ভ্রমণ কাহিনি
সুলতান সেলিম আহমেদ
কোন দিন ভাবি নাই এভাবে লিখবো । তাহলে সময়, তারিখ ও সন উল্লেখ করে ডায়েরিতে নোট রাখতাম। সম্ভবত: সময়টা ১৯৯৬ সাল। ম্যানেজারদের একটা মিটিং সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলা অফিসে আহবান করেছিলাম। তখন জৈন্তাপুরের ম্যানেজার ছিলেন শ্যামল বাবু । আমাদের প্রকল্পের অথরাইজড অফিসিয়াল মোঃ তাজিম উদ্দিন, তিনি আমাদের সাথে যাবেন। সকালের ট্রেনের টিকিট কাটা হয়েছে। এক সাথে যাব বলে। সকালে কমলাপুর যাব। কিন্তু বাদ সাধলো পরিবারের সদস্যরা। আমার দেড় বছরের ছেলে অসুস্থ, তার শ্বাস কষ্ট। উভয় সংকটে পরলাম। মিটিং আহবান করেছি আমি, আমি যাব না তা কি করে হয়। পরিবারের সদস্যদের দাবী এভাবে ছেলেকে রেখে তুমি যেতে পার না। হাতে সময় খুব কম। এ মূহুর্তে যেতে না পারলে ট্রেন পাওয়া যাবে না। অনেক যুক্তি তর্কের পর তারা রাজী হলো । বেবী টেক্সী নিয়ে রওনা হলাম আল্লাহর উপর ভরসা করে । প্লাটফর্মে পৌছানোর পর দেখি তাজিম সাহেব ট্রেনের জানালা দিয়ে মাথা বেড় করে তাকিয়ে আমাকে খুঁজছেন। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। তাকে হাতে ইশারা করে চলন্ত ট্রেনের শেষ বগিতে উঠলাম এবং ট্রেনের ভিতর দিয়ে হেঁটে আমাদের বগিতে গেলাম। এভাবে জৈন্তাপুর পৌছালাম ।
আমাদের তাজিম সাহেবের এক চাচা জৈন্তাপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন দীর্ঘ বছর ধরে । তারা তাজিম সাহেবকে পেয়ে বেজায় খুশী। তারও সময় ভাল কাটার কথা । কারণ বহু বছর পর তাদের দেখা । তার একটা চাচাতো বোন ছিল দেখতে বেশ ভাল । জৈন্তাপুর থাকাকালিন তাজিম সাহেবকে বেশ সময় দিয়েছে। পর দিন মিটিং শেষে আমরা জাফলং, শ্রীপুর পাথর কোয়ারী, চা বাগান এবং সারি নদীর নয়নাভিরাম সৌন্দর্য সহ নানা স্থান ঘুরে দেখলাম। এ ছাড়া পায়ে হেঁটে লালা খাল যাওয়া, সীমান্ত পিলার পযর্ন্ত যাওয়া । আমার এ অঞ্চলে বহুবার আসা হয়েছে তারপরও সাথীদের সময় দেয়া আর কি । মোবাইল ব্যবস্থা না থাকায় ছেলের অসুস্থতার খোঁজ নেয়া যায় নাই। তবে বিশ্বাস ছিল চিকিৎসায় ছেলে সুস্থ হবে ইনশা’ল্লাহ।
জৈন্তাপুর উপজেলার নির্বাহী অফিসার তখন আবুল হাশেম সাহেব। তিনি সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তার উপজেলায় আমরাই একমাত্র এনজিও। তিনি রসিকতা করে বলতেন ,একটা এনজিও পেলাম তাও আবার ফকিন্নী এনজিও। আমাদের কাজ ছিল গ্রামে গ্রামে জন্মনিয়ন্ত্রণের পিল-কনডম বিতরণ করা। ফান্ড ছিল কম। আবুল হাশেম সাহেব অত্যন্ত ভদ্রলোক ছিলেন। ব্যবহারে ছিলেন বিনয়ী। একটা ঘটনা বললে বুঝতে পারবেন, আমি যতবার তার সাথে দেখা করার জন্য তার অফিসে গিয়েছি ততবার ভদ্র লোক বিদায়ের সময় আমার সাথে যেখানে রিক্সা পাওয়া যায় সে পর্যন্ত আসতেন এবং রিক্সা না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন। আমি বলতাম,আমি যেতে পারবো ,আপনার আসার দরকার নেই। উনি বলতেন, আপনি আমার মেহমান আপনাকে এগিয়ে দেয়া আমার কর্তব্য। জানিনা এ অমায়িক ভদ্রলোক এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন। যেখানেই তিনি থাকুন না কেন আল্লাহ যেন তাকে ভাল রাখেন, সুস্থ রাখেন।
১৯৮৯ সালে আমাদের খলিল সাহেব আর আমি প্রথম জৈন্তাপুর গিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে ট্রেনে সিলেট, পরের দিন বাসযোগে জৈন্তাপুর । বাস বলতে মুরির টিন টাইপের বাস। রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ, যেতে বেশ সময় লাগে, সম্ভবত ঘন্টা দুই হবে। আমাদের জন্য থাকার ব্যবস্থা হলো সড়ক ও জনপথ বিভাগের ডাক বাংলায় । আধা পাকা ডাক বাংলা। শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে ভারতের পাহাড় দেখা যায়। কিছু কিছু ঝর্ণাও চোখে পড়ে। সে এক নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য । সেসময় প্রথম জাফলং দেখা, মামার হোটেলে স্বর পুঁটি দিয়ে ভাত খাওয়া, কাছে থেকে ভারতের সুবিশাল পাহাড় আর ঝর্ণা দেখা । এখনো এসব স্মৃতি মনে মাঝে মাঝে উঁকিুঝুকি দেয় ।
একদিন বিকালে জৈন্তাপুর থানার পার্শ্বে দাড়িয়ে আছি। শ্রীপুর থেকে পাথর ভর্তি ট্রাক আসে, থানার সামনে দাঁড়ায়, আর পুলিশকে টাকা দিয়ে চলে যায় । একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, কত টাকা দেয় এবং কেন দেয় । কারণ পাথর সরকারী বিধি অনুযায়ী আমদানী হয় । এখানে টাকা দিতে হবে কেন? তারা বললেন, টাকা না দিলে পুলিশ বলে পাথরের নীচে অবৈধ মাল আছে, মাল নামায় । একটা ট্রাক থেকে পাথর নামাতে আবার তুলতে কত সময় আর কত টাকা দরকার হয় । তাই বিশ টাকা দিয়ে তারা চলে যায়, এটা একটা অলিখিত চুক্তি । যাহোক আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা। ঘড়ি ধরে দাঁড়ালাম এবং দেখলাম প্রতি পাঁচ মিনিটে তিনটি ট্রাক যায় । সে হিসাবে ঘন্টায় যায় ছত্রিশটি ট্রাক আর দিনে যায় ৮৬৪ টি, অর্থাৎ ২৪ ঘন্টা ট্রাক চলে । দিনে ইনকাম ১৭,২৮০ টাকা, মাসে ৫১৮,৪০০ টাকা, বছরের হিসাব আপনাদের জন্য রইলো । ঐ সময় ২০ টাকার ভেলু ছিলো অনেক।
এরপর অনেকবার জৈন্তাপুর গিয়েছি, সব স্মৃতি তুলে ধরা এতো বছর পর সম্ভব নয় ।একবার ঢাকা থেকে ট্রেনে সিলেট যাচ্ছি, গন্তব্য স্থল সেই জৈন্তাপুর । আমাদের বগিতে এক ভদ্র মহিলা তার কিশোর ছেলে নিয়ে সিলেট যাচ্ছেন। হকারের কাছ থেকে কি একটা কেনার সময় কিশোরের সাথে তর্কাতর্কি। হকারের বয়স কিশোরের কাছাকাছি। কিশোর এক পর্যায়ে হকারকে থাপ্পর দিল, শুরু হলো হাঙ্গামা, যাত্রীদের মধ্যস্থতায় থামানো হল ।
কিন্তু আমার মনে হলো ঘটনা এখানে শেষ নয়, সামনে আরো বড় ঝামেলা অপেক্ষা করছে । সামনে ব্রাম্মনবাড়ী ষ্টেশন, বর্ডার এলাকা, ট্রেন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে, এখানে ঝামেলা হবে। আশঙ্কা ঠিক হলো । একদল হকার এসে হাজির, কিশোরকে মারবে বলে । আবারও যাত্রীদের মধ্যস্থতায় থামানো হল, ভুল স্বীকার করে । অন্য একবার আমার দুই বন্ধু মনোয়ার আর টুটুল, দুই জন রাজশাহীর শহরের বাসিন্দা ,তাদের নিয়ে জৈন্তাপুর গেলাম । উদ্দেশ্য জমি ক্রয় করা। আমাদের অফিস সহকারী সুজিতদের এগারো বিঘা জমি পাওয়া গেল। দাম বেশী নয়, কিন্তু সবার একমত না হওয়ার কারণে বাস্তবায়ন হয় নাই ।
আরেকবার জৈন্তাপুরের উদ্দেশ্যে সিলেট যাচ্ছি। দুপুর দুইটা নাগাদ পৌছানোর কথা । কিন্তু কোন এক ষ্টেশনে গিয়ে ট্রেন দাড়িয়ে আছে। ছাড়ার কোন নাম নেই। খবর পাওয়া গেল, ট্রেন লাইনে একটা বাস দূর্ঘ্টনায় পড়ে আছে। বাস না সরানো পর্যন্ত ট্রেন ছাড়বে না । খুব চিন্তিত হয়ে পড়লাম। কারণ আমার কাছে তখন অনেক টাকা। জৈন্তাপুরের অফিস কনস্ট্রাকশনের টাকা । ট্রেন কখন পৌছাবে ঠিক নেই। অবশেষে রাত একটার পরে সিলেট পৌছালাম। ষ্টেশন থেকে রিক্সা নিয়ে হোটেলে যাওয়া সমিচিন নয়। বিধায় ষ্টেশনের সাথে লাগানে খাবার কাম আবাসিক ছোট হোটেল থাকার সিদ্ধান্ত মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম। ট্রেন থেকে নেমে এক দৌড়। গিয়ে বললাম সিট হবে, তারা বললো একটা সিট আছে, দাও বলে উঠে পরলাম । সারা রাত কি যে উচ্চ স্বরে গান বাজানো, ঘুমের বালাই নেই ।
এক সময় অফিস নির্মাণের কাজ শেষ হলো। কিন্তু নানা কারণে আমরা ঐ অফিস ব্যবহার করতে পারি নাই। স্থানীয় তরুণ সংঘের কিছু যুবক কৌশলে এটা দখল করে নেয় । এ ঘর তৈরী সময় একজন মিস্ত্রীর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। বয়স্ক লোক নাম সম্ভবত: রাজমনি। তার কাছে জৈন্তাাপুরের রাজার অনেক গল্প শুনতাম। আমার চলার পথে বইতে তার শোনা থেকে একটা গল্প লেখা ছিল। জৈন্তাপুরের অনেক স্মৃতি হয়তো ধুসর হয়ে গেছে । কিন্তু ভুলিনি সেই শ্লোক “পান, পানি আর নারী- এই তিনে জৈন্তাপুরী”।
লেখক : প্রবীণ সমাজকর্মী, জাতীয় তরুণ সংঘের সাবেক কর্মকর্তা। বর্তমানে পরিচালক, গণ উন্নয়ন সংস্থা, ঢাকা।