আবদুর রাজ্জাক রাজু
তাড়াশ প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠার ৩৮ বছর চলছে। সে দৃষ্টিকোন থেকে প্রতিষ্ঠা পূর্বকাল হতে প্রতিষ্ঠা পরবর্তী সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত এর ধারাবাহিক স্মৃতিচারণ করা এতো দিন পরে এসে একটা দুরূহ কাজ।এক্ষেত্রে কিছু স্মৃতি হাতড়িয়ে খুঁজে ফিরতে হবে। কেননা ,সে স্মৃতির আকাশের কিছু নক্ষত্র আজো উজ্জল। কিছু তারকা ধুসর ,মিট-মিটে জ্বলে। আবার এমনও আছে যেগুলো তেমন জ্বলে না। ফলে কোথায় শুরু হয়ে কোথায় শেষ হবে তা মনস্থির করা মুশকিল। তবে এটা সত্য যে, সেসব সোনালী স্মৃতি কখনই ভোলার নয়।
চলনবিল তথা তাড়াশের সাহিত্য-সাংবাদিকতার পথিকৃত ও পূর্বসূরী যথাক্রমে শাফাতুল্লাহ মুন্সী, মাওলানা সেরাজুল হক, অধ্যাপক এম. এ হামিদ, মরহুম ফজলুর রহমান খাঁ, অধ্যাপক বাহাদুর আলী , তোফায়েল উদ্দীন সিদ্দিকী ও মমতাজ উদ্দিনসহ আমাদের পূর্বসূরী প্রেরণার উৎস বেশ কিছু কৃতি ও গুণীজনের কর্ম আদর্শ অনুসরণ করে তাড়াশের আমরা ক’জন নবীন-তরুণ প্রথমে সাহিত্য অত:পর সাংবাদিকতায় পদচারণা শুরু করি স্বাধীনতার পর থেকে। বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমি, কাজী রূহুল আমীন ও বিনসাড়ার সাইদুর রহমান সাজু গুরুদাসপুরে যাতায়াত করতাম। প্রথমে উদ্দেশ্য ছিল চাঁচকৈড় শিক্ষাসংঘ থেকে বিচিত্র বই সংগ্রহ করে পড়া। এরপর ছোট খাটো সংবাদ লেখার সূত্রে ওখানকার তৎকালীন সাংবাদিকদের সাথে ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে চলনবিল প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠায় আমরা যুক্ত হই। সেই কমিটিতে রূহুল আমীন সহ-সভাপতি ও আমাকে দেয়া হয় যুগ্ম সম্পাদকের পদ। এরপূর্বে ১৯৭৪-৭৫ শিক্ষা বর্ষে আমি গুরুদাসপুরে শহীদ শামসুজ্জোহা কলেজে ডিগ্রীতে লেখা পড়া করেছি। তখনও সেখানে কিছুটা সাহিত্য চর্চ্চায় লিপ্ত ছিলাম। প্রেরণা যোগাতেন উক্ত কলেজের আমাদের বাংলা বিভাগের শিক্ষক তৎকালীন খ্যাতনামা সাহিত্যিক অধ্যাপক নজিবর রহমান আব্বাসী। ইতোমধ্যে মাওলানা রুহুল আমিন তাড়াশ থেকে ইত্তেফাক সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। যুগপৎ আমি, সাইদুর রহমান সাজু, সাইদুর রহমান সাইদ, আব্দুল কুদ্দুস ,আব্দুর রহমান প্রমুখ বিভিন্ন সংবাদপত্রে যোগাযোগ করে সংবাদ লিখতে থাকি। গুরুদাসপুর প্রেস ক্লাবের দৃষ্টান্তে অনুপ্রেরিত হয়ে তাড়াশে একটি প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠার উদ্দ্যেশ্যে আমাদের মধ্যে পারস্পারিক আলোচনা চলতে থাকে। এ লক্ষে চুড়ান্ত সিদ্ধান্তের পর তাড়াশ-রায়গঞ্জের তৎকালীন এমপি জামশেদ আলীকে প্রধান অতিথি হিসেবে তাড়াশ প্রেস ক্লাবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১৯৮০ সালের ১৫ জানুয়ারী গাজী আব্দুর রহমানের তাড়াশ বাজারের দ্বিতল টিন শেড ঘরে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় তাড়াশ প্রেস ক্লাবের। মাননীয় সাংসদ রায়গঞ্জ উপজেলার ধামাইনগর ইউনিয়নের বাকাই গ্রাম থেকে এসেছিলেন গরুর গাড়ী চড়ে। সেখানে আজকের সাংসদ ম.ম. আমজাদ হোসেন মিলন ও তদানীন্তন বিশিষ্ট সমাজকর্মী সরদার আব্দুল জলিল প্রমুখ রাজনৈতিক-সামাজিক নেতৃবৃন্দসহ তাড়াশের কবি লেখক ও সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক সূধীজন উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে গুরুদাসপুর থেকে তাড়াশ প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠা লগ্নে যোগ দিতে এসেছিলেন সাংবাদিক অধ্যাপক শামছুর রহমান এবং মো. জাকির হোসেন।
এর পূর্বে তাড়াশ কলেজের চত্বরে কাঁঠাল গাছতলায় গঠিত হয় ৯ সদস্যের নি¤েœাক্ত আহবায়ক কমিটি। সেই কমিটিই ঘোষিত হয়েছিল উদ্বোধনী সভায়। (সূত্রঃ তাড়াশ প্রেসক্লাবের দ্বিতীয় প্রকাশনা “অভিষেক ’৮৪” পৃষ্ঠা নং- ১৬)
১. রুুহুল আমীন-দৈনিক ইত্তেফাক, আহবায়ক
২. আব্দুল কুদ্দুস-দৈনিক সংবাদ(শিক্ষানবীশ),যুগ্ম -আহবায়ক
সদস্যবৃন্দ ঃ
৩. অধ্যাপক শামছুর রহমান-দৈনিক গণকন্ঠ(গুরুদাসপুর)
৪. জাকির হোসেন-দৈনিক আজাদ(গুরুদাসপুর)
৫. সাইদুর রহমান সাজু-দৈনিক বার্তা
৬. আবদুর রাজ্জাক রাজু-সাপ্তাহিক কাঁকন/রাজশাহী বার্তা
৭. আবদুর রহমান মিয়া-সাপ্তাহিক জীবন
৮. সাইদুর রহমান সাইদ-দৈনিক দেশ (শিক্ষানবিশ)
৯. শ্রী শংকর দাস-সাপ্তাহিক খবর(মিছমিথুইর/ভাঙ্গুড়া)
এর তিন মাস পরে ১৯৮০ সালের ৩১ আগষ্ট ১৯৮০-১৯৮২ দ্বি বার্ষিক সর্ব প্রথম স্থায়ী কমিটি গঠিত হয় যাদের নিয়ে। (অভিষেক ’৮৪, পৃষ্ঠা নং – ১৭)
১. রুহুল আমিন, সভাপতি-দৈনিক ইত্তেফাক
২. অধ্যাপক শামছুর রহমান,সহ সভাপতি-দৈনিক গণকন্ঠ
৩. আবদুর রাজ্জাক রাজু, সাধারণ সম্পাদক-রাজশাহী বার্তা/কাঁকন
৪. আব্দুল কুদ্দুস,যুগ্ম সম্পাদক-দৈনিক প্রবাহ
৫. সাইদুর রহমান সাঈদ-অফিস সম্পাদক-দৈনিক দেশ (শিক্ষানবিশ)
সদস্যমন্ডলী ঃ
৬. জাকির হোসেন-দৈনিক আজাদ
৭. সাইদুর রহমান সাজু-দৈনিক করতোয়া
৮. শহিদুল ইসলাম-দৈনিক বার্তা(গুরুদাসপুর)
৯. শ্রী শংকর দাশ-সাপ্তাহিক খবর
১০. আবদুর রহমান মিয়া-সাপ্তাহিক জীবন
তাড়াশ প্রেস ক্লাবের ১৯৮২-৮৪ মেয়াদে প্রথম নির্বাচিত নির্বাহী পরিষদ (অভিষেক’৮৪,পৃষ্ঠানং-১৮) ঃ
১. সভাপতি -রুহুল আমীন, দৈনিক ইত্তেফাক
২. সহ-সভাপতি-আব্দুর রহমান মিয়া, সাপ্তাহিক জীবন
৩. সাধারণ সম্পাদক-আব্দুল কুদ্দুস, দৈনিক গণকন্ঠ
৪. সহ-সাধারণ সম্পাদক- সাইফুল ইসলাম, পাবনা বার্তা
৫. সাহিত্য সম্পাদক-আবদুর রাজ্জাক রাজু, দৈনিক দেশ
৬. কোষাধ্যক্ষ-সাইদুর রহমান সাজু, দৈনিক বার্তা/করতোয়া
সদস্যবৃন্দঃ
৭. জাকির হোসেন দৈনিক আজাদ
৮. শহিদুল ইসলাম-দৈনিক বার্তা
৯. শংকর দাশ-সাপ্তাহিক খবর
১৯৮৪-১৯৮৬ দ্বি বার্ষিক কার্যকরী কমিটির নির্বাচিত কর্মকর্তাবৃন্দ( অভিষেক ’৮৪,পৃষ্ঠা-৪)
১. সভাপতি ঃ আবদুর রাজ্জাক রাজু-দৈনিক দেশ/সাপ্তাহিক রাজশাহী বার্তা
২. সহ-সভাপতিঃ জামশেদ আলী-সাপ্তাহিক নতুন বাংলা
৩. সাধারণ সম্পাদক ঃ আব্দুল লতিফ সরকারÑ দৈনিক উত্তর বার্তা
৪. সহ সম্পাদকঃ শামসুল আলম সেলিম-দৈনিক উত্তরাঞ্চল
৫. সাহিত্য সম্পাদকঃ সাইদুর রহমান সাজু-দৈনিক বার্তা/করতোয়া
৬. কোষাধ্যক্ষ ঃ মাওলানা আব্দুর রহমান-সাপ্তাহিক সোনার বাংলা
৭. দফতর সম্পাদক ঃ সাইফুল ইসলাম-সাপ্তাহিক পাবনা বার্তা
এরপর পর্যায়ক্রমে মেহেরুল ইসলাম,আতিকুল ইসলাম বুলবুল ,সনাতন দাশ , মামুন হুসাইন এবং জাকির আকনের এর মতো নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকগন বিভিন্ন সময়ে তাড়াশ প্রেস ক্লাবে নেতৃত্ব দিলেও কেবল উপেক্ষার দেয়াল লিখন ব্যতিত তাদের কোন প্রকাশনা ও তাদের আমলের কোন রেকর্ডপত্র সেভাবে সংরক্ষিত আছে কিনা তা আমার জানা নেই। কিছুদিন আগে শুনেছিলাম, প্রেস ক্লাবের বর্তমান কমিটি ক্লাব সম্পর্কে একটি প্রকাশনা শীঘ্রই করতে যাচ্ছে যদিও তার কোন আলামত এখনও দেখা যাচ্ছে না। এখানে উল্লেখ্য, ওই সময়ে আমাদের সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের আড্ডার একমাত্র কেন্দ্রস্থল ছিল তাড়াশ প্রেস ক্লাব। তাড়াশে তখনও বাস্তবে কোন গণপাঠাগার ছিল না যেমন আজকেও নেই। ফলে সাহিত্য সংবাদ আমোদী সবারই মিলনস্থল হিসেবে দ্বিতীয় পরিবার ছিল এই প্রেস ক্লাব। এক সময় আমার ওপর দায়িত্ব বর্তায় প্রেস ক্লাবের জন্য নিজস্ব জায়গা খুঁজে বের করতে। গুরুদাসপুরের শিকারপুর মসিন্দা হতে তাড়াশে স্থায়ী বসবাসরত পশ্চিম ওয়াবদা বাঁধ সংলগ্ন বাসিন্দা জমি জরীপকারী (আমিন) আবুল কাশেমকে সাথে নিয়ে অনুসšধান চালিয়ে অবশেষে তাড়াশ ডিগ্রি কলেজের উত্তর পাশের আজকের প্রেস ক্লাব নির্ধারিত স্থান বের করা হয় যা ৮ শতাংশ। ১৯৮৪-৮৬ মেয়াদে আমি যখন ক্লাবের সভাপতি, সে সময়ে তাড়াশ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিলের সহানুভুতিতে তাড়াশ উপজেলা পরিষদের সৌজন্যে ৪৪ হাজার টাকা অনুদানে বর্তমান টিন শেড ঘর নির্মিত হয়। একই সাথে কিছু আসবাব পত্র দেওয়া হয়েছিল ক্লাবে। তবে এ ঘরের কাঁচা মাটি ও ইট সুরকি মিশ্রিত দেয়াল স্থাপনা পূর্বেই আমরা তৈরী করেছিলাম। আর সেখানে তাড়াশ গ্রামের বেলাল হোসেন ডিলার ছাদ নির্মাণে পোড়া মাটির তৈরী টাইলস খোলা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন যা ছিল তার বিশেষ বদান্যতা। এরপর ১৯৮৩ সালের এপ্রিলের কোন এক সময় এখানে প্রথম টালি খোলার ঘর তৈরী হলে আমরা আব্দুর রহমান সাহেবের ঘর ছেড়ে এখানে স্থানান্তর হয়ে চলে আসি। নতুন কার্যালয় উদ্বোধন উপলক্ষে প্রকাশিত হয় প্রেসক্লাবের প্রথম প্রকাশনা “মাছ পাখীর দেশে”।
কিন্তু বিশেষ স্মরণযোগ্য, পরবর্তীতে তৎকালীন উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক তাড়াশ বাজারের রাস্তা স¤্রসারণ করার সময় কিছু দোকানদারকে কৌশলে প্রেস ক্লাবের জায়গা ছেড়ে দিয়ে এর উত্তর পার্শ¦ দিয়ে রাস্তা বের করা হলে প্রেস ক্লাবের জায়গা অনেকটা বেদখল ও সংকুচিত হয়ে যায়। প্রথমে কথা ছিল ওই সব দোকানীরা প্রেস ক্লাবকে ভাড়া দিয়ে জায়গা ভোগ দখল করবে। পরে নানা কারণেই সেটা তো আর হলোই না। অধিকন্তু স্থানীয় জনৈক ব্যক্তি প্রেস ক্লাবের জায়গা ¯্রফে গায়ের বলে জোড়পূর্বক বেদখল করে পরে তা নিজ নামে লিজ কেটে নেয়। এ নিয়ে আমাদের সাথে তার দীর্ঘ দিন দ্বন্দ্ব চলে এবং এক পর্যায়ে তা সংঘর্ষে রুপ নেয়। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় হল, এই জবরদখলকারীকে যেমন সরানো যায়নি, তেমনি এই প্রেস ক্লাবের লীজ জায়গাটুকু অদ্যাবধি দীর্ঘমেয়াদী লীজ নেয়া সম্ভব হয়নি কেন – তার জবাব কে দেবে।
আমাদের সময়ে তাড়াশ প্রেস ক্লাব হতে মাত্র দু’টি প্রকাশনা আমরা করতে পেরেছি , যতদূর মনে পড়ে। এর প্রথমটির শিরোনাম “মাছ পাখীর দেশে” যা আগেও বলেছি। দ্বিতীয়টি “অভিষেক ’৮৪” প্রকাশকাল জানুয়ারী ১৯৮৫। প্রকাশনা দুটির ফটোকপি আমার সংরক্ষণে আজো সযতেœ রেখেছি। এছাড়াও স্বপ্নিল স্বৃতিময় দু’টি বড় ঘটনা আমার জীবনে এই প্রেস ক্লাবে বসেই ঘটে। এর একটা হলো ১৯৮৪ সালে বিপিএস ও অপরটি ১৯৯১ সনে পরিবর্তন নামে বেসরকারি দুটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার গোড়াপত্তন। এ দু’টো প্রতিষ্ঠানেরই নাড়ী পোঁতা তাড়াশ প্রেস ক্লাব কক্ষে। আরো স্মরণীয় অধ্যায় হলো ,সিরাজগঞ্জ জেলায় কুষ্ঠ রোগের অস্তিত্ব পরিবর্তন কর্তৃক সর্বপ্রথম আবিস্কৃত হয় এই প্রেস ক্লাব চত্বরে জনৈক ব্রিটিশ চিকিৎসাবিদের দ্বারা। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশে ভয়াবহ নজিরবিহিন বন্যা হলে এ খাকছারের নেতৃত্বে বিপিএস এর তদানীন্তন কার্যালয় এই প্রেস ক্লাব থেকে বৃটিশ দাতা সংস্থা অক্সফ্যাম এর সহায়তায় তাড়াশ উপজেলার বন্যাক্ষতিগ্রস্থ মানুষের মাঝে বিপুল পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়।যা দেখতে এসেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব হংকং এ সর্বশেষ ব্রিটিশ গভর্ণর ক্রিস্টোফার প্যাটেন। তিনি হেলিকপ্টারে করে এসে কহিত গ্রামের পশ্চিমে ক্ষুদ্রমাঝিড়া গ্রামের উন্মুক্ত মাঠে নেমে বন্যা ত্রাণ ও পূনর্বাসন কাজ পরিদর্শন করেন। এভাবে প্রেস ক্লাব এবং উক্ত দুই সংগঠন মিলে আমার যৌবনের একটা বড় অংশ কেটেছে এই ক্লাব কার্যালয়ে। প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠার পূর্বে ১৯৭৮এ আমি সরকারী সমাজসেবা বিভাগের চাকুরীতে তাড়াশ অফিসে যোগদান করলাম। চাকুরী , লেখালেখি ও ক্লাবে আড্ডা সব যুগপৎ চলছিল। আশানবাড়ি গ্রামের বাড়িতে অধিকাংশ দিন যাওয়া হতো না। প্রেস ক্লাবেই কাটতো দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। সম্ভবত ১৯৮১ সালে তৎকালীন তাড়াশ থানা সমাজসেবা কর্মকর্তা আমাকে দিয়ে তালম ইউনিয়নের বিত্তহীন ভূমিহীন লোকদের লোন দেয়ার বিনিময়ে পার্সেন্টেজ আদায়ের চাপ দিলে আমি অস্বীকার করে বসি। এতেই বেধে যায় বিপত্তি। ‘সরকারি চাকুরী করে সাংবাদিকতা করা যাবে না’ – এই ছুতো তুলে শুরু হলো আমাকে নানামুখী হয়রানি- নাজেহাল। এই চক্রান্তে হাত মেলালো তাড়াশের সর্বপ্রথম টিএনও আব্দুর রহিম। বদলী করা হলো পার্শ্ববর্তী রায়গঞ্জে। সাংবাদিকতার প্রতি বিমুগ্ধ, অবিচ্ছেদ্য মোহাবিষ্ট হয়ে এই অনৈতিক-অন্যায়ের প্রতিবাদে আমি নিজে নিজে নীরবে চাকুরী ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলাম কাউকে না বলেই। তবে ইস্তফা পত্র না দিয়ে স্বল্পকালীন ছুটি নিয়ে প্রথমে কর্মক্ষেত্র থেকে সরে পড়লাম। ওদিকে সাংবাদিকতার তৎপড়তা নেশাগ্রস্থের মতো চলতে থাকল। তখন দৈনিক দেশ পত্রিকায় সাংবাদিকতার সুবাদে ১৯৮২ সালে আমি রাজশাহীতে পিআইবি আয়োজিত ১২ দিনের সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ লাভ করি।
এরই মধ্যে ১৯৮৪ সালে আমি বিপিএস (এনজিও) রেজিষ্ট্রেশনের জন্য পাবনা জেলা সমাজকল্যাণ অফিসে গেলে কর্মরত ডিডি আমাকে বললেন, আপনাকে আমরা ধরতে পারি না চেষ্টা করেও। আপনি যদি আর চাকুরী না-ই করেন,তবে আজ ইস্তফা লিখে দেন। আমি আপনাকে রেজিষ্ট্রেশন দিব। অথবা চাকুরীতে ফিরে আসুন , আমরা আপনাকে সব বকেয়া পাওনা দেব। আমার সিদ্ধান্তে অটল থেকে তাই করলাম। পদত্যাগ পত্রের বিনিময়ে বিপিএস এর নিবন্ধন নিলাম। এই কাহিনী আজো আমার পরিবার-পরিজন স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে নি। কারণ , সাংবাদিকতার টানে সরকারী চাকুরী পরিত্যাগ করা হয়তো আজকের দিনে অকল্পনীয় বটে। কিন্তু যে বিপিএস রেজিষ্ট্রেশনের জন্য আমাকে চাকুরিতে পদত্যাগ করতে হল ১৯৮৯ সনে অন্তর্দ্বন্দ্বের হেতু সেই সংগঠন ছেড়ে স্থানীয় অন্য একটি সংস্থায় কিছুকাল কাজ করা অবস্থায় আমি জাতীসংঘ স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে মনোনীত হয়ে ভারত চলে যাই।
তাড়াশ প্রেস ক্লাবকে ঘিরে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সংশ্লিষ্ট সবার কমবেশী জানা। এই প্রতিষ্ঠানটি বরাবরের মত এখনও রুগ্ন জীর্ণ-শীর্ণ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রথম নির্মিত টিনশেড ঘরের উপর। এর প্রকৃত উন্নতি-সমৃদ্ধির জন্য কেউ ভেবেছে তেমন দৃষ্টান্ত নেই।একে পূঁজি করে শুধু খ্যাতি ও আত্ম তুষ্টি খুঁজেছে সবাই- সেটাই প্রতীয়মান হয়।মাঝখানে ক্লাবটি দখল-বেদখলের কবলেও পড়েছে একাধিকবার। তথাকথিত সাংবাদিক নামধারী অপশক্তি এবং অপনেতৃত্ব এটা নিয়ে টানাহেঁচড়াও করেছে। এ ক্লাবের সংবিধান কাটাছাটা ও গ্রহণ-বাতিল হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। এখানে উল্লেখ্য, মামুন হুসাইন এর উদ্যোগে তাড়াশ রিপোর্টার্স ইউনিটি গঠিত হওয়ার পর মামুন কর্তৃক তাড়াশ প্রেস ক্লাবের উপর চাপানো মামলাটি অদ্যাবধি অমিমাংসিত ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। একই পরিস্থিতিতে তাড়াশ প্রেস ক্লাবের সংবিধানও আর টেকসই আলোর মুখ দেখতে পারে নি। বিশেষ করে আমাদের সম্মতি ও সই-স্বাক্ষরে ২১-০৫-২০০৪ এ গৃহীত প্রেস ক্লাবের গঠনতন্ত্র (প্রনেতাঃ সাইদুর রহমান সাইদ, কাজী রূহুল আমীন ও আবদুর রাজ্জাক রাজু) পরবর্তীতে বিলোপ করে কেবল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদেরই নামগন্ধ ইতিহাস মুছে ফেলে মর্যাদাহানি করা হয়নি,সেই সাথে নানা ষড়যন্ত্র এবং দ্বন্দ্ব-বিরোধের পরিণামে সেই সংবিধানের অস্তিত্বই মুছে ফেলা হয়েছে। সে কারণে বর্তমানে এ ক্লাবের কোন কার্যকরী গঠনতন্ত্র নেই। ক্লাবটির প্রতিষ্ঠাতাদের সবাই এখনও জীবিত। ক্লাবে নেতৃত্বদানকারী প্রাক্তন-সাম্প্রতিক সকলেই বহালতবিয়তে সামাজিকভাবে যার যার নিজস্ব পেশা কর্মে খ্যাতিমান, অগ্রসর ও সমুজ্জল। কেবল অনুজ্জল ও নিস্প্রভ প্রদীপের ন্যায় সকরূণ অনুশোচনাসহ নির্বাক চেয়ে চেয়ে ইতিহাসের নির্মম পরিক্রমা লক্ষ্য করে যাচ্ছে কালের সাক্ষীরুপে এই প্রেস ক্লাব। বিগত অনেক বছরের মতই আজো এখানে ত্যাগী নেতৃত্ব এবং সার্বিক দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাব দুঃখজনকভাবে বিরাজমান। আর কিছুকাল পর চার দশক অতিক্রম করবে তাড়াশের এই সর্বাধিক সুপরিচিত ও স্বনামধন্য সংগঠন। তখনো হয়তো মানুষ দেখবে – এর সাথে পূর্বাপর জড়িত সবারই কোন না কোনভাবে পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু পরিবর্তন তথা উন্নয়ন হয় নাই শুধু সাইনবোর্ড এবং নামসর্বস্ব তাড়াশ প্রেস ক্লাবের।
০৫.০৮.২০১৮
লেখক : অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, তাড়াশ প্রেস ক্লাব ।