চলনবিলে আধুনিক শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রচেষ্টা ভেস্তে গেছে : দরকার সরকারি উদ্যোগ

Spread the love

লুৎফর রহমান

বৃহত্তর চলনবিল অঞ্চলে আধুনিক ও স্বাস্থ্য সম্মত পদ্ধতিতে  শুঁটকি মাছ প্রক্রিয়াজাত  করণ প্রচেষ্টা সম্পূর্ণরুপে ভেস্তে গেছে। দাতা সংস্থার অর্থে পরিচালিত প্রকল্পটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাস্তবায়িত হওয়ার কারণে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে না হতেই চাতাল মালিকরা ফিরে গেছেন সনাতন পদ্ধতিতে। যার ফলে চলনবিল অঞ্চলে আহরিত মিঠাপানির শুঁটকি দেশে ও দেশের বাইরে ব্যাপক চাহিদা থাকলেও এর উপর এখন নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট শুঁটকি ব্যবসায়ীরা। সরেজমিনে চলনবিলের বিভিন্ন উপজেলার শুঁটকি চাতালে ঘুরে এ তথ্যের সত্যতা মিলেছে।

সূত্রমতে, দেশের মৎস্য ভান্ডার খ্যাত চলনবিল। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্র মতে, চলনবিলে প্রায় এক হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯ টি বিল, চার হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট ২২ খাল রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি বিলে প্রবেশ করে সৃষ্টি করে বিশাল জলাধার। প্রজনন কাল থেকে শুরু করে শুষ্ক মৌসুম পর্যন্ত মিঠা পানির মাছের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয় চলনবিল। এ সময় শত শত টন বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরা পড়ে জেলেদের জালে। এ বিলের মাছ দিয়ে দেশের মিঠা পানির মাছের বড় একটি অংশের চাহিদা পুরণ করা হয়ে থাকে। চলনবিলের মাছ স্বাদযুক্ত হওয়ায় এখানকার বিভিন্ন প্রজাতির মাছের শুঁটকিও দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে।

শুঁটকি ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্যমতে, চলনবিলের মাছের শুঁটকি পার্শ্ববর্তী ভারত সহ আমেরিকা, মালেশিয়া ,কাতার, সৌদি আরব, বাহারাইন, কাতার ও দুবাই সহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। রাজশাহী মৎস্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো:শাহীনুর রহমান জানান, বৃহত্তর চলনবিল  ও তার প্লাবনভূমিতে প্রতি বছর গড়ে চার শ থেকে সাড়ে চার শ মেট্রিকটন শুটকি উৎপাদন হয়ে থাকে। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ২৮ থেকে ৩০ কোটি টাকা। সুপ্রাচীনকাল থেকেই চলনবিল অঞ্চলের জেলেরা সনাতন পদ্ধতিতে মাছের শুটকি করে আসছেন। এ জন্য তারা উঁচু বাঁশের মাচা তৈরি করে , কাঁচা মাছ  রোদে শুকায়ে শুটকি তৈরি করে থাকেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাছের পচন রোধে এবং পোকা ও মাছি মুক্ত রাখতে অনেক সময় কীটনাশক সহ রাসায়নিকজাত দ্রব্য মেশানোর অভিযোগ  উঠলে শুটকির বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

এ লক্ষে  আধুনিক ও স্বাস্থ্য সম্মত উপায়ে শুঁটকি তৈরি করার জন্য বিগত ২০১৪  সালে চলনবিলের চাতাল মালিকদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি একটি প্রকল্প হাতে নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্প (হেকেপ)।  ২০১৬  সালে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মহিষলুটিতে প্রকল্পটি পরিদর্শনে আসেন মালেশিয়ার কেব্যাংস্যাং ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড.মু. ইউসুফ মাসকাত, ভারতে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.সুশান্ত কুমার চক্রবর্তী সহ বাংলাদেশের মৎস্য অধিদপ্তরের উর্ধতন কর্মকর্তারা । তারা প্রকল্পটি দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন। পরিচ্ছন্ন পরিবেশে শুটকি উৎপাদন করায় এর চাহিদাও বৃদ্ধি পায় বলে জানায় শুটকি ব্যবসায়ীরা। কিন্তু ২০১৬  সালেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়া মাত্রই চাতাল মালিকরা ফিরে যায় তাদের নিজস্ব  স্থানীয় পদ্ধতিতে।

এনিয়ে কথা হয় চলনবিল অধ্যূষিত নওগাঁর আত্রাই উপজেলার আহসানগঞ্জ, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মহিষলুটি বাজার, উল্লাপাড়ার মোহনপুর বাজার, পাবনার চাটমোহর উপজেলার বিলমারি, নাটোরের সিংড়া উপজেলার নিংগুইর এলাকার শুটকির চাতাল মালিকদের সাথে। মহিষলুটি শুটকি আড়তের মালিক আব্দুস সালাম জানান, দেশে-বিদেশে শুটকির চাহিদা থাকলেও সরকার এ ব্যাপারে উদাসীন। শুটকি উৎপাদনকারীদের সরকারি সহায়তা, যেমনঃ স্বল্প সূদে ব্যাংক ঋণ, প্রশিক্ষণ, এমনকি প্রণোদনা কোনটিই না থাকায় শুটকির ক্ষেত্রে এমন বেহাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি “হেকেপ” প্রকল্প প্রসঙ্গে বলেন, স্যাররা এসে আমাদের সহায়তা দিয়েছিলেন বলে আমরা আধুনিক পদ্ধতিতে শুটকি তৈরি করেছি। কিন্তু এখন কোন প্রকার সহায়তা না মেলায় আমরা নিজস্ব পদ্ধতিতেই শুটকি তৈরি করছি। ফলে তা আর অধুনিক ও মান সম্মত উপায়ে করা সম্ভব হচ্ছে না।

সিংড়া উপজেলার নিংগুইর বাজারে কথা হয় সৈয়দপুর থেকে আসা শুটকি ব্যবসায়ী রুস্তম আলীর সাথে। তিনি বলেন , এখনতো ডিজিটাল যুগ। সব খবরই সবখানে পাওয়া যায়। বেশি দাম দিয়ে হলেও ক্রেতারা ভাল শুটকি কিনতে চায়। কিন্তু ভাল ও পরিচ্ছন্ন শুটকি উৎপাদনে যে খরচ পড়ে, তার চেয়ে অনেক কম খরচ পরে চাতাল মালিকদের নিজস্ব পদ্ধতিতে। এ কারণে তারা নিজস্ব পদ্ধতিতে শুটকি উৎপাদনে ত বেশি আগ্রহী হলেও বাজারে এর খারাপ প্রভাব পড়ছে।

হেকেপ প্রকল্পের তৎকালীন উপ প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. ফৌজিয়া এবিদ ফ্লোরার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, চলনবিলের শুটকি মানসম্মত ও আধুনিক পদ্ধতিতে তৈরির জন্য হেকেপ ২০১৪ সালে একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৬ সালে। আসলে এ বিষয়ে  সবার আগে সরকারকেই  এগিয়ে আসতে হবে। উৎপাদনকারীদের ঋণ, প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে হবে। সেই সাথে স্থানীয় বাজার তৈরি ও আধুনিক পদ্ধতিতে উৎপাদন করা গেলে দেশী বাজারের পাশাপাশি বিদেশেও এর চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। আসলে এ চিত্র গোটা চলনবিল অঞ্চলের শুটকি উৎপাদনকারীদের। এ কারণে তারা সরকারি সহায়তার পাশাপাশি স্থানীয় বাজার সৃষ্টি ও সংরক্ষণাগার নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD