আবদুর রাজ্জাক রাজু
আমি তাড়াশ ডিগ্রী কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র।আমাদের শিক্ষাবর্ষ ১৯৭২-১৯৭৩, তবে ‘৭৪এ আমাদের এইচএসসি ফাইনাল পরীক্ষা হয় শেরপুর কলেজ পরীক্ষা কেন্দ্রে। সে কথায় পরে আসি।
তাড়াশ কলেজ প্রতিষ্ঠা আমাদের স্থানীয় শিক্ষা ক্ষেত্রে একটা মাইলফলক উদ্যোগ। কেননা, এর পূর্বে তাড়াশ থানায় আর কোন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় নি।তাড়াশের চারজন স্বনামধন্য মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদ এ কলেজটি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এলাকার শিক্ষার উন্নয়নে তাদের এই দূরদর্শী চিন্তা ও সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন তাড়াশ উপজেলাবাসীর নিকট চির স্মরণীয় হয়ে আছে। আমি তাড়াশ পাইলট হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাশের পর এখানে মানবিক বিভাগে ভর্তি হই।
কলেজের প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হন কামারখন্দ উপজেলার জামতৈল নিবাসী অধ্যাপক আব্দুল মান্নান। তার ডাক নাম ছিল সূর্য। তারও পূর্বে ১৯৭২এ কলেজ প্রতিষ্ঠা লগ্নে তাড়াশের তৎকালীন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ পাবনাস্থ বুলবুল কলেজের অধ্যাপক মো: মোসলেম উদ্দিনকে আনা হয় কলেজের একাডেমিক হাল ধরতে। তাকে অধ্যাক্ষ নিয়োগের আশ্বাসও দেয়া হয়েছিল উদ্যোক্তাদের পক্ষ হতে। এই সে দিনও অধ্যাপক মোসলেম স্যার তাড়াশ ডিগ্রে কলেজ প্রাঙ্গনে আমিন উল আলম স্যারের শবদেহের পাশে দাঁড়িয়ে আলাপের স্থলে প্রসঙ্গক্রমে অনুশোচনা করে বললেন, আমিই সব প্রভাষকের নিয়োগপত্র ডিজাইন করলেও অজ্ঞাত রহস্যজনক কারণে আমাকে বাইপাস করে অন্যজনকে অধ্যক্ষ নিয়োগ করা হয়। সেদিন কর্তৃপক্ষ আমাকে দেয়া কথা রাখেন নি। অথচ পাবনার বুলবুল কলেজে থাকলে আমি সরকারী অধ্যাপক হতে পারতাম, প্রমোশনও হতে পারত। সে যাহোক, আমিন উল আলম স্যার এসেছিলেন জামতৈলের মান্নান সাহেবের সংগে। মান্নান সাহেব আরো একজন কমার্স শিক্ষক সিরাজগঞ্জ শহরের তামান্না বুক ডিপো লাইব্রেরীর স্বত্তাধিকারীর ছেলে হামিদুর রহমানকে সাথে এনে তারা একসংগে তাড়াশ ডাকবাংলোয় অবস্থান করছিলেন। আপাতত সেখান থেকে কলেজের দায়িত্ব পালন করতেন। মান্নান সাহেব ছিলেন মেজাজী ও কিছুটা দাপুটে ধরণের, তবে বেশ নেতৃত্বমনা মানুষ। কোন এক রাতে হামিদুর সাহেবের সাথে ডাকবাংলোয় বাকবিতন্ডা ও ঝগড়াসূত্রে তাকে গালিগালাজ ও রান্নার লাকরি (খরি) দিয়ে তাকে পিটালে ঘটনাটি কলেজ কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত গড়ায়। হামিদুর রহমান এতই ভদ্র ও ন¤্র ছিলেন যে, সালিশে তিনি জানান, মান্নান সাহেব তাকে গালমন্দ ও মার দিলেও জবাবে তিনি কিছুই করতে পারেন নি। কারণ তাদের বংশে ও পরিবারে কারো এ ধরণের আচার ব্যবহার জানা নেই। সবশেষে সালিস সিদ্ধান্তের জেরে অধ্যাপক মান্নানকে অধ্যক্ষ পদ থেকে সরিয়ে দিলে তিনি কিছুকাল পর তাড়াশ কলেজ ত্যাগ করে ফিরে গিয়ে সিরাজগঞ্জে আইন পেশা শুরু করেন। উল্লেখ্য, আমি জীবনের কোন এক ঘটনাক্রমে জামতৈলের বড়কুরা গ্রামে ওই সময় জায়গীর থেকে সিরাজগঞ্জ শহরে স্টেনো- টাইপ শেখার সময় জামতৈল শহরে মান্নান স্যারের বাসায় বিভিন্ন সময় গিয়েছি। তার বড় ভাইয়ের ডাক নাম তারা। তিনি ছিলেন রেলওয়ে বিভাগের টিকিট চেকার। সেটা ছিল ১৯৭৩ সালের কথা।
এবার ফিরে আসি আমিন উল আলম স্যারের প্রসঙ্গে। তাড়াশ কলেজে তিনি আমাদের বাংলা পড়াতেন। মূলত: বাংলার শিক্ষক হলেও প্রায়ই ইংরেজী ক্লাসও নিতেন। বাংলা সাহিত্যে তার গভীর জ্ঞান গভীরতার পাশাপাশি ইংরেজী সাহিত্যেও ছিলেন পারদর্শী। হোমার,টিএসএলিয়ট,মিলটন , লর্ড বায়রন ও শেক্সপিয়ার প্রমূখ ইংরেজ কবির কবিতা পড়ানোর ক্ষেত্রে তার ভংগিমা ও রস বিশ্লেষণে আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপভোগ করতাম। স্যারের এই দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মূলে কী ছিল তা একবার জানতে চাওয়ায় তিনি বলেছিলেন, তাদের পূর্ব পূরুষ ছিল জমিদার। সবাই উচ্চ শিক্ষার অধিকারী ছিলেন। তাঁর মা বৃটিশ আমলে আইএ পাশ বিদুষী নারী। ফলে ওই সবের আলোকিত প্রতিচ্ছবি তার মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে।
আমি কেেলজে পড়াকালেও টুকটাক সাহিত্য চর্চ্চা করতাম। এ জন্য স্যার একটু ভিন্নভাবে আমাকে ডাকতেন ও ভালবাসতেন। তখন এমন পাকা পথ ও যান্ত্রিক যানবাহন ছিল না। আমাকে ¯েœহের টানে একবার পায়ে হেঁটে তিনি আশানবাড়ীতে আমাদের বাসায় গেলেন। আমার প্রথম মেয়ে রেবেকা সবে হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছে। তাকে দেখে আদর ¯েœহ করলেন।পরে আমার দু মেয়ে আমারই মতো তার ছাত্র ছিল। আমার জীবনে অনুরুপ ঘটনা আরেকটি ক্ষেত্রেও ঘটেছে। তাহল তাড়াশ পাইলট হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক তাড়াশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ ফজলুর রহমান সাহেবও আমার সহ আমার ছেলে মেয়ে ও নাতীর শিক্ষা গুরু। তাই ফজলুর রহমান ভাই ও আমিন উল আলম স্যারের কাছে আমাদের পরিবার চির ঋণ ও চির কৃতজ্ঞতায় বাধা পড়ে আছে – তা আমরা সর্বদাই শ্রদ্ধাভরে স্মরণে রাখি। তিনি যখন তাড়াশে আসেন তখনো ছিলেন অকৃতদার। পরে তিনি এখানকার পেঙ্গুয়ারী গ্রামে বিবাহ করে তাড়াশ সদরে বসতি স্থাপন করেন। তাড়াশ বাজারের গলির ভেতর দেখা হলে আমি আগে সালাম দিলেই তিনি জবাব দিয়ে জিঞ্জেস করতেন, রাজ্জাক কেমন আছো। রেবেকার খবর কী? অর্থাৎ আমার বড় মেয়ে ছিল তার খুবই প্রিয় অনুগত ছাত্রী। তাকে তিনি কখনো ভুলেননি।
তাড়াশ কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রথম দিককার দিনগুলি ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং। আমরাও স্যারদের সাথে গ্রামে গ্রামে ছাত্র সংগ্রহ , ধানসংগ্রহ ও দান সংগ্রহ করেছি। সেসব স্মৃতি অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও তৃপ্তির খোরাক এজন্য যে, এই কলেজটি আজ বহুদূর এগিয়ে গেছে। যদিও দু:খ শুধু নেতৃত্বের কোন্দলে এটা সরকারী হলো না। তবে ১৯৭৫ সনে বোধ করি কলেজের দুরাবস্থার কথা তুলে ধরে আমার সম্পাদিত “চলনবিল রত্ন” বইয়ে “স্মৃতির দর্পনে জনাব এম এ হামিদ” লেখার একজায়গায় তাড়াশ কলেজ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “আরও একবারের কথা- উনি তখন বগুড়া নরকারী আযিযুল হক কলেজে অধ্যাপক। তাড়াশ মহাবিদ্যারয়ের অবস্থা তখন অত্যন্ত শোচণীয়।ছাত্র নেই, অর্থ নেই এমনকি কলেজের মঞ্জুরী নেই।তাড়াশের প্রভাবশালী লোকজন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য চার জন তখন রানীতির ঘূর্ণাবর্তে দিশেহারা। আমি জনাব জনাব হামিদ সাহেবের শরণাপন্ন হলাম। তাড়াশের গণমানুষকে সংগঠিত করে কলেজের নতুন প্রাণ সঞ্চারের জন্য। সরকারী কলেজে অধ্যক্ষ পদে আসীন অবস্থায় অনেক কর্মভার ও দায়দায়িত্ব থাকা সত্বেও উনি আমার ডাকে সাড়া দিলেন।তাড়াশে এসে জনসভা করলেন।কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে সে সময়কার কলেজ এবং পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কেইই এগিয়ে এলন না। এমনকি কলেজ পরিচালনা কমিটির সদস্যদের কেউ কেউ মন্তব্য করলেন,“কলেজ ভেঙ্গে যাক, আমরা সঙ্গে নেই”। সে দিনের সভা শেষে জনাব হামিদ সাহেবের আশা ভঙ্গের বেদনায় মুর্চ্ছাহত মখায়বয়ব আজও আমার স্মরণপটে জল জল করছে। তাই এ অধ্যায় লেখা। উনি আমার বাসায় এলেন। দু’চোখ ভরা জল। হাত ধরে কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বেদনা জড়িত কণ্ঠে বললেন, “ প্রিন্সিপাল সাহেব, আমি অধ্যাপক হামিদ, জীবনে অনেক কাজ করেছি। কিন্তু দূর্ভাগ্য আপনার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। সে দিন উনার ঐ চোখের জল এক অভূতপূর্ব অনুভূতি আর ঐশী প্রেরণা আমাকে স্তব্ধবাক করে দিয়েছিল। অনেক কষ্টে আমি বললাম, স্যার, আপনাকে আমি অনেক দু:খ দিলাম। চিন্তা করবেন না। যতদিন কলেজে একটিমাত্র ছাত্র আছে ততদিন আমিও কলেজে আছি। ইনশআল্লাহ কলেজ হবে। সত্যি সত্যি একদিন উনার মুখে হাসি ফুটাতে সক্ষম হয়েছিলাম। পরে কেমন করে আমার এলাকা থেকে ছাত্র-ছাত্রী এনে কলেজ চালু করলাম। কলেজ পূন: মঞ্জুরী পেল, থাক সে সব কথা।” এ থেকে বুঝা যায় , তাড়াশ কলেজ বর্তমান পর্যায়ে আসার পেছনে তার অসামান্য অবদান কখনো ভোলার নয়।
পরিশেষে বলবো, শ্রদ্ধেয় আমিন উল আলম স্যার একজন আদর্শবান শিক্ষক ছিলেন যা এযুগে কম দেখা যায়। । তার ন¤্র, ভদ্র,বিনয়ী,গম্ভীর অথচ সরল, সহজ, সদালাপী,সততা ও নিষ্ঠতা এবং একই সাথে বাংলা-ইংরেজী সাহিত্যে জ্ঞান-প্রজ্ঞার বিশালতা নতুন প্রজম্মের জন্য সত্যি অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় বটে। এ যুগে তার মতো শিক্ষা গুরুর সন্ধান খুব বেশী পাওয়া যাবে না। তার নিবিড় সান্নিধ্য আমাকে তথা আমাদেরকে লেখালেখিতে, সমাজসেবায় তথা জ্ঞানার্জনে অনুপ্রেরণা উৎসাহ ও উজ্জীবিত করেছে। তার ব্যবহারে মুগ্ধ ও আপ্লুত হয় নি এমন কেউ মনে হয় বলতে পারবে না। এমন বিদগ্ধ জ্ঞানী ও সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ মানুষ আজকে সমাজে বেশী চোখে পড়ে না। তাকে হারানোর অভাব ও শুন্যতা আমাদের মাঝে অনুভূত হবে বহুদিন। তার স্মৃতি রক্ষার্থে তাড়াশ কলেজে কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভবনের বা স্থাপনার অথবা প্রবেশ গেটের নামকরণ করার প্রস্তাব রাখছি কলেজ কর্তৃপখ্ষের কাছে। সবশেষে এই মহান শিক্ষাবিদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।