বড়দিন: মিলন ও উৎসবের দিন

Spread the love

বড়দিন: মিলন ও উৎসবের দিন
ফাদার উত্তম রোজারিও

প্রতি বছর ২৫ শে ডিসেম্বর সারা পৃথিবীতে খ্রীষ্টানুসারীগণ যীশু খ্রীষ্টের জন্মোৎসব মহাসমারোহে উদ্যাপন করে থাকেন। এ জগতে শান্তি ও ন্যায্যতার বাণী ঘোষণা করতে মহামানব যীশু খ্রীষ্ট আজ থেকে দু হাজার বছর আগে এ পৃথিবীতে আসেন। এ জগতে এসে তিনি মানুষের কাছে ভালবাসা, দয়া, ক্ষমা, শান্তি ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার কথা প্রচার করেন। তাঁর প্রচারিত বাণীতে বহু মানুষ বিশ্বাসী হয়ে তাঁর অনুসারী হয়ে উঠে। অন্যদিকে সেই সময়কার বেশ কয়েকজন সমাজনেতা ও ধর্মনেতা তাঁর বিরোধিতা করেন এবং তাঁকে ক্রুশারোপন করে হত্যা করেন। মত্যুর পর তৃতীয় দিবসে তিনি পুনরুত্থান করেন। পুনরুত্থানের ৪০ দিন পরে তিনি মহাগৌরবে স্বর্গারোহন করেন। খ্রীষ্টবিশ্বাসীরা তাঁকে প্রভু, গুরু ও মুক্তিদাতা বলেই সম্বোধন করেন।
প্রভু যীশুর জন্মোৎসবের দিনটিকে বাংলায় বড়দিন বলা হয়। যদিও ঘন্টার হিসেবে ২৫ শে ডিসেম্বর দিনটি বেশি বড় নয় কিন্তু অর্থ ও তাৎপর্যের দিক থেকে এই দিনটি খ্রীষ্টানুসারীদের কাছে খুবই বড় একটি দিন। তারা বিশ্বাস করেন যে, এই দিনে স্বয়ং ঈশ্বর মানবরূপে এ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন। মানবরূপে জন্মগ্রহণের মধ্য দিয়ে মানুষের প্রতি ঈশ্বর তাঁর ভালবাসা প্রকাশ করেন এবং এর ফলে মানবসত্তার সাথে ঐশসত্তার মিলন সাধিত হয়। তাই যীশু খ্রীষ্টের জন্ম বারতা সকলের কাছে মিলনের আহŸান জানায়। মানুষ যেন পরস্পর মিলে মিশে, শান্তিতে ও আনন্দে জীবন যাপন করে-এই আহŸানই যীশু খ্রীষ্ট সব মানুষের নিকট করে থাকেন। তিনি চান জগতের প্রতিটি মানুষ যেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল প্রকার ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একে অপরকে ভালবাসে এবং দয়া, ক্ষমা, সততা, বিশ্বস্ততা ও ন্যায্যতায় জীবন যাপন করে।
বড়দিন উৎসব হল আনন্দের মহোৎসব। সারা পৃথিবীতে এই দিনটিকে কেন্দ্র করে নানা রকম উৎসব ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বড়দিনের প্রায় ১ মাস আগে থেকেই শুরু হয় বড়দিন উৎসব পালনের প্রস্তুতি। বাড়ি-ঘর, দোকানপাট, অফিস-আদালত, বাজার-ঘাটসহ সর্বত্রই নানা রকম আলোক সজ্জা করা হয়। নতুন রঙে ও নতুন ঢঙে সাজানো হয় সবকিছু। নাচ-গান, কীর্তন, বিশেষ খাবার-দাবার, নতুন পোশাক-আশাক ইত্যাদির মাধ্যমে খ্রীষ্টানুসারীগণ এই দিনে তাদের হৃদয়ের আনন্দ প্রকাশ করে থকেন।
বাংলাদেশে আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর পূর্বে পর্তুগীজ মিশনারীগণের মাধ্যমে সর্বপ্রথম খ্রীষ্টবিশ্বাস প্রচারিত হয় এবং কিছু মানুষ খ্রীষ্টবিশ্বাসে দীক্ষিত হয়। বর্তমানে এদেশে খ্রীষ্টবিশ্বাসীদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.৩% হলেও তারা ধর্মবিশ্বাসে অত্যন্ত বিশ্বস্ত। প্রতি বছর তারা পৃথিবীর অন্যান্য খ্রীষ্টানদের মতোই মহানন্দে বড়দিন উৎসব পালন করে থাকেন। এ দেশীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতি অনুসারে তারা নানা রকম উৎসব ও অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিনটি উদ্যাপন করে থাকেন। নি¤েœ এ দেশীয় খ্রীষ্টানুসারীদের বড়দিন উদ্যাপনের নানা দিক বর্ণিত হল:
১. বড়দিন উৎসবের প্রস্তুতি: বড়দিনের প্রায় এক মাস আগে থেকেই শুরু হয় উৎসব উদ্যাপনের নানা প্রস্তুতি। এই প্রস্তুতি দুই রকম: ক. বাহ্যিক প্রস্তুতি ও খ. আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি। বাহ্যিক প্রস্তুতির মধ্যে রয়েছে গীর্জাঘর, বাড়ি-ঘর, দোকানপাট ও প্রতিষ্ঠান সাজানো গোছানো, নতুন পোশাক ও খাবার-দাবার সামগ্রি ক্রয় ইত্যাদি। আধ্যাত্মিক প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বড়দিনের এক মাস আগে থেকেই গীর্জায় গীর্জায় চলে বিশেষ প্রার্থনা। এই এক মাস সময়কালকে বলা হয় আগমনকাল। যীশুর আগমন বা জন্মদিন উপলক্ষ্যে খ্রীষ্টবিশ্বাসীরা পাপের পথ থেকে মন পরিবর্তন করেন, ঈশ্বরের কাছে পাপস্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং বড়দিনের আগে নয় দিন যাবৎ গীর্জায় গিয়ে বিশেষ নভেনা প্রার্থনা ও উপাসনায় অংশগ্রহণ করেন।

২. বড়দিনের সাজ-সজ্জা: প্রতি বছর বড়দিনে এদেশের প্রতিটি গীর্জাঘর বর্ণিল সাজে সজ্জিত করা হয়। গীর্জা চত্বর এবং খ্রীষ্টবিশ্বাসীদের বাড়ি ও পাড়া-মহল্লায় আলোক সজ্জা করা হয়। বড়দিনের একটি বিশেষ আকর্ষণ হল বড়দিনের তারা। যীশুর জন্মের সময় আকাশে একটি বড় তারা দেখা যায়। সেই তারাটির স্মরণে বড়দিনের সাজ-সজ্জার মধ্যে তারা অন্যতম। রঙিন কাগজ ও নানা রকম লাইটিং করে তারা সাজানো হয় এবং তা উঁচু স্থানে ঝুলিয়ে রাখা হয়। কোথাও কোথাও আবার বড়দিন উপলক্ষ্যে ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয়। শহর ও গ্রাম বাংলায় অনেক সময় ঘরের দেয়াল ও ফ্লোর বা আঙিনায় নানা রকম আলপনা করা হয়। ঘরের দেয়ালে ‘শুভ বড়দিন’ বা গবৎৎু ঈযৎরংঃসধং লেখা হয়। এছাড়া গোয়াল ঘরে যীশুর জন্মের কথা স্মরণ করে শিশু যীশু ও তাঁর মা-বাবার মূর্তিসহ গরু, ভেড়ার মূর্তি দিয়ে গোশালাও সাজানো হয়।
৩. বড়দিনের খাবার-দাবার: বড়দিন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশী খ্রীষ্টান ভাই বোনেরা নানা রকম পিঠা তৈরী করে। পিঠা খেয়ে তারা আনন্দ করে। চাউলের গুড়ি দিয়ে এসব পিঠা বানানো হয়। বর্তমানে বড়দিন উপলক্ষ্যে অনেকে ছোট-বড় কেক তৈরী করে বা দোকান থেকে কিনে আনে। প্রতি পরিবারে বড়দিন উপলক্ষে মাছ-মাংস রান্না করা হয়। নানা প্রকারের মিষ্টিও পাওয়া যায় প্রতি বাড়িতে। মাংস, পোলাও, বিরিয়ানি, পিঠা, কেক, মিষ্টি ইত্যাদি দিয়ে এ দিন নানা ভোজ উৎসবে মেতে উঠে বাঙালী-আদিবাসী খ্রীষ্টান ভাই বোনেরা।
৪. বড়দিনের পোশাক পরিচ্ছদ: বড়দিন উপলক্ষ্যে ছোট-বড়, ধনী-গরীব প্রত্যেকেই নতুন পোশাক পরিধান করে। নতুন কেনা জুতা, মোজা, শার্ট, প্যান্ট, শাড়ি, ফ্রক, কামিজ, পাজামা ইত্যাদি পরিধান করে পরিবারের সদস্য-সদস্যাগণ গীর্জায় ও আত্মীয়-স্বজনসহ প্রতিবেশীদের বাড়িতে বেড়াতে যায়।
৫. বড়দিনের উপাসনা: বড়দিন উপলক্ষ্যে ২৪ ডিসেম্বর রাতে ও ২৫ ডিসেম্বর সকালে প্রতিটি গীর্জায় বিশেষ উপাসনা করা হয়। বড়দিনের উপাসনায় খ্রীষ্টভক্তগণ অংশগ্রহণ করেন সক্রিয়ভাবে। তারা এ দিন শিশু যীশুর অনুগ্রহ চেয়ে প্রার্থনা করেন।
৬. শুভেচ্ছা বিনিময়: বড়দিনের উপাসনা শেষ করে সাধারণত খ্রীষ্টভক্তগণ একে অপরের সাথে বড়দিনের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন হ্যান্ডশ্যাক বা কোলাকুলির মাধ্যমে। এ দিন বড়রা ছোটদের আশীর্বাদ দেন এবং ছোটরা বড়দের কাছ থেকে আশীর্বাদ গ্রহণ করে থাকে। প্রবীণ ও অসুস্থ যারা তাদের সাথে পরিবারের সদস্যসহ প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজনেরা সময় কাটান। তাদের মঙ্গল কামনা করেন।
৭. বড়দিনের কীর্তন: বড়দিন উপলক্ষ্যে এ দেশীয় খ্রীষ্টানগণ কীর্তন গান ও নাচ করে থাকেন। নানা সুরে ও তালে কীর্তন গান গেয়ে ও গানের সাথে সবাই একসাথে নেচে তারা আনন্দ করে থাকেন। সাধারণত যীশুর জন্মের ঘটনাবলী সম্পর্কিত কথা বা বাণী দিয়ে এই কীর্তন গানগুলি রচনা করা হয়।
৮. বড়দিনের সামাজিকতা: বড়দিন উপলক্ষ্যে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নানা আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করা হয়। সমাজের সদস্য-সদস্যাগণ বড়দিন উপলক্ষ্যে একে অপরের বাড়িতে যান, গান-বাজনা করেন, পুরনো ভেদাভেদ ও দ্ব›দ্ব ভুলে পরষ্পরকে শুভেচ্ছা জানান এবং একসাথে খাওয়া দাওয়া করেন। বড়দিনের পরদিন থেকে নতুন বৎসরের প্রথম সপ্তাহ যাবৎ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে বিবাহ ভোজ, বিবাহের জুবিলী উদ্যাপন, সামাজিক মিলন ভোজ, পোস্ট ক্রীসমাস গেদারিং, বড়দিন পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান ইত্যাদি অন্যতম।
বড়দিন হল পরিবারিক মিলন উৎসবের দিন। এদিন পরিবারের সদস্যরা একত্রে মিলিত হয় ও একসাথে আনন্দ করে। বড়দিন হল ক্ষমা ও ভালবাসার উৎসবের দিন। এ দিন সবাই পুরনো দ্ব›দ্ব ও মনোমালিন্য ভুলে একে অপরকে ক্ষমা করে, ভালবাসে ও শান্তিতে বসবাসের প্রতিজ্ঞা করে।
বড়দিনকে বলা হয় বড় হবার দিন। একে অপরকে ক্ষমা করে, একে অপরের কাছে ক্ষমা চেয়ে, পরষ্পরকে ভালবেসে ও পরষ্পরের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে আমরা বড় হয়ে উঠতে পারি। তাই সকল খ্রীষ্টানুসারী ভাই-বোনকে আহŸান জানাই: আসুন আমরা প্রভু যীশুর শিক্ষানুসারে পরষ্পরকে ভালবেসে এবং একে অপরের প্রতি ক্ষমা, দয়া ও সহানুভূতি প্রদর্শনের মাধ্যমে এবারের বড়দিন উৎসবে বড় হয়ে উঠি। শিশু যীশুর অনুগ্রহ ও আশীর্বাদে প্রতিটি পরিবার, সমাজ ও দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক! ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহনশীলতা বৃদ্ধি পাক! সকল প্রকার যুদ্ধ ও হানাহানি বন্ধ হোক! মানবিকতার ঐশ্বর্য্য সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়–ক!

(লেখক: সহকারী প্রধান শিক্ষক, সেন্ট রীটাস্ হাই স্কুল, মথুরাপুর, চাটমোহর, পাবনা এবং সহকারী পাল-পুরোহিত, মথুরাপুর ক্যাথলিক চার্চ, চাটমোহর, পাবনা)।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD