মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতিকথা (পর্ব-১০)

Spread the love

আবদুর রাজ্জাক রাজু

গুরুদাসপুরে পরীক্ষা দিতে গিয়ে ফিরে এলাম

১৯৭১ সাল পর্যন্ত তাড়াশে কোন মাধ্যমিক পরীক্ষা কেন্দ্র ছিল না। ফলে ওই বছর তাড়াশ ইসলামিয়া পাইলট হাইস্কুলের আমরা যারা এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম তাদের পরীক্ষা কেন্দ্র নির্বাচিত হয়েছিল গুরুদাসপুর পাইলট হাইস্কুলে। যেটা গুরুদাসপুর সদরে থানা ক্যাম্পাসের পশ্চিমে অনতিদূরে অবস্থিত। তখনকার দিনে চলনবিল অঞ্চলে আজকের মতো যোগাযোগের রাস্তাঘাট ছিল না। আর যান্ত্রিক যানবাহনের তো প্রশ্নই উঠে না। তাই শিক্ষকদের নির্দেশে তাড়াশ থেকে বই পুস্তকসহ লাগেজ নিজেদের হাতে আর শ্রমিকের কাঁধে-মাথায় নিয়ে আমরা মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা সাড়াদিন হেঁটে ও ধামাইচে খেয়া নৌকায় পাড় হয়ে গুরুদাসপুরে পাড়ি জমালাম। আমি থাকলাম বামনকোলা। এটা চাঁচকৈড় বাজারের দক্ষিণ পূর্ব কোনের নিকটস্থ গ্রাম, বর্তমান গুরুদাসপুর পৌরসভার কাছাকাছি অবস্থিত। এখান থেকে গুরুদাসপুর পাইলট হাইস্কুল পরীক্ষা কেন্দ্র প্রায় ২ কি.মি.। সেই দিনগুলিতে এটুকু পথ হাঁটা আমাদের জন্য নস্যি ছিল বটে। কারণ পায়ে হাঁটাই ছিল সেকালে চলাচলের বড় মাধ্যম। সময়টা যথাসম্ভব ফেব্রুয়ারী মাস হবে। দু’দিন পর আমি গুরুদাসপুর পাইলট হাইস্কুল পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়েছি পরীক্ষা দিতে। কিন্তু বন্ধুদের কাউকে দেখছি না। পরীক্ষা কেন্দ্র জনশূন্য,ফাঁকা। তাড়াশের জনৈক শিক্ষকের দেখা হতেই আমি জানতে চাওয়ার আগেই তিনি বললেন, রাজ্জাক, তুমি শোনোনি মনে হয়। দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। তাই পরীক্ষা স্থগিত হয়ে গেছে। তোমার সাথী ছাত্র-ছাত্রীরাও তাড়াশে ফিরে গিয়েছে। তুমি আর এখানে থেকে কী করবে। শীঘ্র বাড়ী ফিরে যাওয়াই ভালো। রাষ্ট্রের পরিস্থিতি ভাল নয়। কখন কী হয় বুঝা যাচ্ছে না।
স্যারের কাছে এসব শুণে তৎক্ষনাৎ মনটা কেমন যেন ভেংগে গেল। অনেকটা নিরুদ্যম মনে বামনকোলা জ্যাঠার বাড়ী ফিরে এসে পরদিন আবার পাততাড়ি গুটিয়ে তাড়াশের পথে রওয়ানা হলাম। এতো প্রস্তুতির পর পরীক্ষাটা না দিতে পেরে মনটা এক ধরনের হতাশায় ভরে গেল। তবু স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা ভেবে পাকিস্তান শাসকদের বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভ এবং বিদ্বেষ জেগে উঠল অন্তরের নিভৃত গহীনে। পরবর্তীতে ১৯৭১ এর ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালের প্রথম ব্যাচে আমরা আবারো গুরুদাসপুর একই পরীক্ষা কেন্দ্রে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। নকলে রমরমা সেই পরীক্ষার একটা স্মৃতি মনে হয় আমরণ স্মরণে থাকবে। তাহল প্রথম দিন আমি পরীক্ষায় বসে গভীর মনোযোগের সাথে খাতা লিখে চলেছি। বিষয় খুব সম্ভবত ছিল বাংলা প্রথম পত্র। প্রশ্নপত্রও তেমন কঠিন ছিল না। ফলে স্কুলে শেখানো নৈতিকতা ও নিয়ম-শৃংখলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে কোন দিকে নজর না দিয়ে আমি একান্ত আপন মনে নিজস্ব ভূবনে পরীক্ষায় মশগুল। তিন ঘন্টা পরীক্ষার শেষ বেলায় দেখি হলের মধ্যে তুমুল হৈচৈ। প্রথমে পরীক্ষার আবেশ কাটিয়ে বুঝে উঠতে পারলাম না – হৈহল্লার কারণ কি। তবে বই-খাতা নিয়ে পরীক্ষার্থীরা পরস্পরে দেখাদেখি এবং টানাহেঁচড়া করছে। পাশের একজন আমাকে বলল, বোকার মত ধ্যানের রাজ্যে ডুব দিয়ে পরীক্ষার সাধনা করছ। ওদিকে সমগ্র হলে নকলের মহাপ্লাবন বইছে, তা খেয়াল করোনি বুঝি।এমনকি কর্তব্যরত হল পরীক্ষকগণও এতে সহায়তা দিচ্ছে যা মারাত্মক, শোনা এবং দেখাও পাপের নামান্তর।। ততক্ষণে ঘন্টা পড়ে গেল। আজকের মত পরীক্ষা শেষ। যখন বাড়ী ফিরছি, মনটা তখন কেন যেন অজানা আশঙ্কা আর বিতৃষনায় ছটফট করে ঊঠল এই ভেবে যে, একটি সদ্য স্বাধীন দেশে যদি শিক্ষা ব্যবস্থায় এ ধরনের নকল ভেজাল দিয়ে শুরু হয়, তবে ভবিষ্যতে এদেশের শিক্ষার মান কেমন হবে। এরপর সবচেয়ে লজ্জিত হয়েছিলাম আমার সে পরীক্ষার ফলাফল শুনে আমার পিতার মন্তব্যে। তিনি বলেছিলেন , চোরের (নকলবাজ) আর প্রথম স্থান কিসের। এছাড়া আমাদের এক শিক্ষক বলতেন, “নকলে নকল মানুষ গড়ে।”
যাহোক, তাড়াশে ফেরার পর আমরা আবার স্কুলে মিলিত হলাম। মুক্তিযুদ্ধ আসন্ন বলে স্যাররা আমাদের প্রস্তুতি নিতে উপদেশ দিলেন। তারা বললেন, জীবনে পরীক্ষার অনেক মূল্য আছে, তা ঠিক। তবে দেশের স্বাধীনতা ও মানুষের স্বাধিকার তার চেয়ে অনেক বড় এবং অমূল্য বস্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। আমরা এই স্কুলেই প্রাথমিকভাবে আপাতত দেশী অস্ত্র চালানো তথা প্রচলিত বন্দুক প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে যাচ্ছি। তোমরা যারা আগ্রহী আশা করি তারা এতে যোগদান করবে। এ কথা শুনে এবারে মনটা চাঙ্গা এবং প্রকারান্তরে চিত্তে একটা প্রবল বেগবান ঝর উঠে গেল। বাড়ী ফিরে পিতার সম্মতি নিয়ে পরদিনই অন্যান্য বন্ধুদের সাথে আমি তাড়াশ স্কুল অস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যোগ দিলাম। সে আবেগ আর অনুভূতি বলে বুঝাবার নয়।

স্বাধীনতার বছর যেমনি বন্যা তেমনি মাছ

৭১-এ যারা তরুণ-যুবক সবারই মনে আছে ওই বছরের বড় বন্যার কথা। চলনবিলের প্রায় সব গ্রাম-জনপদে বাড়ীঘরে পানি উঠে ছিল। চলনবিলকে মনে হত পদ্মা-যমুনার মত। সাথে ছিল প্রায়শ বিরামহীন ঝড়-বৃষ্টি। মূলত ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি হয়েছিল। আমাদের গ্রাম আশানবাড়ীর প্রায় সকল বাড়ীর সামনের উঠান পানিতে ডোবা। পাড়ার ওপর দিয়ে নৌকা ডোঙ্গা চলতো। বাড়ীর উঠানে-খোলায় আমরা মাছ ধরেছি খেয়া জাল ও হেচি জালে। ওই সময় আজকের মতো একচেটিয়া ইরি-বোরো ধানের আবাদ হতো না। বর্ষাকালে আমন ধানই ছিল প্রধান ফসল। যা বন্যার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠতো আর ভেসে থাকতো জলের উপরে। অতি বন্যায় মাঠের বেশীরভাগ জমির ধান ছিল পানির নিচে। অনেক ভিটে-পুকুরও পানিতে তলিয়ে যাবার কারণে সে বছর বন্যার পানির সাথে মাছের আগমণ ছিল প্রচুর যা এখনকার দিনে কল্পনা করা যায় না। সম্পূর্ণ দেশী জাতের অসংখ্য বিচিত্র মাছের সে স্মৃতি ভোলার নয়। তাড়াশ,বিনসাড়া, উলিপুর, নওগাঁ, চাঁচকৈড়সহ চলনবিলাঞ্চলের অধিকাংশ হাটবাজার বন্যার পানিতে তলিয়ে মাছ বিক্রয়ের জায়গা ছিল না। অন্যান্য দোকানপাট ও সরিয়ে নিতে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ধকল আর বন্যার প্রকোপে গ্রামীণ হাটবাজারে ব্যবসা বাণিজ্য প্রায় বন্ধ। আমাদের গ্রামের মধ্যে আমার পিতা ছিলেন মাছ শিকারে অভিজ্ঞ এবং বিখ্যাত। প্রতি দিন নিজ হাতে মাছ ধরা ব্যতীত তার পেটে ভাত যেত না। যুদ্ধকালীন অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মানুষের হাতে কাজ ছিল না। তারা বাইরে দূরে যেতে পারত না। তদুপরি ভয়াবহ বন্যার ছোবল। সুতরাং গ্রামের প্রায় সবাই মাছ শিকারে নেমে পড়েছিল। তখনকার দিনে ইঞ্জিন চালিত নৌকা ছিল না। সব নৌকাই লগি-বৈঠা দ্বারা চালানো হত।
আমাদের গ্রামের ঠিক উত্তরের পাশে অদূরে মাঠের মধ্যে পদ্মচাকা নামক এক জলাশয় ছিল। তার চার পাড় জুরে ছিল বিন্যার ঝোপঝাড়। আজকের মত সেখানে বাড়ীঘর বা বসতি হয়নি। স্বাধীনতার বছরে সে সব বিন্যার ও ঝোপ জংগল ডুবে সামান্য মাথা দেখা যেতো। পিতা আমাকে নিয়ে ডিংগি নৌকায় বৈঠা মেরে চলে আসতো এই পদ্মচাকার পাড়ে। সেখানে আমি লগি দিয়ে নৌকা ধরে রাখতাম। আর তিনি বুক পানিতে নেমে কখনো ডুব দিয়ে মাছ ধরার ভাঁইড়, বিত্তি, খলসুনি, কারেন্ট জাল ইত্যাদি টেনে তুলতেন আবার পাততেন। সেগুলো থাকতো মাছ বোঝাই। আজকের প্রজন্মের নিকট এত মাছের কথা অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয় মনে হবে। সবই দেশী প্রজাতির মাছ। প্রতিবারই ওসব তুলতে মাছের লাফালাফিতে যে ঝাঁকুনি ও ফরফরানি আওয়াজ হতো তা উপভোগ্য বটে। ক্ষেত্র বিশেষে মাছের ভারী ওজনের দরুন কোনোটা পানির উপরে তুলতে বেশী শক্তি লাগতো। মনে পড়ে একবার বাজান(পিতা) পানির ভেতর থেকে ভাইড় তুলে আমাকে ধরতে বললে আমি ধরার সাথে সাথে আকস্মিক চিৎকার মেরে তা আবার জলে ফেলে দিই। কারণ, ভেতরে ছিল বড় বড় কৈ, মাগুর, কাতল ,ষোল মাছ। পানির উপরে তুলতেই যখন মাছগুলো গাঝাড়া দিয়ে ফরফর করে নড়ে উঠে লাফালাফি-দাপাদাপি শুরু করে বড় একটা ঝাকুনি দিয়েছে, আমি ভয় পেয়ে তা পানিতে ছেড়ে দিয়েছি। তাতে রেগে গিয়ে বাজান আমার গালে একটা চড় বসিয়ে দিল। কিছুক্ষণ কেঁদে আমি আবার স্বাভাবিক হলাম। জালে ধরা কইগুলোর কোনটা প্রায় ৮-৯ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতো। পাবদা ,মাগুড়, জিয়ল, টেংড়া , টাকি, গোলসা ইত্যাকার বেশ বড় বড় সাইজের সেই মাছের আজ দেখা পাওয়া আর সম্ভব নয়। চলনবিলের কই মাছের ছিল অপূর্ব স্বাদ আর ঐতিহাসিক খ্যাতি বা সুনাম। সে প্রসঙ্গ আজ অতীত কল্পকাহিনি। বাড়ীতে মা কই মাছ রান্না করলে আমরা তার কেবলমাত্র পুরু মাংসের অংশটুকু খেয়ে তার পীঠের কিছু অংশসহ ফেলে দিতাম। সে বন্যায় মাছ খেতে খেতে অভক্তি এসে গিয়েছিল। কত বিচিত্র মাছ আর কতই বা খাওয়া যায়। স্বাধীনতার বছর চলনবিলে মাছ আর বন্যার পানি সমালে সমান বলে লোকেরা মন্তব্য করতো। সে দৃশ্য, সে স্মৃতি কোন দিন ভুলে যাবার নয়। চিরদিন মনের নিভৃত কোনে স্বর্ণের মত উজ্জø হয়ে থাকবে। তবে দু:খের বিষয় ছিল, হাটবাজারে প্রচুর বললে ভুল হবে, বেশুমার মাছ আমদানী হলেও রাজাকাররা সে মাছ হয় নাম মাত্র দামে তারা কিনে নিতো, নয়তো ক্ষেত্র বিশেষে জেলে বা বিক্রেতাদের নিকট থেকে পছন্দ মত মাছ জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিতো। এটা ছিল প্রায় নিত্য দিনের দৃশ্য। সে বন্যাকালে গ্রামে প্রায় সবার বাড়ীতেই কম বেশী নানা ধরনের মাছ ধরার ফাঁদ বা উপকরণ আর মাছের প্রাচুর্য ছিল। যদিও পাক সোনা, রাজাকার এবং শান্তি কমিটির সদস্যদের উপদ্রবে নিশ্চিন্তে মানুষের মাছভাত খাওয়া তো দূরের কথা, রাতের ঘুমও হারাম হয়ে গিয়েছিল। তবে এ বন্যাই আবার পাক সেনাবাহিনীর নির্বিচার অভিযান চালাতে বহু ক্ষেত্রেই সমস্যা ও প্রতিকুলতা সৃষ্টি করেছিল সেটাও ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে। তাই এই বন্যা অন্য অর্থে বাঙ্গালী জাতির জন্য সে বছর ছিল আশীর্বাদ স্বরুপ তা বলাই বাহুল্য ।

কোহিত পালিয়ে থেকে আরেক জ্বালা

উজ্জল স্মরণে পড়ে, আমি গুরুদাসপুরের বামনকোলা থেকে মসিন্দা ধামাইচ হয়ে তাড়াশের কহিত গ্রামে চলে এলাম। এটা তাড়াশের পশ্চিম পার্শ্ববর্তী গ্রাম, আমার নিজ গ্রাম আশানবাড়ীরও নিকটবর্তী। তাড়াশের সাথে মেঠোপথে এ গ্রামের যোগাযোগ। তখনও আজকের মত সড়ক যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। উক্ত গ্রামের রমজান আলী সরকারের বাড়ী আশ্রয় নিলাম মানে পালিয়ে থাকলাম। তাকে আগে থেকেই জ্যাঠা বলে ডাকতাম। ঠাঁই হল তার পশ্চিম ঘরের দক্ষিণের এক কোনার পূর্ব দুয়ারী রুমে। প্রসঙ্গত রমজান সরকার ছিল অবস্থাসম্পন্ন স্বচ্ছল গৃহস্থ। কাজ ছিল শুধু বই পড়া আর টুকটাক লেখা। তিন বেলাই ভাতের ব্যবস্থা বাড়ীর সবার জন্য, খাবার সময় হলে আমাকে কেউ ডাক দিতো। তখন আমি নামাজ পড়তাম, তবে অনিয়মিত। যাহোক এখানে আমার আগমণের খবর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে গেল। কহিত গ্রামে পূর্ব হতেই আমার যাতায়াত ছিল। গ্রামের লোকেরা সেই সুবাদে চিনতো আমাকে। ইতোমধ্যে পার্শ্ববর্তী কহিত তেতুলিয়া গ্রামের হাবিবুর রহমানের কানেও আমার আসার কথা চলে গেছে। সে ছিল তাড়াশের মুসলিমলীগ ও শান্তি কমিটির ঘেষা তাদের একজন করিৎকর্মা অন্য কথায় খাঁটি দালাল। লোকেরা তাকে হবিবর পাগলা নামে ডাকতো। আশানবাড়ীতে আমাদের বাড়ীতেও সে মাঝে মাঝে যেত। সখ্যতা ছিল আমার পিতার সাথেও। সে ছিল আমার জ্যেষ্ঠ। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার তৎপড়তা ছিল যুবক-তরুণ ছেলেদের উদ্ভুদ্ধ করে রাজাকার-আলবদর বাহিনীতে ভর্তি করা। এক্ষেত্রে তিনি লোভ-টোপ দিতেন। ভয়-ভীতিও দেখাতেন তার কথা মতো কাজ না করলে।
আমি তার মোটিভ বুঝে বারবারই তার থেকে নিরাপদ দুরত্বে থাকতাম। প্রতিবারই তাকে দেখলে সটকে পড়তাম। সে ছিল গোঁড়া পাকিস্তান পন্থী এবং মুসলিমলীগ ঘেঁষা। স্বভাব ছিল পাগলাটে। সেসময় একদিন হঠাৎ করেই কহিত প্রাথমিক স্কুল প্রাঙ্গনে তার দেখা মিলল। দেখা মাত্রই সে বলা শুরু করলো, রাজ্জাক তোকে অনেক দিন দেখি না, থাকিস কোথায়। এখন কী করছিস ? এদিকে আয়, বসে কিছু কথা বলি। এই বলা মাত্রই কাছে এসে আমার হাত ধরে টানাটানি শুরু করলো। আমি ততক্ষণে প্রমাদ গুনছি এই ঝামেলার পাল্লায় পড়ে। তার কথায় সায় দিয়ে কোথাও বসি এমনি ভান করলাম আর সুযোগ খুঁজছি পালাবার। এরই মধ্যে গ্রামের আরো দু’একজন এসে ওর সাথে কথা শুরু করলো। আমি তখন বললাম ভাই, একটু পেসাব করে আসি। আপনি ততক্ষণে এদের সাথে আলাপ করেন। বলেই আমি এই সুযোগে দ্রুত পায়ে চলে যেতে যেতে পেছনে তাকিয়ে দেখি হবিবর ভাই আমাকে সন্দেহমূলকভাবে ধরতে আসছে। অর্থাৎ সে বুঝে ফেলেছে, আমি ভেগে পড়তে যাচ্ছি। বেকায়দা বুঝে দিলাম জোড়ে দৌড়। সেও দৌড়াচ্ছে আমার পেছনে। কিন্তু পারল না আমার সাথে। তাকে চোখের আড়াল করে আমি এক বাড়ীতে পালিয়ে থাকলাম। হয়তো সে আমাকে সন্ধান করে এক সময় চলে গেছে। আমার মনে হল , এরপর আমার আর কহিতে না থাকাই ভাল। কেননা, হবিবর সাহেব অত:পর দলবল নিয়ে আমাকে ধরার চেষ্টা করবে। লক্ষ্যনীয়, কহিত ও তেতুলিয়া দুটি পাশাপাশি লাগোয়া গ্রাম। ফলে তার এ গ্রামে যাতায়াত প্রাত্যাহিক ব্যাপার। সে কারণে আমাকে ধরতে বা তাড়াতে তার বরং সুবিধাই ছিল। আর তাহলে আমার রেহাই পাওয়া সম্ভব হবে না। নাম লেখাতে হবে তার পছন্দের দলে বা বাহিনীতে। সেহেতু এ গ্রাম থেকে চলে যাওয়াই উত্তম মনে করলাম। তাই পরদিন উক্ত গ্রাম ছেড়ে আবারও নিজ গ্রাম আশানবাড়ী পাড়ি জমালাম।

মুক্তিযোদ্ধা সোবাহান ভাই প্রথম আসেন আসানবাড়ী গ্রামে

ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে । খুব সম্ভবত: জানুয়ারী মাসের প্রথম দিকে। শীতকাল চলছে। আমি জামা-লুংগি ও গরম কাপড় পড়ে গ্রামের পাশের কাঁচা সড়ক পথ হয়ে তাড়াশ রওয়ানা হয়েছি সবেমাত্র। গ্রামের মফিজ তালুকদার মামার বাড়ীর দক্ষিণে আসানবাড়ী কবরস্থানের পূর্ব-উত্তর কোনে মাঠের মধ্যে সামনাসামনি মুখোমুখি সাক্ষাৎ পেলাম তাড়াশের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সোবাহান ভাইয়ের। গ্রামে এইমাত্র ঢুকতে যাচ্ছেন। দিব্যি গাজী সৈনিকের বেশে তিনি আমাদের গ্রামে বেড়াতে এসেছেন বলে জানালেন। তার বাড়ী তাড়াশের মাগুড়াবিনোদ গ্রামে। তিনি বয়সে আমার বেশটা বড়। সোবাহান ভাই একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা । ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। খাকী পুলিশী পোশাকে কাঁধের পেছনে চায়নিজ রাইফেল ঝোলানো। কেবল মুখে মোচ আছে। দাঁড়ি দাঁড়ি তখনো উঠে নাই। কালো চুল মাথায়। মাজার সাথে বন্দুকের গুলির চেইন বা ফিতা বাধা। সব মিলে তাকে দেখে আমার চোখে বাঙ্গালীর জাতীয় কবি নজরুলের সৈনিক জীবনের ছবিটা ভেসে উঠল। অনেকটা সেরকমই লাগছে দেখতে। সালাম দিয়ে জিঞ্জেস করলাম, ভাই কেমন আছেন।
অবশ্য এর আগেই অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তাকেও তাড়াশে দেখেছি ও কথা হয়েছে। সোবাহান ভাই আমাকে বললো, কোথায যাচ্ছিস। চল আমার সাথে। তোদের গ্রামে একটু ঘুরে আসি। তুই আমার সাথে থাকবি। এ প্রস্তাবে ভুলে গেলাম তাড়াশ যাবার কথা। তার আহবানে সাড়া দিয়ে ওর সাথে গোটা গ্রামে এক চক্কর ঘুরে এলাম। আসানবাড়ী গ্রামটি একটি পুকুরের তিন পাড়ে বসতি। খুব ছোট্ট্র গ্রাম। গ্রাম ঘুরে বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে কিছু লোকের সাথে কথা বললেন সোবাহান ভাই। তাদের কুশলাদি জানলেন। যুদ্ধকালীন সময়ে কেমন ছিল এ গ্রামের লোকজন তারও খোঁজ নিলেন। ঘোরাঘুরি শেষে আমার সাথে এসে মফিজ উদ্দিন তালুকদার মামার বৈঠকখানায় বসলেন। এর মধ্যে বেশ কিছু লোক জমে গেল। তাকে এক নজর দেখার আগ্রহ অনেকের। কথা বললেন তাদের সাথেও। মূল প্রসঙ্গ ছিল এ গ্রাম থেকে কেউ শান্তি কমিটি, রাজাকার বা জামাত মুসলিমলীগে কাজ করতো কিনা। জবাবে সবাই বললো না- তেমন কেউ এ গ্রামে নেই। যদিও মুক্তিযুদ্ধের প্রবল সমর্থক এবং কর্মী থাকলেও এখান থেকে সরাসরি কেউ মুক্তি বাহিনীতেও যোগ দেয় নি। তখন তিনি আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসি দিলেন। সে হাসির অন্তর্নিহিত অর্থ অন্য কেউ তেমনটি না বুঝলেও আমি তা অনুধাবন করতে পেরেছিলাম। বিশেষ স্মরণযোগ্য, সোবাহান ভাইই সর্বপ্রথম সদ্য স্বাধীনতা যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আশানবাড়ী গ্রাম পরিদর্শন করেন। সেটা একটা স্মৃতিবহ ব্যাপার বটে।

আজকের তাড়াশ চক্ষু হাসপাতাল ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বিতীয় ক্যাম্প

১৬ ডিসেম্বর দেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা বিজয়ী বীরের বেশে প্রথম তাড়াশ থানা চত্বর দখলে নেয়। সেখানেই তাদের অধিকাংশ জোয়ান অবস্থান করে। তবে মনে পড়ে, এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান অধিনায়ক ও স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থানীয় বিশিষ্ট সংগঠক ম ম আমজাদ হোসেন মিলন ভাইসহ উর্দ্ধতন কমান্ডারদের কয়েকজন অবস্থান করেন আজকের তাড়াশ চক্ষু হাসপাতালে। স্বাধীনতা পূর্বকালে এটা ছিল সরকারী পল্লী স্বাস্থ্য কেন্দ্র। তবে তখন এটা খালি পড়েছিল যুদ্ধকালীন সংকট ও তৎপরবর্তী দূর্যোগময় মুহুর্তে। মিলন ভাই থাকতেন এই হাসপাতাল প্রাঙ্গনের উত্তরের কোয়ার্টারে। এখানে তিনি একাই থাকতেন। তবে রাতে যথারীতি সেন্ট্রি নিয়োজিত থাকতো। বিশেষ প্রণিধানযোগ্য, স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদানের পূর্বে আমজাদ ভাইয়ের নামের সাথে মিলন নিক নেম বা ওরফে নাম যুক্ত ছিল না। এটা তার যুদ্ধকালীন প্রাপ্ত অন্যান্য সহযোদ্ধাদের মতই প্রতীকি বা ছদ্ম নাম যে নামে মুক্তিযোদ্ধাগণ পালিয়ে থেকে অপারেশনকালে এক অপরকে সম্বোধন করে ডাকতেন নিরাপত্তার কারণে প্রকৃত নাম আড়াল করে। তাড়াশের বহু মানুষের আজকে হয়তো অজানা যে, এক সময় আমজাদ হোসেন মিলন ভাইয়ের সাথে আমার প্রগাঢ় সম্পর্ক ছিল। তার বাবারও আমি স্নেহভাজন এবং ভক্ত অনুরক্ত ছিলাম। বয়সে তার চেয়ে আমি অনেক ছোট। তাই তিনি আমাকে ছোট ভাইয়ের মত স্নেহ করতেন। এর আরো একটা কারণ হতে পারে এই,আমি তাড়াশ সরকারী প্রথমিক বিদ্যালয় থেকে সম্ভবত ১৯৬৫ সালের দিকে তৎকালীন পঞ্চম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষায় আমি বৃত্তি পাই। ছিলাম কিছুটা দুষ্ট অথচ মেধাবী ছাত্র। তখনকার দিনে বৃত্তি পাওয়া ছাত্রের কদর ছিল। সে জন্য মিলন ভাই আমাকে আদর দিতেন। তাড়াশ পাইলট হাইস্কুলে পড়াকালেও তার সাথে ওই সখ্যতা বজায় ছিল। এমনকি আমি তাকে বড় ভাই সম্বোধন করে বহু সাহিত্যভাবমন্ডিত চিঠি লিখেছি। জবাবে তিনিও আমাকে কাব্যিক ছন্দময়তার ভাষায় প্রত্যুত্তর দিয়েছেন অসংখ্য পত্র লিখে। উল্লেখ্য, তখনকার দিনে এখনকার মত ডিজিটাল ব্যবস্থা না থাকায় বন্ধুত্বের ভাববিনিময় হতো চিঠি আদানপ্রদানের মাধ্যমে। ফলে আজকের দিনে তাড়াশের কারো পক্ষেই আমাদের সেই মধুর সৌহার্দের বিষয়টি অনুধাবন করা সম্ভব নয়। এর আরও একটি কারণ হল, পরবর্তীতে মিলন ভাই সক্রিয় রাজনীতিতে নিবেদিতভাবে জড়িয়ে যান। কলেজে পড়াকালেও তিনি ছাত্র রাজনীতিতে নেতৃত্বের আসনে ছিলেন। অপরদিকে আমি ক্রমশ সমাজকর্ম, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার দিগন্তে ধাবিত হই। এভাবে দু’জনার দ’ুটি পথ হলেও আমার সাংবাদিকতা ও পরবর্তীতে তাড়াশ প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠায় আমাদের যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের পেছনে তার যথেষ্ট প্রেরণা ও অবদান রয়েছে যা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণে রাখি।
ফিরে যাই পূর্ব প্রসঙ্গে। সেদিন আমি হাসপাতাল চত্বরে তার কক্ষে হঠাৎ করেই ঢুকে পড়লাম। আগেই খবর নিয়েছিলাম। তিনি রুমেই আছেন। দেখলাম সবুজ রঙ দেয়া কাঠের দরজা খোলা। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করে দেখলাম রুমে কেউ নেই। ছোটখাট একটা মাত্র বেড। তাতে চাদরও নেই। শুধু কাঁথা। বিছানার উপর ছোট একটা বাদাম বালিশ। সবই কেমন যেন অপরিষ্কার,অপরিছন্ন। আর সদ্য যুদ্ধ পরবর্তী মুহুর্তে এমনটা হওয়ারই কথা। মুক্তিযোদ্ধারা তখনও স্বাভাবিক জীবনে পরিপূর্ণরুপে থিতু হতে পারেনি। আমি পূবেই দুস্টুমীবশত মনে মনে একটা আন্দাজ করে গিয়েছিলাম। তাদের অস্ত্র, টাকা পয়সা বা যুদ্ধে প্রাপ্ত কোন দামী জিনিষ পত্র দেখতে পাবো এমনটাই। তাই তিনি ওই মুহুর্তে বাথরুমে গেছেন জেনে তার বালিশ-কাঁথা সত্ত্বর উল্টিয়ে উঁকি দিলাম। বালিশের নীচে ম্যাচ সিগারেট ছিল। কিন্তু কাথার নীচে এক পাশে কিছু টাকার নোট নজরে পড়লো যেগুলো ছিল রক্ত মাখা। তবে সেগুলো খুব বেশী নয়, সামান্য কিছু। পরে তিনি বাথরুম থেকে বের হয়ে শয়ন কক্ষে এসে আমাকে দেখে কিছুটা চমকে উঠে বললেন, রাজ্জাক কেমন আছিস। এখন কি করিস। তুই তো মুক্তিযুদ্ধে গেলি না। যাওয়া উচিৎ ছিল। তারপর তিনি আমাদের বাড়ীর কুশলাদি জিঞ্জেস করলেন। পূর্বের সহৃদয়তা ও বন্ধুত্বের সূত্রে পরবর্তীতে তাড়াশের প্রায় সকল নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধার সাথেই আমার আন্তরিকতা ও সুসম্পর্ক গড়ে উঠে যা আজো বিদ্যমান।

(মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতিকথার ১০ পর্ব সমন্বয়ে লেখকের এ সম্পর্কিত বই শীঘ্রই প্রকাশ পেতে যাচ্ছে। আগ্রহী পাঠকেরা বইটি সংগ্রহের জন্য চলনবিল বার্তার ঠিকানায় যোগাযোগ করতে পারেন।)
Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD