সৈয়দ শুকুর মাহমুদ
বাংলার মাটিতে জন্ম নিয়েছি তাই জন্মসূত্রেই বাংলাদেশী, বাঙালি। বাংলা আমার মায়ের ভাষা। হাজার বছর সংগ্রাম করে অর্জিত হয়েছে এ ভাষার স্বাধীনতা। আজ বিশ্ব মাতৃভাষা দিবসে অঙ্গিকারÑ ‘যতদিন অক্ষুন্ন থাকবে এ ধরা, ততদিন বুকের মাঝে আগলে রাখব আমার মাতৃভাষা’। অথচ বর্তমান ইন্টারনেট আর স্যাটেলাইটের দৌরাত্মে বিশ্বের অন্যান্য সংস্কৃতি আর পরদেশী ভাষার অশুভ বন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে আমাদের হাজার বছরের সংগ্রামের ফসল।
২১শে ফেব্রুয়ারি বা ৮ই ফাল্গুন আমাদের ভাষা শহিদ দিবস। বিদেশী অপশক্তি দখলদার পাকিস্তানি ঊর্দূ ভাষা-ভাষীরা যখন আমাদের মাতৃভাষা মুছে দিতে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিলো তখন বাঙালি বীর সন্তানেরা ১৯৫২ সালের এই দিনে রুখে দাঁড়িয়েছিলো হায়েনাদের অপশক্তির বিরুদ্ধে। সেদিন প্রতিবাদি মিছিলের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছিলো অসংখ্য ভাষা সৈনিক বাঙালি। এজন্যই এ দিনটি বাংলার ইতিহাসে ভাষা শহিদ দিবস হিসেবে পরিচিত। মাতৃভাষা রক্ষার্থে প্রতিবাদ করতে শহিদদের রক্তের মূল্য দিতেই বিশ্ববাসি এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২১শে ফেব্রুয়ারি এলেই বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করে। প্রতি বছরই এ দিবসটি উদযাপিত হলেও দিবসটির মর্যাদার দিকে খেয়াল করা হয় না। এ দিনের অনুষ্ঠানগুলোতে চলে খেলাধুলা, আনন্দ বিনোদন, নানা রকম ডিসপ্লে ইত্যাদি। মাইকে চলে বিদেশী মিউজিক আর হিন্দি গীত। দিবসের চেতনা ও তাৎপর্য বিষয়ে ও বাংলা ভাষার বর্তমান হালহকিকত সম্পর্কে আলোচনার সুযোগ নেই। কেন ২১শে ফেব্রুয়ারি? এ দিনে কি হয়েছিল? এদিনটি আমাদের জাতীয় জীবনে কি গুরুত্ব বহন করে? এই দিবসে আমাদের কী করণীয় নির্ধারণ করা উচিৎ ? এ দিনটিতে এ ধরণের কোন আলোচনা করার সুযোগ থাকে না। ফলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দিনটির গুরুত্ব সম্পর্কে জানানোর কোন সুযোগ নেই।
ভারত উপমহাদেশে বিভিন্ন ভাষার উৎপত্তি যেভাবে: ভারত উপমহাদেশে প্রথম আগমনকারী মিশরীয় এ্যারাবিয়ান। তারা এখানে বসতি স্থাপনের পর তাদের মুল ভাষা বদলে গিয়ে মাটির টানে সংস্কৃতি ভাষায় প্রবর্তন হয়। পরবর্তীকালে এ অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু ভাষার প্রবর্তন হয়েছে। ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে উর্দু, আফগান, বেলুচ, পাঠান, কাবুল, কেরালায় হিন্দি এবং ভারতের উত্তর পূর্বাংশে বাংলা। একমাত্র সংস্কৃত ভাষা থেকেই এ সকল ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। আজকের পরিশুদ্ধ বাংলা ভাষা কবে ও কখন থেকে শুরু হয়েছে তার কোন সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। শুধু আমি, তুমি, আসা, যাওয়া, খাওয়া এ সকল বাক্য দিয়ে জাতির কথোপকথন হয়ে আসছিল। জাতি ও ভাষার কোন পরিচয়ও ছিল না। এক সময়ে পারসীয়রা এদেশে ভ্রমনে এসে অনুকূল পরিবেশ দেখে তারা এ দেশে থেকে যায়। এক পর্যায়ে দেশকে শাসন করতে শুরু করে। তারা যখন দেখল- এ দেশের মানুষ সহজ, সরল ও হাবা এ অবস্থায় পারসীয় ভাষায় হাবাদেরকে বোঙ্গা বলা হতো। তারা এ দেশীয়দের বোঙ্গা বলে ডাকতে শুরু করে। আর এ বোঙ্গাদের ভাষা বোঙ্গালা নাম প্রচার করে। পরবর্তীকালে অন্যান্য দেশের আগতরা এ জাতিকে বাঙ্গাল বলে আখ্যায়িত করে। যার ফলে এ অঞ্চলের নামকরণ করে বাঙ্গাল মুল্লক। আরপরে এটিকে কিছুটা উন্নত করে বঙ্গ ভাষা, বঙ্গ দেশ নামে প্রচার করে। সর্বশেষ বাংলা ও বাঙালি নামে জাতিটির পরিচয় হয়। বঙ্গভূমির দক্ষিণাংশে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। এ সাগরটি বঙ্গভূমির কোল ঘেষে হওয়ায় এটি বঙ্গভূমির পুত্র হিসেবে বঙ্গোপসাগর নামে পরিচয় হয়। তখন পর্যন্ত ভাষাটির কোন বর্ণমালা বা অক্ষর ছিল না। পরবর্তীকালে দক্ষিণ আরব থেকে আগত দ্রাবির বংশীয়রা কিছু শিলালিপি নিয়ে আসে। এগুলো কখন কোন সময়ে কারা কি প্রয়োজনে পাথরে খোদাই করেছিল তারও কোন প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে এগুলোকেই বাংলা বর্ণমালায় প্রবর্তন করা হয়। এ ছিল বাংলা ভাষার আদি তথ্য। এ অঞ্চলের কোন ভাষাই আধুনিক নয়। এগুলো অনেক পুরানো ভাষা। বাংলা ভাষায়ও রয়েছে নানা আঞ্চলিকতা। তবে যেভাবেই আঞ্চলিকতায় কথা বলুক না কেন মূলতঃ বাংলা ভাষার লোকেরাই বাঙালি । বাংলা এলাকার উত্তরাঞ্চল আসামের লোকদের কথার সুর ও বাচনভঙ্গি, শব্দের গাঁথুনি ভিন্ন রকম। রংপুর দিনাজপুরের ভাষা একটু আলাদা। পশ্চিমবঙ্গ কিছুটা ব্যতিক্রম। পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এলাকা নোয়াখালি কুমিল্লা চট্টগ্রাম মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য এরাও বাঙালি। তবে তাদের ভাষা আঞ্চলিকতার কারণে ভিন্ন রকম হলেও তারাও বাঙালি ও বাংলার মানুষ। আদিকাল হতেই ভারত উপ-মহাদেশের এলাকা (পূর্বাঞ্চল) উর্বরা, শষ্য শ্যামল সবুজে ঘেরা হাজারও নদী অববাহিকায় বেষ্টিত, ¯্রােত ধারায় সুপিয় মিষ্টি পানি, মৌসুমি বাতাস, পাহাড়ি শীতল ঝর্ণা। এ সকল সৌর্ন্দয ও সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও জাতের মানুষ এসেছে এদেশে। কেউ বা মৎস্য শিকার করতে এসে রয়ে গেছে। অন্যদিকে সৌখিন বা শিক্ষিতরা ভ্রমণে এসে দখলদারিত্ব নিয়ে শাসক হয়ে বসেছে, শাসক হয়ে শাসন করতে শুরু করেছে। এ কারণেই বাংলার মাটি ও বাঙালি জাতি পরাধীনতার জালে আবদ্ধ ছিল। এ সকল কারণেই ভারতের সকল ভাষার মধ্যে মিশে আছে অসংখ্য বিদেশী ভাষা। বিশেষ করে বাংলা ভাষার মধ্যে মিশে আছে আরবি, ফার্সি, তুর্কী, ইংরেজী ভাষাসহ আরও অন্যান্য ভাষা। বাংলা ভাষায় মোট সোয়া লক্ষ শব্দ পাওয়া যায়। এর মধ্যে আরবি ও ফারসি প্রায় ১০ হাজার শব্দ, ইংরেজি ১ হাজার, তুর্কী ৪ শতটি শব্দ পাওয়া যায়। অন্য তথ্য ও গবেষণায় কোন কোন গবেষকদের মতে ৩০ শতাংশ আরবি-ফারসি শব্দ আছে। এগুলো নিয়েই আমাদের বাংলা ভাষা সমৃদ্ধশালী হয়ে আছে। আমাদের ভাষা, আমাদের মাতৃভূমি থেকে বিদেশী শাসক ও অন্য ভাষাভাষীর দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য বহু প্রতিবাদ সংগ্রাম আন্দোলন গড়ে উঠেছে বহু বার। শহিদ হয়েছে বহু বাঙালি। যার সঠিক পরিসংখ্যান আজ আর মানুষের কাছে নেই। তবে ১৯৫২ সালে বাঙালি বীর সন্তানেরা ফুসে উঠেছিল ভাষার জন্য। সে আন্দোলনে সালাম, রফিক, শফিক, বরকত, জব্বারসহ কত নাম না জানা ভাষা সৈনিক প্রাণ দিয়েছিলেন। সর্বশেষ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষাধিক বাঙালির বুকের তাজা রক্ত, দুই লক্ষাধিক মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমাদের এই মাতৃভূমির স্বাধীনতা, বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার মুক্তি অর্জিত হয়েছে। হাজার বছরের সংগ্রামের ফসল আমাদের ভাষার স্বাধীনতা।
বিদেশি সংস্কৃতি এসে বাংলা সাহিত্য ও বাঙালির সংস্কৃতির মুখ থুবরে দিয়েছে। বাঙালির সংস্কৃতির স্থান এখন দখল করে নিয়েছে ইংলিশ মিউজিক ও হিন্দি গীত। বাঙালি নারীদের বস করেছে ইউরোপীয় নগ্নতা, বাঙালির পোশাক হারিয়ে যাচ্ছে। এদেশের উৎপাদন ও বিপণ কেন্দ্রগুলোর অধিকাশ নামফলকই ইংরেজী লেখা দেখা যায়। দূরপাল্লার গাড়ী গুলোতেও একই অবস্থা বিরাজমান। এ গুলো দেখে মনে হয় বাংলা ভাষা কারও কাছে বিক্রি বা বন্ধক রাখা হয়েছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য যা বিদেশে রপ্তানী যোগ্য এগুলোর কভারে শুধুমাত্র ইংরেজী ভাষা লেখা হয়। প্রতিবেদনের দাবী রপ্তানী যোগ্য পণ্যের কভারে ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলা ভাষা লিখলে মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত থাকবে।
পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও দেখা যায় না কারও মাতৃভাষার উপর কেউ আঘাত করেছে। অথচ অন্য ভাষাভাষির অপশক্তির আক্রমনে বারবার আক্রান্ত হয়েছে বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতি। পৃথিবীর কোন জাতিই মায়ের ভাষার জন্য যুদ্ধ করে জীবন দেয়নি। শুধু বাঙালি জাতি মায়ের ভাষার জন্য যুদ্ধ করে জীবন দিয়েছে। যে কারণে বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে বাঙালি জাতির মাতৃভাষার দিবস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষায় সমাদৃত হয়েছে। তাই প্রতি বছর ৮ই ফাল্গুনে বিশ্ববাসী বলে “ডবষপড়সব ওহঃবৎহধঃরড়হধষ গড়ঃযবৎ খধহমঁধমব উধু”. মায়ের ভাষার জন্য যে জাতি জীবন দিয়েছে তারা কত বড় জাতি। এজন্য বিশ্ববাসী বাঙালি জাতিকে সম্মান দিয়ে মূল্যায়ন করেছে। অথচ সেই গর্বিত জাতি হয়ে মায়ের ভাষার জায়গার মধ্যে অন্য ভাষা স্থান দিয়েছে যা ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানিত করার শামিল। তাই মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে জাতির কাছে উদাত্ত আহবান।
লেখক: কথা সাহিত্যিক ও কলামিস্ট,শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ। মোবাইল ঃ ০১৭৮২৪৫৭৭৮৩