আবদুর রাজ্জাক রাজু
চারিদিকে যখন দুঃসংবাদ, নানা রকম খারাপ খবর; তখন এটা নিঃসন্দেহে স্বস্তির, সুসংবাদ, সুখবর। সেটা হল তাড়াশের সব না হলেও বেশ কিছু সাংবাদিকদের সমবেত হওয়া তথা মিলন মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। অতীতে কখনও এমনটি হয়েছে বলে মনে পড়ে না। সেই দৃষ্টিকোন থেকে এটা একটা ভাল উদ্যোগ, গঠনমূলক শুভ চিন্তা। নিশ্চয়ই স্বরণে রাখার মতো। তবে জিজ্ঞাসা জাগে- এখানকার বিভাজিত সংবাদসেবীদের প্রকৃত মিলন মেলা বা সত্যিকার মেলবন্ধন হবে কবে। আর তেমনটি হলে তা হবে ঐতিহাসিক, মাইলফলক বটে।
আমি ফেসবুকে তাদের নীল রংয়ের টি-শার্ট পড়া পোজ দেওয়া গ্রুপ ছবি ও নিউজ দেখে প্রথমে বিষয়টি জানতে পারি। তাড়াশের গণ মাধ্যমকর্মীরা গত শুক্রবার ২২ অক্টোবর এক সৌহার্দ্য সমাবেশে মিলিত হয়েছিলেন। স্থান ছিল নিমগাছির দীপশিখা প্রাঙ্গন। উল্লেখ, দিনভর সেখানে চলে স্মৃতিচারণ, আলোচনা, ও কুইজ প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। পরে তারা জয়সাগরসহ বিভিন্ন প্রাচীন স্থাপনা ঘুরে বেড়ান। অনুষ্ঠিত হয় সম্প্রীতির সমাবেশ। তাড়াশের সাংবাদিকতার অঙ্গনে এটা অনন্য দৃষ্টান্ত। কিছুটা হলেও এ বিরল দৃষ্টান্ত এক নতুন সূর্যোদয়ের হাতছানি। হয়তো কারো স্পন্শরশীপের বদান্যতায় আয়োজনটি হয়ে থাকবে। আর স্থানীয় সকল সাংবাদিক ওখানে না গেলেও চার সাংবাদিক সংগঠনের প্রায় অর্ধেক সাংবাদিক সেখানে যোগ দিয়েছেন, স্বার্থকতা সেখানে। তাসত্বেও এ মিলন মেলা ছিল এক অর্থে খন্ডিত, অপূর্ণ। সে জন্য তাড়াশের সাংবাদিকদের মধ্যে বিদ্যমান ব্যবধান কমাতে এর কোন ইতিবাচক ছায়াপাত ঘটবে কি না আগামী দিনগুলো তা বলে দেবে। তবে আমন্ত্রনের বাইরে থাকা সাংবাদিকদের মধ্যে এ কারণে সামান্য হলেও ক্ষোভ ও অভিমান জমতে পারে , অস্বাভাবিক নয়। চলমান অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতা বাড়াতে যা হালকা ইন্ধন যোগানোর হতে পারে নতুন উপাদান কিংবা ইন্ধন।
ফিরে যাই এক ঝলক অতীতে। সত্তুরের দশকে তাড়াশের সাংবাদিকতা শুরু হয় মাত্র গুটি কয়েক যুবকের হাতে। কিন্তুু এর পত্রপুষ্প প্রষ্ফুটিত হয় এবং ডালপালা বিস্তার লাভ করে অনেকখানি পার্শবর্তী গুরুদাসপুরে। সে ইতিহাস তাড়াশের নতুন প্রজম্মের সাংবাদিকদের সম্ভবত অজানা। ১৯৭৮ সালে গুরুদাসপুরে চলনবিল প্রেসক্লাবের গোড়াপত্তন হলে তাড়াশের সংবাদ ক্ষেত্রের তিন তারকা ওখানে যোগ দেন। সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুশীলনের সুত্রে পূর্ব থেকেই এদের সেখানে যাতায়াত ছিল। এরা হলেন রূহুল, সাজু ও রাজু। বিশেষত তাড়াশে লেখালেখির জগতে রাজু-সাজু দীর্ঘদিন জুটি হিসেবে স্থানীয় সমাজে পরিচিত ও প্রচলিত ছিল। রুহুল আমীন ছিলেন মেনটর বা গুরু শ্রেণির। পরবর্তীতে তাড়াশ প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮২ সালে। তাড়াশ-গুরুদাসপুর দুটো প্রেসক্লাবেই পূর্বে দ¦ন্দ্ব কলহ তেমনটি ছিল না। নব্বই দশকের শেষ দিক থেকে তাড়াশ প্রেসক্লাবে মতানৈক্য এবং বিভাজন দেখা দেয়। ২০০০ সালের পর হতে এই ফাটল এক ধরনের ভাঙনে রুপ নেয়।উদ্ভব ঘটে দল ও রাজনীতির প্রভাব-প্রতিপত্তির। এমনকি ক্রমান্বয়ে পেশী শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটে।
এই অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বিভক্তি চরম আকার ধারণ করলে এক পর্যায়ে তাড়াশ প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি সাংবাদিক মামুনের নেতৃত্বে ২০১২ সালে তাড়াশ রিপোর্টার্স ইউনিটি জম্ম লাভ করে। এমন কি তিনি তাড়াশ প্রেসক্লাবের অনিয়মের অভিযোগ এনে সিরাজগঞ্জ কোর্টে মামলা ঠুকে দেন। এর আরো পরে তাড়াশ প্রেসকøাবের আর একটা ছোট দলছুট অংশ সাংবাদিক-অসাংবাদিক সংমিশ্রনে প্রতিষ্ঠা করেন উপজেলা প্রেসক্লাব। এই ধারাবাহিকতায় আরো দেরিতে মাত্র বছর দুই আগে ৪র্থ সাংবাদিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০১৯এ আবির্ভাব ঘটে তাড়াশ মডেল প্রেস ক্লাবের। এমুহুর্তে মনে হয় সেটাও ভাঙনের মুখে। এতে আঞ্চলিকভাবে সাংবাদিকদের মধ্যে চরম অবনতির চিত্র প্রতিফলিত হয়। মূলত: তাড়াশ প্রেসক্লাবের দিগন্ত থেকে উল্কা ছিটকে পড়ার মতই বিভিন্ন সময়ে ক্লাব ছেড়ে আসা কলম সৈনিকেরা বিভিন্ন নামে তাদের কোটারি আবাস গড়ে তুলেছেন। ইতোমধ্যে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দেয়ার ফলে সমাজে তাদের পেশাগত মর্যাদা ও সম্মান ক্ষুন্ন হয়েছে। বিচ্ছিন্নতার কারণে তাদের শক্তি ও সংহতি হয়েছে দুর্বল থেকে দুর্বলতর। গ্রহণযোগ্যতা গয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ। তথাপি তারা গা’ করেননি। সমাজমানসের সমালোচনায় কান না দিয়ে, অনুতপ্ত- লজ্জিত না হয়ে অধিকন্ত দাপটের সাথে শীর উঁচু করে আত্মজাহিরি বজায় রেখে চলেছেন।তারা আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মসংশোধনের কোন চিন্তাও করেননি। এদের মধ্যে অতি অল্প সংখ্যক বাদে যেমনি আছে অপরিপক্ক-আনাড়ী সাংবাদিক তেমনি আছে তথাকথিত সাংবাদিকতার তকমাধারী আত্মস্বার্থপর ধান্দাবাজ সাংবাদিক।অনেকেই চামচাগীরি, তোষামেদ ও তেলমারা সাংবাদিকতায় নিয়োজিত। কারো না কারো মনোরঞ্জন ও কামাই তাদের লক্ষ্য। কারো বা এটাই প্রধান উপার্জনের খাত। যদিও সাংবাদিকতা কোন চাকুরী নয়। ঐতিহাসিকভাবে যুগ যুগ শোষনের যাঁতাকলে পিষ্ট এ কর্মে নিয়োগ নেই, বেতন নেই , পেশার নেই কোন স্বীকৃতি। সেজন্যই প্রতিবাদী ও আদর্শমন্ডিত সৎ সাংবাদিকতা বেমালুম অনুপস্থিত। আজকে আমাদের দেশ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে যে মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্বের অবক্ষয় বাসা বেধেছে, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নে সয়লাব গোটা জাতি; তার ঢেউ সাংবাদিকদের অঙ্গনেও লেগেছে সমান তালে। কেননা, তারা তো ভিন গ্রহের কোন বাসিন্দা নয়, এদেশেরই মানুষ। যদিও তাদের ¤্রােতের বিপরীতে চলার কথা ছিল।সকল অনৈতিকের বিরুদ্ধে তাদের কলম চালানোর অঙ্গীকার থাকবে-সেটাই জনগণের প্রত্যাশা। অপরদিকে তাড়াশে তাদের ক্লাবসমূহের কোনটাই, সুস্থ, সবল, প্রাণবন্ত এবং সক্রিয় নয়। প্রথমত ব্যবস্থাপনা সমস্যাগ্রস্থ, গঠনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক নিয়ম চর্চার বালাই নেই। সর্বোপরি নানামুখী স্বার্থের সংকীর্ণ কোন্দলে, দলাদলিতে প্রতিটি ক্লাবের পরিবেশ বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত। এ দৃশ্য আজ কমবেশী আমাদের জাতীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনা কোন প্রতিষ্ঠানকে বড় করতে পারে না। সেজন্য দরকার প্রাতিষ্ঠানিক পরিকল্পনা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, নিয়মকানুন। সুদুরপ্রসারী মুক্ত প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গী। অথচ এসব মহৎ গুণাবলীর প্রচন্ড অভাব রয়েছে তাড়াশের গ্রামীণ সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে। তার বড় প্রমাণ প্রায় ৪০ বছর বয়সী তাড়াশ প্রেস ক্লাব। যেখানে অবশেষে অর্থমুখি বাণিজ্যিকীকরণ মুখ্য লক্ষ্য হওয়ার দরুন গোটা ক্লাবের পরিবেশ ম্লান, নিস্প্রভ তথা এক কথায় ব্যাহত-বিনষ্ট হয়েছে – তা বললে অত্যুক্তি হবে না। এভাবেই আসল এবং নকল-ভেজালে মিশ্রিত সবগুলো ক্লাব। এ প্রসঙ্গে তাদের নিজেদের মধ্যেই গীবত চর্চা বেশী। কে ভাল কে মন্দ তা নিয়ে তারা নিজেরাই সোচ্চার, সরব সর্বক্ষণ। সাংবাদিকদের এক অপরের তথা পরস্পরের বিরুদ্ধে নিন্দা-কুৎসা ও বিষোদ্গার বহুল চর্চিত। এলাকায়ও এ ব্যাপারে গণগুঞ্জন ও আলোচনা-সমালোচনা কম নয়। তাড়াশে অধিক সংখ্যক সাংবাদিক সংস্থা ও সাংবাদিকতার অখ্যাতি, দুর্নাম সব মিলে এলাকার সাংবাদিকতার পরিবেশ বর্তমানে কলুষিত ও কলংকযুক্ত তা ওপেন সিক্রেট বিষয়ে পরিনত হয়েছে। তাদের নীতিহীন কর্মকীর্তির ফলে সাধারণ সমাজে তাদের মূল্যমানের ব্যারোমিটার জিরোতে নেমে এসেছে। এমনকি অতি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা পাল্টাপাল্টি নোংড়া ও অরুচিকর পোষ্ট-ষ্ট্যাটাস-কমেন্টস দিয়ে এলাকার বাতাস বিষাক্ত করে তুলেছে। এতে সাংবাদিক শ্রেণির মাথা সমাজে আরো নিচু হয়ে যাচ্ছে। জেলার মধ্যে এক্ষেত্রে তারা বোধ করি চ্যাম্পিয়ন তেমনটিই সর্বত্র শোনা যায়। এটা আমাদের সবার জন্য বড়ই পরিতাপের ও বেদনার বিষয়।
এমতাবস্থায় এই কালিমাপূর্ণ মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থেকে স্বচ্ছ এবং সতাদর্শের সাংবাদিকতায় ফেরার একমাত্র উপায় হতে পারে এলাকার সকল সাংবাদিকের সমন্বয়ে একটিমাত্র প্লাটফরম গড়ে তোলা। আর সেটা করতে হলে তাদেরকে সম্মিলিতভাবে একই মঞ্চে, এক ছাতার তলে একত্রিত, সমবেত হতে হবে সব মত, পথ ও অতীত গ্লানি ভুলে। বিচ্ছিন্নভাবে তৈরী ঘরগুলো ভেঙে দিয়ে একটি ঘরে তাদের টেকসই স্থায়ী নিবাস নিশ্চিত করতে হবে। সেটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। সেই মুক্ত এবং উদার মানসিকতা ক’জনের আছে। তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হল – বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধবে কে। না, দুশ্চিন্তার কারণ নেই। যারা একদা বিচ্ছিন্ন হয়ে এক একটা স্বতন্ত্র সাইনবোর্ডসহ আলাদা ভঙ্গুর দুর্গ স্থাপন করেছেন, একত্রীকরণের মহতী উদ্যোগও আসতে পারে তাদের মধ্য থেকেই। আবার বাইরের সতীর্থরাও সম্প্রীতি স্থাপনে এগিয়ে আসতে পারে। তবে ঐক্যবদ্ধ একক প্রেসক্লাব স্থাপনে সত্যকার ত্যাগ ও আন্তরিকতার দরকার, মুখের কথা বা কথার কথা নয়। শুধু প্রয়োজন ক্ষুদ্রতা, প্রতিহিংসা, হীনমন্যতা ও পরশ্রীকাতরতা ঝেড়ে ফেলে , আত্মস্বার্থপরতার উর্দ্ধে উঠে তাদের সামষ্টিক মঙ্গলের লক্ষ্যে ভবিষ্যত বিনির্মাণের দিকে দৃষ্টি দেয়া। যাতে আগামী প্রজম্ম তাদের নিন্দিত না করে, ধিক্কার না দিয়ে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। সেটা যত দ্রুত হয় সাংবাদিক সমাজের জন্য ততই কল্যাণকর। এছাড়া তাড়াশের সাংবাদিকতার প্রেক্ষাপটে যে সামাজিক অপবাদ ও ঘৃনার আবহ তৈরী হয়েছে তা দূর করার উপায় নেই।