তাড়াশে দলিল লেখক বাচ্চুর অবৈধ সম্পদের পাহাড় – তদন্তে দুদকের হস্তক্ষেপ কামনা এলাকাবাসীর

Spread the love

গোলাম মোস্তফা, বিশেষ প্রতিনিধিঃ কথিত দলিল লেখক ফেরদৌস হোসেন ওরফে বাচ্চু। সে এসএসসি পাশ না করে নিজেকে দলিল লেখক হিসেবে পরিচয় দেন সরকারি নীতিমালা বহিভর্‚তভাবে সবখানে। তার এ পরিচয় নিছক প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু সে তাড়াশ দলিল লেখক সমিতির নেতৃত্বের ভ‚মিকায় রয়েছেন ২০০০ সালে তাড়াশ দলিল লেখক সমিতি গঠিত হওয়ার পর থেকে। বাচ্চু দলিল লেখক সমিতির সভাপতি কামারুজ্জামানের খুব প্রিয়ভাজন একজন ব্যক্তি। তাড়াশে দলিল লেখক সমিতির গঠন হওয়ার পর থেকে দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে সভাপতির পদে আসীন রয়েছেন কামরুজ্জামান। এই সুবাদে বাচ্চু দলিল লেখক সমিতি থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। বাচ্চুর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন তাড়াশের দলিল লেখকরা।
এদিকে তাড়াশ দলিল লেখক সমিতির সভাপতি কামরুজ্জামান বলেন, ফেরদৌস হোসেন ওরফে বাচ্চু জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি পাশ করেছেন। বাচ্চু প্রতি বছর ১৫০ বিঘা জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেন। এ বছর সে ৭৫ বিঘা জমিতে সরিষার আবাদ করেছিল। বাড়িতে গিয়ে দেখে আসেন, বাচ্চু এ বছর কত টাকার সরিষা বেচবেন। কেউ পরিশ্রম করে এগিয়ে গেলে তাকে বাধা দেওয়া ঠিক না।
অপরদিকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, ফেরদৌস হোসেন ওরফে বাচ্চু অষ্টম শ্রেণি পাশ। বাচ্চু নিজেও সে কথা স্বীকার করেছেন। স্থানীয়রা বলেন, বাচ্চুর ১৬ বিঘা জমিতে তার ভাই বাবলু চাষ আবাদ করে দেন। তাছাড়া প্রতিবিঘা জমির ইজারা মূল্য ১২ হাজার টাকা। সে হিসাবে ১৫০ বিঘা জমির ইজারা মূল্য আসে ১৮ লাখ টাকা। এরপর বোরো আবাদে খরচ হয় বিঘা প্রতি আরো ১৪ হাজার টাকা। এ হিসাবে খরচ হয় ২১ লাখ টাকা। বাচ্চুর এত টাকার উৎস কী ? বাচ্চু বোরো ও সরিষার আবাদ করেন না। তার বাড়িতে সরিষা মজুত নেই। মূলত দলিল লেখক সমিতির দুর্নীতির টাকা ও গ্রামের মসজিদ-মাদ্রাসার টাকা আত্মসাৎ করে সে কোটিপতি বনে গেছেন। সরেজমিনে দেখা গেছে, বাচ্চুর গ্রামে মাগুড়া মুকুন্দ পাড়াতে টিনের চাল ও টিনের বেড়ার ১টি বাড়ি। সেখানে বাচ্চুর ভাই বাবলুসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা বসবাস করেন।
জানা গেছে, বাচ্চুর দাদী আমিনা বেওয়া তার ৩ ভাই কিসমত আলী, আজাহার উদ্দীন ও বরাত আলীর কাছ থেকে ওয়ারিশ হিসেবে ১৪ বিঘা জমি পান। কিন্তু বাচ্চুর বাবা প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা সাকোয়াত হোসেন বেঁচে থাকতেই অভাবে পড়ে সেই জমি বেচে দেন। এরপর তাদের কোন সম্পত্তি ছিল না। বাচ্চুর ভাই বাবলু গ্রামের লোকজনের ডিজেল চালিত শ্যালো মেশন মেরামত জীবিকা নির্বাহ করেন।
অপরদিকে বাচ্চু তার নিজ গ্রাম মাগুড়া বিনোদ ইউনিয়নের মাগুড়া মুকুন্দ পাড়া জামে মসজিদ ও মাদ্রাসার টাকার ক্যাশিয়ার পদ জোরপূর্বক ধরে রেখেছেন দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর যাবৎ। আগে এ ক্যাশিয়ারের পদ প্রতি দুই বছর অন্তর পরিবর্তন হয়ে আসছিল গ্রামের রীতি অনুযায়ি। কিন্তু বাচ্চু প্রভাব খাটিয়ে এ পদে রয়েছেন দীর্ঘদিন। এ গ্রামের মসজিদ ও মাদ্রাসা পুকুর ইজারা দিয়ে কোটি টাকার উপরে পাওয়া যায় প্রতিবছর। সেসব টাকার কোন হিসাব দেন না ক্যাশিয়ার ফেরদৌস হোসেন ওরফে বাচ্চু। বরং গ্রামের সাধারণ লোকজন মসজিদ-মাদ্রাসার টাকার হিসাব চাইতে গেলে তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে দমিয়ে রাখা হয়। বিশেষ করে হিসাব চাওয়া নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে মুকুন্দ পাড়ার জলিলের পরিবারে হত্যার উদ্দেশ্যে তান্ডব চালায়। জলিল ও তার সহোদর ভাই ছাইদুরের হাত-পা ভেঙে দেয়, মাথা ফাটিয়ে দেয়। পরে তাদের বাড়িতেই অবরুদ্ধ করে রাখেন বাচ্চু ও তার লোকজন।
দলিল লেখক সমিতির সভাপতি কামরুজ্জামানের দলিল লেখার কম্পিউটার অপারেটর ও তালম ইউনিয়নের চৌড়া গ্রামের আব্দুল খালেকের ছেলে টুকু বলেন, আমি মাস্টার্স পাশ। কিন্তু দলিল লেখার লাইসেন্স পাইনি এখনো। ২০১০ সাল থেকে লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রয়েছে। আমি একটি দলিল লিখে ২০০ টাকা পাই। কথিত দলিল লেখক বাচ্চুর সম্পর্কে বলেন, বাচ্চু এসএসসি পাশ নন। দলিল লেখক অফিসে তার কোন পদ পদবি নেই। নাম প্রকাশে না করার শর্তে বেশ কয়েকজন দলিল লেখক বলেন, সরকারি নিয়ম অনুযায়ি ফেরদৌস হোসেন ওরফে বাচ্চুর দলিল লেখক পরিচয় দেওয়া ডাহা মিথ্যে কথার সামিল। তার বাবা গাজি বীর মুক্তিযোদ্ধা সাকোয়াত হোসেন একজন দলিল লেখক ছিলেন। মূলত তিনি মারা যাওয়ার পর বাচ্চু দলিল লেখক সমিতির সভাপতি কামারুজ্জামানকে ম্যানেজ করে তার হয়ে নেতৃত্ব দিতে থাকেন দলিল লেখক অফিসে। কথিত দলিল লেখক ফেরদৌস হোসেন ওরফে বাচ্চুর বাড়ি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মাগুড়া বিনোদ ইউনিয়নের মাগুড়া মুকুন্দ পাড়াতে। তার পিতা গাজি বীর মুক্তিযোদ্ধা সাকোয়াত হোসেন।
জানা গেছে, মাগুড়া মুকুন্দ পাড়ার জামে মসজিদ ও মাগুড়া মুকুন্দ পাড়া মাদ্রাসার নামে রায় পুকুর, বড় পুকুর, ধোয়া পুকুর, চৈত্র্যা, বালা গাছা, দিঘা গাড়ি, হেচা গাড়ি, মুচার পুকুর, কোদাল ধাও, চৌকি ও ২টি গরমহলসহ ১২ টি পুকুর রয়েছে। এসব পুকুর থেকে বাৎসিক ১ কোটির বেশী ইজারার টাকা আসে।
অপরদিকে ফেরদৌস হোসেন ওরফে বাচ্চুর স্থাবর সম্পত্তির অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসে থলের বিড়াল। সে তাড়াশ পৌর শহরের খাঁন পাড়াতে খাঁনপাড়া জামে মসজিদের পাশে সেমি পাকা একটি বাড়ি কিনেছেন ১৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে। শহরের দক্ষিণ পাড়ায় জায়গা কিনেছেন ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার। শহরের কোনাই পাড়াতে জায়গা কিনে রেখেছেন আরো ১০ লাখ টাকার। তার নিজ গ্রামে জমি কিনেছেন ১০ বিঘার মত। বগুড়া শহরে প্লট কিনেছেন। তাছাড়া বগুড়া মালতিনগর তার শশুর বাড়ির এলাকাতে বাচ্চুর জায়গা কেনা রয়েছে। এসব জায়গা-জমি কিনতে তার নগদ গুণতে হয়েছে কোটি টাকার বেশী।
তাড়াশ পৌর শহরের ফলের দোকানদার আব্দুল মমিন বলেন, সারে ৩ শতক জায়গাতে গড়ে তোলা ৪টা বেড রুম ও ১টি ডাইনিং রুমসহ বাচ্চুর কাছে বাড়িটি বেচে দেই ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ১৯ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। বাচ্চু পরিবার নিয়ে সে বাড়িতেই থাকে। পৌর শহরের দক্ষিণ পাড়ার বাসিন্দা নবীর উদ্দীন বলেন, আমার কাছ থেকে শহরের দক্ষিণ পাড়ার ৬ শতক জায়গা কিনেছেন বাচ্চু ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ২০২৩ সালে। শহরের কোনাই পাড়ার বাসিন্দা মোজাম্মেল হক মাসুদ বলেন, আমার কাছ থেকে কোনাই পাড়াতে ৪ শতক জায়গা কিনে রেখেছেন ১০ লাখ টাকায় ২০২৯ সালে। এছাড়াও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাগুড়া গ্রামের মুকুন্দ পাড়ার অনেকে বলেন, বিগত তিন থেকে চার বছরে বাচ্চু গ্রামে জমি কিনেছেন ১০ বিঘার মত।
মাগুড়া মুকুন্দ পাড়ার জলিল নামে এক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, আগে দুই বছর পর পর মুকুন্দ পাড়া জামে মসজিদ ও মাদ্রাসার ক্যাশিয়ার পরিবর্তন করা হত গ্রামের সাধারণ লোকজনের মতামতের ভিত্তিতে। কিন্তু বাচ্চু প্রায় ১৭ বছর ধরে মসজিদ ও মাদ্রাসার টাকার লোভে ক্যাশিয়েরর দায়িত্ব ধরে রেখেছেন জোরপূর্বকভাবে। নির্যাতিত এ পরিবারটি আরো বলেন, মুকুন্দ পাড়া মসজিদ ও মাদ্রাসার কোটি কোটি টাকার হিসাব নিয়ে কেউ কথা বলেন না গ্রামের বাচ্চু বাহিনীর ভয়ে। আমাদের পরিবার থেকে হিসাব চাওয়ার কারণে আমাকে (জলিল) ও আমার ভাই ছাইদুরকে বাঁশের লাঠি সোঠা দিয়ে হাত-পা ভেঙে দেন। হাঁসুয়া দিয়ে মাথায় কোপায়ে গুরুতর জখম করেন। পরে আমাদের বাড়িতে অবরুদ্ধ করে রাখেন। সঠিক সময়ে জরুরি চিকিৎসা সেবাও নিতে পারি নি আমরা। ২০২২ সালের ফেব্রæয়ারি মাসের সেই বর্বরোচিত নির্যাতনের আতংক আমাদের এখনো কাটেনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাগুড়া গ্রামের মুকুন্দ পাড়ার একাধিক ব্যক্তি বলেন, মুকুন্দ পাড়াতে প্রায় ১২শ পরিবারের বসবাস। কিন্তু এ পাড়ায় কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। বাচ্চু গ্রামে বিদ্যালয় করার প্রতিশ্রæতি দিয়ে মসজিদ ও মাদ্রাসার ক্যাশ থেকে ২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে ঘুষ দেওয়ার কথা বলে। পরে তিনি সেই টাকায় ওমরা হজ¦ করে আসেন গত বছরে।
তারা আরো বলেন, বাচ্চু তার দুর্নীতি আড়াল করতে ইতোমধ্যে গ্রামের এতিম তিন কন্যার বিয়ে দিয়েছেন। এদের সবার বাল্য বিয়ে হয়েছে। বিয়েতে সামান্য টাকা খরচ করেন। কিন্তু এ কাজের প্রচার-প্রচারণায় নিজেকে একজন মানবিক মানুষ হিসেবে জাহির করে সরব রাখেন বাচ্চু। ঈদে সে ১২০ থেকে দেড় লক্ষাধিক টাকা মূল্যের গরু কোরবানী করেন। গ্রামের লোকজনের কাছে বলে বেড়ান “ আমি বড় গরু কোরবানী না করলে মুকুন্দ পাড়ার অসহায় ও গরীব-দুখী মানুষ গোস্ত খেতে পাবে কোথা থেকে।” কথিত দলিল লেখক ফেরদৌস হোসেন ওরফে বাচ্চু তার বিরুদ্ধে লেখালেখি না করার জন্য অনুরোধ জানান। তিনি নিজ মুখে তার স্বল্প পড়ালেখার কথা স্বীকার করেন। অন্যদিকে তাড়াশের সচেতন মহল মনে করছেন, কথিত দলিল লেখক ফেরদৌর হোসেন বাচ্চু ও তার প্রশ্রয় দাতাদের দুর্নীতির সঠিক তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তারা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা সাব-রেজিষ্টারের কার্যালয়ের সাব রেজ্রিষ্টার মো. হাসানুজ্জামান বলেন, ফেরদৌস হোসেন ওরফে বাচ্চুর বিরুদ্ধে অভিযোগ বিস্তর। কিন্তু একজন সাব রেজিষ্ট্রার হিসেবে আমি শুধু দলিল লেখক অফিসের অনিয়মের বিষয়গুলো দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করব।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD