একুশ আমার অহংকার একুশ আমাদের চেতনা

Spread the love

হাদিউল হৃদয়
একুশ মানে চেতনা আমার/মায়ের ভাষায় কথা বলা,/একটা স্বাধীন দেশের জন্য/সবাই মিলে যুদ্ধ করার। কবির এ চেতনার ধারায় পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত হয়ে আমরা পেয়েছি মাতৃভাষার কথা বলার অধিকার আর একটি স্বাধীন সার্বভৌম জাতির স্বীকৃতি। একুশের রক্তাক্ত সেই স্মৃতিময় দিনটিকে কেন্দ্র করেই বিশ^ব্যাপী পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
দিনের পর মাস আসে, মাস পেরিয়ে বছর, সকলই পতিত হয় অনন্তকালের গর্ভে। কিন্তু জীবনে এমন কিছু ক্ষণ আছে, দিন আছে যা কখনোই বিস্মৃত হওয়ার নয়। প্রতি বছরই সেসব দিন আসে মানুষের তেচনাবোধকে সমৃদ্ধ করতে। তেমনই একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন ২১ শে ফেব্রুয়ারি। মহান ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ভাষার জন্যে এতখানি ত্যাগ স্বীকার করেছে এমন জাতি পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আপন সত্তা আবিষ্কারের মহিমা, অসাম্প্রদায়িক গণচেতনার বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে। ভাষা শহিদদের পবিত্র স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মিত হয়েছে জাতীয় মর্যাদার প্রতীক শহিদ মিনার। শহীদ মিনারের প্রতিটি ইট যেন প্রতিনিয়ত ঘোষণা দিচ্ছে বাংলা ও বাঙালির শৌর্য-বীর্যের।
‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলাভাষা!/তোমার কোলে, তোমার বোলে কতই শান্তি ভালোবাসা।’ মাতৃভাষা মা ও মাতৃভূমির মতই আমাদের বড়ই প্রিয়- তাই এদের উপর যখন আঘাত আসে, তখন আমরা সর্বশক্তি দিয়ে তাকে প্রতিহত করি। কারণ মাতৃভাষা নিঃশ্বাস বায়ুর মত আমাদের মানবিক সত্তার এক অপরিহার্য অংশ। বাঙালি বড় বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি। নিজেদের ইতিহাস ভুলে বসে থাকে। কখনো বিকৃতও করে অহর্নিশি। বাঙালি বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে, স্বাধীনতার ঘোষক নিয়েÑ শেখ মুজিবের, ভাসানীর, ফজলুল হকের, জিয়াউরের… অবদান নিয়ে। এমন কোন বিষয় নেই যা নিয়ে বাঙালি বিতর্ক করে না। সেই বিস্মৃতি পরায়ণ জাতি নিয়ে আমরা একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করি, উল্লাসে একে অভিহিত করি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে।
বাংলাদেশের কৃষ্টি, সাহিত্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ জাতীয় চেতনার দিন অমর একুশ ফেব্রুয়ারি। এদিন আমাদের বাঙালি সমাজের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন। বাঙালিত্বের চেতনার উন্মোষের উৎকৃষ্ট মানদ- একুশ ফেব্রুয়ারি। আজ বিশ্বও বাঙালির এ অস্তিত্ব-চেতনার স্বীকৃতি দিয়েছে। এ দিবসটি আজ আর শুধু বাংলাদেশের একক সম্পাত্তি নয়, পৃথিবীর ছোট বড় সকল ভাষাগোষ্ঠীর কাছেই এ দিনটি আসে নতুন প্রেরণা ও উৎসার নিয়ে। এ আমাদের জন্যে বড়ই আনন্দের, বড়ই গর্বের।
একুশ মানে প্রতিজ্ঞা, একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশ আমাদের মুক্তির চেতনা। একুশের চেতনা আমাদের মনের চেতনা। সাহিত্যে একুশের চেতনা জাগ্রত হয়েছে সর্বাধিক। বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতি-কৃষ্টির সঙ্গে এ চেতনা মিশে আছে স্বাভাবিকভাবে। প্রগতিশীল লেখকগোষ্ঠী এ ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই সাহিত্যের বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন। কথাসাহিত্য, নাটক, ছোটগল্প, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, গান অর্থাৎ সাহিত্যের প্রতিটি ধারায় একুশের চেতনাকে তুলে ধরেছেন এদেশের সচেতন লেখকসমাজ। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্যে যে তরুণেরা রক্তের অঞ্জলি দিয়েছিলেনÑ তা উত্তরকালে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের ধমনীতে নিত্য সক্রিয় রয়েছে। হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সিকান্দার আবু জাফর, মুনীর চৌধুরী, আবুল ফজল প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশ-কাল-সমাজের সমকালীন কালপুরুষের দিকে যাত্রা করেছেন। শামসুর রহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ‘শহীদ স্মরণে’ গোলাম মোস্তফার ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ প্রভৃতি কবিতায় ভাষা আন্দোলনের চেতনা প্রস্ফুটিত হয়েছে। বস্তুত ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এদেশের সাহিত্যিকগণ রচনা করেছেন অজ¯্র সাহিত্য। ভাষা আন্দোলনের চেতনা তাদের উজ্জীবিত করেছেন মুক্তির সংগ্রামে।
পরিশেষে বলতে চাই, একুশ হোক জগতের সকল অনৈক্য, সংঘাত ও অশান্তির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ হাতিয়ার। হোক সমুদ্রপথের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অন্ধকার রাতের আশার প্রদীপ। ভাষার জন্য প্রাণোৎসর্গকারী বাংলা মায়ের সেসব অদম্য শহিদের প্রতি রইলো আমার বিন¤্র শ্রদ্ধা।

হাদিউল হৃদয়: কবি, সম্পাদক, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক। তাড়াশ, সিরাজগঞ্জ।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD