সুজন কুমার মাল
বর্ষাকালে চলনবিলের আশপাশের একটু উঁচু নিচু অনাবাদি জমিতে দিন ভর বাতাসে দোল খায় কচুরিপানা। এই বর্ষায় বেড়ানোর জন্য আপনি নিশ্চিন্তে বেছে নিতে পারেন চলনবিলের তাড়াশ উপজেলাকে।
বর্ষাকালে চলনবিলের তাড়াশের রূপের কোনো তুলনাই নেই। গাছে গাছে কত না রঙের ফুল। কামিনী, কদম, শিউলি, হাসনাহেনা ফুটে সুঘ্রাণ ছড়াচ্ছে দিনে-রাত সমান তালে। বর্ষায় তাড়াশ যেন একখানি ছবির মতন। ছবির মতো রূপ দেখে হয়তো আপনার মনে জেগে উঠবে ফেলে আাসা দিনগুলোর। এছাড়া চলনবিলের মধ্যে বয়ে চলছে অসংখ্য নদ-নদী ও খালবিল।বর্ষায় চলন অঞ্চলে চারিদিকে জলে থৈ-থৈ করে। আকাশে কে যেনো রং তুলি নিয়ে সাদা আর নীলের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে। আত্রাই, গুড়, বারনাই, বড়াল, তুলসী, চেঁচুয়া, ভাদাই নদীতো বয়ে গেছে চলনবিলের ওপর দিয়ে। মেঘ গর্জন করলেই- অঝোর ধারায় নেমে আসে বর্ষণধারা।
তখন নৌকা ভাড়া করে দূরে, বহু দূরে চলে যেতে পারেন। এভাবে বেড়াতে চাইলে কয়েক বন্ধু মিলে আসলে ভালো হয়। চলনবিলে নৌকায় ৩ থেকে ৪ রাত কাটিয়ে দারুণ আনন্দ উপভোগ করা যায়। নৌকা যখন কোনো তীরে এসে ভিড়বে, তখন পাশে দেখবেন বিলের জলে ছবির মত জলের মধ্যে বাড়ি ঘড়গুলো।সুযোগ পেয়ে কাশফুলরা পুরো এলাকা জুড়েই বসতি গেড়েছে। মন তখন আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠবে। হয়তো মনে জেগে উঠবে, ‘বরষার জল সরিয়া গিয়াছে জাগিয়া উঠেছে চর/গাঙ-শালিকেরা গর্ত খুঁড়িয়া বাঁধিতেছে সবে ঘর। রান্নাবান্না হবে নৌকাতেই। উফ সে কি আনন্দ !
তাড়াশ উপজেলায় আসলে যা দেখবেন: তাড়াশ উপজেলায় দর্শনীয় স্থানের অভাব নেই। এখানকার অন্যতম আকর্ষণ রাধা গোবিন্দ মন্দির, রশিক লাল ত্রিদল মঞ্চ, নকুলেশ্বর শিব মন্দির, বড় কুঞ্জবন দীঘি, উলিপুর দীঘি, মথুরাপুর দীঘি, মাকরসন দীঘি, নওগাঁ মাজার, বিনসাড়ার জিয়ন কূপ, তালম শিব মন্দির, ইমাম বাড়ী, চৌধূরী বাড়ী, গুল্টা মিশন সহ আরো অনেক কিছু। শরতের শেষ দিকে শুরু হয় দুর্গাপূজা। তখন তো এখানকার মন্দিরে মন্দিরে বাজে ঢোল-বাদ্য, আকাশে ওড়ে ফানুশ। কীর্তন গানে মুখরিত হয় তাড়াশের আকাশ-বাতাস। আর তাড়াশের চারদিকে ফুটে থাকে কত শত কাশফুল।
তাড়াশে বেড়াতে এসে জানবেন, এখানকার কপিলেশ্বর শিব মন্দির, বিভিন্ন দেব দেবীর মন্দির ও তার কথকথা, বাসুদেব ও গোপাল বিগ্রহের কথা । তাড়াশে ধ্বংসাবশেষ প্রাচীন কীর্তির নিদর্শন আছে অনেকগুলো।এই তাড়াশে রশিক লাল রায়, কপিলেশ্বর শিব প্রভৃতি যে কয়টি বিগ্রহের মন্দির আছে, এর মধ্যে কপিলেশ্বর শিব মন্দির অন্যতম। এসব দেখতে দেখতে ফিরে যাবেন অতীত যুগে। অতীত যুগে ফিরে যাওয়া মানেই নস্টালজিয়ায় ভোগা।তখন স্মৃতিতে ভেসে উঠবে পূজা পার্বণের সেই দিন গুলোর কথা। দেখবেন, এখানকার প্রতিটি মন্দিরের গায়ে রয়েছে অপরূপ কারুকাজ। প্রাচীনকালে ক্ষুদ্র ইট দিয়ে এসব মন্দির তৈরি হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এক সময় তাড়াশের নাম শুনেই মনে ত্রাস বা তরাসের সৃষ্টি হতো। অনেকেই অনুমান করেন, ‘তরাস’ শব্দ থেকেই তাড়াশ নামের উৎপত্তি হয়েছে।
বাংলা সাহিত্য কিংবদন্তি বেহুলা সুন্দরীর বাবা বাছো বানিয়া ওরফে সায় সওদাগরের বাস ছিল এখানে। বিনসারায় গিয়ে কয়েকটি কূপও দেখবেন, একটি কূপের নাম ‘জীয়ন কূপ’। এই কূপটি বড় অদ্ভুত ধরনের। ইটের গাঁথুনি দিয়ে নির্মিত এটি। ওখানে গিয়ে লোকমুখে আরও জানবেন, বাছো বানিয়া মনসা পূজারী ছিলেন। ‘দুধ পুকুর’ নামে তার একটি পুকুর ছিল। পুকুরটি সাপদের জন্য নাকি দুধে ভর্তি থাকত। এখনও আছে দুধ পুকুর, তবে সেখানে দুধ নেই, সাপও নেই। দুধ পুকুর দেখার সময় তবুও কেন জানি ভয় ভয় লাগবে। সাপ না দেখলেও এখানকার জঙ্গলে দিনের বেলা লুকিয়ে থাকে সাপ। যা রাতের বেলা বের হয়ে আসে। তা সত্বেও বেড়াতে এসে চারদিকের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পড়বেন।
তাড়াশের বারুহাঁসে গিয়ে একটি ইমাম বাড়ার ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাবেন। লোকমুখে শুনবেন, এটি শাহ সুজার আমলে নির্মিত হয়েছিল। এখানে একজন দরবেশের মাজার আছে বলে অনেকেই বিশ্বাস করেন। কারও মুখে শুনবেন, তিনি এখানে বসে এবাদত করতেন। পঙ্খিরাজ ঘোড়ার পিঠে তরবারি হাতে মানুষের ছবি বাংলোটির গায়ে থাকায় এটি মুসলিম কীর্তির নিদর্শন বলে অনেকে মনে করেন। মোগল আমলে ইমাম-মোয়াজ্জেমের হুজরাখানার জন্য এরূপ বাংলো নির্মিত হয়েছিল বলে জানা যায়। চৈত্র মাসের পূর্ণিমার দিন বারুহাঁস গ্রামে বিরাট মেলাও বসে। আর প্রতি বছর নওগাঁয় ওরশ শরীফে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে আসেন।