এমএসএম জামান :
চলনবিল অধ্যুষিত সিরাজগঞ্জের তাড়াশে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী হাতে তৈরি খেজুর পাতার পাটি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় প্লাস্টিকের তৈরি পাটি, বেতের তৈরি শীতল পাটি, বিভিন্ন ধরনের চট ও কার্পেট এবং পলিথিনের তৈরি বিভিন্ন উপকরণসহ আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহারের কারণে গ্রামবাংলার নিদর্শন চলনবিলের ঐতিহ্যবাহী হাতের তৈরি খেজুর পাতার পাটির চাহিদা কমায় বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। কিন্তু প্রাচীন কাল থেকেই এ এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কাছে খেজুর পাতার পাটির ব্যাপক চাহিদা ছিল।
স্বাধীনতার পরও এই উপজেলার সকল পরিবারেই দেখা যেত খেজুর পাতার পাটির ব্যবহার। পরিবারের সদস্যরা নিজস্ব খেজুর গাছের পাতা পেড়ে রোদে শুিকয়ে নিজেরাই ঘরে শুয়ে থাকার জন্য, মাটিতে পেড়ে ভাত খাওয়ার জন্য ও নামাজ পড়ার জন্য এবং আবাদি জমির ফসল নিতে এই পাটি তৈরি করতেন। আদিবাসীসহ নিম্ন শ্রেণির জনগণ বৃষ্টির দিনে ছাতার পরিবর্তে খেজুর পাটির তৈরি ঘোমটা বৃষ্টি আটকানো ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতেন। এছাড়াও অনেকেই এই পাটি তৈরিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে জীবিকা অর্জন করতেন।
এক সময় এ এলাকায় প্রচুর খেজুর গাছ ছিল। বিশেষ করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবারের সদস্যরা দিনে পরিশ্রমের কাজ করে ফাঁকা সময়ে তারা তৈরি করত এই পাটি। বর্তমানে এই পাটির চাহিদা কমে যাওয়ায় ও এলাকায় খেজুর গাছ কমে যাওয়ায় এবং অল্প সময়ে আধুনিক যন্ত্র দ্বারা বেশি উৎপাদন করায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী সেই খেজুর পাতার পাটির দেখা মেলাই স্বপ্ন মনে হচ্ছে।
বর্তমানে মানুষের পারিবারিক ও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার্য ঐতিহ্যবাহী খেজুর পাটির পরিবর্তে স্থান করে নিয়েছে আধুনিক বেতের তৈরি শীতল পাটি, নলপাটি, পেপসি পাটি, বিভিন্ন ধরনের চট ও কার্পেট, মোটা পলিথিনসহ নানা উপকরণ। এই উপকরণগুলো সহজেই বাজারে পাওয়া যায় বলে মানুষ খেজুর পাতার পাটির বদলে এসব আধুনিক উপকরণ ব্যবহারে দিন দিন ঝুঁকে পড়ছে। ফলে হারিয়ে গেছে খেজুর পাটির কদর। খেজুর পাটির চাহিদা কমে গেলেও উপজেলার আদিবাসী নারীরাসহ গ্রামবাংলার নারীরাও আজও অবসর সময়ে খেজুর পাতার পাটি তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকেন। হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী খেজুর পাতার পাটিকে তারা নিজস্ব সংস্কৃতিতে আজও আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। এমনটাই চোখে পড়ছে উপজেলার বারুহাস ইউনিয়নের বস্তুল গুচ্ছগ্রাম এলাকায়।বারুহাস ইউনয়িনের বস্তুল গ্রামের খেজুর পাতার পাটি তৈরি করা গৃহবধূ শাপলা খাতুন বলেন, আমরা এখনো খেজুর পাতা সংগ্রহ করে সংসারের সকল কাজকর্ম সেরে অবসর সময়ে পাটি তৈরি করি। এই পাটি আমাদের নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে অন্যদের কাছে বিক্রি করে যে টাকা পাই তা আমার সংসারের কাজে ব্যয় করি।
ওই গ্রামের বাসিন্দা আখলিমা খাতুন বলেন, প্লাস্টিকের পাটি পাওয়া যায় বলে খেজুর পাতার পাটির কদর আর নেই। আগে এই পাটি বিক্রি হতো হাট-বাজারে। কিন্তু এখন আর বিক্রি হয় না। আবার আগে খেজুর পাতা পাওয়া যেত, গাছ কমে যাওয়ায় পাতাও পাওয়া যায় না। তাই এই পাটি তৈরি করতেও সমস্যা হচ্ছে। এখন আর কেউ খেজুর গাছ লাগাতে চায় না।এ ব্যাপারে বারুহাস ইউপি চেয়ারম্যান মোক্তার হোসেন মুক্তা বলেন, আমরা খেজুর গাছ ও তাল গাছ লাগানোর জন্য জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করছি। এতে একদিকে যেমন বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া খেজুর গাছ ও তাল গাছ রক্ষা পাবে, অপরদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে আবার পাটি তৈরির সাথে জড়িত আদিবাসী ও অন্যরা এ পাটি ব্যবহারসহ বিক্রি করে সংসারে অর্থের জোগান দিতে পারবে।