মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং প্রতিবেদন নভেম্বর ২০২৩

Spread the love

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)

৩০ নভেম্বর, ২০২৩

সার সংক্ষেপ:

২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর রাজনৈতিক সংকট, হরতাল, অবরোধ, সহিংসতা, মামলা, গায়েবী মামলা, গণগ্রেফতার, সরকার বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি সংঘাতময় পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে যা জনজীবনে গভীর বিপর্য্যয়ের সৃষ্টি করেছে। একই সাথে ক্ষমতাশীন দলের রাস্তায় শক্তি প্রদর্শন কিংবা বিরোধী দল দমনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। পুলিশের অভিযান সত্ত্বেও সরকারি দলের নেতাদের প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিতে দেখা গেছে। ফলে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আচরণ পক্ষপাতদুষ্ট। জনমনে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি করেছে।

নতুনভাবে যোগ হয়েছে মুখোশ পরে গুপ্ত হামলার মতো ঘটনা। অত্যন্ত উদ্বেগজনক এ বিষয়টির বেশির ভাগ ঘটনা রাতে ও নির্জন রাস্তায় ঘটছে। মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাসে করে এসে মুখোশধারী ব্যক্তিরা আহত ও নিহতদের পিটিয়ে, কুপিয়ে, হাত-পায়ের রগ কেটে, গুলি চালিয়ে হত্যা ও গুরুতর জখম করছে। খবরের তথ্য অনুযায়ী গুপ্ত হামলার শিকার বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মী। ঘটনাগুলোকে বিচারবর্হিভূত কর্মকান্ড হিসেবেই গণ্য করা যায়। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভুমিকা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। সারা দেশকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়ার পরও অপরাধীরা কিভাবে এ ধরণের ঘটনা ঘটাচ্ছে। পুলিশ বলেছে, ঘটনায় মুখোশ বা হেলমেট পরিহিত হামলাকারীদের বিষয়ে তারা কিছুই জানে না। এম এস এফ এ সমস্ত ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার দাবী জানাচ্ছে।

অর্থনৈতিক নেতিবাচক প্রভাবের কারণে অনেক গার্মেন্ট কারখানা বন্ধের উপক্রম হয়। বেকারত্ব বাড়ার পাশাপাশি মালিকদের অনেক শ্রমিকেরা বেতন-ভাতা দিতে না পারায় দীর্ঘদিন বকেয়া পড়েছে। শ্রমিক ছাঁটাইও চলছে। এর মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকরা ন্যূনতম বেতন বৃদ্ধি ও বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। মজুরি নিয়ে পোশাকশ্রমিকদের অসন্তোষকে কোনোভাবেই অযৌক্তিক বলার সুযোগ থাকার কথা নেই। কিন্তু পোশাকশ্রমিকদের ন্যায্য আন্দোলন দমনে সরকার শ্রমিক বিক্ষোভের কারণ বিবেচনায় না নিয়ে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে শ্রমিক হতাহতের মত ঘটনা ঘটিয়েছে তা দুর্ভাগ্যজনক।

গ্রেফতার অভিযান চালাতে গিয়ে পলাতক বিরোধী দলের কর্মীদের বাড়ীতে না পেয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের ধরে নিয়ে যাওয়া, এমন কি পলাতক বাবাকে না পেয়ে মাকে ধরে নিয়ে শিশুসন্তানদের অসহায় অবস্থায় ফেলে দেওয়ার মত ন্যাক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছে।পাশাপাশি সারা মাস ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে নাগরিক ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের অপহরণ অব্যাহত রয়েছে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই চলেছে। পুলিশের আটকের ও নির্যাতনের ভয়ে আত্মরক্ষার জন্য পালাতে গিয়েও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে সাংবাদিকেরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত ও অবিরত হুমকির সম্মুখিন হচ্ছেন। অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার, সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে নাগরিকের মৃত্যু, সংখ্যালঘু নির্যাতন, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা, গণপিটুনির মত ঘটনা অব্যাহতভাবে ঘটেই চলেছে যা মানবাধিকারের চরম লংঘন। সামগ্রিক বিবেচনায় এমএসএফ মনে করে, অনির্দ্দিষ্ট ঘটনায় মামলা, হামলা ও গ্রেফতার মানবাধিকার লংঘনের সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত। দেশের নাগরিকদের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের লংঘন। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও আইনি পরিবেশ উন্নয়নে গণগ্রেফতার বন্ধ ও গায়েবি মামলাগুলি প্রত্যাহার করার পাশাপাশি সবধরনের সহিংসতা, বিশৃঙ্খলা ও ভীতিকর পরিবেশ বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ত্বরিত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য এমএসএফ জোর দাবি জানাচ্ছে। নীচের সরণীতে বিগত দুই মাসের মানবাধিকার লংঘনের তুলনামূলক পরিসংখ্যান তুলে ধরা হল।

 

অক্টোবর ও নভেম্বর মাসের তুলনামূলক পরিসংখ্যান

বিষয় ধরণ মোট ঘটনা অক্টোবর মোট ঘটনা নভেম্বর
রাজনৈতিক সহিংসতা মামলা ৩৭ ১০১ ৩৫ ১১৫
গ্রেফতার ২৫৩৮ ২৬৬৩
আহত ৩৪৩ ২৬০
নিহত
মুখোশ পরে গুপ্ত হামলা আহত ২০ ১৭
নিহত
আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক অপহরণ ও নিখোঁজ ১২ ১৬
আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হেফাজতে মৃত্যু
নির্যাতনে মৃত্যু
নির্যাতনে আহত
ধাওয়া খেয়ে মৃত্যু
ধাওয়া খেয়ে আহত
সংঘর্ষে মৃত্যু
কারা হেফাজত মৃত্যু ১৬ ১১
পোষাক শ্রমিক অসন্তোষ মামলা   ৪১
আসামীর সংখ্যা   ১৬৫০০
গ্রেফতার   ১১৯
আহত   ১০০+
নিহত  
সাংবাদিক নির্যাতন, হামলা, আহত, হুমকি ও হয়রানি ১১ ১৬ ১১ ১৬
ডিজিটাল/সাইবার নিরাপত্তা আইন মামলা
গ্রেফতার
আসামি
অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার ৩৯ ২৬
সীমান্ত পরিস্থিতি নিহত    
নির্যাতন/গুলিবিদ্ধ আহত
লাশ উদ্ধার
সংখ্যালঘু নির্যাতন    
নারী ও শিশু সহিংসতা ধর্ষণ ৩৫৮ ৫৯ ৩০৬ ৪৩
দলবেধে ধর্ষণ ১২
ধর্ষণ ও হত্যা
ধর্ষণ চেষ্টা ১৩ ১৮
যৌন নিপিড়ন ৩৩ ১৭
শারীরিক নির্যাতন ৮২ ৪৬
এসিড নিক্ষেপ
আত্মহত্যা ৫৯ ৬৯
হত্যা ৭৫ ৮২
বেআইনী মধ্যস্থতা
নবজাতক উদ্ধার
গণপিটুনি নিহত ১৬ ১১ ১৩
আহত ১০

 

বিস্তারিত

 

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী নভেম্বর, ২০২৩ সময়কালে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ মাসেও দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, নির্যাতন, তাদের পরিচয়ে অপহরণ, বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পাইকারী গ্রেফতার, গায়েবি মামলা, কারাদন্ড ও পুলিশি বলপ্রয়োগের ঘটনা বন্ধ হয় নাই বরং অনেক ক্ষেত্রে তা বেড়ে চলেছে। যেমন হরতাল ও অবরোধকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা বেড়েই চলেছে। প্রাপ্ত তথ্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ধর্ষণসহ নারী ও শিশুদের উপর সহিংসতার ঘটনা কিছুটা কমলেও তা উদ্বেগজনক। সাইবার ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে হুমকি, শারীরিক নির্যাতন ও হামলা তথা সাংবাদিকতা এবং মত প্রকাশের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার মত ঘটনা ক্রমাগত ঘটেই চলেছে। কারা-হেফাজতে মৃত্যু অব্যাহত রয়েছে, সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিংসতা ও সীমান্তে হতাহতের মতো ঘটনা বন্ধ হয়নি বরং উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের ঘটনার ধারাবহিকতা রয়েই গেছে। অপরদিকে গণপিটুনির মত আইন হাতে তুলে নেয়ার ঘটনা ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে। এর সাথে যোগ হয়েছে মুখোশধারীদের দ্বারা হত্যাকান্ডে। মানবাধিকার লংঘনের এই ঘটনাগুলো ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এমএসএফ এসব ঘটনা রোধে সরকারের নিষ্ক্রিয়তার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে।

 

রাজনৈতিক সহিংসতায় হতাহত, মামলা, গ্রেফতার, সাজা ও সমাবেশে বাধা

 

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠনের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি আদায়ে প্রধান বিরোধী দলসহ অধিকাংশ বিরোধী দল ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের আয়োজন করে। মহাসমাবেশ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটেছে। ঘটেছে সাংবাদিক লাঞ্ছনা, অগ্নিসংযোগ এবং প্রধানবিচারপতির বাসভবনে হামলার মত ন্যাক্কারজনক ঘটনা।

এই প্রেক্ষিতে  সরকার সম্ভাব্য সহিংসতা প্রতিরোধের দায়িত্ব পালনের কারণ দেখিয়ে প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে  বল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সহযোগী সংগঠনগুলোর তৎপরতা বাধাগ্রস্ত করে তোরে। ফলে বেড়ে যায় সহিংসতা, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা,  গায়েবি মামলায় অজ্ঞাতনামা হিসেবে বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিকে আসামি করা হচ্ছে, যার মুখ্য উদ্দেশ্য গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মী ও সংগঠকদের ভীত-সন্ত্রস্ত ও আতঙ্কের মধ্যে রাখা, যাতে তারা সভা-সমাবেশ করতে না পারে। এরপরও বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা-কর্মী গ্রেফতার করা হয়। এইসব কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে বিরোধী দলের রাজনীতি করার যে সাংবিধানিক অধিকার তা বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে,, ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে যা রাজনৈতিক অঙ্গনকে বিপন্ন করে তুলেছে। অন্যদিকে বিরোধী দল বিএনপিসহ সহযোগী সংগঠনগুলো হরতাল ও অবরোধের মত কর্মসূচী দিয়ে জন জীবনকে অতিষ্ট করে তুলেছে। বেড়েছে সহিংসতা, আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত অতিরিক্ত বল প্রয়োগ, তল্লাশী, চলাচলে বাধা সৃষ্টিতে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ সকল দলের কর্মসূচী পালনের জন্য উত্তপ্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে ওঠে। এম এস এফ সামগ্রিক পরিস্থিতির তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে এবং গনতন্ত্র ও রাজনৈতিক পরিবেশ উন্নয়নে সরকারের সক্রিয় ভূমিকা রেখে শাস্তি নিশ্চিত করার দাবী জানাচ্ছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী নভেম্বর মাসে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনগুলোর মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সারাদেশে হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী এবং সন্দেহভাজন সাধারন মানুষসহ ৩৫টি ঘটনায় গ্রেফতার ও আটক হয়েছেন ২৬৬৩ জন।

এর মধ্যে ঢাকায় গ্রেপ্তারের সংখ্যা ৯৩৬ জন এবং বাকি ১৭২৭ জন গ্রেফতার হয়েছেন দেশের অন্যান্য জেলা থেকে। এ মাসে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনগুলোর  রাজনৈতিক কর্মসূচী হরতাল , অবরোধকে  কেন্দ্র করে মামলা হয়েছে মোট ১১৫টি। ঢাকায় মামলা হয়েছে ৩৫ টি  এবং বাকি ৮০ টি মামলা হয়েছে অন্যান্য জেলাগুলোতে। ১১৫টি মামলার মধ্যে ৩টি মামলা করেছে বাস ও ট্রাকের মালিক, ১টি মামলা করেছেন একজন ট্রাক ড্রাইভার, ১টি মামলা রেল স্টেশন মাস্টার, ১টি মামলা করেছেন আতিকুর  রহমান নামের এক ব্যক্তি, ৭টি মামলা করেছেন আওয়ামী লীগের কর্মী, পুলিশ করেছেন ৬৫টি মামলা এবং বাকি ৩৭টি মামলার বাদীর পরিচয় গণমাধ্যমে জানা যায়নি।

এ ছাড়া এ মাসে ১৭টি রাজনৈতিক পুরানো মামলায় বিএনপির ২৮১ জন নেতা-কর্মীকে সাজা দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, পুলিশের ওপর হামলা, সরকারী কাজে বাধা, ককটেল বিস্ফোরণ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, অগ্নিসংযোগসহ নাশকতার অভিযোগে ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের রাজনৈতিক মামলায় এ সমস্ত সাজা হচ্ছে নেতাকর্মীর। উল্লেখ্য যে, এত দ্রুততার সাথে বিচারকাজ সম্পন্ন হচ্ছে যে,  দণ্ডপ্রাপ্তরা জীবিত না মৃত, গুম না মুক্ত, ঘটনাস্থলে ছিলেন কি-না, তা বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে রাজধানীর বংশালে পুলিশের ওপর হামলা ও দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়ার মামলায় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ৬২ নেতা-কর্মীকে ৪২ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ওই একই সময় বনানীর কামাল আতাতুর্ক রোডের প্রসাদ ট্রেড সেন্টারের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচির নামে রাস্তায় যানবাহন ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণের দায়ে দণ্ড দেওয়া হয়েছে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল আলিম নকিসহ আরও ১০ জনকে। এছাড়াও চার বছর আগে মৃত আবু তাহের দাইয়া নামের এক বিএনপি কর্মীকে আড়াই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। আদালত দণ্ড দিয়েছেন গুমের শিকার দুই ব্যক্তিকেও। দণ্ডপ্রাপ্তদের একজন ঢাকা মহানগর ৩৮ (বর্তমান ২৫) নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমন, তিনি ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ  এবং অন্যজন তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম জাকির। তিনি ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে নিখোঁজ।

এ ছাড়াও চলতি মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে ৪ জন নিহত ও ২৬০ জন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৩জন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এর কর্মী যাদের মধ্যে ২ জন অন্তদ্বন্দ ও ১ জনকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি ও জামাত এবং ১ জন বিএনপি কর্মীকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কর্মীরা হত্যা করেছে।

যশোর জেলা যুবদলের সহসভাপতি ও সদর উপজেলার আমদাবাদ ডিগ্রি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ কলেজশিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাহিত্য ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক আমিনুর রহমান মধুকে ২৯ অক্টোবর রাতে যশোর-নড়াইল মহাসড়কে দুটি বাস থেকে ককটেল, লাঠি ও পেট্রল জব্দের ঘটনার মামলা ও পরে হরতাল–অবরোধে নাশকতার আরও দুই মামলার আসামি হিসেবে ২ নভেম্বর গ্রেফতার করে পুলিশ।

উল্লেখ্য যে আমিনুর রহমান মধু ইতোপূর্বে বাইপাস সার্জারি করা হয়েছে, এরপরও হৃদরোগে আক্রান্ত সংকটপূর্ণ অবস্থায় আমিনুর রহমান মধুকে পুলিশ পাহরায় হাতে দড়ি প্যাঁচানো, দুই পায়ে ডান্ডাবেড়ি ও ডান হাতে হাতকড়া লাগানো অবস্থায় হাসপাতালের মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। স্বজনদের অভিযোগ তার সান্নিধ্যে যেতে দেয়নি পুলিশ। এমনকি সময়মতো ওষুধ সেবন পর্যন্ত করতে দেওয়া হয়নি।

এমএসএফ মনে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের এমন অবস্থায় একজন হৃদরোগে আক্রান্ত বন্দিকে পুলিশ পাহারায় হাতে দড়ি প্যাঁচানো ডান্ডাবেড়ি ও হাতকড়া পরিয়ে চিকিৎসার নামে হাসপাতালের মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া অত্যন্ত অমানবিক ও চরম মানবাধিকারের লংঘন।

মুখোশ পরে হামলা ও হতাহত

চলতি সময়ে অত্যন্ত উদ্বেগ-আতঙ্কের বিষয় ছিল হেলমেট ও মুখোশ পরে গুপ্ত হামলা ও হত্যার মতো ঘটনা। নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যখন সারা দেশে একটা নৈরাজ্য বিরাজ করছে ঠিক সে সময় এ ধরণের অনাকাঙ্খিত ঘটনাগুলো জনজীবনের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি অধিকতর প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানা যায়, গত ১৬ অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত অন্তত বিশটি হামলার ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে নাটোরে এগারটি, নওগাঁতে পাঁচটি, রাজশাহীতে তিনটি, পাবনাতে একটি হেলমেট পরা মুখোশধারীরা হামলা চালিয়ে ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করেন। এতে তিনজন নিহত ও ১৭ জন গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। আক্রান্তদের সবাই বিএনপি, জামায়াত বা ইসলামী সংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। হতাহতদের অন্তত সাতজন দল দুটির পদধারী নেতা। প্রায় প্রতিটি ঘটনায় হামলাকারীরা সাদা মাইক্রোবাস কিংবা মোটরসাইকেলে করে হেলমেট পরে আসে । হামলার সময় তাদের মুখে মুখোশ থাকে। প্রায় প্রতিটি ঘটনায় হামলাকারীরা হাত-পায়ে, বুকে-পিঠে কুপিয়েছে কিংবা পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দিয়েছে। আহতদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, তারা হামলাকারীদের কেউকে চিনতে পারেনি, পরবর্তীতে তাদেরকে আবারো এ ধরণের আচারণ করতে পারে এ ভয়ে তারা থানায় মামলা করতে পারেনি, যদিও এ ঘটনাগুলোতে এ পর্যন্ত ১২টি মামলা হয়েছে। মামলাগুলোর কোন অগ্রগতি নেই, পুলিশ বলেছে, ঘটনায় মুখোশ বা হেলমেট পরিহিত হামলাকারীদের বিষয়ে তারা কিছুই জানে না।

এ ছাড়াও মুখোশধারী সন্ত্রাসীরা চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলায় চারজন বিএনপি নেতার বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালায়। ঢাকা ও যশোরে বিএনপির দুই নেতার বাড়িতে ককটেল হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে।

এমএসএফ মনে করে, সরকার ঘোষনা দিয়ে বিরোধী দলীয় কর্মসূচি মোকাবিলায় সারা দেশে পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব ও বিজিবি সদস্যদের মোতায়েন করে নিশ্ছিদ্র এসব পাহারার ব্যবস্থা করেছে। তার মধ্যে এ রকম গুপ্ত হামলা ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে। এতে করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকায় নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুপ্ত হামলা ও সন্ত্রাসী দমনের চেয়ে বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দমনে বেশি ব্যস্ত থাকছে। হেলমেট ও মুখোশ পরে যারা গুপ্ত হামলা ও হত্যা চালাচ্ছে, তাদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে দ্রুত বিচারের সম্মুখীন করা জরুরী বলে এমএসএফ মনে করে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ/নিখোঁজ

 আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের নামে যে অপতৎপরতা চলছে তা অন্যায়, ক্ষমতার অপব্যবহার, মানবাধিকারের চরম লংঘন ও বিচারহীনতার ক্রমবর্ধমান অবক্ষয়ের চিত্র। এই উদ্বেগজনক ঘটনাসমূহ নাগরিক জীবনে চরম উৎকন্ঠার সৃষ্টি ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি ক্রমাগত আস্থাহীনতা সৃষ্টি করছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী নভেম্বর মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার অন্তত ১২টি ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। যার মধ্যে অপহ্নত হয়েছেন ১২ জন বিএনপির নেতাকর্মী, ১ জন গণঅধিকারের নেতা, ১ জন আওয়ামী লীগ কর্মী, ১ জন ইসলামী আন্দোলনের কর্মী ও ১ জন অজ্ঞাতনামা।

১ নভেম্বর খুলনা জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ আহমেদ আদল এবং কয়রা উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক সাব্বির আলম বাবুকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। একই দিনে কুষ্টিয়া জেলা বিএনপি’র সভাপতি সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমি, সহ-সভাপতি রেজা আহমেদ বাচ্চু মোল্লা ও সাধারণ সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিনকে তুলে নিয়ে যায় জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। ৮ নভেম্বর কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জকরিয়াকে

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD