আবুল কালাম আজাদ : একসময়ের প্রমত্ত্বা বড়াল পদ্মার শাখা নদী, যা রাজশাহী জেলার চারঘাট থেকে উৎপন্ন হয়ে রাজশাহীর চারঘাট, বাঘা, নাটোরের লালপুর,বাগাতিপাড়া,বড়াইগ্রাম এবং পাবনার চাটমোহর ইপজেলার চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মুশাখা,নারদ,নন্দকুজা,চিকনাই সহ বেশ কয়েকটি নদীর জন্ম দিয়ে শেষ পর্যন্ত পাবনার ভাঙ্গুড়া বনওয়ারীনগর ফরিদপুর ,সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ী হয়ে হুড়াসাগর নদীর সাথে যুক্ত হয়ে যমুনায় মিলিত হয়েছে। নদীটি চলনবিলেরও অন্যতম প্রধান জলাধার। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ২২০ কি.মি। বড়াল নদীর সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত কমপক্ষে পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ। এই নদী ৪টি জেলা এবং ৯টি উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। দেশের বৃহত্তম দুটি নদী পদ্মা-যমুনা এবং বৃহত্তর জলাভূমি চলনবিলের মধ্যে প্রধান সংযোগ রক্ষাকারী নদী হচ্ছে বড়াল।
১৯৮১ সালে রাজশাহীর চারঘাটে পদ্মা থেকে উৎপত্তি বড়ালের উৎস মুখে অপ্রসস্ত একটি স্লুইসগেট, ৪৬ কি.মি ভাটিতে আটঘড়ি নামক স্থানে আবারও একটি স্লুইসগেট, এরই ধারাবাহিকতায় বড়াইগ্রাম উপজেলার আটঘড়ি থেকে বনপাড়া পৌর সদর ও তার ভাটিতে তিড়াইল পর্যন্ত ব্যাপক দখল, ১২৫ কি.মি ভাটিতে পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলায় ১৯৮৯ সালে বড়ালের বুকের উপর আবারো তিনটি ক্রস বাঁধ এবং একটি স্লুইসগেট প্রমত্তা বড়াল নদীকে কয়েকটি বৃহৎ পুকুরে পরিণত করে। বড়াল নদী চালু ও তা রক্ষার জন্য বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বড়াল রক্ষা আন্দোলন, চলনবিল রক্ষা আন্দোলন সহ বিভিন্ন সংগঠন, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া এবং সর্বস্তরের মানুষ ২০০৮ সাল থেকে আন্দোলনে নেমেছে। বাপা, এএলআরডি ও রিভারাইন পিপল গবেষণা কর্ম পরিচালনা করেছে। বেলা আইনী সহায়তা দিয়েছে।
গত ২০০৮ সাল থেকে অদ্যাবধি ২২০ কি.মি ব্যাপী মানববন্ধন, এক লক্ষ মানুষের গণস্বাক্ষর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে জমা দান, বিশাল বিশাল জনসভা, নদী পাড়ের বিভিন্ন স্থানে ও রাজধানী ঢাকায় অসংখ্য সভা, সমাবেশ, মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন হয়েছে। বড়াল কনভেনশন ও বড়াল সম্মেলন সহ নানা কর্মসূচী ধারাবাহিকভাবে পালিত হয়েছে। একই সাথে আইনি সহায়তাও গ্রহণ করা হয়েছে।
ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে, আবদ্ধ বড়াল নদীকে চলমান করার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার ইতিমধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছেন। বড়াল নদী মাছ চাষের জন্য লীজ ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। এছাড়া পাবনার চাটমোহর উপজেলার দহপাড়া মাটির বাঁধ, নতুন বাজার মাটির বাঁধ, বোথর ঘাটের মাটির বাঁধ, রামনগর ঘাটের মাটির বাঁধ অপসারণ হয়েছে। বোথর ঘাটের ব্রীজ নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং রামনগর ঘাটের ব্রীজ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। দীর্ঘ ৩০-৩৫ বছর রাজশাহীর চারঘাট স্লুইসগেট অচল ছিল, যা গত দুই বছর হলো মেরামত হয়েছে। চারঘাটে পদ্মার সাথে বড়াল সংযোগ চর পরে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল, এখানে ১৮০০ মিটার খনন করে বড়াল-পদ্মার সংযোগ স্থ চালু করা হয়েছে। সিরাজগঞ্জ জেলার বাঘাবাড়ী অংশে দেশবন্ধু সিমেন্ট কারখানার দখলের
বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা শুরু হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক ইওএম (ইনষ্টিটিউট অফ ওয়াটার মডেলিং) কে সমীক্ষা করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। মহামান্য হাইকোর্টও নদী পূনরুদ্ধারে আদেশ দিয়েছেন।
বর্তমানে রাজশাহীর চারঘাট থেকে নাটোরের আটঘড়িয়া পর্যন্ত ৪৬ কি.মি নদী অনেকটাই চালু হয়েছে তবে স্লুইসগেটগুলোকে খুলে দিলে পানি প্রবাহ সন্তোষজনক হবে। আটঘড়িয়া থেকে বনপাড়া পর্যন্ত ১০-১৫ কি.মি নদী একেবারে বেদখল আছে। বেদখল অংশটুকুর পর থেকে অর্থাৎ নাটোরের বনপাড়া থেকে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি হয়ে যমুনা নদী পর্যন্ত প্রায় ১৪০ কি.মি এর ভেতরেও তেমন বড় কোন বাধা নেই। এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, আটঘড়ি থেকে বনপাড়া পর্যন্ত ভূমি দস্যুদের উচ্ছেদ করে এই ১০-১৫ কি.মি নদী খনন করা এবং চারঘাট স্লুইসগেট ও আটঘড়ি স্লুইসগেট উচ্ছেদ করা।
যেহেতু ১৯৮৫ সাল থেকে বড়াল নদী বদ্ধ পুকুরে রূপ নিয়েছিল, তাই এই সময়ের মধ্যে বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া থেকে চাটমোহর উপজেলার দহপাড়া পর্যন্ত কচুরি পানা দিয়ে ভর্তি আছে। এছাড়া কয়েকটি শিল্প কারখানার বর্জ্য, বড়াল পাড়ের ৮ টি পৌরসভার বর্জ্য, ৮টি সরকারি হাসপাতাল এবং শত শত বেসরকারি ক্লিনিকের বর্জ্য, শত শত পোল্ট্রি খামারের বর্জ্য, শত শত হোটেল/রেস্টুরেন্টের বর্জ্য, হাজার হাজার গৃহস্থালী পরিবারের বর্জ্য এবং পয়: নিস্কাশন লাইন সরাসরি নদীর সাথে যুক্ত আছে। অতি সম্প্রতি চাটমোহরে গুনাইগাছায় প্রাণ কোম্পানী একটি কারখানার বর্জ্য নিষ্কাশনের পাইপ লাইন সরাসরি বড়াল নদীতে যুক্ত করেছে। এসব কারণে পানি দূষণ অব্যাহত রয়েছে। ফলে এই পানি সর্বসাধারণ ব্যবহার করতে পারছে না। এদিকে ভূমি দস্যুদের দখল প্রক্রিয়াও অব্যাহত আছে। ফলে রাজশাহীর চারঘাট থেকে আসা পদ্মার পানি আটঘড়ি থেকে সরাসরি বড়াইগ্রাম, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া হয়ে বাঘাবাড়ি পৌছাচ্ছে না। নদী পাড়ের অর্ধকোটি অসহায় জনতা এখনো আংশিক মুক্ত বড়ালের সুফল পাচ্ছে না। এলাকার জনগণ আজ তাদের সচল প্রবাহমান বড়াল ফেরত চায়।
মরা বড়ালকে সচল করতে দাবিসমুহঃ
১। বড়াল নদীর উপর নির্মিত চারঘাট,আটঘড়ি স্লুইসগেট সহ সকল বাধা অপসারণ করতে হবে এবং পূর্ণপ্রস্থ ব্রীজ নির্মাণ করতে হবে।
২। বড়াল নদীর সীমানা চিহ্নিত করে দখলদার উচ্ছেদ করতে হবে এবং ভূমি দস্যুদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
৩। বড়াল নদীকে পদ্মা-যমুনার সাথেই ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের আওতায় এনে খনন করতে হবে।
৪। বড়াল পাড়ের সকল পৌরসভার বর্জ্য, পোল্ট্রি খামারের বর্জ্য, হোটেল রেস্টুরেন্টের বর্জ্য, গৃহস্থালি বর্জ্য, সরকারি ও বে-সরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিকের বর্জ্য, প্রান কোম্পানি সহ সকল শিল্প কারখানার বর্জ্য নদীতে ফেলা বন্ধ করতে হবে এবং দূষণ বন্ধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫। আগামী বর্ষা মৌসুমের পূর্বেই বড়াল নদীর কচুরিপানা পরিষ্কার করতে হবে।
৬। বড়াল থেকে বিলকুড়–লিয়া হয়ে চিকনাই নদী পর্যন্ত খাল পূন: খনন করতে হবে।
৭। চাটমোহর নতুন বাজার এবং দহপাড়ায় পূর্ণপ্রস্থ ব্রীজ নির্মান করতে হবে।
লেখক: মোঃ আবুল কালাম আজাদ, সভাপতি, চলনবিল প্রেসকøাব , গুরুদাসপুর।