মোঃ আবুল কালাম আজাদ ।।
[ এই লেখা ২০ শে আগষ্ট ২০২১ মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের ৩৫ তম মৃত্যু বার্ষিকীতে উৎসর্গীত ]
ভুমিকা :১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন।পলাশীর আ¤্রকানন। এখানেই বাংলার শেষ নবাব সিরাজ উদদৌলার পরাজয় ঘটে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে। যুগে যুগে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তথা বৃটিশ শাসন, শোষন,নির্যাতন আর অবিচারের ফলে দেখা দেয় বিদ্রোহের পর বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহগুলি হচ্ছে ১৭৬০ সালে সন্যাসী বিদ্রোহ,১৭৬৮ সালে সমশের গাজী বিদ্রোহ,১৭৬৯ সালে সন্দ্বিপ বিদ্রোহ,১৭৭৬-৮৭ সালে চাকমা বিদ্রোহ,১৮৩১ সালে ওহাবী আন্দোলন,১৮৩৭-৮২ সালে গারো বিদ্রোহ,১৮৩৮-১৯৪৮ সালে ফরায়েজী বিদ্রোহ, ১৮৫৫-৫৮ সালে সাঁওতাল বিদ্রোহ,১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ, ১৮৫৯-১৯৬১ সালে নীল বিদ্রোহ , ১৮৭২-৭৩ সালে সিরাজগঞ্জ বিদ্রোহ এবং ১৯২২ সালে সলঙ্গা বিদ্রোহ সংঘটিত হয়।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে স্বদেশী আন্দোলন, সন্ত্রসবাদী আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন, চট্রগ্রাম অস্ত্রগার লুন্ঠন এবং দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ শেষে ইতিহাসের ধারাবহিকতায় ভারতবর্ষ দ্বিখন্ডিত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামে দু’টি আলাদা রাষ্ট্র জন্ম নেয়।তিতুমির থেকে সূর্যসেন। মজনুশাহ থেকে শুরু করে সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম বিদ্রোহী সিপাহী মঙ্গল পান্ডে সবাই বাংলার। এই বাংলাদেশের।
বৃটিশ সম্রাজ্যবাদের শাসন-শোষন থেকে ভারত উপমহাদেশের মুক্তি,ভারত-পাকিস্তান আন্দোলন,পাকিস্তানের উপনিবেশিক স্বৈরাতান্ত্রিক শাসন ও বল্গাহীন শোষনের কবল থেকে বাংলাদেশের মহান ভাষা আন্দোলন , স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক জাতীয় নেতা মনিষী মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ। তিনি ছিলেন বৃটিশ স¤্রাজ্যবাদ বিরোধী ঐতিহাসিক রক্তাক্ত সলঙ্গা বিদ্রোহের মহা নায়ক, উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্র সেনানী,ঋন শালিশী আইন প্রনয়নের উদ্যোক্তা, ’৪৬ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপস্থাপক ও পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম প্রধান পুরধা। পাকিস্তানের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ও শোষনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী উচ্চ কন্ঠ,বাঙলা ভাষা আন্দোলনের আদর্শিক মহাপুরুষ।
উপরোল্লেখিত দীর্ঘকালীন ইতিহাসে গনমানুষের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক,শিক্ষা- সাংস্কৃতিক মুক্তির সংগ্রামে যাঁরা মহান নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন, জনগনমননন্দিত হয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন খেতাবে ভুষিত হয়েছিলেন- ‘মহাত্মা গান্ধী’মোহন দাস করমচাঁদ, ‘‘ কায়েদে আজম’ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ‘পন্ডিত’ জওয়াহের লাল নেহেরু, ‘স্যার’ সৈয়দ আমেদ, ‘দশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশ, ‘ নেতাজী’ সুভাষ চন্দ্র বসু, ‘শেরে বাঙলা’ এ কে ফজলুল হক, ‘ বিশ^ কবি- কবিগুরু’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ বিদ্রোহী কবি’ কাজী নজরুল ইসলাম, ‘মাস্টারদা’ সুর্যসেন, ‘মীমান্ত গান্ধী খান আব্দুল গাফ্ফার খান, ‘ কাশ্মীর শার্দুল’ শেখ মোহম্মদ আব্দুল্লাহ,‘গনতন্ত্রের মানষপুত্র’ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এবং ‘বঙ্গবন্ধু’শেখ মুজিবুর রহমান।
এমনি একজন ঐতিহাসিক খেতাবধারী ছিলেন মাওলানা আব্দুর রশীদ । তাঁর খেতাব ছিল- ‘তর্কবাগীশ ’ ও ‘শেরে বাবুর’। বৃটিশ সম্রাজ্যবাদ বিরোধী ঐতিহাসিক ‘সলঙ্গা’ রক্তাক্ত বিদ্রোহের মহানয়ক মাওলানা তর্কবাগীশের বিপ্লবী কর্মোদ্দীপনার ইতিহাস এবং কুখ্যাত জমিদার -মহাজনদের সীমাহীন অত্যাচার শোষনে জর্জরিত বাংলার রায়ত-খাতক তথা কৃষক প্রঝাসাধারনের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে ঐতিহাসিক ‘ঋনশালিশী আইন’ প্রনয়নের দাবী উত্থাপন করে তা বাস্তবাযনের লক্ষ্যে তাঁর আপোষহীন কর্মতৎপরতায় মুগ্ধ হয়ে স্বয়ং মহাত্মাগান্ধী ১৯৪২ সালে তাঁকে ‘ শেরে বাবুর’ খেতাবে ভুষিত করেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকেও ‘ কায়েদে আজম’ খেতাবটি মহাত্মা গান্ধীজীই প্রদান করেছিলেন।
প্রথমপর্ব :- শুভ জন্ম কথা :উপমহাদেশে স্বাধীনতার ইতিহাসে সলঙ্গা বিদ্রোহ একটি হিরন্ময় অধ্যায়ের সংযোগ ঘটিয়েছে । সল্গংা বিদ্রোহের বাস্তব গুরুত্ব এবং মর্যাদা এত বিশাল এবং গভীর যা কারো মুল্যায়ন করার অপেক্ষা রাখেনা । চলনবিল অঞ্চল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক যুক্ত বাংলার সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই শীর্ষ স্থানে অবস্থান করছে ্ ব্রিটিশ বিরোধী, পল বিরোধী, কৃষক বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ, মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সিংহপুরুষ চলনবিল অঞ্চলের স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রানের দ্রোহের এক ভাস্বর ইতিহাস হয়ে আছেন চলনবিলের প্রানপুরুষ এক ক্ষনজন্মা বাগ্মী বিপ্লবী প্রতিবাদী কন্ঠস্বর মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ । যার শিশুকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শিক্ষা, সামাজিক, রাজনৈতিক,ধর্মীয় কর্মময় জীবনের ইতিহাস লিখতে গেলে পাতার পর পাতা লিখলেও লেখার সাধ অপুর্ন থেকেই যাবে ।তবুও এই ক্ষুদ্র জ্ঞান ও বিভিন্ন রেফারেন্স ঘেঁটে তথ্যভান্ডারে যা পেয়েছি তাই সম্বল করে পাঠকদের সামনে চলনবিলের মহান ঐতিহাসিক ব্যাক্তিত্ব মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের কর্মজীবনের কিছু ছিটেফোটা তুলেধরছি ।
মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রানপুরুষ আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের অনবদ্য অবদান নিঃসন্দেহে জাতির চেতনা বিকাশের এব গৌরবোজ্জল অধ্যায় । তদানিন্তন পুর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের অভ্যন্তরে তাঁর বলিষ্ঠ ভ’মিকার মধ্যদিয়ে মাতৃভাষা আন্দোলন যৌক্তিক পরিনতি লাভ করে। মাতৃভাষার মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মাওলানা তর্কবাগীশের মহিমান্বিত অবদান সত্যি অতুলনীয় । কেননা ভাষা আন্দোলনের তাঁর সেই বীরত্বগাঁথা ভুমিকার ফলেই জাতীয় জীবনে সুচিত হয় মুক্ত স্বাধীন চেতনার চরম বিস্ফোরন । আর ১৯৭১ এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ তারই চুড়ান্ত ফসল ।
মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ১৯০০ সালের ২৭ নভেম্বর, বাংলা ১৩০৭ সালের ১১ অগ্রায়হন বাংরাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলার চলনবিলের উল্লাপাড়া উপজেলার তারুটিয়া গ্রামের এক প্রখ্যাত পীর পরিবারে জন্মগ্রহন করেন । তারুটিয়াকে পরবর্তীতে তারই নামানুসারে‘ রশীদাবাদ’ নামকরন করা হয়েছে । তাঁর পিতার নাম হযরত মাওলানা আবু ইসহাক (রঃ) । তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত বুজুর্গ আলেম । ‘পীরবাবা ’ নামে ছিল তঁর ব্যাপক খ্যাতি । মাতার নাম বেগম আজিজুন্নেছা । মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের পুর্বপুরুষ সৈয়দ শাহ্ দেওয়ান মাহমুদ ( বড়পীর হযবত আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ)র বংশধর ) ১৩০৩ সালে স¤্রাট আলাউদ্দিন খিলজীর রাজত্বকালে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাগদাদ থেকে বাংলাদেশে আগমন করেন । মাওলানা তর্কবগীশ ১২ বছর বয়সে পিতৃহারা হন । অভিভাকহীন হয়েও তিনি লেখাপড়ায় কখনো অমনোযোগী হননি । বরং লেখাপড়ার সাথে সাথে তিনি বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপ ও অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান ।
ঐতিহ্যবাহী রক্ষনশীল পরিবারের সকল বাধাকে উপেক্ষা করে চিরশোষিত হিন্দু-মুসলমান সাধারন মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে মাত্র ১৪ বছর বয়সে তাঁর সংগ্রামী জীবন শুরু হয়েছিল। ১৯১৪ সাল । মাওলানা আব্দুর রশীদ তখন বগুড়া জেলার শেরপুর ডায়মন্ড জুবলী ইংলিশ হাইস্কুলের ৭ম শ্রেনির মেধাবী ছাত্র । সর্বস্তরের কৃষক-শ্রমিকের প্রতি স্থানীয় দোর্দন্ড প্রতাপশালী জমিদারের অত্যাচার নির্যাতনের প্রতিবাদে তিনি শেরপুরের নিগৃহীত দুধবিক্রেতা আর কৃষকদের সংগঠিত করে আন্দোলনের ঝড় তুলে জমিদারের নির্যাতন থেকে অত্যাচরিত মানুষের সাময়িক হলেও মুক্তির প্রেরনা দেখান । সেই সংগ্রামই ছিল তাঁর আজীবনব্যাপী অনির্বান ।সমাজের অত্যাচার নোংরামী আর পৈশাচিকতাকে উৎপাটনের সংকল্পে অনমনীয় হয়ে উঠলো তাঁর মন-প্রান ।
১৯১৫ সালে চির বিদ্রোহী আব্দুর রশীদ অসাধারন সাংগঠনিক ক্ষমতা ও অসম সাহসিকতার সাথে অনাচারের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলে শেরপুরের কেলাকুশি মেলা থেকে দুইটি পতিতালয় উচ্ছেদ করেন । তঁরই প্রচেষ্টায় দেহ ব্যবসা দুইটি উৎপাটিত হওয়ায় সমগ্র অঞ্চলে তাঁর নামে প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি হয় । এসময় আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ তৎকালীন বাঙালী মুসলমান সমাজের মুসলিম পূনর্জাগরনের নকিব অন্যতম বিখ্যাত বাগ্মী নেতা রেনেসাঁ কবি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর সহযোগী হিসেবে তিনি সমাজসেবা মূলক প্রতিষ্ঠান‘ খাদেমুল ইসলাম’ নামক সংগঠনে যোগ দেন । সারা বাংলায় সন্ত্রসবাদী আন্দোলন ছিল সম্পুর্ন গোপন রাজনৈতিক দল । মাওলানা তর্কবাগীশ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর অনুপ্রেরনায় এই বিপ্লবী দলে যোগ দেন ।
১৯১৯ সালে অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে তিনি যোগ দেন । আন্দোলনের কারনে তাঁর এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেওয়া হলোনা । সেসময় খেলাফত আন্দোলন আর অসহযোগ আন্দোলন একই সাথে চলছিল । তরুন টগবগে যুবক মাওলানা তর্কবাগীশ বৃটিশের কবল থেকে বারতীয় উপমহাদেমের মানুষের সার্বিক মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন । অহিংস মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে বিদেশী পন্য বর্জনের আন্দোলন সর্বত্র ব্যাপক সাড়া জাগায় । তিনি আপন প্রতিভা বলে এবং সাংগঠনিক শক্তিবলে সিরাজগঞ্জ কংগ্রেসের স্বেচ্ছসেবক বাহিনীর সুপারিনটেন্ডেন্ট এবং মহকুমা কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারী নির্বাচীত হন ।
ঐতিহাসিক সলঙ্গা বিদ্রোহের মহানায়ক ঃ
১৯২২সালের ২৭ জানুয়ারী শুক্রবার সলংগা হাটের দিন উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে সলংগা হত্যাকান্ডের ঘটনা যেমন সবচেয়ে নৃশংস ও পাশবিক, তেমনি নিহত – আহতের সংখ্যা সর্বাধিক । বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সলংগা হত্যাকান্ডের তথ্যাবলী জানা একান্ত প্রয়োজন । সলংগা বিদ্রোহের মূল নায়ক ছিলেন চলনবিলের বাগ্মীনেতা মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ।
সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার সলঙ্গা হাট ছিল অত্র এলাকার বিখ্যাত হাট । ১৯২২সাল, তখন মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে চলছিল অসহযোগ এবং বিলেতী পন্য বর্জন অভিযান। ২৭ জানুয়ারী শুক্রবার সলঙ্গার হাট খুব জমজমাট অবস্থানে থাকার প্রক্কালে তর্কবাগীশ তিন শতাধিক স্বেচ্ছসেবক কর্মীবাহিনী নিয়ে‘ বিলেতী দ্রব্য বর্জন কর, এ দেশ থেকে বৃটিশ খেদাও’শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত করেন । সলঙ্গার মাটিতে যখন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে , ঠিক তখনই এই আন্দোলন রুখতে ছুটে আসে পাবনা জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মি. আর এন সাহা, পাবনার পুলিশ সুপার এবং সিরাজগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক মি. এস কে সিনহা ৪০ জন স্বশস্ত্র পুলিশ নিয়ে সলঙ্গা হাটে উপস্থিত হয়ে কংগ্রেস অফিস থেকে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকে গ্রেফতার করে। পুলিশ সুপার তা্রঁ উপর বর্বরোচিত নির্যাতন করে। নির্যাতনে তর্কবাগীশের নাক, কান ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসে। দেহের নানা স্থানে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে সলঙ্গার মাটি রক্তে ভিজে যায় । ।সঙ্গে সঙ্গে হাটের জনতার মধ্যে অগ্নীস্ফুলীঙের ন্যায় বারুদ জ্বলে উঠে । বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের প্রিয় নেতা মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকে ছারিয়ে নিতে পুলিশ সুপার, ম্যাজিষ্ট্রেট এবং মহকুমা প্রশাসককে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে ঘিরে ধরে । উত্তেজিত জনতার ঢল আর আক্রোশ থেেেক বাঁচার জন্য জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ম্যাজিষ্ট্রেট পুলিশকে গুলি চালাতে নির্দেশ দেন । নির্দেশ পেয়ে পুলিশ সাথে সাথে ৩৯ টি রাইফের থেকে উত্তেজিত জনতার উপর নির্মমভাবে গুলি চালালে হাটে আসা বহু নিরিহ লোক নিহত এবং আহত হয় । যার প্রকৃত কোন হিসাব কেউ দিতে পারেনাই । সরকারী হিসেবে ৩৭৯ জন কিন্তু বেসরকারী হিসেবে ১৫-২০ হাজারেরও অধিক বলে কথিত আছে।সিরাজগঞ্জ শহরের উপকন্ঠে রহমতগঞ্জে একটা গনকবর আছে। এই গনকবরে কতজন মানুষকে কবর দেওয়া হযেছিল আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারে নাই । এই ঘটনার পর উপস্থিত হাটের আপামোর জনতা মুহর্তে তীর- ধনুক , লাঠি, ফালা, সড়কি, টেটা, কোচ, বল্লম সহ যে যা হাতের কাছে পেয়েছে তাই নিয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে গগনবিদারী শ্লোগান দিয়ে পুলিশের দলটিকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরে পুলিশের ওপর চরাও হয়ে অস্ত্র কেড়ে নেয় । রাইফেল চালানোর অভিজ্ঞতা না থাকায় ছিনিয়ে নেওয়া রাইফেলগুলি স্থানীয় ফুলজোর নদীতে ফেলে দেয় । জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তৎক্ষনাৎ মাওলানা তর্কবাগীশকে ছেড়ে দিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন ।তাঁকে জীবিত দেখতে পেয়েই হাজার হাজার জনতা প্রচন্ড উল্লাস ধ্বনীতে মুখরিত হয়ে উঠে ।অতঃপর উত্তেজিত বিক্ষুব্দ জনতাকে শান্ত থাকা ও ধৈর্য্য ধারনের জন্য মাওলান সাহব তাঁর স্বভাবসুলভ বাগ্মিতা দিয়ে আহবান জানালে মুহুর্তে শান্ত হয়ে যায় । বৃটিশ বাহিনীর এই গনহত্যার খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে খেলাফত আন্দোলন এবং কংগ্রেসের বহু নেতা-কর্মী , মেডিক্যাল টিম, সাংবাদিক এবং স্বেচ্ছাসেবক টিম ঘটনাস্থলে যান । স্বেচ্ছসেবকেরা বহু আহতকে সিরাজগঞ্জ বা আশেপাশে চিৎিসা করার উপায় না দেখে কোলকাতায় নিয়ে যায়। ঘটনার ভয়াবহতার বিবরন দিয়ে সাংবাদিকরা বিষÍারিত খবর পাঠালে দেশ- বিদেশের সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে খবর ছাপা হলে চারিদিক থেকে তদন্তের জোড় দাবী উঠে । যদিও দাবির প্রেক্ষিতে তদন্ত হলেও তদন্তের রিপোর্ট আজও বিস্তারিত ও নিরপেক্ষভাবে জনসমক্ষে প্রকাশ পায়নি। পরবর্তীতে এবছরই বৃটিশ বাহীনি এই বাগ্মী চলনবিলের গনমানুষের নেতা মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকে গ্রেফতার করে। ১৯২৩ সালের শেষের দিকে প্রায় এক বছর পর তিনি জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন ।
উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে রক্তাক্ত সলঙ্গা বিদ্রোহ তিনটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। কিন্তু বৃটিশ-ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পুর্ববাঙলার তীর্থভুমি সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা বিদ্রোহের রক্তাক্ত ইতিহাস আজো লেখা হয়নি।
প্রথমতঃ এদেশের মাটিতে স¦াধীনতা সংগ্রামীদের গনকবর রচিত হয়। দ্বীতিয়তঃ সিপাহী বিদ্রোহের পরে এই বিদ্রোহে সর্বাধিক পরিমান স্বধীনতাকামী বুকের তাজা রক্ত দিয়ে গর্বিত শহীদ হন । তৃতীয়তঃ অসহযোগ আন্দোলনের মূলমন্ত্র অহিংসার এক অসামান্য ত্যাগ স্বীকার উপমহাদেশের একমাত্র সলঙ্গাতেই রক্ষা করা হয়েছে ।
মুক্তির পর তিনি জেলের বাইরে এসে দেখলেন যে অসহযোগ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গেছে । এবার তিনি লেখাপড়ার দিকে ঝুঁকলেন ।
২য় পর্ব ঃ ( ‘ তর্কবাগীশ খেতাবে ভুষিত’)
১৯২২ সালে ২৭শে জানুয়ারী শুক্রবার সলঙ্গা বিদ্রোহে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ পুলিশ সুপারের নির্মম নির্যাতনে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন । সাথে সাথে তর্কবাগীশ মারা গেছেন মর্মে খবর ছড়িয়ে পড়ে । যুবক তর্কবাগীশের দাদা ও পিতার মুরিদ এবং জনতা একত্রিত হয়ে পুলিশ, মহকুমা প্রশাসক, ্এসপি ্এবং ম্যাজিষ্ট্রেটদের ওপর চরাও হয়ে রাইফেল কেড়ে নিয়ে ফুলজোড় নদীতে ফেলে দেয় । অবস্থা বেগতিক দেখে তারা মাওলানাকে আত্মরক্ষার কাজে ব্যবহার করে । তারা তর্কবাগীশকে ছেড়ে দিয়ে মারমুখী জনতার কবল থেকে রক্ষার জন্য আবেদন জানায় ।অহিংস নেতা মাওলানা তর্কবাগীশ সেদিন অহিংস আন্দোলনের নেতা হিসেবে জনতার কবল থেকে বৃটিশের এসপি, ম্যাজিষ্ট্রেট, মহকুমা প্রশাসক , পুলিশসহ সকলের প্রনরক্ষার বিরাট ভ’মিকা রেখেছিলেন । তা নাহলে ঘটনা আরো ভয়ঙ্কর হতে পারতো । বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের উপমহাদেশের ইতিহাসে সলঙ্গার ভয়াবহ ঘটনার সাথে তুলনা করা হয় ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল জালিয়ান বাগের হত্যাকান্ডের ।ঐ হত্যাকান্ডের নিহতের সংখ্যা সরকাররি হিসেবে ৩৭৯ জন কিন্ত বেসরকারি হিসেবে নিহতের সংখ্যা কয়েক হাজার ।
আজ যে স্বাধীনতা সার্বভৌম বাংলার বুকে স্বাধীন নাগরিকদের অবাধ বিচরন তার পেছনে রয়েছে অনেক রক্তাক্ত ইতিহাস । সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের যাঁরা মহা নায়ক তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন চলনবিলের কৃতি সন্তান মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ । তাঁর দীর্ঘ জীবনের শেষমুহর্ত পর্যন্ত এই মহান নেতা জাতির কল্যানে সুচিন্তা করেছেন । জাতির বৃটিশ শোষনের হাত থেকে মুক্তির ভীষন কান্ডারী হিসেবে দেশ ও জাতিকে পথ নির্দেশনা দিয়েছেন এসব ক্ষনজন্মা প্রানপুরুষেরা ।মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ তাঁর মেধা, মনন,দক্ষতা ,যোগ্যতা, সততা, নিষ্ঠা ও কঠোর পারিশ্রম দিয়ে এ দেশের বিপদসংকুল রাজনৈতিক অঙ্গনকে করে গেছেন মসৃন ।
মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ দু‘দুটি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সম্মুখ পানে এগিয়ে গেছেন। পরাজয়কে তিনি কঠোর হসেÍ জয়করেছেন ।তিনি কখনো হতাশ হননি । আর হতাশ হননি বলেই তিনি উপমহাদের ঐতিহাসিক দলিলে গুরুত্বপুর্ন স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছেন । সেই অবস্থান থেকে তাঁকে কেউ অদ্যাবধি সরাতে পারে নাই । বৃটিশ হটাও আন্দোলনে তিনি চিরকাল অম্লান হয়ে থাকবেন ।
১৯২৪ সালের প্রথমদিকে আব্দুর রশীদ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ভারতের যুক্ত প্রদেশের বেরেলী এশাতুল উলুম মাদরাসায় ভর্তি হন । এই মাদরাসায় বাঙ্গালী বিদ্বেষী মনোভাব বিরাজ করছিল । এ অবস্থায় আব্দুর রশীদ প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন এবং প্রবাসী বাঙালী ছাত্রদের সংগঠিত করে অবাঙ্গালীদের আচরনের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেন । আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বাঙালী ছাত্রদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় । কিছুদিন পর তিনি বেরেলী ছেড়ে প্রখ্যাত সাহারান মাদরাসায় ভর্তি হন । এখানেও ঐ একই অবস্থা, বাঙ্গালী বিদ্বেষী মনোভাব বিরাজ করছিল । এখানেও তিনি বাঙ্গালীদের সাথে নিয়ে আন্দোলন করে দাবী আদায় করে ছাড়েন । এরপর মাওলানা আব্দুর রশীদ এই মাদরাসায় শিক্ষা অসমাপ্ত রেখে বিশ্বের প্রখ্যাত ইসলামী শিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠস্থান বিখ্যাত দেওবন্দ মাদরাসায় ভর্র্তি হন । দেওবন্দেও অর্ধেকেরও বেশী ছিল বাঙ্গালী কিন্তু তাদেরও অবস্থা ছিল অত্যন্ত সোচনীয় । মাদরাসার সর্বত্রই বাঙ্গালী বিদ্বেষী আচার- আচরন ও অব্যবস্থাপনা । এর প্রতিকারে চির প্রতিবাদী ও সাংগঠনিক শক্তির অধিকারী মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ১৯২৪ সালের শেষ দিকে ‘আজাদ সমিতি’ নামে একটি বাঙ্গালী সংগঠন করেন । তিনি ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ।তাঁর গতিশীল নেতৃত্বে সমগ্র ভারতবর্ষে বাঙ্গালী মুসলমান সমাজের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়েযায় ।
১৯২৬ সালে মাওলানা আব্দুর রশীদ উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য তৎকালীন বিশ্ববিখ্যাত মিশরের জামে আজহার মাদরাসায় ( আল্ আজহার বিশ্বদ্যিালয় ) যাওয়ার জন্য বৃটিশ সরকারের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন । অতীত বৃটিশ বিরোধী নানামুখী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তাঁর প্রতি বিরূপ মনোভাব থাকায় আবেদন মঞ্জুর হয়না । অতঃপর তিনি লাহোরে গমন করে এশায়েত কলেজে ভর্তি হন । এখানে তিনি তর্ক ইংলিশ মিডিয়ামে অধ্যায়ন শুরু করেন । কলেজে সাপ্তাহিক বাহাস(তর্ক) অনুষ্ঠানে তিনি পাকা তার্কিকে পরিনত হলে পাঞ্জাব ও তার আশেপাশে বড় বড় বাহাসে তিনি কৃতিত্বের সাথে অংশগ্রহন করে বিজয় ছিনিয়ে আনতেন ।পরপর ১১ টি বাহাসে বিজয়ের গৌরব অর্জন করেন । ১৯২৭ সালে তিনি কৃতিত্বের সাথে পরিক্ষায় উত্তীর্ন হন এবং তর্কশাস্ত্রে বিপুল দক্ষতার জন্য তিনি ‘ তর্কবাগীশ’ উপাধিতে ভ’ষিত হন । তখন থেকেই তাঁকে “ মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ” নামে ডাকা শুরু হয় ।
১৯২৭ সালে মাওলান আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ তাঁর মানষগুরু সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর মনোনীত চলনবিলের তাড়াশ থানার বারুহাস গ্রামের মৌলভী দেলোয়ার হোসেন খান চৌধুরী সাহেবের কন্যা বেগম নুরুন্নাহার চৌধুরানীর সাথে শুভ প্রনয় সুত্রে আবদ্ধ হন । তাঁদের বিয়ে উপলক্ষে ইসমাইল হোসেন সিরাজী একখানী অনন্য কবিতা লিখে তাঁদেরকে উপহার দেন । মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ তিন ছেলে এবং তিন কন্যার জনক । তাঁর জেষ্ঠপুত্র সৈয়দ নুরুল আলম ৫২-র ভাষা আন্দোলনের অন্যতম ছাত্রনেতা ছিলেন । মেঝ পুত্র সৈয়দ শামসুল আলম হাসু একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়ী । কনিষ্ঠ পুত্র বদরুল আলম একজন সক্রিয় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পরিচিত ।
১৯২৮ সালে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ আর্থিক দুরাবস্থায় নিপতিত জাতিকে রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সচেতন করে তোলার ব্রত নিয়ে গড়ে তোলেন “ আঞ্জুমানে তারাক্কিয়ে ইসলাম ” নামক একটি সংগঠন । তিনি হন এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি । এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি গ্রামে গ্রামে প্রাইমারী স্কুল,মাদরাসা প্রতিষ্ঠা,সমবায় ব্যাঙ্ক স্থাপন, মহাজনকে সুদ না দেওয়া, জমিদারকে বর্দ্ধিত খাজনা না দেওয়া, কোন প্রকার নজরানা না দেয়া,জোতদারদেরকে বীজ ও অন্যান্য খরচাদি বহনে বাধ্য করা, অল্প পুজিতে ব্যবসার প্রসার,কামার-কুমার,সুতারের কাজে উৎসাহিত করা, ঝগড়া- বিবাদ মিমাংসার জন্য জদিার কাচারিতে না যেয়ে নিজেরাই নিস্পত্তি করা ইত্যাদি বৈপ্লবিক কার্য্যক্রমে জনসাধারনকে উদ্বুদ্ধকরনসহ নানান প্রগতিশীল গনমুখী স্বনির্ভর সাম্যবাদী আন্দোলন অল্পসময়ের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়ে তোলেন ।
স্থানীয় জমিদার, জোতদার, মহাজন তথা কয়েমী স্বার্থবাদীচক্র এ আন্দোলনের তীব্রতা দেখে ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে । মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের এই গনজাগরনী সাম্যবাদী আন্দোলনকে নস্যাৎ ও তাঁকে বিপদে ফেলার জন্য জমিদাররা একযোগে তাদের লাঠিয়াল বাহিনীসহ ঘাতকদের তাঁর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয় । এ সময় বাংলার প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সহরোয়ার্দী মাওলানা আব্দুর রশীদের পাশে এসে দাঁড়ান । বহ বাধাবিপত্তি সত্বেও মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের অনেক দাবী-দাওয়া সরকার মেনে নিতে বাধ্য হয় ।
সে সময় মাওলানা আলম খাঁর খুবই নাম-ডাক ছিল । তিনি বাগ্মী নেতা মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের কর্মকান্ড ইহলৌকিক ও ইসলাম বিরোধী বলে প্রচার করতেছিলেন । মাওলানা তর্কবাগীশের সভায় থাকলে ঈমান নষ্ট হয় বলে নিজের লোকদের নিয়ে আলম খাঁ একসময় সভাস্থল ত্যাগ করেছিলেন। মাইক ব্যবহার, রেডিও শোনা নাজায়েজ বেদাত বলে তখন এদেশের সব আলেমই ফতোয়া দিয়েছিলেন। মাওলানা আব্দুর রশীদ তখন এসব আধুনিক জ্ঞান- বিজ্ঞানের ফসলকে শুধু জায়েজই বলেননাই এ সবই ইসলামিক বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন।এই সময়ে সিরাজগঞ্জ জামে মসজিদের সরু গেিল দিয়ে দূর্গা প্রতিমার র্যালী নিয়ে মসজিদের সামনে দিয়ে বিসর্জন দেওয়ার ঘৃন্য সাম্প্রদায়িক পরিকল্পনা নিলে সিরাজগঞ্জের আলেম সমাজ তাতে বাধা দেওয্রা জন্য জমায়েত হন । পুলিশের সহযোগীতা নিয়ে যখন দূর্গা প্রতিমা নিয়ে প্রসেসন আসা শুরু হলো তখনই বাধাদানে প্রস্তত মুসল্লিসহ সকল আলেম ভযে পালিয়ে যান । ঘটনাক্রমে তখন মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ সিরাজগঞ্জ উপস্থিত ছিলেন। এভাবে মজিদের অবমাননা সহ্য করতে না পেরে তিনি একাই প্রসেসনের বিরুদ্ধে অসিম সাহসিকতায় রুখে দাঁড়ালেন। সেদিন বৃটিশ সরকারের মদদপ্রাপ্ত মিছিল রুখে দিয়ে পবিত্র মসজিদের সম্মান রক্ষা করলেন। সেদিন মহান ব্যাক্তি আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের অসিম সাহসিকতায় রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক সহিংসতার হাত থেকে সিরাজগঞ্জবাসী রক্ষা পায় । ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের মর্যাদা রক্ষা পাওয়ায় সিরাজগঞ্জ বাসির হৃদয়ের মনিকোঠায় স্থান করে নেন বৃ¦ৃটিশ বিরোধী অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের নির্ভিক অবিসম্বাদিত নেতা । তাঁর এই অসিম সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে চির বৈরী সাম্প্রদায়িক মাওলান আলম খাঁ সহ সিরাজগঞ্জের আলেমকুল তাঁকে মুজাদ্দিদ বলে মানতে থাকেন ।
এক সময়ে আহলে হাদিস( লামোজাহাবী) সম্প্রদায়ের অবিসম্বাবিত আধ্যাত্মিক নেতা মাওলানা আব্দুল্লাহেল আল্ কাফী হানাফী সমপ্রদায় ভক্তদের কাফের আখ্যা দিয়ে ফতোয়া দিয়েছিলেন । এক পর্যায়ে তৎকালিন বাংলার প্রখ্যাত মোর্শেদ হযরত পীর হযরত আবু বক্কর সিদ্দিকী (রঃ) প্রধান খলিফ প্রখ্যাত আলেম রুহুল আমিনকে সিরাজগঞ্জের জামতৈল ষ্টেশন বাজারে মাওলানা আল কাফী আহলেহাদীস সম্প্রদায়ের লোকজন নিয়ে শারীরিক লাঞ্ছনা পর্যন্ত করেছিলেন । রাজশাহীর নাটোর অঞ্চলের মশিন্দা, হাসমারী, ধারাবরিষা, মহারাজপুর চাঁদপুর, পীরগঞ্জসহ সবিভিন্ন এলাকায় আহলেহাদিস (লামোজাহাব) সম্প্রদায়দের নিয়ে মাওলানা কাফী সাহেবের দৌরাত্ব এমন এক পর্যায় পৌঁছায় যে, হানাফি সম্প্রদায়ের লোকজনদের স্বভাবিক জীবনযাত্রাতে নানাভাবে বিঘœ সৃষ্টি করতে থাকে। মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ নিজে এইসমস্ত মোজাহাবের মুসলমানদে মধ্যে বিভক্তি মানতেননা।তাঁর মতে এক আল্লাহ, কোরআন ও এক রসুলে বিশ্বাসী সব মুসলমান এক মোজাহাবভ’ক্ত।
আহলেহাদীস সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক নেতা মাওলানা আব্দুল্লাহেল আল কাফী সাহেব একপর্যায়ে ঔদ্ধত্য প্রকাশে সাহাসি হন । তিনি হযরত মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে একটি পত্র লেখেন । এর ফলে সর্বত্র মাওলানা কাফীর সমর্থকরা হানাফী মাযহাবপন্থীদের দ্বারা ব্যাপক প্রতিরোধের সম্মুখীণ হন ।মাওলানা কাফী সাহেব নিজে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন । মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ নাটোরের গুরুদাসপুর থানার চাঁচকৈড়,মশিন্দা শিকারপুর, হাসমারি, কামারখন্দ, বগুড়া, তালোরা,ধোপাকান্দি ও বশিরহাটে বিশাল বিশাল ধর্মসভায় আহালেহাদিস সম্প্রদায়ের ভ্রান্ত ধারনা ও কোরান-হাদিসের খেলাপ মতবাদের বিরুদ্ধে সঠিক দালিলিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন। মাওলানা সাহেবের জনপ্রিয়তা এবং আকাশচুম্বি প্রভাব ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক খ্যাত মাওলান াআল ্কাফী সাহেবের তৎপরতা ও লামোজাহেবীদের ধর্মীয় উন্মাদনা সম্পুর্ন ধুলায় মিশে যায়। যার ফলে এলাকার হাজার হাজার লামোজাহাবী মুগ্ধ হয়ে তাদের ভুল বুঝে মাওলানা হুযজুরের হাতে তওবা পড়ে পুনরায় হানাফী মতে মুরিদ হন ।
উল্লেখ্য যে এই বিশাল ব্যাক্তিত্ব মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ অন্যতম শিষ্য ছিলেন আমার পিতা (প্রতিবেদকের) মরহুম আব্দুল জাব্বার মিয়া (মাষ্টার) ,দাদা মরহুম ফজলার রহমান, মেঝ দাদা সেকেন্দার আলী মোল্লা, ছোট দাদা মরহুম নওশের আলী ডাক্তার, মতি সরকার চেযারম্যান, কফির উদ্দিন মোল্লা, রফাত মুন্সি. ফয়েজ উদ্দিন পন্ডিত, আজিজুলহক মাষ্টার, হাকিম সরকার,সরাফত উল্লাহ তালুকদার চেয়ারম্যান, রেকায়েত প্রামানিক প্রমুখ। আমার পিতার কাছে শুনেছি মাওলানা সাহেব মশিন্দা আসলে আমাাদের বাড়িতেই থাকতেন । ১৯৫৭ সালে মাওলান আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ আমাদের পুর্বপুরুষ হাজী শকাতল্লাহর ওয়াকফ্ কৃত সম্পত্তি শিকারপুর গ্রামে আমাদের বাড়ির সংলগ্ন গুমানী নদীর দক্ষিন তীরে মশিন্দা এলাকার হানাফী মাজহাবের মুরিদদের নিয়ে বৃহত্তর একমাত্র ঈদমাঠ প্রতিষ্ঠা করে নিজে ঈদের জামাতে নিয়মিত ঈমামতি করতেন বলে শুনেছি। তর্কবাগীশের মত পীর বুজুর্গ আলেমের পিছনে ঈদের নামাজ আদায় করতে পেরে সবাই সৌভাগবান মনে করতেন।
আহলেহাদীস সম্প্রদায়ের সাম্পদায়ীক নেতা মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফির সমর্থকদেও ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত মশিন্দা শিকারপাড়া দাখিল মাদ্রাসা(বর্তমানে শিকার পাড়া সিনিয়র মাদরাসা) এর বিপরীতে শিষ্যদের নিয়ে ১৯৫৮ সালে ১ জানুয়ারী নিজ নামে পাল্টা ‘ শিকারপুর রাশিদীয়া দাখিল মদরাসা’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতি বছর এই মাদরাসায় অনুষ্ঠিত বার্ষিক ইসলামী জালসায় তিনি ওয়াজ নসিহত করতেন। প্রতিটা সভাতেই বাগ্মী বক্তা মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের মাওলানাদের সাম্প্রদায়ীক উস্কানীমুলক বক্তব্যের বিপক্ষে কোরআন -হাদীস এবং ফিকাহ্র দালিলিক অকাট্য প্রমান দেখিয়ে দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতেন। তাঁর যুক্তিপুর্ন বক্তেব্যে এলাকার হানাফী মাজহাবের সমর্থকদের মধ্যে মনোবর চাঙ্গা হতো। এ নিয়ে স্থানীয় হানাফী এবং আহলে হাদীস মাজহাবের মধ্যে মাঝে মাঝেই ধর্ম নিয়ে বাহাস হতো। এতে দুই মাজহাবের মধ্যে সাম্প্রদায়ীক দাঙ্গাও বেধে যেত।আমার মেঝ দাদা পীর মাওলানা সেকেন্দার আলী মোল্লা ও মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের একজন অন্যতম আধ্যত্মিক শীষ্য হিসেবে আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে দালিলিক মাসয়ালা নিয়ে বাহাস করতেন। তাঁর কাছ থেকে শুনেছি কোন এক বাহাসে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ নামাজে আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের পুরুষ নামাজীরা এহরাম বুকের উপরে বাঁধাকে কেন্দ্র করে জবাব দিয়েছিলেন যেহেতু নামাজে দাঁড়িয়ে মেয়েদের এহরাম বুকের ওপড়ে বাঁধার নিয়ম তাই আহলে হাদীস সমর্থক পুরুষদেরকে মারতে হলে বাম হাত দিয়ে থাপ্পড় মারতে হবে , ডান হাত দিয়ে নয়। কারণ মেয়েদের অবস্থান পুরুষের বাম পাশে। আমি দেখেছি আহলেহাদিস সম্প্রদায়ের শিকারপাড়া মাদ্রাসায় বর্ষিক ইসলামী জালসায় মাওলানা আব্দুল্লাহেল কাফি , মাওলানা আব্দুল্লাহ ইবনে ফজল, মাওলানা দুরুল হুদা আইয়ুবি, অন্ধ হাফেজ মাওলানা আব্দ্রল্লাহ ইবনে কাজেমসহ জাদরেল জাদরেল মুহাদ্দেসিন তাঁদদের বক্তব্যে হানাফী মাজহাবের বিরুদ্ধে ধর্মীয় উস্কানীমুলক বক্তৃতা দিয়ে উভয় মাজহাবের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করতেন। এর প্রতিবাদে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কাগীশ, মাওলানা আবু তাহের বর্ধমানীসহ নামকরা পীরে কামেল বুজুর্গ মুহাদ্দিসগন আহলেহাদিস সম্প্রায়দেরকে পাল্টা জবাব দিয়ে বক্তব্য রাখতেন।
১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্বাচনী প্রচারনায় গুরুদাসপুরে এবং স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে শিকারপুর তাঁর নিজ নামে প্রতিষ্ঠিত রাশিদিয়া মাদ্রাসা মাঠে এবং চাঁচকৈড় নাজিম ্উদ্দিন হাইস্কুল মাঠে জনসভায় এসে আমাদের বাড়িতে থেকেছেন। আমি নিজ হাতে মাওলানা সাহেবকে খাইয়েছি। এজন্য আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি ।মাওলানা তর্কবাগীশের চেহারা মোবারক ছিল নুরানী সুন্দর ধবধবে ফর্সা। মুখে সাদা দাঁড়িতে ভড়া। লম্বা –উচু সুঠাম দেহের অধিকারী। তাঁকে দেখলেই শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে যায় আপনিই।
৩য় পর্ব ঃ (‘ শেরে বাবুর’ উপাধিতে ভুষিত )
১৯৩০ সালে মাওললানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী টাঙ্গাইলের বাড়িতে অনুষ্ঠিত প্রজা সম্মেলনে বক্তৃতা করার জন্য মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকে দাওয়ত করেছিলেন। এখানেই তিনি পরিচিত হন কিংবদন্তি নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে।
১৯৩২ সালের প্রথমদিকে মাওলানা আব্দুর রশীদ বাঙলার অবিসংবাদিত নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙলার নিপিড়িত কৃষক রায়ত-খাতকদের মুক্তির লক্ষ্যে ‘নিখিল বঙ্গ রায়ত-খাতক সমিতি’গড়ে তোলেন । সমিতির প্রতষ্ঠাতা সভাপতি হলেন হোনে শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং সাধারন সম্পাদক হলেন মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ।
১৯৩৩ সালে রাজশাহী জেলার নাটোর মহকুমার গুরুদাসপুর থানার চাঁচকৈড় হাইস্কুলের মাঠে মাওলানা তর্কবাগীশ‘ নিখিল বঙ্গ রায়ত-খাতক সমিতির’ মহা সমাশের আহবান করেন ।হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এই মহাসমাবেশে সভাপতিত্ত্ব করেন। মাওলানা তর্কবাগীশ ঐ মহাসমাবেশে সর্বপ্রথম শতাব্ধীর অভিশপ্ত মহাজনী ঋনে জর্জরিত নিপিড়িত বাংলার কৃষকদের মুক্তির লক্ষ্যে “ঋন সালিশী ”আইন প্রনয়নের দাবী উত্থাপন করেন।
১৯৩৪ সালে এ আইন পাস করানোর জন্য মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কৃবাগীশ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সভাপতিত্বে পুনরায় সিরাজগঞ্জের জামতৈলে কৃষক সমাবেশ আহবান করেন।সমাবেশ বাস্তবায়নের জণ্য বাংলার কৃষক সমাজের আন্দোলন জোড়দার করেন। এতে বৃটিশ সরকার ক্ষেপে গিয়ে সমাবেশের ওপর ১৪৪ ধার জারি করে। কিন্ত তিনি ১৪৪ ধার ভঙ্গ করে নাটোরের গুরুদাসপুর থানার মশিন্দা শিকারপুর রাশিদিয়া মাদ্রাসা মাঠে আবার একটা সমাবেশ ডাকেন। বৃটিশ সরকার বিপ্লবী মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকে স্তব্ধ করতে না পেরে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে সম্মেলনের আগের রাতে মাওলানা তর্কবাগীশকে গ্রেপ্তার করে জনরোষের ভয়ে গোপনে রাজশাহী কেন্দ্রীয় জেলে প্রেরন করে এবং “রায়ত-খাতক সমিতির” সকল সভা-সমাবেশের উপর ১৪৪ ধারা জারি করে।এর প্রতিবাদে সমগ্র বাংলায় তীব্র প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বাঙলার দুই প্রখ্যাত নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শরৎচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে রাজপথে এবং বঙ্গীয় আইন পরিষদ কক্ষে তুমুল আন্দোলন গড়ে ওঠে।ফলে বৃটিশ সরকার বাধ্য হয় তর্কবাগীশকে মুক্তি দিতে। আর আন্দোলনের তীব্রতার তোড়ে সরকার মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের উত্থাপিত ‘ঋনসালিশী আইন’ প্রনয়নের প্রস্তাব বঙ্গীয় আইন পরিষদে উত্থাপনে সম্মত হয়।অবশেষে শহীদ সোহরাওয়ার্দী আনীত প্রস্তাবের উপরে খাজা নাজিমউদ্দিন সমর্থন দিলে তা আইনে পরিনত হয়। পরবর্তীতে শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হক সরকারের আমলে তা কার্যকরহয়।এতে পুর্ব বাঙলার হাজার হাজার কৃষকদের ওপর থেকে ২৫০ কোটি টাকার ঋন মওকুফ হয়। মাওলানা তর্কবাগীশের এই বিপ্লবী কর্মকান্ডে মুগ্ধ হয়ে মহাত্মাগান্ধী ১৯৪২ সালে তাঁকে “শেরে বাবুর” উপাধিতে ভুষিত করেন।
১৯৩৯ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে তর্কবাগীশ ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি গঠন করে সাধারন সম্পাদক হন। কিছুদিন পর মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহর আহবানে তাঁরা নিখিল ভারত মুসলিম লীগে যোগদান করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বৃটিশদের একটি প্রতিরক্ষা কমিটিতে বঙ্গীয় পরিষদের প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা অন্যতম সদস্য হন। মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটি এজন্য বৃটিশ প্রতিরক্ষা কমিটি থেকে সকল সদস্যের পদত্যাগের সিদ্ধন্ত নেয়।শেরে বাংলা এ আদেশ অমান্য করেন। তর্কবাগীশ সেই মন্ত্রীসভার ভুল কার্যকলাপের সমালোচনা করায় শ্যামা-হক তাঁকে দীর্ঘদিন গৃহবন্দি করে রাখে।
১৯৪২ সালে তর্কবাগীশ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পাশপাশি থেকে অকøান্ত পরিশ্রম এবং সাংগঠনিক কার্য্যক্রম দ্বারা বঙ্গীয় পরিষদের উপ নির্বাচনে নাটোরে কাজী আবুল মাসউদকে এবং বালুরঘাট থেকে প্রতাপশালী কংগ্রেস প্রার্তীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে মুসলিম লীগ প্রার্থীকে এম এন এ পদে বিজয়ী করেন।এই উপ নির্বাচনে মাওলানা আব্দুর রশীদ এর ত্যাগ কর্মদক্ষতা ও সাংগঠকি কার্য্যক্রমের উপর ২২ এপ্রিল তৎকালিন সর্বাধিক জনপ্রিয় দৈনিক ্ আজাদ পত্রিকায় মাওলানা আক্রাম খাঁ উপসম্পাদকীয়তে তাঁকে‘ত্যাগ সুন্দর পুরুষ’ বলে অভিহিত করেছেন।
১৯৪৬ সালের সাধারন নির্বাচনে মাওলানা আব্দুর তর্কবাগীশ সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া আসন থেকে শক্তিশালী প্রপিক্ষ কংগ্রেস ও শেরে বাংলার কৃষক প্রজা পার্টির প্রর্থিীদ্বয়কে বিপুল ভোটে পরাজিত করে মুসলিমলীগের পক্ষে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য এম এন এ নির্বাচিত হন। এই সাধারন নির্বচনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলা প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী হন। সমগ্র নির্বাচনে মুসলিমলীগ মাত্র ৯ টি আসন হারায়। এ নির্বাচনই পাকিস্তান আন্দোলনের চুড়ান্ত রূপ নিয়েছিল।
চতুর্থ পর্ব ঃ (‘পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভ’)
১৯৪৬ সালের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ৪০ নং থিয়েটার রোড (কোলকাতা) বাসভবনে বিপ্লবী মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ নিখিল বঙ্গ মুসলিমলীগের সাধারন সম্পাদক আবুল হাশিম, নিখিলবঙ্গ মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি শামসুল হক,সাধারন সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য নেতাকর্মীরা দিনের পর দিন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা চালান। একপর্যয়ে হোসেন শহীদের ইঙ্গিতে মাওলানা তর্কবাগীশ আইন সভাসহ মুসলিম লীগ পরিষদে স্বাধীন সার্বভৌম বাঙলাদেশ প্রতিষ্ঠার দাবী উত্থাপন করেন।কিন্ত গান্ধিজীর বিরোধীতার মুখে তা ব্যর্থ হয়ে যায়। অতঃপর সর্ব ভারতীয় নেতৃত্বে ভারত-পাকিষÍান প্রতিষ্টার আন্দোলন চালানোর সিদ্ধান্ত হয় ্ পাশাপাশি সোহরাওয়ার্দী এবং শরৎচন্দ্র বসু স্বাধীন বাঙলাদেশ প্রতিষ্ঠারও আন্দোলন চালাতে থাকেন।কিন্ত সুচতুর বৃটিশ সরকার কংগ্রেস- মুসলিম লীগকে বাঙলার বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে ভারত-পাকিস্তান নামে দুই ভাগে বিভক্ত করার অশুভ পাঁয়তার করে।সেই লক্ষ্যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পুর্ব বাঙলাকে পাকিস্তান এবং হিন্দু সংখ্যা-গরিষ্ঠ পশ্চিম বাঙলাকে ভারতের সাথে মিশিয়ে দিতে ‘র্যাডক্লিপ রোয়েদাদ’ এর সিমানা নির্ধারন কার্যক্রম শুরু করে। এ কার্যক্রমের আওতায় বাঙলাদেশের বৃহত্তর সিলেট জেলা পাকিস্তান না ভারতের অংশে হবে সে লক্ষ্যে একটি গনভোটের আয়োজন করা হয়। নিখিলবঙ্গ মুসলিম লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা তর্কবাগীশের নেতৃত্বে ছাত্রনেতা শামসুল হক, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, ও শেখ মুজিবসহ প্রায় দু’শত নেতাকর্মী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন সিলেটকে পাকিস্তানের পক্ষে আনার জন্যে। তাঁদেও অক্লান্ত সাংগঠনিক কার্য্যক্রমে সিলেটের জনগন পাকিস্তানের জনগন পাকিস্তানের পক্ষে নিরঙ্কুশ রায় প্রদান করে।
১৯৪৭ সালের ১৪ ই আগষ্ট পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাভাবিকভাবেই মাওলানা তর্কবাগীশ পাকিস্তান রাজনীতিতে একজন বিশিষ্ট রাজনীতিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র অনিবার্য কারনে প্রতিষ্ঠা হলেও মাওলানা তর্কবাগীশ বাঙ্গালীর স্বাতন্ত্রসত্বা ও তার স্বার্থকেক্ষুন্ন হতে দেননি। অতএব পাকিস্তান রাজনীতির শুরুতেই তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারায় তাই ব্যতীক্রমী চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বিশ^াসে একজন খাঁটি মুসলমান শাসক মুসলিম লীগ সমর্থিত পুর্ব বাঙলা আইন পরিষদেও সদস্য হয়েও বাঙ্গালীর জাতীয় চেতনারযাবতীয় প্রগতিশীল ধারাকেই তিনি রাজণীতিতে মৌলনীতি হিসেবে গ্রহন করে বাঙ্গালী স্বার্থের বিভিন্ন দাবী-দাওয়ার ভিত্তিতে আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে যান। পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পরই পুর্ব পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন গনতন্ত্র বিরোধী প্রক্রিয়া চালাতে শুরু করেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই মাওরানা তর্কবাগীশ বুঝতে পারলেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার শাসনের নামে ইসলামের আলখেল্লা পড়ে কার্যতঃ পুর্ববাঙলাকে একটি উপনিবেশ বিবেচনা করে শোষনকার্য চালাচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি-বাকরি, শিল্প-বানিজ্য ওঅন্যান্য নীতিমালায় বাঙালীরা চরমভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের শোষন বঞ্চনার বিরুদ্ধে চিরসংগ্রামী মাওলানা তর্কবাগীশ মুসলিমলীগ সরকারের সৈরাচারী অগনতান্ত্রিক কার্যকলাপের বিরোধীতায় অবতীর্ন হলেন। তিনি মুসলিমলীগ পার্লামেন্টারী দলের সোহরাওয়ার্দী অনুসারী ৪ জন এম এল এ নিয়ে পুর্ব পাকিস্তান সংসদের প্রথম বিরোধী দলের নেতৃত্ব দেন। এতে একাত্মতা প্রকাশ করেন বগুড়ার মোহাম্মাদ আলী,সবুর খান, খয়রাত হোসেন,আনেয়ারা খাতুন,টি আলী প্রমুখ। সেই সাথে মুসলিমলীগ বিরোধী একটি রাজনৈতিক দলগঠনের লক্ষ্যে সোহরাওয়ার্দীর আশির্বাদপুষ্ট মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী,আবুল মনসুর আহমদ,তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, শামসুল হক এবং বিপ্লবী তরুন নেতা শেখ মুজিবকে অনুপ্রানিত করেন।যার ফলশ্রুতিতে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানীর নেতৃত্বে ‘ পুর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী সভাপতি এবং শামসুল হক সেক্রেটারি হন। বিরোধী রাজনৈতিক দল ‘ পুর্ব পাকিস্তান আওয়ামি মুসলিম লীগ’ গঠনে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ বলিষ্ঠ ভুমিকা রাখেন।
১৯৪৯ সালের ২৫শে মার্চ মাওলানা আব্দুর রশীদ প্রাদেশিক আইন পরিষদে প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের দুঃখ – দুর্দশার কথা তুলে ধরেন এবং প্রতিকারের জোড় দাবী জানান।সরকার তা মেনে নিতে বাধ্য হন। ঐ বছরই ৯ ডিসেম্বর পারষদে তর্কবাগীশ প্রথম বেশ্যাবৃত্তির অমানবিকতাকে তুলে ধরেন এবং তা নিরোধকল্পে আইন প্রনয়নের জন্য বিল আনলে তা তাৎক্ষনিকভাবে পাশ হয়। পরদিন ১০ ডিসেম্বর বিনা ক্ষতিপুরনে কুক্ষ্যাত জমিদারী প্রথা উচ্ছেদেও জোড়ালো দাবী উত্থাপন করেন কিন্ত কায়েমী স্বার্থবাদী সদস্যদেও বিরোধীতায় বাস্তবায়ন হয়নি। যদিও মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশও উত্তরাধিকার সুত্রে একটি জমিদারী পেয়েছিলেন।
১৯৫১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী মাওলানা তর্কবাগীশ মাদরাসা শিক্ষাকে আধুনিকীকরন এবং সর্ব ক্ষেত্রে ইসলামের সাম্যনীতি প্রবর্তনের একটি রূপরেখা পরিষদে পেশ করেন। এটা ছিল তার একান্তই প্রানের দাবী। তিনি ছিলেন মুক্তবুদ্ধির লোক। অকাট্য যুক্তির উপর ছিলেন নির্ভরশীল।ধর্ম বিষয়ে ছিল অগাধ পান্ডিত্য। এ জন্যেই মাওলান তর্কবাগীশ নিজেই হয়ে উঠেছিলেন বাঙালী মানষবোধের একটি বিশাল প্রষ্ঠিান। তাঁর এ প্রাতিষ্ঠানিক অস্তিত্ব তিনি প্রদর্শন করেছিলেন ৫২-র ভাষা আন্দোলনে।
পঞ্চম পর্ব ( মহান ভাষা আন্দোলনের সিংহ পুরুষ )
১৯৪৮ সালের ৮ ই ফেব্রুয়ারি। করাচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভার ( কন্সটিটুউয়েন্ট এ্যাসেম্বলি) বৈঠকে রাষ্ট্রভাষা কি হবে সেই বিষয়েও আলোচনা হচ্ছিল। মুসলিমলীগের নেতারা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী।পুর্বপাকিস্তানের অধিকাংশ মুসলিমলীগ সদস্যেরও একইমত। কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবী করলেন বাংলাভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক।কারন পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু মানেুষের ভাষা হলো বাংলা। মুসলিমলীগের সদস্যরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেননা। বাংলা বাদদিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরাট ষড়যন্ত্র চলছিল। তখন পুর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস এর প্রতিবাদ করে দাবী জানায় যে, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। এই সময়ে পুর্বপাকিস্তান মুসলিম ছত্রলীগ ও তমুদ্দুন মজলিস যুক্তভাবে সভা আহবান কওে ‘ রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। সভায় ১১ মার্চকে ‘ বাংলাভাষা দাবি দিবস’ ঘোষনা করা হলো।
১১ ই মার্চ ভোর বেলায় শত শত ছাত্র ইডেন বিল্ডিং,জেনারেল পোষ্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করে। জেনারেল পোষ্ট অফিসের সামনে ছাত্রদেও উপড় ব্যাপক লাঠিচার্জ করে পুলিশ। একদল মার খেয়ে স্থান ত্যাগ করে আর এক দল হাজির হয়। এইভাবে গোলমাল মারপিট চলতে থাকে। খালেক নেওয়াজ খান,বখতিয়ার,শহর ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক এম এ ওয়াদুদ,কাজী গোলাম মাহাবুব, শওকত মিয়া ও আরো অনেক ছাত্র আহত হয়। এসময় ছাত্রনেতা শেখ মুজিব,শামসুল হক, তোহা, তাজউদ্দিন, অলি আহাদসহ প্রায় সত্তর-পচাত্তর জন গ্রেফতার হয়।
১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত এক জনসভায় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনষ্ঠানে তদানিন্তন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কায়েদে আযম মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ঘোষনা করেন যে, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা”। তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে বক্তৃতা করতে উঠে তিনি যখন আবার বললেন “ উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে”-তখন ছাত্ররা নো, নো বলে চিৎকার করে ওঠেন। এসময় জিন্নাহ প্রায় ৫ মিনিট চুপ কওে ছিলেন। এই প্রথম জিন্নাহর মুখের উপড় প্রতিবাদ করে বাংলার ছাত্ররা। এরপর জিন্নাহ যতদিন বেঁচে ছিলেন আর কোন দিন বলেন নাই‘ উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’ ।‘ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে সর্বপ্রথম আন্দোলন শুরু করে পুর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে এই আন্দোলনের সুচনা করেন ডঃ মোহাম্মাদ শহীদুল্লাহ, ডঃ কাজী মোতাহার হোসেন ও অধ্যাপক আবুল কাশেমসহ আরো অনেকে। পাকিস্তান গনপরিষদে প্রস্তাব উঠেছিল যে, শুধু উর্দু ও ইংরেজীতে বক্তৃতা করতে হবে।গনপরিষদ সদস্য ধীরেন বাবু প্রথম এর প্রতিবাদ করেছিলেন।
১৯৪৮ সালে পুর্ববঙ্গ আইন পরিষদে ‘বাংলাকে’ অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থনে একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ,খয়রাত হোসেন, মিসেস আনোয়ারা বেগম, মি. মনোরঞ্জন ধর, আলি আহম্মদ খান এবং ওসমান আলিসহ মাত্র কয়েকজন সদস্য প্রস্তাবিত এই দাবীর প্রতি সমর্থন করেন। এরপর ১৯৪৯,৫০ ও ৫১ সাল পর্যন্ত বাঙলা ভাষা আন্দোলন ছাত্র ও শিক্ষিত সমাজে সীমাবদ্ধ থাকে এবং ক্রমে ক্রমে সাধারন মানুষের মনে এই আন্দোলন আলোড়ন সৃষ্টি করতে থাকে।
১৯৪৭ সালের বেশকিছু পুর্বেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে এক বিতর্কের সুচনা হয়েছিল।তৎকালিন আলিগড় মুসলিম বিশ^বিদ্যালয়ের এক উর্দুভাষী ভাইস চ্যান্সেলর ডক্টর জিয়াউদ্দিন উর্দু ভাষাকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহনের সুপারিশ করে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেন।তখন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালী ভাষাবিদ ও বাঙলা ভাষার অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লহ উক্ত বিবৃতির প্রতিবাদে পাল্টা আরেক বিবৃতির মাধ্যমে প্রস্তাবিত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে ‘বাংলা’র দাবিকে তুলে ধরেন। সে সময়ে বহুভাষাবিদ ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বগুড়ার বেসরকারী আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ পদে ছিলেন এবং একই সাথে কলেজের বাঙলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন।
১৯৫২ সাল।বাঙলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের লক্ষ্যে তৎকালিন পুর্ব পাকিস্তানের ছাত্র, বুদ্বিজীবি ও রাজনীতিক সমাজে দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলন গড়ে উঠে। ১৯৪৮ সালের শুরু থেকেই এই আন্দোলন চলে আসছিল।‘৫২-র শুরুতে তা প্রবল রূপ ধারন করে।মুসলিম লীগ বরাবরই এর বিরোধীতা করে আসছিল। সেই মুসলিম লীগের পরিষদ সদস্য একমাত্র মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশই রাষ্ট্রভাষা বঙলার পক্ষের আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে আসছিলেন।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারী পুরানা পল্টনে মুসলিম লীগ আযোজিত এক সভায় তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পুনরোক্তি করে ঘোষনা করেন “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা” । এর ফলে পুর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও বুদ্ধিজীবিসহ সকল মহলে প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং বাঙলা ভাষার দাবীকে প্রতিষ্ঠার জন্য ঢাকা জেলা বার এসোসিয়েশনের হলে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ছাত্র, শিক্ষক বুদ্ধিজীবিসহ সর্ব শ্রেনির কর্মীদের এক সমাবেশে সর্বদলীয় “ বাঙলাভাষা কর্ম পরিষদ” গঠন করা হয়।সমগ্র দেশব্যাপী বাঙলা ভাষার দাবীতে ব্যাপক গন আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা কাজী গোলাম মাহবুবকে এই কর্ম পরিষদের আহবায়ক করা হয়। ১৫০, মোগলটুলী(চকবাজার) পুর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সর্ব দলীয় বাঙলা ভাষা কর্ম পরিষদের অন্যতম সদস্য এস এম নূরুল আলম( তৎকালে মুসলিম সলিমুল্লহ হলের ছাত্র) ২১ শে ফেব্রুয়ারী দেশব্যাপী“ বাঙলাভাষা দিবস” পালনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী। অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আবুল হাশেম, আওযামী লীগ প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শামসুল হক,খালেক নেওয়াজ খান, আব্দুল আজিজ, শওকত আলী, মো. তোহা,আলী আহম্মদ খাঁ, আব্দুল ওদুদ, শামসুল হক চৌধুরী, এম এ আওয়াল, অলি আহাদ প্রমুখ।সভায় সর্ব সম্মতিতে উক্ত প্রস্তাব গৃহিত হয়।
১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী সভা, সমাবেশ ও শোভযাত্রার নিষিদ্ধ করে ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারী করা হয়। ৯৪ নবাবপুর রোডে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সর্বদলীয় বাঙলা ভাষা কর্ম পরিষদের এক সভা অনষ্ঠিত হয়। ঐ সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা নিয়ে আলোচনা হয়। কিছু কিছু আওয়ামী লীগ নেতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরোধীতা করেন কিন্তু ছাত্র নেতাদের চাপে অবশেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে,আগামী কাল ২১শে ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আমতলার সাধারন ছাত্র সভায় চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এবং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আন্দোলনের পদক্ষেপ গ্রহন করা হবে। এই সভায় আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শামসুল হক, মানিক মিয়া, অলি আহাদ, খালেক নেওয়াজ খান, আব্দুল আজিজ, শওকত আলী, গাজিউল হক, আব্দুল মতিন, তোহা, এস এম নরুল আলম, এম এ আউয়ার ওদুদ,সহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন। ২০ শে ফেব্রুয়ারী রাতে সমস্ত শহরে বেশ উৎসাহ উদ্দিপনা ও গুজব ছড়াতে থাকে, আগামী কাল কিছু একটা হবে।এও গুজব রটে যে, নুরুল আমিন সরকার হাসপাতালে বেড খালি করে রেখেছেন ও বাঙালী পুলিশদের নিরস্ত্র করা হয়েছে।
‘৫২-এর ফেব্রুয়ারী মাসে ঢাকার রাজপথ ভাষার দাবীতে উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এ সময় মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ গুরুতর অসুস্থ হয়ে সিরাজগঞ্জে অবস্থান করছিলেন। ভাষার দাবীতে ছাত্র সমাজের জঙ্গী মনোভাব ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগের নুরুল আমিন সরকারের অসহিসনুতা দেখে তিনি ঢাকায় চলে যান। এদিকে ২১শে ফেব্রুয়ারী থেকেই প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশন আহবান করা হয়।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী। চারিদিকে সাজ সাজ রব। গন-জাগরনের উত্তাল তরঙ্গে তদানিন্তন স্বৈরাচারী সরকারের গদি টলটলায়মানপ্রায়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় সহ সকল এলাকায় ছাত্র সমাজের পুর্ব নির্ধারিত সভা সমাবেশ ও মিছিলের ওপর সরকার ১৪৪ ধারা ও কারফিউ জারি করে ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে জঘন্য এবং ঘৃন্যতম চক্রান্তে মেতে উঠে। এর প্রতিবাদে রনাঙ্গনে পরিনত হয় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এলাকা। বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতার বাঁধভাঙ্গা প্রতিবাদ রুখে দেওযার জন্য মোতায়েন করা হয় রনসাজে সজ্জিত পুলিশ ও সেনাবহিনীকে। তার পরও ভাষাসৈনিক উত্তাল ছাত্র জনতা ঢাকা ,নারায়নগঞ্জ হতে মিছিল সহকারে পুর্ব নির্ধারিত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হয়। বেলা অনুমান ১০ টায় আমতলায় ছাত্র সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় শামসুল হক, অলি আহাদ, তোহা, গাজিউল হক, এস এম নুরুর আলম, আব্দুল মতিন, খালেক নেওয়াজ খানসহ হাজার হাজার ছাত্র-জনতা উপস্থিত ছিলেন। সর্বসম্মতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, শান্তিপুর্নভাবে ৫ জন ৫ জন করে ক্ষুদ্র ক্ষদ্র দলে মিছিল সহকারে স্বৈরাচারী সরকারের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৫ জন করে গেট হতে বের হয়ে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে চুরমার করে দুর্বার গতিতে পার্লামেন্ট ভবনের দিকে (বর্তমানে জগন্নাথ হল) ছুটে চলে।তাদের মুখে ছিল গগনবিদারী শ্লোগান-‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। প্রথম ৫ জনের দলকে পুলিশ গ্রেফতার করে ট্রাকে তুলতে লাগলে পুলিশের সাথে ছাত্রদের ধস্তাধস্তি হতে থাকে । এক পর্যায়ে বেরা ১ টার সময় মিছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের আমতলাতে পৌছামাত্রই পুলিশ নৃশংসভাবে গুলি চালায় ছাত্র জনতার বিক্ষুব্ধ মিছিলের উপর।শহীদ হলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এম এ শেষ পর্বের ছাত্র আবুল বরকত,জব্বার, রফিক,শফিক, সালামসহ আরো নাম নাজানা অগুনতি ছাত্র যুবক। আহত হলেন কয়েকশত।এই খবর সমস্ত শহরে ছড়িয়ে পড়লে দাবানলের মত দাউ দাউ করে জ¦লতে থাকে।সমস্ত অফিস আদালত কোট কাচারী বন্ধ হয়ে যায়।সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে একজন শহীদের ছবি ছাপা হলে নুরুর আমিন সরকার গভীর রাতে ইত্তেফাকের সমস্ত কপি সীজ করে। সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের সেই সংখ্যা আর আলোর মুখ দেখতে পায়নাই।
পাকিস্তানী স্বৈরাচারী সরকারের নৃশংসতার শিকার ভাষা আন্দোলনের এই অকুতভয় বীর শহীদদের রক্তে রঞ্জিত হলো ঢাকার পিচঢালা রাজপথ।ছাত্র জনতার মিছিল ক্ষনিকের জন্য ছত্রভঙ্গ হলো।ভাষা শহীদের রক্তাক্ত নিথর দেহ রাজপথে রক্তসয্যায় শায়িত।বিভিন্ন স্থানে ছাত্র জনতা আর পুলিশের সংঘর্ষ, লাঠি চার্জ, কাঁদুনে গ্যাস , গ্রেফতার, ইট নিক্ষেপ আর তুমুল হৈ চৈ এর মধ্যেও পুর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশন শুরু হয় নির্ধারিত সময়ের কিছুক্ষন পরে। মন্ত্রী এবং পরিষদ সদস্যদের সেদিকে কোন ভ্রƒক্ষেপ নাই। সিংহের মত গর্জ্জে উঠলেন একমাত্র চলনবিলের কৃতিসন্তান বাংলার শার্দুল অকুতভয় নেতা মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ । তিনি চিৎকার করে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষন করে বলেন ‘ মাননীয় স্পিকার এসব হচ্ছে কী? আমাদের ছেলেরা ভাষার দাবীতে গুলি খেয়ে রাজপথে লুটিয়ে পড়ছে, আর আমরা কি-না আমাদের বেতনভাতা বৃদ্ধি নিয়ে আইন পাশে মশগুল? এসবের মধ্যে আমি নেই। বন্ধ করুন এ প্রহসনের এসেম্বলী।’ তাঁর কথায় কেউ কর্নপাত করলোনা।সরকারী সদস্যদের আচরনে মাওলানা তর্কবাগীশ ক্ষুব্ধ হয়ে বলিষ্ঠ কন্ঠে ঐ পৈশাচিক হত্যাকন্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করে বাইরে আসেন। বিরোধী দলের সদস্যরাও তাঁকে অনুসরন করেন। পরিষদের বাইরে রাজপথে বেরিয়ে এসে তীব্র পদক্ষেপে হাজার হাজার পুলিশ, ইপিআর ও পাঞ্জাবী সেন্যদের নিঃñিদ্র বেষ্টনী ভেঙ্গে ছুটে গেলেন ঢাকা মেডিকের কলেজ হাসপাতালে। দেখেন, ছাত্ররা চিৎকার করছে, আহতরা আর্তনাদ করছে। শত শত ছাত্র-যুবক আহাজারী আর আর্তনাদ করছে। তিনি দেখলেন পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছেন অনেক ছাত্র। মাওলানা আব্দুর রশীদ স্থির থাকতে পারলেননা। তিনি নিজ হাতে আহতদের সেবা করলেন এবং ছাত্র জনতার আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানালেন। এই মর্মান্তিক ও নৃশংস দৃশ্য দেখে তীব্র বেদনা মাখা ক্ষোভের আগুনে দগ্ধ হয়ে অশান্ত মন নিয়ে পুনরায় ফিরে আসেন পরিষদ কক্ষে। তখনও পরিষদের কার্যক্রম চলছিল।
স্পীকার আব্দুল করিম আসন গ্রহন করার সাথে সাথে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ পরিষদ কক্ষে প্রবেশ করে সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন স্পীকারের সামনে। পরিষদে তখন মুখ্যমন্ত্রী নুরুর আমিন অন্য প্রসঙ্গে ও ওপর বক্তব্য রাখছিলেন। মাওলানা তর্কবাগীশকে বিক্ষুব্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ‘ স্পীকার অর্ডার অর্ডার বলে হাতুড়ি পিটিয়ে মাওলানাকে নিজ আসনে বসার আহবান জানান। তার পরও বিক্ষুব্ধ মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ দাঁড়িয়ে ছাত্রদের উপড় গুলিবর্ষনের তদন্ত দাবী করে বলেন-“জনাব স্পীকার সাহেব,পশ্নোত্তরের পুর্বে আমি আপনার কাছে একটি নিবেদন করতে চাই। যখন দেশের ছাত্ররা যারা, আমাদের ভাবী আশা-ভরসার স্থল, পুলিশের গুলির আঘাতে জীবন লীলা সাঙ্গ করেছে, সেই সময় আমরা এখানে বসে সভা করতে চাইনা।” ‘ প্রথমে ইনকোয়ারী , তারপর হাউস চলবে।’
মাওলানা তর্কবাগীশ মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে আগে নিজ চোখে এই ঘৃন্য- জঘন্য পৈশাচিক ঘটনা দেখে আসার দাবী জানান। এনিয়ে তুমুল তর্ক বিতর্ক শুরু হয়। এক পর্যায়ে স্পীকার অধিবেশন মুলতবী ঘোষনা করতে বাধ্য হন। পরিষদের অধিবেশন ১৫ মিনিট মুলতবীর পর আবার শুরু হলে মাওলানা তর্কবাগীশ আবেগাপ্লুত হয়ে উচ্চকিত কন্ঠে বলেন-“ যখন আমাদের বক্ষের মানিক, আমাদের রাষ্ট্রের ভাবী নেতা ৬ জন ছাত্র রক্তশয্যায় শায়িত, তখন আমরা পাখার নীচে বসে হাওয়া খাব, এ আমি বরদাশত্ করতে পারিনা।আমি জালেমের এই জুলুমের প্রতিবাদে পরিষদগৃহ পরত্যাগ করছি এবং মানবতার দোহাই দিয়ে আপনার মধ্যস্থতায় সকল মেম্বরের কাছে পরিষদ গৃহ ত্যাগের আহবান জানাচ্ছি।” (ইস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলী প্রসিডিংস এর ৫৫,৫৬,৫৭ ও ৬০ নম্বর পৃষ্ঠায় ইংরেজীতে এই বিবরনী লিপিবদ্ধ আছে।)
শুরু হলো স্পীকার আব্দুল করিম এবং মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের মধ্যে বাদানুবাদ। স্পীকার বার বার তাঁকে আসন নিতে ও শান্ত থাকার যতই আদেশ দিতে থাকেন , ততোই মাওলানা উচ্চকন্ঠে বলতে থাকেন Ñ‘আগে তদন্ত, তারপর পরিষদ চলবে, অন্যথায় পরিষদ চলতে দেওয়া হবেনা।স্পীকার তখন তাঁর হাতের শেষ অস্ত্রটি ছেড়ে দিয়ে বলেন, আপনি শান্ত হোন, নইলে আমি পরিষদের ১০ -এর ক ধারা প্রয়োগ করতে বাধ্য হবো। চির বিপ্লবী মাওলানা তর্কবাগীশও ক্রোধের আগুনে ফেটে পড়েন এবং বলেন-আমি শান্ত হবোনা, এ পরিষদ চলতে দিবনা।’ এক পর্যায়ে স্পীকার কয়েক মিনিটের জন্য পরিষদ মুলতবী ঘোষনা করেন।মাওলানা তর্কবাগীশ তখন ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে চিরদিনের জন্য মুসলিম লীগ ত্যাগের কথা ঘোষনা করে তাৎক্ষনিক পরিষদ কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে যোগ দিলেন ছাত্র-জনতার কাতারে। ঐদিনই ছাত্র-জনতার সমাবেশে তিনি মর্মস্পর্শী ভাষন দানের একপর্যায়ে যে কোন মুল্যে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের বর্ধমান হাউসকে ‘বাঙলা একাডেমিতে’ রূপান্তরিত করা হবে বলে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারী ২১শের বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের প্রেক্ষিতে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ তাঁর মুলতবী প্রস্তাব অর্থাৎ তদন্তানুষ্ঠানের দাবী পুনরায় উত্থাপন করেন। অধিবেশন মুলতবীর এই প্রস্তাবের প্রতি ৩৫ জন সদস্যে সমর্থন আছে কিনা তা সদস্যদের কাছে স্পীকার জানতে চাইলেন। কিন্তু খয়রাত হোসেন,খান সাহেব ওসমান আলী,আলি আহম্মদ খান,আনোয়ারা খাতুন,মনোরঞ্জন ধর, ধীরেন দত্ত,গোবিন্দ বল্লভ ব্যানার্জি,বসন্ত কুমার দাস,আকবর আলী আকন্দ,শামসুদ্দিন আহম্মদ,ডা. ভোলানাথ বিশ^াস ও শ্রী হারান চন্দ্র বর্ম্মন ছাড়া আর কেউ এই প্রস্তাবেসমর্থন করলেননা। ফলে মুলতবী প্রস্তাব স্পীকার নাকচ করে দিলেন। অতঃপর মাওলানা তর্কবাগীশ নুরুল আমিন সরকারের প্রতি ছাত্র হত্যার অভিযোগ তুলে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারীঅধিবেশন মুলতবী রাখা হয়। ঘোষনা দেওয়া হয় ২৫ তারিখে মুলতবী অধিবেশনে নুরুল আমিনের প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব আলোচিত হবে। ২৩ ফেব্রুয়ারী শনিবার মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ পত্রটি ছিল নি¤œরূপ-
“ বাঙলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান করিতে হইবে, পুর্ব পাকিস্তানের জনগনের এই সর্বাত্বক দাবীর আওয়াজ তোলার অপরাধে নুরুল আমিন সরকার বিগত ২১ শে ফেব্রুয়ারী হইতে রাজধানী ঢাকার বুকে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর দ্বারা বেপরোয়ভাবে গুলিবর্ষন করাইয়া শিশু,কিশোর,যুব,প্রৌঢ় নিবশেষে যে হত্যাকান্ড চালিযাছেন,সভ্য জগতের ইতিহাসে এরূপ দৃষ্টান্ত বিরল।আমার বিবেচনায় জনগনের প্রতিনিধি হিসাবে এই সরকার গদিতে প্রতিষ্ঠিত থাকিতে পারেনা- সেই অধিকার আর তাদের নাই।
এই সম্পর্কে পরিষদ ভবনে আমি যে প্রতিকার দাবী করিয়াছিলাম, সরকার পক্ষ তাহাতে কর্নপাত করেন নাই। কাজেই এই সরকারের সমর্থক সদস্য হিসাবে নিজেকে যুক্ত রাখিতে আমি আর ইচ্ছুক নই।আমি ঢাকার এই নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে মুসলিম লীগ পরিষদ দল হইতে অদ্য পদত্যাগ করিলাম।সবচাইতে মজার ব্যাপার হইল, যে দাবী উত্থাপন করিতে যাইয়া আজ আমাদের ছেলেরা পুলিশের গুলিতে শহীদ হইয়া চলিয়াছে, নুরুল আমিন সরকার গতকল্য পরিষদে সেই দাবীই যে কোন কারনেই হউক ন্যায়সঙ্গত কারনে মানিয়া লইয়াছে।তবে কি আমাদের ইহাই মনে করিতে হইবে যে, একই কথা মন্ত্রী সাহেবেরা বলিলে হইবে ‘পবিত্র’ আর দেশের লোক বলিলেই হইবে অপবিত্র ও অপরাধ, আর তাহার বদলা দিতে হইবে অসংখ্য তরুন-তাজা প্রনা দিয়া? এই পরিস্থিতিতে একটা কথাই পরিস্কার হইল যে, ন্যায্য অধিকার বা মানবীয় অধিকার বলিতে কোন কিছুর অস্তিত্ব এই সরকার দেশে রাখিতে চাহেননা। আমি শহীদানের ও আহতদের উদ্দেশ্যে গভীর শ্রদ্ধা এবং সমবেদনা জ্ঞাপন করিতেছি এবং জনগনের এইসব দাবীর যৌক্তিকতা ঘোষনা করিয়া মুসলিম লীগ হইতে বিদায় গ্রহন করিতেছি।”
এদিকে ঢাকাসহ সারা দেশে নুরুল আমিন সরকারের বিরুদ্ধে দাউ দাউ করে আগুন জ¦লছে। ভাষার দাবীতে আন্দোলনের গতি তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। এ প্রস্তাব প্রত্যাহারের জন্য তাঁকে নানারকম প্রলোভন এবং ভয়ভীতি দেখানো হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারী এস্কান্দার খান একই প্রস্তাব নিয়ে আবারো আসেন। প্রস্তাবের মধ্যে ছিল সরকারের রিকুইজিশন করা কয়েকটি বাড়ি এবং মোটা অংকের টাকার লোভ।সরকারের পক্ষ হতে এ লোভের প্রস্তাব মাওলানা তর্কবাগীশের অন্যতম বন্ধু প্রধান মন্ত্রী নুরুল আমিনের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী এস্কান্দার আলী খান মাওলানাকে দেন। বন্ধু এস্কান্দারের প্রস্তাবে মাওলানা তর্কবাগীশ বিস্মিত এবং চরমভাবে ক্ষুব্ধ হন এবং ঘৃনাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। কিছুতেই এই চির বিপ্লবী অকুতভয় নেতাকে বাগে আনতে না পেরে নুরুল আমিন সরকার ভীত হয়ে ২৪ শে ফেব্রুয়ারী রাত তিনটায় গভর্নর ফিরোজ নুন বিশেষ ক্ষমতা বলে অর্ডিন্যান্স জারী করে ব্যবস্থাপক পরিষদের অধিবেশন বন্ধ ঘোষনা করেন এবং ঐ রাতেই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আইনে মাওলানা তর্কবাগীশকে এবং তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পুরধা ছাত্রনেতা সৈয়দ মো. নুরুল আলম, তাঁর পাশের কামরায় অবস্থানরত খয়রাত হোসেনকে গ্রেফতার করে কোতোয়ালী থানায় এবং পরে নিয়ে যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। একই রাতে আরো গ্রেফতার করা হয়, শ্রী মনোরঞ্জন ধর,গোন্দিবল্লভ ব্যানার্জী,নারায়নগঞ্জ থেকে নির্বাচিত খানসাহেব ওসমান আলীসহ বহু ছাত্রকর্মীকে।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে কারাবন্দি হওয়ার পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য করে নেন। একই সময় তাঁকে পুর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ১ নং সহ সভাপতি করা হয়।
দীর্ঘ ১৮ মাস কারাভোগের পর ১৯৫৩ সালের ৩১শে জুন মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ও জেষ্ঠ পুত্র নুরুল আলমসহ মুক্তি লাভ করেন। এদিকে কারাভোগের সময় নুরুল আমিন সরকার তাঁর গ্রামর জমিজমা সবই বাজেযাপ্ত করে।পরবর্তীকালে মামলা-মোকদ্দমা করে তিনি সেসব উদ্ধার করেন। অতঃপর তিনি সার্বক্ষনিকভাবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পাশে থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রমে আত্মনিয়োগ করে দলকে জনপ্রিয় করেন। পাশাপাশি তিনি তাঁর আজীবনের সেবাস্থল কৃষক সমাজের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে নিখিল পাকিস্তান কৃষক সমিতি গঠন করে সভাপতি হন।
‘ ৫২র ভাষা আন্দোলন ওই সময়ের শুধু প্রতিবাদ, বিদ্রোহ এবং বীর ভাষাশহীদদের আত্মাহুতির মধ্য দিয়েই শেষ হয়ে যায়নাই। ভাষার জন্য এদেশের মানুষকে সবসময় আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়েছে। সংগ্রাম করতে হযেছে রাজপথে, সংগ্রাম করতে হয়েছে পার্লামেন্টে। মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ এক্ষেত্রে অসাধারন সাহসী ভুমিকা পালন করেছেন। তৎকালীন একমাত্র এবং প্রথম সদস্য যিনি নুরুল আমিন সরকারের পার্লামেন্টে বাংলায় বক্তৃতা করেন এবং পরিষদের অন্যতম ভাষা হিসাবে ‘ বাংলা’কে গ্রহন করার জন্য জোর দাবী উত্থাপন করেন।
১৯৪৭ – ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান হওয়ার পর পুর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্যদের নিয়ে পাকিস্তান গনপরিষদ গঠিত হয়। ১৯৫৩ সালে নিখিল পাকিস্তান কৃষক সমিতির মাওলানা তর্কবাগীশ সভাপতি নির্বাচিত হন। ইতিপুর্বেই আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সভাপতি করে নেওয় হয়েছিল। ১৯৫৩ সালে ময়মনসিংহে আওয়ামী মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির তিনদিনের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে অধিবেশনে মাওলানা তর্কবাগীশের বক্তৃতার ফলে ১৯৫৪ সালে ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট যে নির্বাচন করে তার নীতিমালার প্রথমেই লেখা হয়েছিল, কুরআন ও সন্নাহর নীতি বিরোধী কোন আইন তৈরী করা হবেনা এবং সাম্য এবং মৈত্রীর ভিত্তিতে আইন তৈরী করা হবে।
এই পরিষদে দীর্র্ঘ ৮ বছর অর্থৎ ১৯৫৫ সালের ১১ ই আগষ্ট পর্যন্ত ইংরেজী এবং উর্দুই গনপরিষদের ভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু নাগরিক বাঙ্গালির মাতৃভাষা বাংলায় কোন সদস্য ৮ বছর গনপরিষদে বক্তৃতা করেন নাই। এমনকি সংখ্যাগুরু পাকিস্তানির ভাষা বাংলা পরিষদের অন্যতম ভাষা হওয়া উচিৎ এ কথাও কেউ কোনদিন উত্থাপন করেননাই। মাওলানা তর্কবাগীশ সর্বপ্রথম পাকিস্তানের গনপরিষদে বাংলায় বক্তৃতা করেন এবং বাংলাকে গনপরিষদেও অন্যতম ভাষা হিসেবেস্বীকৃতি দিতে বাধ্য করেন। বিভিন্ন সময়ে মাওলানা তর্কবাগীশ বাংলা ভাষার মর্যাদা সমুন্নত করার দাবীতে মাতৃভাষায় যেসব বক্তৃতা করেন ,পাকিস্তান গনপরিষদের কার্যবিবরনী থেকে, কিছু কিছু অংশ তুলে ধরা হলো-
পাকিস্তানের গনপরিষদে প্রথম বাংলায় বক্তৃতা দেন তর্কবাগীশ ঃ
জনাব স্পীকার ,
চার কোটি বাইশ লক্ষ লোকের মাতৃভাষায় আমি আপনাকে ধণ্যবাদ দেয়াটা আমার নিজের জন্য গৌরবজনক বলে মনে করি। জানিনা তা আপনার নিজের জন্য গৌরবজনক মনে করবেন কিনা। তাছাড়া আপনার চেহারা একজন সত্যিকার মুসলমান আলেমের মত। এই চেহারার আবরনে আজ ১৩০০ বছর পর্যন্ত বহু লোক ইসলাম ও মুসলমানকে ফাঁকি দিয়েছে।আমি আশা করি, আপনার এই চেহারা এই আদর্শ চেহারা সত্যিকার ইসলাম ও মুসলমানের চেহারাই হবে। আমি বিশ^াস করি , আপনি সর্ব প্রথম আমাদেরকে যে অধিকার দিবেন সেই অধিকার, এই পরিষদে বাংলাভাষায় বক্তৃতা দেয়ার অধিকার। এ কয়দিন আমি কিছু বলতে পারিনি, তার কারন , যিনি চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি আমার যুক্তি বুঝতে পারতেননাকিন্তু আপনি আমার যুক্তি বুঝতে পারবেন।গনপরিষদেও স্পীকার হয়ে নিশ্চয়ই আপনি বাংলাভাষা ভুলে যাবেননা- এই আশা করি।কাজেই আমার কথা আপনি বুঝতে পারবেন সে বিশ^াসেই আজ আমি আপনাকে ধন্যবাদ দিতে দাঁড়ালাম। (১১ আগষ্ট ১৯৫৫)।
জনাব স্পীকার,
একটি স্বাধীন গনতান্ত্রিক দেশের গনপরিষদে গনতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে সে দেশের অধিকাংশের রায় অনুযায়ী যাতে সকল কাজ সম্পন্ন হয় তজ্জন্য অধিকাংশের মাতৃভাষা উর্দু,পস্তু বা বাংলা যাই হোকনা কেন –আইন ন্যায়ত এবং যুক্তিসঙ্গতভাবে সেই ভাষায় বক্তৃতা করতে বাধ্য।যেহেতু আমি উর্দু জানি সেইহেতু আমাকে উর্দুতে বক্তৃতা করতে হবে এর কোন অর্থ হয়না। জমহুরিয়াত বা গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে অধিকাংশ নাগরিকের ভাষাকেই পরিষদের ভাষা হিসেবে গুরুত্ব দিতে হবে। সেহেতু অধিাংশের ভাষায় আমি বক্তৃতা দেয়া অপরিহার্য বলে আমি মনে করি।
এই পাকিস্তানে চার কোটি বাইশ লক্ষ লোক বাস করে পুর্ব বাংলায়। যদি আপনারা জমহুরিয়তে মানতে চান , তাহলে স্বীকার করতে হবে ,আপনাদেরকে মেনে নিতেই হবে অধিকাংশের রায়। এটাকি যুক্তিসঙ্গত নয় যে, চার কোটি বাইশ লক্ষ লোকের যেখানে বাস , সেই পুর্ব বাংলায় আপনাদেও পাকিস্তানের নাজধানী হবে। কিন্তু তা হয় নাই।অস্বভাবিকভাবে রাজধানী হযেছে করাচিতে, দেড় হাজার মাইল দু।ে (২০ সেপ্টেম্বর ১৯৫৫)।
জনাব স্পীকার,
আমি জানি যাদেও বুকে-কানে মোহর লেগে আছে, তাদের জন্য আমার বক্তৃতা নয়।তারা কৌতুক করতে পারেন আমার সামনে। পাকিস্তানের গনপষিদের মাত্র এই ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠই নয় আমার সামনে আমার বিরাট জনতা,দেশের দুঃখী সর্বহারা মানুষ আমার চোকে আজ ভেসে উঠছে। বেদনায় মুছড়ে পড়ছি।
পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ জন নাগরিকের মাতৃভাষায় বক্তৃতা দেয়া আমি গৌরব বলে মনে করি। শুধু তাই নয়, সে ভাষার দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে সেদিন আমার সন্তানেরা এই জারেম সরকারের গুলির সম্মুখীন হযেছিল, আমার সন্তানেরা নিজেদেও উত্তপ্ত শোনিতধারা ঢাকার মাটিতে ঢেলে দিয়েছিল, আজ সেই মাতৃভাষায় বক্তৃতা দিতেযারা লজ্জাবোধ করে, আমি বরতে দি¦ধাবোধ করবোনা যে, তারা নিজ জাতির সাথে গাদ্দারী করছে…।
মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ মাতৃ ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কী অসাধারন ভুমিকা পালন করেছেন , মাতৃভাষার প্রতি কতটা অকৃত্রিম ছিল তার মমত্ববোধ তা এসব বক্তৃতা থেকেও অনুধাবন করা যায়।তিনি ভাষা আন্দোলনের সুচনাকালেই জড়িয়ে পড়েন এই মহৎ সংগ্রামে।
ষষ্ঠ পর্ব ঃ ( যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসলিম লীগের সোচনীয় পরাজয়)
বাঙলার অবিসংবাদিত নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ,মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী এবং তরুন সংগ্রামী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রবল দাবীর প্রেক্ষিতে মুসলিম লীগ সরকার সাধারন নির্বচনের ঘোষনা করতে বাধ্য হয়।ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে ভোট যুদ্ধে মোকাবেলা করতে সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাষানী, মাওলানা তর্কবাগীশ, শেখ মুজিব ও অন্যান্য কয়েকটি ছোট ছোট দলের নেতাদের যৌথ নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘যুক্তফ্রন্ট’ নির্বাচনী মোর্চা। মাওলানা তর্কবাগীশ, মাওলানা ভাষানী ও শেখ মুজিবের অনলবর্ষী বক্তৃতা এবং সাংগঠনিক দক্ষতায় সাধারন নির্বাচনে ভোটযুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসলিম লীগের সোচনীয় পরাজয় ঘটে। এ নির্বাচনে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ৮ জন শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বির সকলের জামানত বাজেয়াপ্ত করে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয় লাভ করেন। নির্বাচনের পর শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়।
১৯৫৫ সালের ১৭ ফেব্রুযারী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সরকারের কিছু স্বেচ্ছাচারীতার প্রতিবাদ করে ব্যর্থ হয়ে যুক্তফ্রন্ট পার্লমেন্টারী পার্টিতে অন্যতম শরীক দল পুর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ একটি অনাস্থা প্রস্তাব এনে নতুন নেতা নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহন করে। স্বয়ং শেরে বাংলার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। সে এক অগ্নী পরিক্ষা। পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা হিসেবে বৈঠকে শেরে বাংলারই সভাপতিত্ব করার কথা। তিনি অনুপস্থিত থাকলে বিধিমোতাবেক পরবর্তী ব্যাক্তি হচ্ছেন আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম নেতা আতাউর রহমান খান। কিন্তু সভায় আওয়ামী মুসলিম লীগের অপর নেতা জহিরুদ্দিন খান পুর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক বৈঠকে সভাপতিত্ব করার জন্য মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের নাম প্রস্তাব করার সাথে সাথে দলের প্রভাবশালী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রস্তাবটি সমর্থন করেন এবং প্রস্তাবটি সাথে সাথে বিপুল করতালির মাধ্যমে অনুমোদন লাভ করে। অতঃপর মাওলানা তর্কবাগীশের বিজ্ঞসভাপতিত্বে যুক্তফ্রন্ট পার্লামেন্টারী পার্টির সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় শেরে বাংলার স্থলে আওয়ামী মুসলিম লীগের আতাউর রহমান খান পার্লামেন্ট নেতা নির্বাচিত হন এবং মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহন করেন।
সপ্তম পর্ব ঃ (অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ গঠনের প্রস্তাবক)
১৯৫৫ সালের ২১,২২ ও ২৩ অক্টোবর ঢাকার সদরঘাট রূপমহল সিনেমা হলে তিনদিন ব্যাপী পুর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলসহ সোহরাওয়ার্দী, তর্কবাগীশ এবং শেখ মুজিবের এক ঐতিহাসিক প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত কাউন্সিল অধিবেশনে মাওলানা ভাষানী ও শেখ মুজিবুর রহমান পুর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। কাউন্সিল অধিবেশনের শেষ পর্যায়ে পুর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ সেই ঐতিহাসিক প্রস্তাবটি পেশ করেন তা হলো , আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ধর্মীয় সম্প্রদায়ভিত্তিক ‘ মুসলিম’ শব্দটি তুলে দিয়ে দলকে জাতীয় কাঠামোর উপরে প্রতিষ্ঠিত করা। স্বয়ং দলের সভাপতি মাওলানা ভাসানীসহ তাঁর অনুসারীরা এই প্রস্তাবে বিরোধী ছিলেন।ফলে প্রবল ধর্মীয় ভাবাবেগে প্রস্তাবটি কাউন্সিলে নাকচ হওয়ার ভয় ছিল। পুর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক সেখানে উপস্থিত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মৌনতা পালন করেন।দলের সাধারন সম্পাদক শেখ মুজিব মাওলানা তর্কবাগীশের প্রস্তাবটি সমর্থন করে এক তেজস্বী বক্তৃতাদানের পর প্রস্তাবটি কোরান ইসলাম ও মহানবীর আদর্শভিত্তিক কিনা এবং দেশবাসীর সর্ব সম্প্রদায়ের গ্রহনযোগ্যতার আলোকে বিচার বিশ্লেষ ও ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য প্রস্তাব উত্থাপনকারী মাওলানা তর্কবাগীশকে বক্তব্য রাখার অনুরোধ জানান।
মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ তাঁর স্বভাবসুলভ জলদগম্ভীর কন্ঠের বাচনভঙ্গী প্রবল যুক্তি-তর্ক, কোরান- হাদিস, ইসলাম ও মহানবী থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরে দলের নাম থেকে ‘ মুসলিম’ শব্দটি তুলে দিয়ে জাতীয় কাঠামোতে দাঁড় করিয়ে অবারিত গনতন্ত্র , মানবতাবাদ ও প্রগতিশীলতার পক্ষে ঘন্টার পর ঘন্টা একটানা বক্তৃতা করেন। তাঁর প্রবল মনীষাযুক্ত যুক্তি তর্কে কাউন্সিলে আগত পক্ষ- বিপক্ষের সকল ডেলিগেটরা মন্ত্রমুগ্ধের আবেশে বিপুল করতালির মধ্য দিয়ে প্রস্তাবের পক্ষে সর্বসম্মত রায় ঘোষনা করেন। মাওলানা তর্কবাগীশ বক্তৃতা করে এমন বশীভুত করেন যে,প্রস্তাবটি অনুমোদনে হাত উত্তোলন করতে কেউ দ্বিধা করেন নাই। পরে অবশ্য প্রস্তাবটি সমর্থন করেও কেউ কেউ মন্তব্য করেন যে,‘ এ প্রস্তাব মাওলানা তর্কবাগীশের। তিনিই বক্তৃতার মাধ্যমে সকলকে বশীকরন করে প্রস্তাবটি পাশ করিয়েছেন। এরপর কিছু হলে সে দায়িত্ব তার’।এভাবে মাওলানা তর্কবাগীশের ব্যক্তিত্বের পরশে অবারিত গনতন্ত্র ও জাতীয় চরিত্র নিয়ে আওয়ামী লীগের নবযাত্রা সুচিত হলো।
মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের একক প্রচেষ্টাতেই আওয়ামী মুসলিম লীগের ‘ মুসলিম’ শব্দটি রহিত হয়ে শুধুমাত্র‘ আওয়ামী লীগ’ নামকরন হয় । কাউন্সিল অধিবেশনে পুর্ব নির্ধারিত কর্মসুচি অনুযায়ী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিরব থাকেন এবং মাওলানা ভাষানী যাতে বিরোধীতা না করেন , সে জন্য তাঁকে এ সম্পর্কে কোন বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত রাখা হয়।
১৯৫৫ সালে ১০ ই মে, পাকিস্তান ফেডারেল কোর্ট কনষ্টিটিউশন কনভেনশন হয়।কনষ্টিটিউশন এসেম্বলী অর্থাৎ গনপরিষদ গঠনের নির্দেশ দিলে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মাদ ২৮ মে ৮০ সদস্যবিশিষ্ট গনপরিষদ গঠনের আদেশ জারী করেন।পাকিস্তানের উভয় অংশ থেকে ৪০+৪০ জন সদস্য নির্বাচনের বিধান দেয়া হয়।পুর্ব পাকিস্তানের ৪০ জনের মধ্যে মাত্র ১২ জন গনপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ এই ১২ জনের ১ জন ছিলেন।
পাকিস্তান গনপরিষদে সুদক্ষ পার্লমেন্টারিয়ান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের মাত্র ১২ জন সদস্য মাওলানা তর্কবাগীশ, আবুল মনসুর আহমদ, আতাউর রহমান খান,শেখ মুজিবুর রহমান, জহির উদ্দিন,দেলদার আহমদ প্রমুখ মুসলিম লীগ সরকারকে সর্বদা বিব্রতকর অবস্থায় নাস্তানাবুদ করে ছাড়তেন। এদেও মধ্যে সবচাইতে সোচ্চার ছিলেন মাওলানা তর্কবাগীশ, আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, জহিরুদ্দিন খান ও শেখ মুজিবুর রহমান।
পাকিস্তান গনপষিদে বক্তব্যদানের ভাষা ছিল ইংরেজী ও উর্দু। এটা ছিল একটা বিধানও বটে। এ বিধানকে সর্বপ্রথম চ্যালেঞ্জ করেন মাওলানা তর্কবাগীশ।তিনিই সর্বপ্রথম পাকিস্তানের গনপরিষদে বাংলা ভাষায় বক্তৃতাদানের রেওয়াজ সৃষ্টি করেন, যা পরবর্তীতে আইনে পরিনত হয়। মাওলানা তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের রাজধানী করাচী থেকে রাওয়ালপিন্ডি স্থানান্তরের তীব্র বিরোধীতা করে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের প্রধান শহর ঢাকায় স্থানান্তরের দাবী জানান।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠর সময় এ প্রদেশের নাম ছিল পুর্ব বাংলা কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তা পরিবর্তন করে পুর্ব পাকিস্তান নামকরন করলে মাওলানা তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান তার তীব্র বিরোধীতায় ফেটে পড়েন এবং পরিষদ থেকে প্রতিবাদে ওয়াক আউট করেন।
মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ পুর্ব বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা , পাটশিল্পের দুরবস্থা, শিক্ষা – সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা, শিল্প ও বানিজ্য এবং প্রশাসনিক কেন্দ্রীয় চাকরী-বাকরী সহ নানা ক্ষেত্রে বাঙ্গালীদের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতাসুলভ আচরনের প্রকৃত চিত্র সোচ্চার কন্ঠে তুলে ধরে ইসলামের দৃষ্টিতে ন্যায় বিচারর মাধ্যমে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবীতে অকাট্য যুক্তি প্রমান উপস্থাপন করে দিনের পর দিন এক নাগারে তেজস্বী ভাষায় দীর্ঘ বক্তৃতা করেন। দিনের পর দিন গনপরিষদে কখনো উর্দু, কখনো বাংলায় কথনো ইংরেজীতে বকতঋতা করেন তা পাকিস্তান শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে এক অনন্য উদাহারন হয়ে রয়েছে। পাকিস্তানী ইসলামী শাসনতন্ত্রের বিভিন্ন ধারা-উপধারার উপর সুতীক্ষè-সুগভীর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষন করে কীভাবে বাঙ্গালী জাতির উপড় পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক-চক্র ইসলামের নামে অবিচারের হলিখেলা চালিয়ে যাচ্ছে তার সকরুন চিত্র অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় তুলে ধরেন।
১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। মাওলানা তর্কবাগীশ প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে পুর্ব বাংলার বিভিন্ন আর্থসামাজিক সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রাখেন। বাংলা ভাষা-শিক্ষা-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে তাঁর একান্ত প্রচেষ্টায় এসময়ে ‘বাংলা একাডেমী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৫৭ সালের প্রথম দিকে পাকিস্তানের বৈদেশীক নীতি ও অন্যান্য রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা তর্কবাগীশ, শেখ মুজিবের সাথে মাওলানা ভাষানী ও তাঁর সমর্থকরা সোহরাওয়ার্দীসহ তাঁর সমর্থকদের বিরুদ্ধে নানান কটাক্ষপুর্ন বক্তব্য দিতে থাকলে অধিবেশন ভন্ডুল হয়ে যায়। মাওলানা ভাষানী তাঁর সমর্থকদের নিয়ে অধিবেশন ত্যাগ করেন এবং পরবর্তীতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি দল গঠন করেন।
আওয়ামী লীগের এই দুঃসময়ে অবশেষে নতুন কাউন্সিল অুষ্ঠিত হয়। মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ সর্বসম্মতিক্রমে পুর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। বস্তুতঃ মাওলানা তর্কবাগীশের গতিশীল নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অচিরেই অবহেলিত গনমানুষের একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
অষ্টম পর্ব ঃ (পুর্ব-পশ্চিমের বৈষম্যের প্রতিবাদী কন্ঠ)
১৯৫৭ সালের ৩০ আগষ্ট পাকিস্তান গনপরিষদে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পুর্ব পাকিস্তানে গমনকারী বাঙ্গালী যাত্রীদের বিমান বন্দরে কাষ্টমস সাধারন নাগরিক তো বটেই , গনপরিষদেও সদস্যদেরও তল্লাশী করতো এবং এ সম্পর্কে কোন টু শব্দটি করতেন না এবং অবমাননাকর বলে উপলব্ধি করতেন না।। পুর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়েই পাকিস্তান। অথচ দুই অঞ্চলে সোনার মুল্য দুইরকম। সোনার মুল্য পশ্চিমে কম পুর্বে বেশী। আর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পুর্ব পাকিস্তানে সোনা নেয়া নিষিদ্ধ। এই ঘৃনিত ও বৈষম্যমুলক ব্যবস্থাটি বাতিল করার জন্য মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ একটি প্রস্তাব পশ্চিম পাকিস্তানের অনুষ্ঠিত গনপরিষদেও অধিবেশনে উত্থাপন করেন এবং সরকারের উদ্দেশ্যে ঘোষনা দেন : ‘এই বৈষম্যমুলক ব্যবস্থা যদি আমাদের পুর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার পুর্বে উঠিয়ে দেওয়া না, তাহলে এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম আমিই আইন ভঙ্গ করবো’। পুর্ববাংলার শার্দুল মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের ব্যাঘ্র হুংকারের পরেই সঙ্গে সঙ্গে সরকারসিদ্ধান্ত নিয়ে ঘোষনা করে যে, এখন থেকে এ ব্যপারে আর কাউকেই তল্লাশী করা হবেনা। অতঃপর এই অপমানজনক ব্যবস্থাটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
১৯৬৩ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ইন্তেকালের পর মুলতঃ আওয়ামী লীগের সর্বময় নেতৃত্বের ভার মাওলানা তর্কবাগীশের ওপর বর্তায়। সোহরাওয়ার্দীর অকাল মৃত্যুতে তিনি গভিরভাবে ভেঙ্গে পড়েন।
আওয়ামী লীগের চরম সংকটের দিনে তর্কবাগীশ শক্ত হাতে সভাপতির দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন এবং দায়ীত্ব পালনে সফল হন। ফলে এ দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব টিকে যায়। ১৯৬২ সালে মৌলিক গনতন্ত্র পদ্ধতির নির্বাচন তর্কবাগীশের বলিষ্ঠ নেতৃতে প্রত্যাখ্যান করে । এরপর মাওলানা তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন।
স্বৈরাচারী সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুবের শাসন- শোষনের বিরুদ্ধে মাওলানা তর্কবাগীশের কন্ঠ ছিল সর্বদা সোচ্চার। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জেনারেল আইয়ুবকে নির্বাচন ঘোষনা করতে বাধ্য করে।
১৯৬৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারী উইনিয়ন পরিষদ সদস্যদের ভোটে সমগ্র পাকিস্তানব্যাপী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন ধার্য করা হয়। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পুর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় সবকয়টি বিরোধী দল একযোগে আইয়ুবের বিরুদ্ধে প্রাতদ্বন্দ্বিতা করার জন্যে কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোর মিস্ ফাতেমা জিন্নাহকে প্রস্তাব দিলে তিনি সর্বপ্রথম আওয়ামী লীগের মতামত জানতে চান। মাওলানা তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পক্ষে দ্ব্যার্থহীন সমর্থন দান করেন। মুলতঃ মিস্ ফাতেমা জিন্নাহ আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভর করেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে রাজী হন। অতঃপর মিস্ জিন্নাহর পুর্ব পাকিস্তান সফরের কর্মসুচি ঘোষিত হয়। মিস্ ফাতেমা জিন্নাহকে ঐতিহাসিক গনসংবর্ধনা ও তাঁর প্রতি আনুষ্ঠানিক সমর্থন জ্ঞাপন উপলক্ষে ঢাকার পল্টন ময়দানে ১০ লাখ লোকের ঐতিহাসিক নির্বাচনী সভায় মাওলানা তর্কবাগীশ সভাপত্বি করেন এবং পুর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বহু সভায় মিস্ জিন্নাহর সাথে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে বক্তৃতা করেন।
১৯৬৬ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে মাওলানা তর্কবাগীশের সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বাঙ্গালীর মুক্তিসনদ ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসুচি অনুমোদন লাভ করে। পরবর্তীতে তা শেখ মুজিব কর্তৃক জনসম্মুখে ঘোষিত হয়।
# প্রথম দফা:
শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি: ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সরকারের বৈশিষ্ট হবে যুক্তরাষ্ট্রিয় ও সংসদীয় পদ্ধতির; তাতে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলো থেকে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচন হবে প্রত্যক্ষ এবং সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে। প্রদেশগুলোকে পুর্ন স্বায় ত্তশাসন দিতে হবে।কেন্দ্রিয় ব্যবস্থাপক সভার প্রতিনিধি নির্বাচন জনসংখ্যার ভিত্তিতে হবে।
# দ্বিতীয় দফা :
কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা: কেন্দ্রীয় বা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের দায়িত্বে থাকবে কেবল প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয়ে সীমাবদ্ধ।অবশিষ্টসকল বিষয়ে অঙ্গরাজ্যগুলোর পুর্ন ক্ষমতা।
তৃতীয় দফাঃ
মুদ্রা ও অর্থবিষয়ক ক্ষমতা : পুর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দু’টি পৃথক মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যা পারস্পরিকভাবে কিংবা অবাধে উভয় অঞ্চলে বিনিময়যোগ্য।
এ ক্ষেত্রে দুই অঞ্চলে স্বতন্ত্র বা পৃথক পৃথক স্টেট ব্যাংক থাকবে এবং মুদ্রা পরিচালনা ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। অথবা এর বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে একটি মুদ্রা ব্যবস্থা চালু থাকতে পারে এই শর্তে যে, একটি কেন্দ্রীয় সংরক্ষন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যার অধিনে দুই অঞ্চলে দুইাট রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। তাতে এমন বিধান থাকতে হবে যেন এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে সম্পদ হস্তান্তর কিংবা মুলধন পাচার না হতে পারে। বিশেষ করে পুর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মুলধন পাচার বন্ধ করারজন্য সংবিধানে কার্যকর ব্যবস্থা থাকতে হবে।
চতুর্থ দফা ঃ
রাজস্ব কর ও শুল্ক বিষয়ক ক্ষমতা: সকল প্রকার রাজস্ব ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকবে অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে।
কেন্দ্রীয় তথা প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয়ে ব্যয় নির্বাহের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রয়োজনীয় রাজস্বেও যোগান আঞ্চলিক তহবিল হতে সরবরাহ করা হবে। সংবিধানে নির্দেশিত বিধানের তহবিলে রাজস্বের এই নির্ধারিত অংশ স্বাভাবিকভাইে ফেডারেল তহবিলে জমা হয়ে যাবে।এহেন সাংবিধানিক বিধানে এমন নিশ্চয়তা থাকবে যে, কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্বের প্রয়োজন মেটানোর ব্যাপারটি এমন একটি লক্ষ্যের সাথে সংগতিপুর্ন হতে হবে যেন রাজস্বনীতির উপর নিয়ন্ত্রন ক্ষমতা নিশ্চিতভাবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকে।
…