আইনের তোয়াক্কা করছে না তাড়াশের ইটভাটাগুলো

Spread the love

গোলাম মোস্তফা : তাড়াশের ইটভাটাগুলোতে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ এর ৬ ধারা লঙ্ঘন করে ইট পোড়ানোর কাজে কয়লার বদলে জ্বালানি কাঠের ব্যবহার করা হচ্ছে। একই সাথে আইনের অন্যান্য ধারারও নূন্যতম তোয়াক্কা করছে না ভাটাগুলো। অধিকাংশ ইটভাটা আবাসিক এলাকা ও কৃষি জমির মধ্যে। ইট তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে ফসলি জমির উর্বর মাটি। ইট তৈরি ও টানার কাজ করছে শিশু শ্রমিকরাও।

উপজেলা ভাটামালিক সমিতির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাড়াশে নাবিলা সুপার ব্রিকস, বন্যা ব্রিকস, সাদিয়া ব্রিকস, আখী ব্রিকস, মেঘনা ব্রিকস, এম আর এইচ ব্রিকস, এমএমবি ব্রিকস, এইচ এন্ড কে ব্রিকস এবং সততা ব্রিকস নামে ৯টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে পরিবেশসম্মত জিগজ্যাগ চিমনির ভাটা ৬টি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, জিগজ্যাগ চিমনিরসহ সবগুলো ইটভাটার ভেতরেই উঁচু উঁচু স্তুপ করে রাখা হয়েছে ফলদ, বনজ ও ঔষধী গাছের ছোট বড় অসংখ্য গুল ও ডালপালার অংশ। সেখান থেকে চলমান ভাটার চুল্লিতে ফেলছেন কয়েকজন শ্রমিক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইটভাটার ওই শ্রমিকেরা বলেন, ইট পোড়ানোর কাজে ভাটার মালিকেরা দেদারচে জ্বালানি কাঠ ও অতি নি¤œমানের কয়লার ব্যবহার করছেন। একটি বড় ইটভাটায় একবারে চার থেকে সারে চার লাখ ইট পোড়াতে ২৫ দিনের মতো সময় লেগে যায়। আর কমপক্ষে ১০ হাজার মণ জ্বালানির প্রয়োজন হয়।

এদিকে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ এর ৮ এর (ক), (ঘ) এবং (চ) ধারা কোনো রকমের অনুসরণ না করেই বিভিন্ন আবাসিক এলাকা, কৃষি জমি ও সরকারি রাস্তার কোল ঘেষে গড়ে উঠেছে ইটভাটাগুলো। একই সাথে ১৫ নং আইনের (ক) উপ-ধারা (১) এর বিধান লঙ্ঘন করে ইট প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে কৃষি জমির মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের কারখানা আইন-১৯৬৫ এর ৩ এর (গ) ধারা উপেক্ষা করে ১৪ বছরের কম বয়সী বহু শিশু শ্রমিক দিয়ে ইট তৈরি ও টানার কাজ করানো হচ্ছে। সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, ৯টি ইটভাটাই সরকারি রাস্তার গা ঘেষে কৃষি জমি নষ্ট করে স্থাপন করা হয়েছে। কেবল ৬ কিলোমিটার তাড়াশ-কালিবাড়ি গ্রামিণ সড়কের সাথেই রয়েছে ৫টি ভাটা। ২টি ভাটা খালকুলা-নওগাঁ গ্রামিণ সড়কে। ২টি তাড়াশ-নিমগাছি আঞ্চলিক সড়কের সাথে। আর প্রতিটি ইটভাটার নিকটেই চারপাশে শ’ শ’ গ্রামীণ পরিবারের বসবাস। রয়েছে ফসলের মাঠ। ওই ৩টি রাস্তায় দিন-রাত ইটবাহী ভারী যানবাহন চলাচল করায় কার্পেটিং উঠে ইটের সোলিং নষ্ট হয়ে খানাখন্দে ভরে গেছে। সড়কের ধুলার আস্তরণে ঢাকা পড়ে আছে আশপাশের বসতঘর। ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় মরে যাচ্ছে ফসল। শুধু তাই নয়, প্রতিটি ভাটাতেই শিশুরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। এদের বেশিরভাগ ইট তৈরি করছে। আবার কেউ কেউ ইট মাথায় করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। শিশু শ্রমিক ইমরান হোসেন, সাব্বির হোসেন, মমিন আলী, আতিকুর রহমান, আব্দুল্লাহ প্রমূখ জানায়, তাদের অনেকের বাবা-মা ভাটা মালিকদের কাছ থেকে দাদন নেওয়ায় তারা পড়ালেখা বাদ দিয়ে ইটভাটায় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।

সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন ছাত্রছাত্রীরা। সততা ব্রিকস ও মেঘনা ব্রিকসের মাত্র সারে তিন থেকে চারশ’ গজ দূরেই দক্ষিণে ঝুরঝুরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পশ্চিমে মাধাইনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধাইনগর দ্বি-মূখী উচ্চ বিদ্যালয় ও মাধাইনগর আদিবাসী মহাবিদ্যালয়। আর সাদিয়া ব্রিকসের নিকটেই ক্ষিরপঁওতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, ওই চারটি বিদ্যালয়ে তিন হাজারের মতো ছাত্রছাত্রী পড়ালেখা করছেন।

শিক্ষার্থী আতিক হাছান, জুয়েল রানা, সৌরভ হোসেন, পিয়াল সরকার, রাজিব এক্কা,  কামনা সিং প্রমূখ জানান, বিদ্যালয়ের পাশের ইটভাটার চিমনি থেকে বিশাক্ত কালো ধোঁয়া নির্গত হওয়ায় তাদের চোখ জ্বালাপোড়া করে। ভারী যানবাহন ও ইট তৈরির যন্ত্রের বিকট শব্দে শিক্ষকের কথা শুনতে পায় না তারা। ধুলাবালু আর ধোঁয়ার কারণে তাদের সারাবছর সর্দি-কাশি লেগেই থাকে। তবে উপজেলা ভাটামালিক সমিতির সভাপতি মোসলেম উদ্দিন বলেছেন, আইন অনুসরণ করেই ভাটাগুলোয় ইট প্রস্তুত করা হচ্ছে। আর জিগজ্যাগ চিমনির ভাটার চুল্লিতেও আগুন দেওয়ার সময় চার থেকে সারে চারশ’ মণ জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন পড়ে।এদিকে তাড়াশ উপজেলা  কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সাইফুল ইসলাম বলেছেন, মাত্র ৩টি ইটভাটার উপজেলা কৃষি দপ্তরের ছাড়পত্র রয়েছে। বাকি ৬টি অবৈধভাবে ফসলি জমির মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে। উর্বর জমির টপসয়েল কেটে ইট তৈরি করায় ফসল উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। একবার টপসয়েল নষ্ট হলে ১০ বছরেরও বেশি সময় লেগে যায় তা পূরণ হতে। সিরাজগঞ্জ জেলা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ-মহা পরিদর্শক বুলবুল আহম্মেদ জানান, কারখানার আইন অনুযায়ী ১২ বছরের কম বয়সী শিশুকে কোনো কাজে নিয়োগ দেওয়া অপরাধ। পরিদর্শন করে প্রমান পাওয়া গেলে ইটভাটা মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয় বগুড়া অঞ্চলের পরিচালক মো. আশরাফুজ্জামান জানান, বিভিন্ন জেলায় মোবাইল কোর্ট অব্যাহত রয়েছে। সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে দ্রুত তাড়াশ উপজেলার ইটভাটাগুলোতে অভিযান পরিচালনা করা হবে। এ প্রসঙ্গে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ওবায়দুল্লাহ  সাংবাদিকদের বলেন, তিনি জেলায় দায়িত্ব পালনের সময় এইচ এন্ড কে ব্রিকস নামে একটি ইটভাটার চার লাখ টাকা জরিমানা করেছিলেন। ভূমি কর্মকর্তা হিসেবে কয়েকদিন হলো তাড়াশে যোগদান করেছেন। শিগগিরই পরিবেশ অধিদপ্তরের সাথে সমন্বয় করে আইন লঙ্ঘনকারী ভাটাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে।

Please follow and like us:
Pin Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Website Design, Developed & Hosted by ALL IT BD