ইসলামের কল্যাণের বিষয়গুলো মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হলো তাবলিগ। হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত হলেও পৌঁছে দাও।’ (জামে তিরমিযি)। বিদায় হজের ভাষণে মহানবী (সা.)–এর সর্বশেষ বাক্য ছিল, ‘তোমরা যারা উপস্থিত রয়েছ তারা যেন অনুপস্থিতদের কাছে পৌঁছে দাও।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম)। দাওয়াত তাবলিগের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো সৎকাজে আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেধ করা।
বিজ্ঞ উলামায়ে কিরাম কোরআন ও হাদিসের আলোকে বলেন, দ্বীনি দাওয়াত, তাবলিগ, তালিম ও তারবিয়াতের কাজে সফলতার জন্য চারটি বিষয় থাকা জরুরি। এগুলো হলো: মোহব্বত, আজমাত, হিকমাত ও খিদমাত। অর্থাৎ দাওয়াত ও তাবলিগের ক্ষেত্রে প্রথমত ভালোবাসা ও দরদ থাকতে হবে; দ্বিতীয়ত সম্মানবোধ থাকতে হবে তথা বিনয়, নম্রতাসহকারে দাওয়াত দিতে হবে, তালিম ও তাবলিগের কাজ করতে হবে; তৃতীয়ত কৌশলী হতে হবে স্থান–কাল–পাত্র বুঝে দাওয়াত, তালিম ও তাবলিগ পেশ করতে হবে; চতুর্থত, দাওয়াত, তালিম ও তাবলিগের জন্য খেদমত বা সেবার পথ অবলম্বন করতে হবে।
সর্বোপরি দাওয়াত, তালিম ও তাবলিগের কাজে সব সময় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ ও লালন করতে হবে। কখনো নেতিবাচক চিন্তা মনে স্থান দেওয়া যাবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা আহ্বান করো তোমাদের রবের পথে, হিকমাহ এবং সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে।’ (সুরা-১৬ নাহল, আয়াত: ১২৫)।
দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে মননে চিন্তায় ও কর্মে উদার হতে হবে। সারা বিশ্বকে একই পরিবার ভাবতে হবে। পুরো মানবজাতি একই পরিবারের সদস্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের আবির্ভাব ঘটানো হয়েছে; তোমরা সৎকাজের
আদেশ করবে, অসৎ কাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহকে বিশ্বাস করবে।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১১০)।
কাউকে হেয় জ্ঞান করা যাবে না, কাউকে প্রতিপক্ষ ভাবা যাবে না। কারও প্রতি হিংসা–বিদ্বেষকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না এবং কাউকে অশ্রদ্ধা করা বা অসম্মান করা সমীচীন হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি এমন উত্তমভাবে মন্দের মোকাবিলা করবে, যাতে তোমার সঙ্গে যার শত্রুতা রয়েছে সে–ও প্রাণের বন্ধু হয়ে যায়।’ (সুরা-৪১ হামিম সাজদাহ, আয়াত: ৩৪)।
নিজের জ্ঞান–গরিমা, যোগ্যতা ও সামর্থ্যের ওপর আত্মতৃপ্ত হওয়া যাবে না। সদাসর্বদা আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে হবে। দাওয়াত ও তাবলিগের উদ্দিষ্টদের জন্য দোয়া করতে হবে এবং নিজের ভুলত্রুটি অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও অপারগতার জন্য প্রতিনিয়ত কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে শরমিন্দা থাকতে হবে ও ক্ষমা ভিক্ষা করতে হবে।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআন মাজিদে বলেছেন, ‘মহাকালের শপথ! মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা ক্ষতিগ্রস্ত নয়, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পর একে অন্যকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যধারণের পরামর্শ প্রদান করে।’ (সুরা-১০৩ আসর, আয়াত: ১-৩)।
নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবা যাবে না। আমি দ্বীনের যে কাজ করছি এটাকে একমাত্র দ্বীনি কাজ মনে করা যাবে না এবং এটাকে সর্বশ্রেষ্ঠ কাজও মনে করা যাবে না। এতে নিজেকে শ্রেষ্ঠ দাবি করা হয়। বরং দ্বীনি কাজকে ইমানি দায়িত্ব মনে করে নিজেকে দ্বীনের সামান্য খাদেম হিসেবে পেশ করতে হবে।
ধৈর্যধারণকারীর সাফল্য সুনিশ্চিত, কারণ আল্লাহ তাআলা ধৈর্যধারণকারীর সঙ্গে থাকেন, আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যার সঙ্গে থাকবেন, তার সফলতা অবধারিত। কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সহিত আছেন।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৫৩)।
এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে বলেন, ‘আমি তোমাদের কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধনসম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করব। তুমি শুভ সংবাদ দাও ধৈর্যশীলগণকে, যারা তাদের ওপর বিপদ আপতিত হলে বলে, “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” অর্থাৎ আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৫৫-১৫৭)। আজও আমরা বিপদ–আপদে পড়লে এই দোয়া পড়ি; কিন্তু এটি আমরা পড়ি অধৈর্য হয়ে পড়লে তখনই। মূলত আমরা এর দর্শন ভুলে গিয়ে এটিকে প্রথায় পরিণত করেছি।
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতের মূলনীতি ছিল এমন যে, ‘না তারা কোনো মূর্তিকে, না ক্রুশকে, না আগুনকে এবং না অন্য কোন কিছুকে প্রভু বলে স্বীকার করবে। বরং কেবল এক আল্লাহরই ইবাদত করব। আর এটাই ছিল প্রত্যেক নবির দাওয়াত।
রোম সম্রাটের প্রতি বিশ্বনবির চিঠি
কোরআনুল কারিমের এই নির্দেশ অনুযায়ী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে চিঠি পাঠান এবং চিঠির মাধ্যমে এই আয়াতের দাবী অনুযায়ী তাকে ইসলাম কবুল করার প্রতি আহবান জানান। দাওয়াতটি ছিল এমন-
فَأَسْلِمْ تَسْلَمْ، أَسلِمْ يُؤْتِكَ اللهُ أَجْرَكَ مَرَّتَيْنِ فَإِنْ تَوَلَّيْتَ فَإِنَّ عَلَيْكَ إِثْمَ الْأَرِيسِيِّينَ
‘ইসলাম কবুল করে নাও, নিরাপত্তা পাবে; মুসলিম হয়ে যাও, তাহলে মহান আল্লাহ তোমাকে দ্বিগুণ নেকি দেবেন। কিন্তু যদি তুমি ইসলাম স্বীকার না কর, তাহলে তোমার কতৃত্বাধীন প্রজাদের পাপও তোমার উপর পতিত হবে।’ (বুখারি)
কারণ, প্রজাদের ইসলাম স্বীকার না করার কারণই হবে তুমি। কোরআনুল কারিমের আলোচ্য আয়াতে তিনটি মৌলিক বিষয় উল্লিখিত হয়েছে। তাহলো-
১. কেবল আল্লাহরই ইবাদত করা;
২. তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক না করা এবং
৩. কাউকে শরিয়তের বিধান প্রণয়নের ইলাহি মর্যাদা না দেওয়া।
এটাই সেই ‘অভিন্ন বাক্য’ যার উপর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রতি আহলে-কিতাবদেরকে আহবান জানানো হয়েছিল। (আহসানুর বয়ান)
সুতরাং বর্তমান সময়েও এই শতধা-বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন উম্মতকে ঐক্যবদ্ধ করতে এ আয়াতে উল্লেখিত উক্ত তিনটি বিষয়কে এবং এই ‘অভিন্ন বাক্য’কে অধিকরূপে মূলনীতি ও বুনিয়াদ হিসাবে গ্রহণ করার বিকল্প নেই।
তাফসিরে জালালাইনের বর্ণনায়-
হে রাসুল! আপনি বলে দিন, হে আহলে কিতাব তথা আসমানি কিতাবের অনুসারি ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানরা, আস এমন কথার দিকে; যা আমাদের ও তোমাদের মাঝে একই রকম। একই সমান তার বিষয়সমূহ। তাহলো- আমরা আল্লাহ ব্যতিত কারও ইবাদত করি না, কোনো কিছুকেই তাঁর সঙ্গে শরিক করি না। তোমরা যেমন তোমাদের ধর্মের অভিজ্ঞ ও সন্ন্যাসীদেরকে ‘রব’ বলে মেনে নিয়েছ, তেমনি আমাদের কেউ আল্লাহ ব্যতিত অপর কাউকেও রব বলে গ্রহণ করে না। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। তাওহিদ তথা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী হওয়া থেকে বিমুখ হয় তবে তোমরা তাদের বল- তোমরা আমাদের ব্যাপারে এ কথার উপর সাক্ষী থাকা যে, আমরা আত্মসমার্পনকারী অর্থাৎ তাওহিদ তথা আল্লাহর একত্ববাদের অবলম্বনকারী।
ভিন্ন ধর্মে দাওয়াতের মূলনীতি
আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে দাওয়াত ও তাবলিগের মূলনীতি, পদ্ধতি কেমন হবে তা ঘোষণা করা হয়েছে। তাহলো- ‘আস! ওই বিষয়ের দিকে, যা আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান’। এ আয়াত থেকে তাবলিগ ও ধর্মের প্রতি কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলকে আহ্বান করার মূলনীতি জানা যায়। তাহলো এমন যে-
‘ভিন্ন মতের কাউকে ধর্মের প্রতি আহ্বান জানাতে হলে প্রথমে তাকে শুধু এমন বিষয়ের প্রতি আহ্বান জানানো উচিত, যে বিষয়ে উভয় পক্ষ একমত হতে পারেন।’
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কুরআনুল কারিমের নির্দেশনা অনুযায়ী ইসলামের দিকে আহ্বান করার তাওফিক দান করুন। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেখানো পদ্ধতিতে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে সম্পৃক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।