মো. আত্হার হোসেন :
বঙ্গবন্ধুর জীবনটাই একটা খোলা বই। এই বইয়ের পাতায় পাতায় লেখা আছে ‘মানুষ মানুষের জন্য।’ আমাদের বড়ই সৌভাগ্য যে, তিনি তার জেলজীবনে ও বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে যেসব সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন তাদের কথা লিখে গেছেন তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে। সুসম্পাদিত বই দুটোতে কত দুঃখী মানুষের সন্ধানই না মেলে। সবার কথা এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে বলা মুশকিল। উদাহরণ হিসেবে শুধু একজন ‘লুদু’কেই বেছে নিলাম। আরও অনেকের কথা আকারে-ইঙ্গিতে এই লেখায় উঠে এসেছে। নাম না জানা এই অসাধারণ মানুষরাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আপনজন। সারাটা জীবন তিনি তাদের জন্যই উৎসর্গ করে গেছেন। নিজের পরিবার-পরিজনের কথা সেভাবে ভাবার সময়ই পাননি। জেলখানাই ছিল তার দ্বিতীয় বাড়ি। ‘১৯৫০ সালে যখন জেলেছিলাম তখন একজন কয়েদির সঙ্গে আলাপ হয়। নাম তার লুদু ওরফে লুৎফর রহমান। ঢাকা শহরের লুৎফর রহমান লেনে তার বাড়ি। আমি তাকে ১৯৫৪ সালে দেখে যাই, আবার যখন ১৯৫৮ সালে মার্শালল’ জারি হয় এবং আমাকে গ্রেপ্তার করে- জেলে এসে দেখি লুদু আছে।]
সে নিজেকে সবার চেয়ে সিনিয়র কয়েদি হিসেবে জাহির করত এবং দায়িত্ব পালন করত। জেলের সাধারণ আইন-কানুন তার কণ্ঠস্থ ছিল। কথায় কথায় আইন ঝাড়ত। তার মতের বিরুদ্ধে কিছু হলেই সে সুপার ও জেলার সাহেবের কাছে নালিশ করত। সে ‘বি-ক্লাস’ কয়েদি ছিল। সাধারণ কয়েদিরা তাকে ভয় করে চলত। কারণ সে খুব সাহসী, সহজে কাউকে মানত না। আমি যেখানে থাকতাম সেখানে সে পানি দিত ও ঝাড়– খাতায় কাজ করত। একজন জেল ওয়ার্ডার আমার ওখানে ডিউটি দিত। লোকটা অমায়িক ও ভদ্র, নাম তার কাদের মিয়া। সে লুদুকে বলত, ‘লুদু ভালো হও, আর চুরি করো না।’ আমি ঘরে বসে বই পড়তাম, তাদের কথা ভেসে ভেসে আমার কানে আসত। আমি তাদের আলাপ চুপচাপ করে শুনতাম। লুদুকে ডেকে বললাম, ‘লুদু তোমার জীবনের ঘটনাগুলো আমাকে বলবা।’ লুদু বলল, ‘হুজুর আমার জীবনের কথা নাই বা শুনলেন, বড় দুঃখের জীবন। প্রায় ২০ বছর আমার জেলখানাতে হয়েছে। ১৩ বছর বয়স থেকে চুরি ও পকেট মারতে শুরু করেছি। কেন যে করেছিলাম আজও তা জানি না। বোধহয় জীবনে আর শান্তি হবে না। চোর ও পকেটমারের জীবনে শান্তি হয় না।’ লুদু বলতে বলতে চোখের পানি ফেলছিল, বোধহয় অনেক দুঃখের কথা তার মনে ভেসে এসেছিল।’ (‘কারাগারের রোজনামচা’, পৃ. ৪৭-৪৮)। লুদুর জীবনের ঘটনাগুলো বঙ্গবন্ধু লিখে রেখেছেন। কেন তিনি এ কাজটি করেছেন, তার উত্তর তার মুখেই শোনা যাক- ‘একটা সামান্য চোরের জীবন আমি কেন লিখছি- এ প্রশ্ন অনেকেই আমাকে করতে পারেন। আমি লিখছি এর জীবনের ঘটনা থেকে পাওয়া যাবে আমাদের সমাজব্যবস্থার চিত্র। মনুষ্য চরিত্র সম্বন্ধে, যারা গভীরভাবে দেখতে চেষ্টা করেন, তারা বুঝতে পারবেন আমাদের সমাজের দুরাবস্থা এবং অব্যবস্থায় পড়েই মানুষ চোর, ডাকাত, পকেটমার হয়। আল্লাহ কোন মানুষকে চোর-ডাকাত করে সৃষ্টি করেন না। জন্মগ্রহণের সময় সব মানুষের দিল একভাবেই গড়া থাকে। বড়লোকের ছেলে ও গরিবের ছেলের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না, যেদিন জন্মগ্রহণ করে। আস্তে আস্তে এক একটা ব্যবস্থায় এক একজনের জীবন গড়ে ওঠে। বড়লোক বা অর্থশালীর ছেলেরা ভালো খায়, ভালো পরে, ভালো শিক্ষা পায়। আর গরিবের ছেলেরা জন্মের পর যে অবস্থা বা পরিবেশে বেড়ে ওঠে এবং যাদের সঙ্গে মেলামেশা করে, তাদের স্বভাব-চরিত্রই তারা পায়।’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৮)।
১৯৬৬ সালে জেলে এসে প্রায় নিয়মিতই ডায়েরি লিখেছেন বঙ্গবন্ধু। ওসব ডায়েরিতেও তার কর্মী, রাজনৈতিক সহকর্মী, মানিক মিয়াসহ সাংবাদিক ও আরও অনেকের কথা স্থান পেয়েছে। বিশেষ করে ৭ জুনের ধর্মঘটের পরের দিন (৮ জুন) তিনি তার ডায়েরিতে ঢালাওভাবে গ্রেপ্তার করা মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা এমন ভাষায় লিখেছেন যে, তাতেই প্রমাণিত হয় কতটা মানবিক ছিলেন তিনি। তার ভাষায়, “ভোরে উঠে শুনলাম সমস্ত রাতভর গ্রেপ্তার করে জেল ভরে দিয়েছে পুলিশ বাহিনী। সকালেও জেল অফিসে বহু লোক পড়ে রয়েছে। প্রায় তিনশত লোককে সকাল ৮টা পর্যন্ত আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৬ বৎসর বয়স থেকে ৫০ বৎসর বয়সের লোকও রয়েছে। কিছু কিছু ছেলে মা মা করে কাঁদছে। এরা দুধের বাচ্চা, খেতেও পারে না নিজে। সমস্ত দিন এদের কিছুই খাবার দেয় নাই। অনেকগুলি যুবক আহত অবস্থায় এসেছে। কারো পায়ে জখম, কারো কপাল কেটে গিয়েছে, কারো হাত ভাঙ্গা, এদের চিকিৎসা করা বা ঔষধ দেওয়ার কোনো দরকার মনে করে নাই কর্তৃপক্ষ। সাধারণ কয়েদি, যাদের মধ্যে অনেকেই মানুষ খুন করে অথবা ডাকাতি করে জেলে এসেছে তারাও দুঃখ করে বলে, এই দুধের বাচ্চাদের গ্রেপ্তার করে এনেছে। এরা রাতভর কেঁদেছে। ভালো করে খেতেও পারে নাই। এই সরকারের কাছ থেকে মানুষ কেমন করে বিচার আশা করে? মেটের পীড়াপীড়িতে নাস্তা খেতে বসেছিলাম। খেতে পারি নাই। দুপুরে ভাত খেতে বসেছি একই অবস্থা। কিছুতেই মনকে সান্ত¡না দিতে পারছি না। কেন মানুষ নিজের স্বার্থের জন্য পরের জীবন নিয়ে থাকে?
তবে এদের ত্যাগ বৃথা যাবে না। এই দেশের মানুষ তার ন্যায্য অধিকার আদায় করবার জন্য যখন জীবন দিতে শিখেছে তখন জয় হবেই, কেবল সময়সাপেক্ষ। যে রক্ত আজ আমার দেশের ভাইদের বুক থেকে বেরিয়ে ঢাকার পিচঢালা কালো রাস্তা লাল করল, সে রক্ত বৃথা যেতে পারে না। আল্লাহর কাছে এই কারাগারে বসে তাদের আত্মার শান্তির জন্য হাত তুলে মোনাজাত করলাম। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এদের মৃত্যু বৃথা যেতে দেব না, সংগ্রাম চালিয়ে যাব। সমস্ত দিন পাগলের মতোই ঘরে-বাইরে করতে লাগলাম। যদি কেহ বন্দি পশুপক্ষী দেখে থাকেন তারা অনুভব করতে পারবেন। শত শত লোককে গ্রেপ্তার করে আনছে। তাদের দুরাবস্থা চিন্তা করতে ভয় হয়। রাস্তায় যাকে পেয়েছে তাকেই গ্রেপ্তার করে নিয়ে এসেছে। খালি গা- কাপড় নাই, গোসল নাই, অনেকের মাথায় আঘাত। অনেকের পায়ে আঘাত, অনেকে হাঁটতে পারে না। জানালা দিয়ে চিৎকার দিয়ে বললাম, ‘জমাদার সাহেব এদের খাবার বন্দোবস্ত করে দিবেন। বোধহয় দুইদিন না খাওয়া।’ রাত কেটে গেল। একটু ঘুম আসে, আবার ঘুম ভেঙে যায়।” (ঐ, পৃ. ৭৪)
তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লে জানা যায়, গভীর মানবিকতার সঙ্গে দেশের দুঃখী মানুষের পাশে তিনি গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। দাঙ্গা-পরবর্তী আশ্রয় শিবিরে, নারায়ণগঞ্জে দাঙ্গা থামাতে, দুর্ভিক্ষের সময় লঙ্গরখানায়, নির্বাচনী প্রচার অভিযানে সাধারণ এক মায়ের কাছ থেকে এক গ¬াস দুধ খেয়ে তার হাত থেকে কৃতজ্ঞতায় অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে কয়েক আনা পয়সা নির্বাচনী খরচের জন্য গ্রহণ করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-কর্মচারীদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে সমর্থন দিতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘রাজটিকিট’ পাওয়া, আটচল্লিশের মার্চ মাসের ১১ তারিখে ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেলে যাওয়া এবং সর্বক্ষণ সাধারণ মানুষের কল্যাণের রাজনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই ছিল তার একমাত্র ধ্যান ও জ্ঞান। এ দীক্ষায় দীক্ষিত হয়েই সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিঁড়ে তিনি এক পর্যায়ে বাঙালির অকৃত্রিম বন্ধু বঙ্গবন্ধুতে রূপান্তরিত হন। বঙ্গবন্ধু হিসেবেই তিনি বাঙালির মুক্তির ডাক দেন। দেশ স্বাধীন করার সেই ডাকে প্রায় প্রতিটি বাঙালি সাড়া দেন এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অনেক রক্ত ঝরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করেন। জেলে বসেই তিনি আমাদের মহত্তম মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। তার যোগ্য সহনেতারা তার নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ সফলভাবে পরিচালনা করেন।
আর তাই ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি জাতির পিতা হিসেবেই মুক্ত বাংলাদেশে পদার্পণ করেন। দেশে ফিরেই দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। দিনরাত পরিশ্রম করে যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বদেশকে ফের সচল করেন। রাস্তাঘাট, রেল, বন্দর, শিল্প-কারখানা, প্রশাসন, ব্যাংক-বীমা আবার চালু করেন। কোটি খানেক শরণার্থীকে পুনর্বাসন করেন। খাদ্যাভাব মোকাবিলা করার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে নিজেকে পুরোপুরি নিবেদন করেন। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য স্বদেশের সংবিধান, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, বাজেট, শিক্ষানীতি, শিল্পনীতিসহ কত উদ্যোগই না গ্রহণ করেন। মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কত চেষ্টাই না তিনি করেছেন। দেশ গড়ার মহান ব্রত নিয়ে তিনি যখন নিঃশঙ্ক চিত্তে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই একদল দেশবিরোধী বিশ্বাসঘাতক আচমকা আক্রমণ করে তাকে শারীরিকভাবে তার প্রিয় দেশবাসীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এই আগস্টেরই এক কালরাতে। কিন্তু ‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে’ যে মহান নেতা এসে দাঁড়িয়েছিলেন জনতার মহামঞ্চে তাকে কি এত সহজেই নিঃশেষ করা যায়? তাই ‘বাংলাদেশের হৃদয়’সম বঙ্গবন্ধু রয়ে গেছেন আমাদের নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে। আছেন তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গেই। টুঙ্গিপাড়ায় শুয়ে থাকলেও আছেন তিনি ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়েই।
‘তুমি কেউ নও, বলে ওরা, কিন্তু বাংলাদেশের আড়াইশত নদী বলে, তুমি এই বাংলার নদী, বাংলার সবুজ প্রান্তর, তুমি এই চর্যাপদের গান, তুমি এই বাংলা অক্ষর, বলে ওরা, তুমি কেউ নও, কিন্তু তোমার পায়ের শব্দে নেচে ওঠে পদ্মার ইলিশ, তুমি কেউ নও, বলে ওরা, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান আর নজরুলের/বিদ্রোহী কবিতা বলে,/তুমি বাংলাদেশের হৃদয়।’
লেখকঃ অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, লেখক, সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।