সেন্ট লুইসে অবস্থিত মার্সি হাসপাতালের গাইনোকোলজিস্ট শাফিয়া ভুট্টোর মতে, সূর্যগ্রহণের সময় পাকিস্তানে মায়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চিত করে শোয়ানো হতো। নইলে নাকি গর্ভের শিশু বিকলাঙ্গ হয়! বাংলাদেশেও এ ধারণার অস্তিত্ব রয়েছে। তবে গর্ভে শিশুকে রেখে চিত হয়ে শোয়াটা মায়েদের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
ধাতব অলংকার পরা, খাবার ও টয়লেটে বারণ
ধাতব অলংকার পরতে বারণ করা আছে ‘অ্যাস্ট্রোসেইজ’ নামে এক জ্যোতির্বিদ্যা সাইটে। অন্যদিকে ম্যাক্সিকান কুসংস্কারে, গ্রহণ চলাকালীন ধাতব অলংকার পরাকে উৎসাহিত করেছে। মেক্সিকোর প্রসূতি মায়েরা পেটের কাছে ধারালো ছুরি রাখতেন যেন গ্রহণের সময় সন্তানকে ঠোঁট কাটা রোগ থেকে বাঁচানো যায়। প্রচলিত আছে, সূর্যগ্রহণের ১২ ঘণ্টা এবং চন্দ্রগ্রহণের ৯ ঘণ্টা আগে থেকে খাবার গ্রহণ করা বারণ। এ সময় যৌন সংসর্গ বারণ, নিষেধাজ্ঞা রয়েছে মলমূত্র ত্যাগেও। তবে এসব ধারণার সুস্পষ্ট কারণ উল্লেখ নেই এবং নিশ্চিত ভাবেই কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই।
যে সংস্কারটি মানবেন
সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের দিকে সরাসরি তাকানো বারণ। এই সংস্কার অবশ্যই মানবেন। সত্যি বলতে, যেকোনো সময়েই সূর্যের দিকে সরাসরি তাকাতে নেই। সে হোক গ্রহণের সময়, কিংবা স্বাভাবিক সময়ে। সূর্যগ্রহণ দেখতে কাঁসার পাত্রে পানি থেকে শুরু করে ব্যবহার হয়েছে কাজে লাগে না এমন এক্স-রে প্লেটও। এখন অবশ্য বিশেষ রোদচশমা দিয়ে সূর্যগ্রহণ দেখা যায়। আজকের গ্রহণ সামনে রেখে ভালোই বিক্রি হচ্ছে এসব। দেখে-শুনে ভালো মানের এমন চশমা কিনতে পারেন। সূর্যগ্রহণ নিয়ে কোনো কুসংস্কারে পাত্তা দেওয়ার কোনো মানে নেই। আপনি যদি প্রসূতি মা হয়ে থাকেন, নিজের শরীরের যত্ন নিন। অনাগত সন্তানের জন্য শরীরে যথেষ্ট পুষ্টির ব্যবস্থা করুন।
যা বলছে ইসলাম
কুরআন ঘোষণা করছে যে, মহাশূন্যে যা কিছুই রয়েছে তারা প্রত্যেকেই আপন আপন কক্ষপথে ঘুরছে (দ্রষ্টব্য: সূরা আল আম্বিয়া: ৩৩, সূরা ইয়াসীন: ৪০)। আল্লাহ আরও বলেন, “আকাসমুহে ও পৃথিবীতে কত নিদর্শন রয়েছে, যেগুলো তারা অতিক্রম করে যায় কিন্তু সেদিকে তারা মোটেও দৃষ্টিপাত করেনা” [সূরা ইউসুফ: ১০৫]। মুর্খেরা মনে করে এসব শুধুই বস্তু। বস্তুর নিয়মেই এগুলো পরিচালিত হয়।
এগুলোকে তারা এন্টি রেডিয়েশন গ্লাস দিয়ে দেখে আর আনন্দ করে। অথচ আকাশ ও পৃথিবীর প্রত্যেকটি জিনিস এক মহাসত্যের প্রতি ইংগিতকারী এক একটি নিদর্শন। পানিকে পানি, গাছকে গাছ এবং পাহাড়কে পাহাড় তো পশুরাও দেখে থাকে এবং নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রত্যেকটি পশু এগুলোর ব্যবহার ক্ষেত্র জানে।
কিন্তু মানুষকে যে উদ্দেশ্যে ইন্দ্রিয়ানুভূতি সহকারে চিন্তা-ভাবনা করার জন্য মস্তিষ্ক দান করা হয়েছে তা শুধুই এ জন্য নয় যে, মানুষ সেগুলো দেখবে এবং সেগুলোর ব্যবহার ক্ষেত্র জানবে বরং অনেক নিদর্শন আল্লাহ্ মানুষের সামনে উপস্থাপন করেন এজন্য যে, মানুষ সত্যের অনুসন্ধান করবে এবং এ নিদর্শনগুলোর সাহায্যে তাকে চিনে নেবে।