শীতের শুরুতে অতিথি পাখির আগমন করতোয়া নদীতে

Spread the love

মোঃ আনোয়ার হোসেন সাগর: সিরাজগঞ্জের তাড়াশের শাহ শরীফ জিন্দানি (রহ.) পুণ্যভূমি নওগাঁর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদীটি পরিযায়ী বা অতিথি পাখির কলতানে মুখর হয়ে উঠেছে। শীত প্রধান দেশ থেকে নিরাপদ মনে করে পাখিরা প্রতিবছর এ নদীতে এসে আশ্রয় নেয়। শীতের মৌসুমে করতোয়া নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির আগমন ঘটে। আর ভোর থেকে রাত পর্যন্ত পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখর হয়ে ওঠে নদী অঞ্চল। আর প্রতিদিন সকাল-বিকেলে পাখির জলকেলির দৃশ্য দেখার জন্য নদীপাড়ে ভিড় করে মানুষ।
সরেজমিন দেখা যায়, করতোয়া নদীতে হাজার হাজার বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ভেসে বেড়াচ্ছে। নীলশির, লালশির, কালোহাঁস, বালিহাঁস, লেঞ্জাহাঁস, খুদে গাঙচিল, বক ও পানকৌড়ি পাখিগুলো দলে দলে পানিতে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। আহারের বিরতি দিয়ে পানকৌড়ি বসছে গাছের ডালে। দিনভর নদীতে খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে সাদা বক, ধূসর বক ও মাছরাঙা। মাঝে মধ্যে গাঙচিল নদীতে মাছ ধরার জন্য ছোঁ দিলে ঝাঁক বেঁধে উড়ে উঠছে পরিযায়ী পাখির দল। সব মিলিয়ে করতোয়া নদী এখন পাখিদের কলতানে মুখর।
জানা গেছে, করতোয়া নদীর বিস্তৃতি একসময় অনেক বড় ছিল। কালের বিবর্তনে এর দুই পারে বসতি গড়ে ওঠায় নদীটি সরু হয়ে গেছে। অপর দিকে পাশ দিয়ে মহাসড়ক, সড়ক ও বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের ফলে নদীটি আরও সংকুচিত হয়েও পড়েছে দিন দিন। এ প্রেক্ষাপটে জীববৈচিত্র ইতিমধ্যে হুমকির মুখে পড়েছে। পাখি হারাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়। কমছে অতিথি পাখির আনাগোনা। তারপরও প্রতিবছর শীত মৌসুমে এ নদীতে আসছে অতিথি পাখিসহ দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন পাখি।
তাড়াশ ডিগ্রি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মর্জিনা ইসলাম বলেন, পৃথিবীতে ১০ হাজারের বেশি প্রজাতির পাখি আছে। এদের মধ্যে প্রায় দুই হাজার প্রজাতি পরিযায়ী বা অতিথি পাখি। এরা নিজ দেশের তীব্র শীত থেকে বাঁচতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আসা-যাওয়া করে। সাইবেরিয়া, ইউরোপ, এশিয়া, হিমালয় থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখি নভেম্বর-ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে আমাদের দেশে আসে। শীত মৌসুম শেষ হলে আবার তারা পাড়ি জমায় নিজ নিজ দেশে। অতিথি পাখি শুধু প্রকৃতির শোভা বর্ধনশীল পাখিই নয় এটি পাখি প্রেমীদের মনের তৃষ্ণা মেটানোর এক অপরাপর মাধ্যম। এগুলো আমাদের দেশের সৌন্দর্য আর জীব বৈচিত্রের শোভাবর্ধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফুল ও শস্যেও ক্ষেতে পোকা মাকড় এবং ইঁদুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনে এরা। পোকামাকড় খেয়ে খেয়ে যেমন তাদের ক্ষুধা নিবারণ হয় ঠিক তেমনই আমাদের ক্ষেত খামারের জন্যও তা বেশ উপকার। অতিথি পাখিরা আমাদের দেশে এসে যেমন জলজ উদ্ভিদ খেয়ে ফেলে ঠিক তেমনি এতে আমাদের জলজ পরিবেশেরও ভারসাম্য রক্ষা হয়।
তিনি আরো বলেন, অতিথি পাখির মল জলাশয়ে মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে শীতে এই দেশের জলাশয়গুলো অতিথি পাখিদের আবাসস্থল হিসেবে বিবেচিত হলেও দিন দিন অতিথি পাখিদের আত্মীয়তা গ্রহণের চাহিদা কমে যাচ্ছে যার ফলে পর্যায়ক্রমে প্রতি শীতে অতিথি পাখিদের আগমনও কমে যাচ্ছে। এর মুখ্য কারণ পাখি শিকার। জলাশয় অঞ্চলের কিছু অসাধু মানুষ শীতে একটা পরিকল্পনা নিয়ে থাকে যে এবার শীতে তাকে গত বছরের চেয়ে বেশি পাখি শিকার করতে হবে। এই অসাধু মানুষগুলো নির্বিচারে অতিথি পাখি শিকার করে বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে। এরা জাল কিংবা সুতার ফাঁদ পেতে কিংবা ছররা গুলি দিয়ে পাখিদের নির্মমভাবে শিকার এবং হত্যা করে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুসারে অতিথি পাখি শিকার ও বিক্রি করার প্রতি এক নীতিমালায় দন্ডনীয় অপরাধ বলে উল্লেখ রয়েছে। তারপরও দেশের এই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অতিথি পাখি শিকারের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে মানব নামের হিংসুটে পাখি শিকারী প্রাণীরা। শুধু শিকারীর অত্যাচার হলে কিছুটা নিস্তার পেত তাদের হ্রাস পাওয়া থেকে। আরো বেশ কিছু কারণে অতিথি পাখিরা সংখ্যায় কমে যাচ্ছে। অতিথি পাখিদের আহারের বিচরণ ভূমি (নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়, বন-জঙ্গল) কমে যাচ্ছে। বন জঙ্গল উজাড় করে ফসলি জমি কিংবা বসত বাড়ি করায় পাখিরা অতিষ্ঠ হচ্ছে তাদের নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেতে। অপর দিকে কৃষক ফসলের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত পাওয়ার লক্ষ্যে ফসলী জমিতে কৃত্রিম সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করছে। যার কারণে অতিথি পাখিরা বিষে আক্রান্ত কীট পতঙ্গ খেয়ে মারা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আবহাওয়ার ভিত্তিতে শীতকালে ইট ভাটা চালু করায় এর মাত্রাতিরিক্ত শব্দ এবং বায়ু দূষণের ফলে অসংখ্য অতিথি পাখি এ দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে, এই সবুজের সমারহে ঘেরা সোনালী বাংলাদেশের জলবায়ুর ন্যায় অন্য এক দেশে। অথচ আমরা আজ বুঝি না এই অতিথি পাখির প্রতি কৃতজ্ঞতা। আসলে আমাদের দেশে সোনালী আভাস মাখা ফসল যখন ঘরে উঠে ঠিক তখনই দেশের রূপ ঐশ্বর্য পূর্ণ রাখতে অতিথি পাখি এসে হাজির হয়। কারণ শীতের সৌন্দর্যের অন্যতম প্রতীক অতিথি পাখি।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD