সৈয়দ সাইদুর রহমান সাইদ
মানুষের মতো মানুষ যদি হতে চাও
১০ টি স্বভাব তুমি দূর করে দাও
কাম, ক্রোধ, লোভ, হিংসা আর মদ
অহংকার বখিলিপনা মিথ্যা গীবত।
মানুষের মতো মানুষ যদি হতে চাও
১০টি স্বভাব তোমার ভিতরে জন্ম দাও
প্রজ্ঞা, বিনয়, ক্ষমা, ভয়, কৃতজ্ঞতা,
ধৈর্য ,ভক্তি, সেবা, প্রেম, খাঁটিত্বতা।
প্রসপারিনা নামক জনৈক ভদ্রমহিলা সেদিন কথার প্রসঙ্গে বলেছিলেন“ মানুষের মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়”। এই মানুষের মতো মানুষ অহ রফবধষ সধহ ড়ৎ ঢ়ৎড়ঢ়বৎ সধহ হওয়ার মিশন আরম্ভ হয়েছে আদি পিতা আদম (আ:) ও মা হাওয়া (আ:) এর চধৎধফরংব ষড়ংঃ এর মধ্য দিয়ে। তাদের অন্যায়ের ফলশ্রুতিই (পৃথিবীর শাস্তি বা অশান্তি স্বরূপ) মানবজাতির পৃথিবীতে পদার্পণ। আর এই জাতি এখানে মানুষের মত মানুষএ পরিণত হয়ে সৃষ্টিকর্তার সন্তেুষ্টি অর্জন করবে। আর পুনরুদ্ধার করবে তাদের আদি পিতা-মাতার হারানো বেহেশত বা স্বর্গ। তাই ইংরেজ কবি জন মিল্টন বিশ্বাস করতেন যে, “গধহ’ং সরংংরড়হ রহ ঃযরং ড়িৎষফ ঃড় ৎবমধরহ ঃযব ষড়ংঃ ঢ়ধৎধফরংব” । এজন্য করে মানুষের মত মানুষ এটি শুধু প্রসপারিনা নয়, বিশ্বের সকল মানুষ পূর্বাপর নানাভাবে এই কথাটি প্রকাশ করেছেন। পৃথিবী যতদিন টিকে থাকবে এরূপ কথা ততদিন পৃথিবীতে থাকবে। কবি কালিদাস বলেছেন “শত মূর্খ নিয়ে স্বর্গে যাওয়া অপেক্ষা তিন পন্ডিত নিয়ে পাতালে থাকা উত্তম”। “মানুষ হয় না জনে জনে – চন্দন হয় না বনে বনে”। “গাছ বৃক্ষ সহজেই গাছ বৃক্ষ, পশুপাখি সহজেই পশুপাখি, কিন্তু মানুষ সহজে মানুষ নয়”। মাওলানা রুমির মসনবী শরীফ“এ বলেছে, “বাজে কথা ছেড়ে দাও ভাবাবেগাপন্ন মানুষ হও। যদি এরূপ হতে চাও পরিপূর্ণ মানুষের কাছে যাও এবং নিজেকে বিলিয়ে দাও”। অপর একজন বলেছেন- “মানুষের মত মানুষ হওয়া ব্যতিরেকে বিশ্ব মানব সমাজে কখনই শান্তি আসতে পারে না”। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা বলেছেন- ‘লাতুফাত্তাহু লাহুম আবওয়াবুসসামাওয়াত”। অর্থাৎ“হে মানুষ, যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি মানুষ হতে না পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার জন্য উর্দ্ধলোকের কোন দরজা খোলা হবে না”। সত্যই মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষার আলো মানব জীবনে প্রতিফলিত হলেই মানুষ হওয়া যায়। আর মানুষ হতে পারলেই বিশ্বের শান্তি-স্বর্গ আসবে মানুষের হাতের মুঠোয়। তাই মানুষকে মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেয়ার নিমিত্তে সৃষ্টিকর্তা সিয়াম সাধনা ফরজ করে দিয়েছেন সকল মানুষের জন্য। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন ‘ইয়া আইয়্যুহাল্লাজিনিা আমানু কুতিবা আলাইকুমুসসিয়ামু কামা কুতিবা আলাল্লাজিনা মিন কুবলিকুম লাআল্লাকুম তাত্তাকুন’- “যারা ঈমানদার বা সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস করে তাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেমন- পূর্ববর্তীদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছিল”। এ রোজার মাধ্যমে দিয়ে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর ভয় ও জবাবদিহিতা সৃষ্টি হবে। এই জবাবদিহিতার কারণে মানুষ অন্যায় থেকে বিরত থাকবে। প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায়। ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হলে পৃথিবী হবে শান্তিময়। মানুষ ফিরে পাবে তাদের হারানো স্বর্গ বা বেহেশত। বিশ্ব মানব সমাজের অশান্তি সৃষ্টির জন্য মানুষের মধ্যে নিহিত স্বভাব একমাত্র দায়ী। এই স্বভাব দূর করার জন্য সিয়াম সাধনার বিকল্প নাই। অথার্ৎ এই সিয়াম সাধনা শিক্ষা দ্বারা মনুষ্যত্ব স্বভাব সৃষ্টির নিমিত্তে পশুত্ব বা আমিত্ব দূর করতে হবে। পশুত্ব স্বভাবের মধ্যে রয়েছে ষড়রিপু। এই ষড়রিপুগুলো হচ্ছে- অহ বহবসু, ধহু ড়ভ ঃযব ংরী রহযবৎবহঃ ারপবং ড়ৎ পধৎফরহধষ ঢ়ধংংরড়হং ড়ভ সধহ, হধসবষু ংবী-ঢ়ধংংরড়হং, ধহমবৎ, মৎববফ, রহভধঃঁধঃরড়হ, াধহরঃু ধহফ রহাু(পড়ষষবপঃরাবষু পধষষবফ) ষড়রিপু। অর্থাৎ কাম, ক্রোধ, লোভ ,মোহ, হিংসা, বিদ্বেষ। বলাবাহুল্য ষড়রিপুর প্রভাব দ্বারাই প্রভাবিত আজকের বিশ্বের সন্ত্রাসবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বৈষম্যবাদ,কমিউনিষ্টবাদ, মার্কসবাদ, জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ। সমস্ত মতবাদ বাদ দিয়ে ষড়রিপুকে দমন করে প্রতিষ্ঠা করতে হবে মানবতাবাদ। এই মানবতাবাদের মধ্যে থাকবে ঐঁসধহ াধষঁবং-অর্থাৎ মানবিক মূল্যবোধ। যার মধ্যে আরও থাকবে ঝড়পরধষ াধষঁবং ধহফ জবষরমরড়ঁং াধষঁবং- অর্থাৎ সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় মূল্যবোধ।
সিয়াম সাধনার মধ্যে দ্বিবিধ বিশেষত্ব আছে। এই বিশেষত্ব দুটির মধ্যে একটি হচ্ছে রোজার মূল অর্থ সর্ববিধ কামনা, বাসনা, লোভ, মোহ, মদ, হিংসা, বিদ্বেষ ও অহংকার পরিত্যাগ করা। আর এই পরিত্যাগ করাটা সম্পূর্ণ অন্তরের কর্ম। কাজেই এর মধ্যে রিয়া এবং অহংকারের অবকাশ নেই। অপরটি হচ্ছে. শয়তানি শক্তি তথা কু-শক্তি। যা সু-শক্তি বা ইনসানি শক্তির অর্থাৎ আদমের চিরশত্রু। উপরোল্লেখিত ষড়রিপু শয়তানের সৈন্য। রোজা রাখার প্রকৃত উদ্দেশ্য সর্বপ্রকার কামনা-বাসনা বর্জন করা। সুতরাং রোজা শয়তানের সৈন্যকে বিনাশ করে। আল্লাহর প্রেরিত মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন“ মানুষের শরীরের শিরায় শিরায় রক্ত যেরুপ সঞ্চারণ করে তদ্রুপ মানুষের অন্তরের মধ্যে শয়তান চলাফেরা করে। ক্ষুধার্ত থেকে শয়তানের চলাচলের পথ দুর্গম করে দাও। রোজা সম্পর্কে তাম্বিয়ায়ে গাফেলিন কিতাবে (উর্দু) ১৭৪ পৃষ্ঠায় বুজুর্গানে দ্বীনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, রোজা তিন প্রকার। (১) আম রোজা অর্থাৎ সাধারণ যা শুধু পানাহার বা স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা। (২) খাস রোজা অর্থাৎ উত্তম। যা শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অর্থাৎ চক্ষু-কর্ণ, জবান , নাসারন্ধ্র, হস্ত-পদাদি সমস্ত কিছুকে খারাপ কাজ সমূহ থেকে বিরত রাখা। সমস্ত নিষিদ্ধ কাজকর্ম পরিত্যাগ করা। (৩) খাস আন খাস রোজা অর্থাৎ অতি উত্তম । এই শ্রেণীর রোজা আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তার ধ্যান ব্যতীত অন্য কোন বস্তু নিচয়ের খেয়াল থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা। এমনকি ইফতারি করার চিন্তা থেকেও বিরত থাকা। রাসূলে পাক (সা:) বলেছেন- “ অনেক রোজাদার এমন আছে যারা একমাত্র পানাহার না করে কষ্ট ভোগ করা ছাড়া আর কোনো ফায়দা বা উপকারিতা লাভ করতে পারল না। এছাড়া অনেক ইবাদতকারী এমন যারা রাত জেগে সারারাত ইবাদত করে। তাদের রাত জাগা ছাড়া ওই ইবাদত দ্বারা কোন উপকার সাধিত হবে না। তাদের রোজা ও নামাজ তাদের জন্য কোনই কাজে আসবে না।
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এর লেখার উদ্ধৃতি থেকে প্রকৃত রোজা পালনের বিষয়যটি সুস্পষ্ট হবে মর্মে হুবহু তুলে ধরা হচ্ছে। তার কীমিয়ায়ে সাআ’দাত কিতাবের ২৩৮ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন- রোজার শ্রেণীভেদঃ পাঠক জানিয়া রাখ শ্রেণীভেদে রোজা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত। (১) সাধারণ লোকের রোজা । (২) উচ্চ শ্রেণীর মহাপুরুষদের রোজা । (৩) মধ্যম শ্রেণীর রোজা।
১। সাধারণ লোকের রোজা ঃ
ইতোপূর্বে রোজা সম্বন্ধে যা কিছু বর্ণিত হইয়াছে ইহা সাধারণ লোকের রোজা। পানাহার ও স্ত্রী সহবাস ইত্যাদি কার্য হইতে বিরত থাকলেই সাধারণ লোকদের রোজার পালনীয় কর্তব্য শেষ হইল। ইহা সর্ব নিম্ন শ্রেণীর রোজা।
২। সর্বোচ্চ শ্রেণীর রোজাঃ
সাধুকুল শ্রেষ্ঠ বুযুর্গগণের রোজা সবোর্চ্চস্তরের রোজা। এই শ্রেণির রোজায় রোজাদারদের অন্তর সর্বদা আল্লাহ তাআলার চিন্তায়ই নিমগ্ন রাখিতে হয় এবং আল্লাহ ভিন্ন অন্যান্য যাবতীয় পদার্থের চিন্তাকে মন হইতে দূর করিয়া নিজেকে সম্পূর্ণরুপে আল্লাহতালার হাতে উৎসর্গ করিয়া দিতে হয়। এইরূপ করিতে পারলেই কেবল আল্লাহ ভিন্ন অন্যান্য সমস্ত বস্তু হইতে অন্তরে ও বাহিরে রোজা রাখা হয়। আল্লাহ তাআলার বাণী এবং তাহার আনুসঙ্গিক কথা ভিন্ন অন্য কথায় মন দিলে রোজা এই উন্নত শ্রেণির মধ্যে গণ্য হয় না। দায়ে ঠেকিয়া সাংসারিক আবশ্যকীয় বিষয়ের প্রতি মনোযোগ প্রদান করা যদিও সাংসারিক কার্যের কতগুলি কার্য পারলৌকিক কাজের মর্যাদা প্রদান করা যায় তথাপি আলেমগণ বলেন, সন্ধ্যাকালে কোন্ বস্তু দ্বারা ইফতার করা হবে দিবাভাগে তাহার আয়োজন করিলে সেই রোজা নষ্ট হইবে ও পাপ বলিয়া গণ্য হইবে। কেননা, দিবাভাগে ইফতারের আয়োজন করিলে মহাপ্রভু আল্লাহকে সকলের জীবিকা প্রদানকারী বলিয়া দৃঢ় বিশ্বাস এর মধ্যে দুর্বলতা প্রবেশ করে। নবী ও সিদ্দিকগণের রোজা এই উন্নত স্তর এর অন্তর্ভুক্ত। তাহারাই সুউচ্চ মর্যাদা লাভ করিয়াছেন। সকল লোক সেই উচ্চ মর্যাদা লাভ করিতে সক্ষম হয় না।
৩। মধ্যম শ্রেণীর রোজাঃ
সাধারণ মানুষের ঊর্ধ্বে এবং শ্রেষ্ঠ বুজুর্গগণের নিম্নে সাধারণ সাধু পুরুষদের রোজা এই মধ্যম শ্রেণীর অন্তর্গত। শুধু, আহার, স্ত্রী সহবাস ইত্যাদি রোজা এই মধ্যম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হয় না। বরং সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে পাপ কাজ হইতে রক্ষা করিতে হইবে
মধ্যম শ্রেণীর রোজার পূর্ণতা কিসেঃ
নিম্নলিখিত ৬ টি বিষয় মধ্যম শ্রেণীর রোজার পূর্ণতা সাধিত হইয়া থাকে। (১) আল্লাহ তাআলার দিক হইতে মনকে বিরতকারী যাবতীয় পদার্থের প্রদর্শন হইতে চক্ষুকে রক্ষা করা। বিশেষতঃ হৃদয়ে কামভাব উদ্দীপক বস্তুর প্রতি কখনও দৃষ্টিপাত করিবে না। এই মর্মে হযরত রাসুলে করিম ছাল্লালল্লাহু আলাইহেওয়াছাল্লাম বলিয়াছেনঃ শয়তানের তীর সমূহের মধ্যে চক্ষুর দৃষ্টি একটি বিষাক্ত তীর। যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে নিষিদ্ধ দৃশ্যের দর্শন হইতে চক্ষুকে সংযত রাখিবে তাহার ঈমানের এমন মধুর ও মনোরম পরিচ্ছেদ পরান হইবে যাহার সুস্বাদ ও মিষ্টতা সে নিজের অন্তরে আস্বাদন করিতে পারিবে। হযরত আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহুর মুখে শোনা গিয়াছে যে, হযরত রাসুলে করূীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম বলিয়াছেন ঃ মিথ্যা কথা, পরনিন্দা, কুটনামী, মিথ্যা শপথ ও কামভাবের সহিত কাহারও প্রতি দৃষ্টিপাত করা, এই পাঁচটি কার্যে রোযা নষ্ট হয়। (২) অনর্থক বকবক হইতে জিহ্বাকে সংযত রাখিয়া আল্লাহ তাআলার যিকির ও কোরআন তেলাওয়াতে মশগুল থাকা; অন্যথায় নীরব থাকা। হাদীস শরীফে উল্লেখ আছেঃ একদা দুইজন রোযাদার স্ত্রীলোক তীব্র পিপাসায় কাতর হইয়া পরে প্রাণনাশের আশঙ্কায় হুযুরে আকরাম ছাল্লাল্লাহু আলাইহেওয়া ছাল্লামের খেদমতে রোযা ভঙ্গের অনুমতি চাহিয়াছিল। তিনি উহাদের নিকট একটি পাত্র পাঠাইয়া উহাতে বমি করিতে বলিয়া দিলেন। প্রত্যেকের গলা হইতে জমাট রক্ত পিন্ড বাহির হইল। ইহাতে দর্শকগণ ভীত হইয়া ইহার কারণ জানিতে চাহিলে হুযুর (দঃ) ফরমাইলেনঃ আল্লাহ তাআলা যে দ্রব্য হালাল করিয়াছেন তাহা দ্বারা ইহারা রোযা রাখিয়াছিল, কিন্তু তিনি যাহা হারাম করিয়াছেন তাহা দ্বারা ইহারা রোযা ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছে। ফলকথা, ইহারা কাহারও নিন্দা চর্চ্চা করিয়াছে। এই যে রক্ত দেখিতেছ ইহা মনুষ্য মাংস। পরনিন্দা করার কারণে উক্ত নিন্দা উহাদের জন্য মনুষ্য মাংস ভক্ষণের ন্যায় হইয়াছে। (৩) আপন কর্ণকে অশ্লীল বাক্য শ্রবণ হইতে বিরত রাখিবে। যেরূপ মন্দ বাক্য বলা উচিৎ নহে, তাহা শুনাও উচিৎ নহে। পরনিন্দা ও মিথ্যা কথা বলিলে পাপ হয়। শুনিলেও শ্রোতা সেই পাপের অংশী হইয়া থাকে। (৪) হাত পা প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গুলিকে কুকার্য হইতে বাঁচাইয়া রাখা। যে ব্যক্তি রোযা রাখিয়া মন্দ কার্য করে তাহাকে সেই রুগ্ন ব্যক্তির সহিত তুলনা করা যায়, যে ব্যক্তি রোগের ভয়ে ফল ভক্ষণে বিরত থাকিল অথচ তীব্র বিষ গলধঃকরণ করিয়া ফেলিল। পাপকার্য করা বিষ ভক্ষণ তুল্য। অল্পক্ষণেই প্রাণ বিণাশ করে কিন্তু ফল ও খাদ্যদ্রব্য অধিক পরিমাণে না খাইলে অনিষ্ট হয় না। কেননা, খাদ্যদ্রব্য মূলতঃ অনিষ্টকর নহে। এই মর্মে হযরত ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া ছাল্লাম বলিয়াছেনঃ এমন অনেক রোযাদার আছে ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্টভোগ ব্যতিত তাহাদের রোযার আর কোন ফল লাভ হয় না। (৫) ইফতারের সময় হারাম অথবা সন্দেহজনক দ্রব্য আহার করিবে না। আবার হালাল দ্রব্যও অতিরিক্ত খাইবে না। দিবা-রাত্রির জন্য নির্ধারিত দুই বারের খাদ্য যদি এক রাত্রিতেই খাইয়া ফেল, তবে কি লাভ হইবে। লোভকে দমন না করিয়া বরং আরও অধিক বৃদ্ধি করা হয়। বিশেষত: যখন নানা প্রকার সুস্বাদু এবং উপাদেয় খাদ্য ভোজন করা হয়, তখন লোভ আরও বৃদ্ধি পাইয়া থাকে। পাকস্থলী শূণ্য না হওয়া পর্যন্ত অন্তর পরিষ্কার ও নির্মল হইবে না। দিবাভাগে অধিক নিদ্রা না যাওয়া সুন্নত। দিবসে নিদ্রা না গেলে ক্ষুদা,তৃষ্ণা ও দুর্বলতা শরীরে অনুভূত হয়। রাত্রিতে অল্প আহার করিয়া শীঘ্র শীঘ্র শয়ন না করিলে শেষ রাত্রে তাহাজ্জুদের নামায পড়িতে পারা যায় না। হযরত রাসূলে করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন ঃ আল্লাহ তাআলার দৃষ্টিতে পরিপূর্ণ উদর অপেক্ষা আর কিছুই অধিকতর ঘৃণিত নহে। (৬) ইফতার করিয়া মনের মধ্যে এই ভয় প্রবল রাখিবে যে, আমার রোযা কবুল হইল কি না। হযরত হাসান বছরী (রহ:) কোন এক ঈদের দিন একদল লোকের সম্মুখ দিয়া যাইতেছিলেনন। তারা ঈদের উৎসবে উন্মত্ত হইয়া ক্রীড়া-কৌতুক এবং আনন্দ প্রকাশ করিতেছিল। তিনি তাহাদের উদ্দেশ্যে বলিলেনঃ সৃষ্টিকর্তা রমযানের মাসকে একটি ময়দানের ন্যায় করিয়াছেন। আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা এই যে, মানুষের মধ্যে একদল সৈন্যকে উক্ত ময়দানে নেক কার্যের ব্যাপারে পশ্চাতে ফেলিয়া অগ্রসর হইয়া যায়, রমযানের ময়দানে যাহারা নেক কার্যে পশ্চাৎপদ থাকিয়া যায়, তাহারা যদি নিজেদের ত্রুটি বুঝিতে সক্ষম না হইয়া আনন্দোৎসবে মশগুল থাকে, তবে তাহাদের আচরণে বিষ্মিত হইতে হয়। খোদা তাআলার খোদায়িত্বের শপথ! যখন আবরণ উন্মুক্ত হইবে এবং প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ পাইবে, তখন যাহাদের এবাদৎ কবুল হইয়াছে তাহারা যেন আনন্দিত হয় আর যাহাদের এবাদৎ অগ্রাহ্য হয় তাহারা যেন অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয় এবং কোন প্রকার আমোদ-আহলাদে মশগুল না হয়। অতএব, কেহই ক্রীড়া-কৌতুকে মত্ত যেন না থাকে।
রোযার প্রকৃত তত্ত্ব ঃ
প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত বিবরণ হইতে অবশ্যই বুঝিতে পারিয়াছ যে, যে ব্যক্তি শুধু পানাহার বন্ধ রাখিয়া রোযা পালন করে, তাহার রোযা প্রাণহীন দেহের ন্যায় মৃত। রোযার প্রকৃত মর্ম হইল-মানুষ নিজেকে ফেরেশতার ন্যায় প্রস্তুত করিবে অর্থাৎ ফেরেশতাগণ যেমন কাম ও লোভ হইতে মুক্ত, মানুষও তেমনি রোযা দ্বারা নিজেকে কাম এবং লোভ হইতে মুক্ত ও পবিত্র করিবে। লোভ চতুষ্পদ জন্তুর উপরই পরাক্রমশালী। লোভ পশুকে যে দিকে চালিত করে তাহারা সেদিকেই চলে। এই জন্য পশু জাতি ফেরেশতা স্তর হইতে বহু দূরে। মানুষের মধ্যেও যাহারা লোভের বশীভূত তাহারা পশুর ন্যায়। কেবল লোভ দমনের ক্ষমতা আছে বলিয়াই মানুষ ফেরেশতাদের নিকটবর্তী ; স্থান হিসেবে নিকটবর্তী নহে। ফেরেশতাগণ আল্লাহ তাআলার নিকটবর্তী। অতএব, ফেরেশতার গুণে গুণবান মানুষও আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপযুক্ত। যে ব্যক্তি ইফতারের শেষে সন্ধ্যার সময় উদর পুরিয়া আহার করে, তাহার লোভ দুর্বল না হইয়া বরং ক্রমশঃ সবল হইয়া উঠে। তাহার রোযা কখনও জীবন্ত (প্রাণদ) হইতে পারিবে না।
পরিশেষেঃ পূর্ববর্তীদের উপর রোযা অবশ্য পালনীয় অর্থে আহলে কিতাবের অনুসারীদের কথা বলা হয়েছে। এ মর্মে আদি পিতা আদম (আঃ) থেকে পৃথিবীর প্রলয় পর্যন্ত সকল মানব সন্তানের জন্য সিয়াম সাধনা ফরজ। তাই সিয়াম সাধনার আত্মিক এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষার আলো সকল আদম সন্তানের উপর প্রতিফলিত হোক, গড়ে উঠুক অনাবিল শান্তিময় বিশ্ব মানব সমাজ।
লেখক : কবি, সাহিত্যিক ও আধ্যাত্মিক পীর।