নোভেল করোনার আতঙ্কে মলিনবাঙালির প্রাণের স্পন্দন বৈশাখ বরণ

Spread the love

মো. আবুল কালাম আজাদ.

আজ বাঙলা ১৪২৭ বঙ্গাব্দের প্রথম মাস বৈশাখে পহেলা দিন থেকেই হচ্ছে বাঙলা নববর্ষের শুভ সুচনা।পুরনো জরা ও গ্লানি ঝেড়ে ফেলে বাঙালি আজ বরণ করে নেবে বাঙলা নতুন বছরকে। বাঙলা নববর্ষের প্রথম দিনটি উপলক্ষে দেশ জুড়ে চলার কথা নানা উৎসবের আয়োজন।তাতে বাঙালি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে উর্ধে তুলে ধরার কথা। কিন্ত বাংলাদেশসহ সারাবিশে^ চলছে মরনঘাতী কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের প্রাণসংহারী থাবার আঘোতে শোকের কান্নার রোল। তাইতো বৈশি^ক নোভেল করোনা আতঙ্কে মলিন এবারে বাঙালির প্রাণের স্পন্দন বৈশাখ বরণের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। তারপরেও কবির ভাষায় আহবান করতে হচ্ছে-‘ এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’।
(এক)
চৈত্রের কাঠফাটা রৌদ্রের উত্তাপে চৌচির করে চারিদিকে ঝড়-বৃষ্টি নিয়ে হাজির হয় বাঙলা নব বর্ষের ‘বৈশাখ’ । কারো বুঝতে অসুবিধা হয়না বৈশাখের প্রলয় নৃত্যের কথা। তাইতো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের ভাষায় বলতে হচ্ছে- ‘ তোরা সব জয়ধ্বনী কর, ঐ নুতনের কেতন ওড়ে , কালবৈশাখী ঝড়, তোরা সব জয়ধ্বনী কর।’ আবার কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়-‘মুছ যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নি স্নানে সূচি হোক ধরা।’ নতুন বছরের শুরুর লগ্নে ধুয়েমুছে পবিত্র হোক ধরনী। কবিগুরুর এমন আকুতি আমাদের বাঙালি সত্ত্বাকে প্রতিবছর নিয়ে যায় ঐতিহ্যের দিকে। পহেলা বৈশাখ উদযাপন আমাদের বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রবাহকে বাঁচিয়ে রাখে। পহেলা বৈশাখ বাঙলাদেশের সবচেয়ে বড় সর্বজনিন উৎসব। এদিন সবাই পেছনে ফেলে আসা শোক, দুঃখ, হতাশা সবকিছু ভুলে এক কাতারে দাঁড়িয়ে প্রত্যাশা করে আসন্ন বছর যেন হয় সুখের,সবকিছু যেন হয় সৌন্দর্যময়।
বাঙলা নববর্ষ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, মহান স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস বাঙলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপিত হয়। ২১ শে ফেব্রুয়ারি ‘ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস এবং ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস উদযাপনের সঙ্গে রয়েছে আমাদের জাতিসত্ত্বার পরিচয় এবং গৌরবোজ্জল সংগ্রামের ইতিহাস। পহেলা বৈশাখ বাঙলা নববর্ষ পালনের পেছনে আমাদের হাজার বছরের লোক সংস্কৃতি ও লোক ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাঙালি সংস্কৃতির পুনঃনির্মাণের প্রয়াস।
বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে শহর এবং গ্রামে মেলা ও অন্যান্য আনন্দ উৎসব হয়। বছরের প্রথম দিন হওয়ায় শুভদিন হিসেবে দিনটিতে ব্যবসায়ীরা নতুন বছরের হিসেবের খাতা চালু করেন।পহেলা বৈশাখ হালখাতা খোলার দিন হিসেবেও পরিচিত। বাংলা নববর্ষের সাথে আমাদের গ্রামীণ জীবন, লোকজ উৎসব এবং নানান খেলা যেমন- লাঠিবাড়ি, হাডুডু, গোল্লছুট, ঘোড়া দৌড়, জারিগান, সারিগান, পুঁথিপাঠ,ভাটিয়ালী, বাউল গান, পুতুল নাচ এবং পান্তা-ইলিশসহ বিভিন্ন আয়োজনে বৈশাখী মেলার উৎসব চলে। বাঙলা নববর্ষ বাঙালির সর্বজনীন অংশগ্রহণে বর্ষবরণের দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বৈশাখ বরণ উৎসব কোন ধর্মের ধর্মীয় উৎসব নয়, এটা বাঙালির সর্বজনীন উৎসব হিসেবে খ্যাত।
(দুই)
বাঙলা বছরের শেষ মাস চৈত্রের শেষে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের চড়ক পূজার মাধ্যমে বছরের বিদায় জানিয়ে আগামী নতুন বছরকে বরণের প্রস্ততি নেয় বাঙালীর ঘরে ঘরে। বছর শেষে চৈত্রমাস এলেই বাঙালী ব্যাবসায়ীদের দোকানে দোকানে চলে পুরাতন হিসাবের খাতার সমাপনী টেনে আগামী বাঙলা বছরের জন্য নতুন খাতায় হিসাব খোলার।যাকে আমরা বলে থাকি হালখাতা। সারা বছরের কেনাকাটায় খরিদ্দারের কাছে দোকানে দোকানে এবং মহাজনের কাছে যত বাঁকী পড়ে, তা সব হিসাব গুনে হালখাতার কার্ডে লিখে খরিদ্দারের বাড়িতে পৌছে দেয়া হয়। খরিদ্দার দোকানী- মহাজনের কার্ডের তারিখে ঋন-কর্জ করে হোক বা ফসল-হালের বলদ বিক্রি করে হোক মহাজনের সারা বছরের বাঁকীর টাকা পরিশোধ করার প্রস্তুতি নিতে থাকে। শুভ হালখাতা খুলতে দোকানদার-মহাজনরাও মহাব্যস্ত হয়ে পড়ে তাদের প্রিয় খরিদ্দারদের সাধ্যমত আপ্যায়নের যোগাড়ে। কে কিভাবে কত সুন্দর করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাজাবে এবং কোথায় বসাবে তারও পরিকল্পনা চলে সবাই মিলে। ব্যবসায়ীদের কাছে খরিদ্দার হচ্ছে লক্ষ্মী। কোনক্রমেই যেন সেই লক্ষ্মী খরিদ্দার অখুশী না হয় সেদিকে সর্বত্রই নজর থাকে ব্যবসায়ীর।খরিদ্দার অখুশী হলে পরবর্তী বছরে হয়তোবা সেই খরিদ্দার কেটে পরবে – এই আশংকা থাকে সবসময়। মিষ্টির দোকানে দোকানে আগাম টাকা দিয়ে বন্দোবস্ত করে রাখে কত পরিমাণ এবং কী সাইজের মিষ্টি বানাতে হবে যা সময়মত দিতে হবে।এছাড়া বড় দোকানদার- মহাজনরা নিজেদের বাড়িতে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বানানোর জন্য নামিদামি কারিগর ঠিক করে রাখে যাতে হালখাতার দিনে সবকিছু ঠিকঠাক তৈরি করে দিতে পারে।এভাবেই শুরু হয় বাঙালীর প্রাণের স্পন্দন ফিরে পেতে চিরচেনা গভির অপেক্ষায় থাকা ব্যবসা প্রতিষ্ঠাগুলোতে হালখাতা উদ্বোধনের মাধ্যমে ‘ শুভ বাঙলা নববর্ষ’ বরণের প্রস্ততির মহোৎসব।
(তিন)
বাঙলা নববর্ষে বরণ উপলক্ষে আমরা যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বর্নাঢ্য আয়োজনে পালন করি ,তা কবে কোথায় কীভাবে শুরু হয়েছিল এবং কবে কীভাবে জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতি অর্জন করলো তা আমাদের প্রজন্মের জানা প্রয়োজন ।আজ থেকে ৩৫ বছর আগে বাঙলা ১৩৯২ সালের পহেলা বৈশাখ (ইংরেজী ১৯৮৫ সালে) যশোরের চারুকলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চারুপীঠের উদ্যোগে বাঙলা বর্ষবরণের নিমিত্তে উদ্যমী শিল্পীরা বাঘ,ভূত, দৈত্যেও মুখোশ, পাখি , প্রজাপতি, বড় বড় হাতপাখা আর কুলা, নানা রঙের ফুল লোকজ বিষয়গুলো তৈরী করে পায়ে ঘুঙুর বেধে কাঁসর , সানাই বাজিয়ে নেচে-গেয়ে প্রথম মঙ্গল শেভাযাত্রা শুর করে।
বাঙলা ১৩৯৩ সাল (ইংরেজী ১৯৮৬ সাল) থেকে ক্রমেই এর কলেবর বাড়তে থাকে। যশোরের বেশীরভাগ সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেয়। পহেলা বৈশাখে যশোরের চারুকলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চারুপীঠের এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ঢাকার জাতীয় চারুকলা ইনষ্টিটিউট বাঙালির জাতীয় সর্বজনীন উৎসবে রূপদানে এগিয়ে আসে।এরপর বাঙলা ১৩৯৬সালে (ইংরেজী ১৯৮৯ সালে) চারুকলা ইনষ্টিটিউটের বরেণ্য শিক্ষক শিল্পী কার্টুনিষ্ট রফিকুননবী (রনবী) এর নেতৃত্বে চারুকলা ইনষ্টিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সবাই মিলে হাতি- ঘোড়া, বাঘ, ময়ুর,সাপ,পাখি, ফুল, প্রজাপতি, ঢাক-ঢোল , কাঁসরি, বাঁশি বাজিয়ে ঢাকার রাজপথে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালে একই পদ্ধতিতে বরিশাল ও ময়মনসিংহে মঙ্গল শেভাযাত্রা বের হয়। এর চার বছর পর ১৯৯৪ সালে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বনগাঁও শহরে ও শান্তিনিকেতনে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। যশোরের মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন দেশের সীমানা ডিঙ্গিয়ে বিশে^র সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। ২০১৬ সালে ডিসেম্বর মাসে এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইউনেস্কো বিশে^র ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যা বাঙালি জাতি এবং যশোরের চারুপীঠের গৌরবের অর্জন। বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙলা দেশের যশোর থেকে শুরু হয়ে আজ জাতিসংঘের ইউনেস্কোর বিশে^র ঐতিহ্যের স্বীকৃতি অর্জন করায় বাঙালি জাতিসত্বার পরিচিতি বিশে^র প্রতিটি দেশে বসবাসকারী বাঙালি গর্বিত এবং মাতৃভাষা আন্দোলন এবং দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ করে বাঙলাদেশ নামের একটি দেশ স্বাধীন করার মর্যাদালাভের ন্যায় বিশে^র দরবারে সেই মর্যাদা আরো উন্নতি লাভ করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বাঙালিরা নেচে-গেয়ে মঙ্গল শেভাযাত্রা বের করছে। এখন সারা বিশে^ বাঙলা নববর্ষের শোভযাত্রা বের হচ্ছে। শোভযাত্রায় মঙ্গলের বার্তা নিয়ে উড়ছে প্রজাপতি। হেলেদুলে হাঁটছে হাতি-রয়েল বেঙ্গল টাইগার। টগবগিয়ে ছুটছে ঘোড়া। বাজছে ঢাক, কাঁসর, বাঁশের বাঁশি।
(চার)
নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলাসহ চলনবিলের প্রতিটি উপজেলায় প্রতিবছর বাঙলা নববর্ষ উদযাপনে পহেলা বৈশাখে উপজেলা প্রশাসনে এবং স্থানীয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের আয়োজনে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হচ্ছে। এতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষ নানা রঙের পোশাকে ফুলে ফুলে সেজে নেচে গেয়ে ঢাক-ঢোল,বাঁশি,কঁসরী বাজিয়ে সড়ক প্রদক্ষিণ করে। বৈশাখ বরণ উপলক্ষে গুরুদাসপুরসহ আশপাশ এলাকায় এবং বাংলাদেশের সর্বত্র সব ধর্মের মানুষ সার্বজনীন মেলা বা উৎসবের আয়োজনে মেতে উঠে। বৈশাখী মেলাগুলি হচ্ছে- বারুহাসের মেলা, বিয়াস মেলা, কুন্দইল মেলা ,তিসীখালি মেলা, বিয়াঘাট সুজার মেলা, জুমুাইনগর মেলা,শিধুলী উল্টাচড়ক মেলা, তেলাকুচ্চার মেলা, বুথরের মেলা, গুরমার মেলাসহ বৈশাক জুড়েই প্রতিনিই কোননা কোন জায়গায় মেলা লেগেই থাকে। মেলাকে কেন্দ্র করে নানা উৎসবের আয়োজন চলে। মেলা এলাকার মানুষ জামাই-ঝী (মেয়ে) ,আত্মীয়-স্বজনকে দাওয়ত করে নিয়ে আসে।ধুমধাম করে খাওয়া-দাওয়া হয়। উপহার দেওয়া হয় অতিথিদের।
(পাঁচ)
এবারে বিশ^ব্যাপী প্রনঘাতী কোভিড-১৯ অর্থাৎ করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুজিব জন্মশতবর্ষ , মহান স্বাধীনতা দিবসসহ সকল প্রকার উৎসব উদযাপনের বা গন জমায়েতের ওপর সরকারের নিশেধাজ্ঞা থাকায় এবারের বৈশাখ বরণের ইউনেস্কো স্বীকৃত মঙ্গল শোভাযাত্রা উৎসব উদযাপিত হচ্ছেনা। বৈশি^ক মহামারী প্রনঘাতী করোনাভাইরাসে বিস্তার প্রতিরোধে বিশ^ব্যাপী চলছে জরুরী অবস্থা, কারফিউ, স্ব্চ্ছো কারফিউ, লকডাউন, হোমকোয়রিনটাইন, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন নানা নামের নিশেধাজ্ঞা। এখন করোনাভাইরাসের অদৃশ্য সংক্রমন থেকে বাঁচতে বিশে^র মানুষ নিশেধাজ্ঞা ছাড়াও নিজে থেকেই ঘরবন্দি জীবন যাপন করছেন। তাই সকল উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা বন্ধ করে জীবন বাঁচাতে নিয়ম মেনে চলাতে বাধ্য হচ্ছে বিশ^মানবজাতি। আসুন আমরা সবাই প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস প্রেিরাধে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হই এবং নিয়ম মেনে চলি। প্রার্থনা করি এই অদৃশ্য দুর্যোগ থেকে মুক্তি পেতে। বাংলাদেশসহ বিশে^র সকল বাঙালিদেরকে জানাচ্ছি বাঙলা ১৪২৭ নববর্ষের শুভেচ্ছ। সেই সাথে যারা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রান দিয়েছেন তাঁদের রুহের শান্তি এবং যাঁরা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন তাঁদেরসহ বিশে^র সকলের সুস্থ্যতা কামনা করছি। আজ পহেলা বৈশাখ আপন শিল্প ও সংস্কৃত ধারাকে ঋদ্ধ ও বেগবান করার শপথ নেওয়ার দিন। নতুন বছর দেশ ও বিশ^বাসীর জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধিও বার্তা বয়ে আনবে, এটাই প্রত্যাশা। শুভ হোক নববর্ষ ১৪২৭ বঙ্গাব্দ।
লেখক: সভাপতি, চলনবিল প্রেসক্লাব ও বিশিষ্ট কলামিস্ট।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD